আলোচনা- 'জনসংখ্যার বিপদ ও পরিত্রাণের পথ' by অধ্যাপক ড. মো. মইনুল ইসলাম

আমরা উন্নয়ন চাই। কারণ আমাদের দেশ খুব গরীব। আর উন্নয়ন বলতে বুঝি দারিদ্র্য বিমোচন। যার ফলে মানুষ ক্ষুধার হাত থেকে মুক্তি পাবে এবং তার সঙ্গে মুক্ত হবে বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অভাব থেকে। উন্নয়নের ব্যাপারে রাষ্ট্র ক্রান্তি কালিন ভূমিকা পালন করে এবং তাই এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের সাফল্য এবং ব্যর্থতা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচিত বিষয়। বিশেষ করে আমাদের মত স্বল্পোন্নত দেশে মানুষের বেঁচে থাকা এবং বিকাশের জন্য যেহেতু উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচন অতি জরুরি কাজ। তাই এই গুরু দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রের মত সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যক্তির ভূমিকাকেও উপেক্ষা করা যায় না।
আর তাই কিছুদিন আগে প্রকাশিত ইউএনএফপি-এর (টঘঋচঅ) বিশ্ব জনসংখ্যা রিপোর্ট-২০১০-এ বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে ভয়াবহ চিত্র প্রকাশিত হল, তাতে উন্নয়ন ও দারিদ্র্য নিরসনের ব্যাপারে হতাশ না হয়ে পারা যায় না। রিপোর্টে দেখা যায় গত এক বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ২২ লাখ এবং বর্তমানে দেশে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৪৪ লাখ। এ-ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে খাদ্য মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি আশঙ্কাজনক এবং এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন (সংবাদ ২১-১০-১০)। আমাদের খাদ্য ঘাটতি সর্বজনবিদিত। দীর্ঘদিন ধরে আমরা খাদ্যশস্য আমদানিকারক দেশ। ২০০৪-০৫ অর্থ বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় বাংলাদেশ গড়ে প্রায় ৩০.৪৭ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য শস্য আমদানি করে থাকে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের সরবরাহ কমছে; ফলে দাম বাড়ছে। এই বিরাট জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে তাই খাদ্য নিরাপত্তার হুমকিটি দেশের জন্য বড় অশনি সঙ্কেত।
বরঞ্চ দেশের সীমিত সম্পদের উপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। এর ফলে দ্রুত আবাদি জমি কমছে এবং কমছে ফসল উৎপাদন। এছাড়া নদ-নদী, খাল-বিল এবং বন জঙ্গলের উপর বাড়তি জনসংখ্যার চাপের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং বাড়ছে দূষণ। অপুষ্টির কারণে স্বাস্থ্যহীন মানুষ অতিশয় অপ্রতুল স্বাস্থ্য সেবার উপর যেমন চাপ সৃষ্টি করছে তেমনি পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া তারা যাতায়াত, পরিবহন, বিদু্যৎ, জ্বালানিসহ সব ধরনের ভৌতিক এবং সামাজিক অবকাঠামোর উপর ক্রমাগত চাপ বাড়িয়ে চলেছে। বিবিএস-এর সাম্প্রতিক শ্রমশক্তি জরিপে (এমএএস ২০০৯) অনুসারে দেশে ২ কোটি ৭০ লাখ লোক কর্মহীন বা বেকার। ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের কারণে তরুণদের একটি বড় অংশ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। তাই দেশে নানাবিধ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটের জন্য বহুলাংশে দায়ী দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যা। মোট কথা জাতীয় পর্যায়ে উন্নয়ন ও ব্যক্তি এবং পারিবারিক জীবনে সচ্ছলতার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরঞ্চ দারিদ্র্য, অনাহার, অস্বাস্থ্য এবং অশিক্ষার চিত্রটিই বড় হয়ে ফুটে উঠছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে শুধু খাদ্য গ্রহণের পরিমাপে দরিদ্র মানুষের পরিসংখ্যানটি দেখলেই দারিদ্র্যের এই ভয়াবহ চিত্রটি পরিস্ফুট হয়ে উঠে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডঋচ) ২০০৯ সালে পরিচালিত বাংলাদেশের খাদ্য-নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী