'ওয়াল স্ট্রিট দখল' আন্দোলন ও আমাদের উপলব্ধি by লুৎফর রহমান রনো

ঠাণ্ডা লড়াই বা স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। সমাজতন্ত্র নামের জুজু অপসৃত হলো বটে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সর্বদাই ব্যতিব্যস্ত থেকেছে 'কল্পিত ডাইনি'র খোঁজে। উদার বাণিজ্যনীতির পৃথিবীতে শত্রুবিহীন শান্ত বিশ্ব পরিস্থিতিতেও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো কোনো না কোনো বাহানায় যুদ্ধের আতঙ্ক জিইয়ে রেখেছে। অতি সাধারণ বুদ্ধিতেও বোঝা যায়, এ হলো আধিপত্যবাদী চরিত্র।


তা ছাড়া সমরাস্ত্র ব্যবসায় মন্দাভাব কাটিয়ে ওঠার জন্যও তা প্রয়োজন। যা হোক, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক কাঠামো ধসে যাওয়ার পর বার্লিন দেয়ালও আর টিকল না। মুক্ত পৃথিবী, মুক্তবাণিজ্য_এবার গড়ে উঠবে স্বপ্নের বিশ্বগ্রাম! বিশ্বগ্রামের মোড়লদের একচেটিয়া বাণিজ্যের পথে যে দেশের নেতাই হুমকি হয়ে উঠছেন, তিনি নিস্তার পাননি। ইউরোপ-আমেরিকার বহুজাতিক কম্পানিগুলো পুরো দুনিয়ার বাজার তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেল। বিশেষ করে, তেল উৎপাদক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের (ঙচঊঈ) চেয়েও তাদের হাতে তেলের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা বেশি। মূলত তাদের প্রযুক্তিগত প্রাধান্যের ফলে। বিশ্বের মোট শক্তি ব্যবহারের ৪০ শতাংশ পূরণ করে শুধু এই তেল। আর এই প্রক্রিয়ায় বিশ্বের বাণিজ্যের ১৫ শতাংশই এই খাতের অধিকারে। এ জন্য বিশ্বের বাজারে অন্যান্য শক্তির দাম নির্ধারণ করে থাকে তেল। তেলের ওপর এরূপ নির্ভরশীলতা অনুমান করা যায়, এ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলবে। এ ছাড়া ভেবে দেখার বিষয়, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিশ্বের এক-সপ্তমাংশ মানুষের চেয়েও কম সংখ্যকের বাস। অথচ তারা পৃথিবীর অর্ধেক তেল ব্যবহার করে থাকে। পৃথিবীতে বিদ্যমান বিবাদ, অস্থিরতা-লাদেনের উত্থান ও মৃত্যু, সাদ্দামের পরিণতি তথা ইরাকের বিধ্বস্ত অবস্থা ও সর্বশেষ গাদ্দাফির মৃত্যু_এ সবই তেলের বাজারের বলি।
বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো মূলত পুঁজিবাদী যুদ্ধবাজ ও বণিক বা বিজ্ঞাপনী সংস্থার সম্পদ। ভোক্তা ও ভক্ত তৈরি করার জন্য তারা তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে ভালোভাবেই। আর একতরফা প্রচারণা গণমাধ্যমের প্রভাবাধীন পৃথিবীতে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল যেমন, গাজায় বা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি আক্রমণ ও দখলের সময় দুনিয়াজুড়ে দেখানো হয় ফিলিস্তিনি শিশু-তরুণরা ইট-পাথর ছুড়ছে। যেন তাদের এই প্রতিরোধ-প্রচেষ্টা বা দখলদারদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশটাই বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধ। কখনোই ক্যামেরায় ধরা পড়ে না ইসরায়েলি সৈন্যদের বর্বরতা। এসব হওয়ারই কথা। আমেরিকা-ইউরোপ যা দেখাতে চাইবে তাই আমরা দেখব, যা শেখাতে চাইবে তা-ই শিখব। আমরা এখন বিশ্বগ্রামের নাগরিক যে! তথাকথিত বিশ্বগ্রামের চার দেয়ালের ভেতরে দু-তিন দশক পার হতে না হতেই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে আকস্মিকভাবে সংগঠিত হয়ে গেল তরুণ প্রজন্ম তাও খোদ আমেরিকায়, নাম দিল 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলন। নিশ্চয়ই তাতে বিশ্বের চিন্তাশীল বাম বুদ্ধিজীবীরা আনন্দে আন্দোলিত হওয়ার চেয়ে বরং খানিকটা হলেও দুশ্চিতায় পড়েছেন। আসলেই দুশ্চিন্তার বিষয়। এই গণ-আন্দোলনের পেছনে একজন শিল্পপতিসহ কিছু কিছু ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে পুঁজি বিনিয়োগের খবরটাও মিথ্যা নয়। আবার কোনো প্রতারণার সূত্রপাত নাকি পুঁজিবাদী কূটকৌশলীদের। তবে নকল বা আসল যে আন্দোলনই হোক, আমেরিকায় এমন কিছু দানা বাঁধার মতো অজস্র উপাদান রয়েছে।
১৯৯৪ সালে ঘঅঋঞঅ বা উত্তর-আমেরিকীয় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমেরিকা কিউবা ছাড়া উত্তর আমেরিকার ৩৪টি দেশে বাণিজ্যিক আগ্রাসন শুরু করে। মেঙ্েিকায় স্বল্প মজুরি এলাকাগুলোর কম্পানিগুলো নিজেদের মালিকানায় নিয়ে নেয়। কানাডারও বহু কম্পানি অধিগ্রহণ করে নেয় আমেরিকার কম্পানিগুলো। ওসব কম্পানির শ্রমিকদের দৈনিক আয় কমে গেল ৪০ শতাংশ। কানাডার সঙ্গে সামাজিক নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও অভিন্নতা দেখা গেল, তাতে আমেরিকার বেকার ভাতা কমে গেল ব্যাপক হারে। কর্মচ্যুত মানুষর যেখানে বেতনের ৭৫ শতাংশ বেকার ভাতা পেতেন, তা ৩৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। তেল উৎপাদক মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে আমেরিকার তো প্রায় একটা হিস্যাই রয়েছে তলে তলে। এ ছাড়া বিশ্বায়নের উদার নৈতিক বাজারব্যবস্থার নামে প্রায় বিশ্বজুড়ে বাণিজ্যিক শোষণ করে চলেছে। এর পরও দিন দিন যুক্তরাষ্ট্রের দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। সামাজিক সুরক্ষানীতি বিপর্যস্ত। ৪৫ মিলিয়ন মানুষের কোনো চিকিৎসাবীমা নেই। '৯০ সালের তুলনায় বীমাহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১৪ শতাংশ। মাত্র ৪০০ জন মানুষ জাতীয় উৎপাদনের ১২ শতাংশ ভোগ করেন এবং অপর ৪০০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ১২ শতাংশ জাতীয় আয় বণ্টন হয়।
বিশ্বজুড়ে লুণ্ঠন বা ব্যবসায়িক ফাঁদ পেতে যুক্তরাষ্ট্রের যে ফায়দা হচ্ছে তাতে মূলত বহুজাতিক কম্পানিগুলোর সম্পদ স্ফীত হচ্ছে। কেন্দ্রীভূত সম্পদ মানুষের কোনো উপকারে আসছে না। আমেরিকানদের এই বোধোদয় ঘটেছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য ছাড়া রয়েছে বর্ণবৈষম্য। প্রায় ১৩ শতাংশ আফ্রো-আমেরিকানের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে নানাবিধ মামলার শিকার বানিয়ে। আশির দশক থেকে পরিবেশবাদী, নারীবাদী, উদার ধর্ম সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, তরুণ প্রজন্মের একাংশ, মানবাধিকার কর্মীগোষ্ঠী মিলে বিশ্বায়ন বা পুঁজিবাদী নির্মমতার বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছিল। ফলে আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম সিয়াটলে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের প্রতিবাদ। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর সে গতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। বরং কট্টর দক্ষিণপন্থী ও উগ্র খ্রিস্ট মৌলবাদী সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর খ্রিস্টান অধিকার সুরক্ষা সমিতির নেতা রেভারেন্ড মেরি ফলওয়েল বিবৃতি দিলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরুষ ও মহিলা সমকামীদের এবং গর্ভপাতকারিণীদের যথেচ্ছ আস্কারা দেওয়ার শাস্তি পেয়েছে।' এই হলো আমেরিকার ভেতরের ভয়ানক চিত্রের খানিকটা।
আশার কথা, এসব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ওয়াল স্ট্রিট দখল আন্দোলন যদি পুঁজিবাদী বর্বরতার বিরুদ্ধে জাগ্রত বিবেকের সত্যিকার জাগরণ হয়, তাহলে একে ঘনায়মান অন্ধকারের ভেতরে আশার আলোক বিন্দু বলা যায় নিঃসন্দেহে।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.