একজন মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন ২ হাজার ২২২ ক্যালরি খাদ্য গ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে এর চেয়ে কম ক্যালরি গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ১ লাখ। ১ হাজার ৮০০ এর কম ক্যালরি গ্রহণ করে এমন জনগোষ্ঠীকে হতদরিদ্র বা ঁষঃৎধঢ়ড়ড়ৎ আখ্যায়িত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এদের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। ১ হাজার ৬০০ এর কম ক্যালরি গ্রহণকারী মানুষকে চরম দরিদ্র বা ঐড়ৎফ পড়ৎব ঢ়ড়ড়ৎ উলেস্নখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এদের সংখ্যা ৩ কোটি ১০ লাখ। এর বিপরীতে বছর প্রতি ২০-২২ লাখ জনসংখ্যা বৃদ্ধি নূ্যনতম খাদ্য গ্রহণের পরিমাপে উন্নয়ন তথা দারিদ্র্য বিমোচনের সংগ্রাম এবং সম্ভাবনাকে কি মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সংগ্রামটি জোরদার করার কোন বিকল্প নেই।
এ ব্যাপারে ব্যক্তির ভূমিকাও কম নয়। এ বিষয়ে ব্যক্তিকে সচেতন এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। কিন্তু পৃথিবীর উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে পরিবার-পরিকল্পনা তথা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রধান। ব্যক্তিকে জন্মনিয়ন্ত্রনে সচেতন এবং উদ্বুদ্ধ করতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের চোখের সামনেই গত তিন দশকে চীনের মত বিরাট জনবহুল দেশ তার জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। জাতীয়ভাবে এক শিশু নীতি (ঙহব পযরষফ ঢ়ষরপু) গ্রহণের ফলে এবং তা কড়াকড়িভাবে প্রয়োগের কারণে চীন একটি ভারসাম্যপূর্ণ জনসংখ্যার দেশে পরিণত হয়েছে। একদিকে অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন এবং অন্যদিকে জন্মহার নিয়ন্ত্রণর ফলে চীনের মানুষ এখন উন্নতমানের জীবন ধারণ করতে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে পরিবার-পরিকল্পনায় সরকারী উদ্যোগ খুব দুর্বল। ১৯৬৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর সংখ্যা শতকরা মাত্র ৫৫ দশমিক ৮ ভাগ। ৪৪ দশমিক ২ ভাগ মানুষ এখনও এই পদ্ধতির বাইরে রয়ে গেছে। দেশে পরিবার-পরিকল্পনা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এতই দুর্বল যে এ ব্যাপারে কোন জাতীয় অভিযান তথা দেশব্যাপী জোরদার প্রচার-প্রচারণা এবং গণমাধ্যমে জোরালো আলাপ-আলোচনা দেখা যায় না। সুশীল সমাজও এ ব্যাপারে অনেকটা নীরব ও নির্বিকার। অথচ ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে বিষয়টি অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত। তাই রাষ্ট্রের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনও দরকার।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হল অজ্ঞতা এবং কুসংস্কার। মানুষ যত শিক্ষিত হয় তত তার অজ্ঞতা এবং কুসংস্কার দূর হয়। ফলে সে ধমর্ীয় এবং সামাজিক কুসংস্কার মুক্ত হয় এবং জীবনের দায়-দায়িত্ব সম্বন্ধে সজাগ এবং সচেতন হয়। তাই জন্মনিয়ন্ত্রণে শিক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ শিক্ষাই জনসংখ্যাকে জ সম্পদে পরিণত করে। শিক্ষিত মানুষই উন্নয়নের মহানায়ক এবং মূল চালিকাশক্তি। এক কথায় শিক্ষা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর উন্নয়নের ফলে কর্মসংস্থান হয় এবং আয় বাড়ে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং আয় বৃদ্ধির ফলে মানুষ সন্তান গ্রহনের ব্যাপারে সচেতন এবং সাবধান হয়। বিশেষ করে এ ব্যাপারে নারীশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সাধারণভাবে শিক্ষা এবং বিশেষ করে নারীশিক্ষার প্রসার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণসহ জাতীয় উন্নয়নের জন্য আমাদের দেশে যুদ্ধকালীন গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ফলেই শিল্পোন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে জন্মহার এত কম যে জনসংখ্যার স্বাভাবিক ক্ষয়কে পূরণ করে বর্তমান পর্যায়ে ধরে রাখাই সম্ভবপর হচ্ছে না। একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এশিয়ার নব্য ধনী কয়েকটি দেশে যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং এবং সিঙ্গাপুরে। জনসংখ্যা বাড়া দূরে থাকুক দেশগুলো বর্তমান পর্যায়েই তা ধরে রাখতে পারছে না। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ঞযব ঊপড়হড়সরংঃ (ঝবঢ়ঃবসনবৎ ১৮ঃয, ২০১০) এ প্রকাশিত অহ বীপবৎপরংব রহ ভবৎঃরষরঃু প্রতিবেদনটিতে উলিস্নখিত বিষয়ে নানা তথ্য-উপাত্ত সংবলিত সুন্দর একটি বিবরণ আছে। সেখানে একই কথা বলা হয়েছে। তাহলো মানুষ যত শিক্ষিত ও সচ্ছল হবে এবং শহরে বসবাস করবে এবং নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে ততই তাদের প্রজনন হার কমবে এবং সন্তানের সংখ্যা হ্রাস পাবে। এক কথায়, উন্নয়ন এবং আধুনিকায়নই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বড় প্রতিষেধক, যা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সার্বজনীন সত্য।
তাই আমাদের উন্নয়নের গতি বাড়াতে হবে। তার সঙ্গে বাড়াতে হবে শিক্ষার হার। অন্যদিকে পরিবার-পরিকল্পনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমও জোরদার করতে হবে। আর এসবের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে রাষ্ট্রের। তার পাশাপাশি একটি সামাজিক সচেতনতামূলক আন্দোলনও সক্রিয় থাকতে হবে। তবে এনজিও জাতীয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও এ ব্যাপারে কম নয় এবং আমাদের দেশে কিছু এনজিও এ ব্যাপারে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করছে। তবে আবারও বলতে হয় রাষ্ট্রের ভূমিকা এ ব্যাপারে মুখ্য এবং চীনের এক সন্তান নীতি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই সাফল্য লাভ করছে। চীনের এ নীতিতে কঠোরতা ছিল, যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সম্ভবপর হতো বলে মনে হয় না। তবে আমাদের মত স্বল্পোন্নত দারিদ্র্যপীড়িত দেশে চীনের মত কঠোরভাবে না হোক, কড়াকড়িভাবে এ ব্যাপারে শক্তিশালী উদ্যোগ নেয়া সবিশেষে জরুরি।
===========================
শিল্প-অর্থনীতি 'বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি:দুর্ভাবনার বিষয়' by ড. আর. এম. দেবনাথ  গল্পসল্প- 'হায়রে নাড়ি ছেঁড়াধন' by শিখা ব্যানার্জী  গল্পসল্প- 'জননী ও জন্মভূমি' by শুভ রহমান  গল্পালোচনা- ''বিভীষণ' বিদায় ও হরতাল সমাচার' by শুভ রহমান  খবর- হরতালের বিরুদ্ধে একজোট, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা  আলোচনা- 'হজ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে কিছু কথা' by এয়ার কমোডর (অব.) মুহম্মদ জাকীউল ইসলাম  শিল্প-অর্থনীতি 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেতন-কাঠামো' by খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ  স্মরণ- 'মীর শওকত আলী বীর উত্তম : একজন বীরের প্রতিকৃতি' by ড. আশকার ইবনে শাইখ  আন্তর্জাতিক- 'মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ' by আহসান হাবীব  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিচিত্র সংকটের আবর্তে একটি বাড়ি' by এবিএম মূসা  ইতিহাস- 'হাজংমাতা শহীদ রাশিমনির স্মৃতিসৌধে' by দীপংকর চন্দ  গল্প- 'ঈর্ষার রং ও রূপ' by আতাউর রহমান  ডিজিটাল-প্রযুক্তি কি মানবতাবিরোধী প্রবণতা তৈরি করে? by মোহীত উল আলম  খবর- এক দশক পর ছেলের সঙ্গে দেখা হলো সু চির  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'ট্রানজিটঃ অর্থের বাইরে বাইরে প্রাপ্তিযোগও ভাবতে হবে' by কে এ এস মুরশিদ  খবর- আমনের বাম্পার ফলনেও বাড়ছে চালের দাম by ইফতেখার মাহমুদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি' by ফজলুল বারী


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ অধ্যাপক ড. মো. মইনুল ইসলাম
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.