গল্পসল্প- 'জননী ও জন্মভূমি' by শুভ রহমান

প্রথাবিরোধী গায়ক নচিকেতা এসেছিলেন সিডনিতে। বিতর্কিত গানের কথা, সুর ও ভঙ্গির মতো তাঁর কথাবার্তাও ভিন্ন ধরনের, মঞ্চ যেন তাঁর হাতের পুতুল। বাক্স্ফূর্তিতে মাতোয়ারা নচিকেতা বাঙালি জীবনে বাবার ভূমিকার কথা বলছিলেন, অভিযোগ করছিলেন, মাকে নিয়ে, মার উদ্দেশে, মাকে ঘিরে যত গান, কবিতা, ইমোশন, বাবাকে নিয়ে ততোটা হয় না। বাবার কি কোনো ভূমিকা নেই? সন্তান কি বাবার কাছেও ঋণী নয়? তার এই বক্তব্য পুরুষ দর্শকদের মনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল এবং এটাই স্বাভাবিক। তাৎক্ষণিক ভালো লাগায় হাততালি দিতে দিতে এক সময় নিজের অজান্তেই থেমে গেল হাতে দুটো।
কাছাকাছি পেঁৗছে যাওয়া করতালুজুড়ে ভেসে উঠল হাজার হাজার মাইল দূরের এক মহিলার ছবি; ছেলেবেলায় রাগী, উপার্জনশীল, শক্তিধর বাবার প্রতাপ থেকেই যিনি ছায়া হয়ে দূরে সরিয়ে রাখতেন। যার উপার্জনহীন শাড়ির আঁচলে বাঁধা টাকা ছিল বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেঁচে থাকার উৎস। যিনি না থাকলে মূলত জীবন ছিল অন্ধকার। অতিসামান্য, আটপৌরে, বাঙালি সেই ভদ্রমহিলা কি শুধু আমার জননী? ইনিই তো সেই মা। যিনি কোনো সময় বিদুষী রোকেয়া, কোনো সময় কুষ্ঠরোগীর মাদার তেরেসা, কখনো জননী জাহানারা ইমাম বা দিব্য জননী মাদার রিসা। এঁদের বাদ দিয়ে হঠাৎ পিতৃবন্দনায় মন সায় দেয়নি। পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও নচিকেতার বাবা-স্তুতি টানল না।
আমাদের জীবনে মার ভূমিকা বরাবরই অন্য ধরনের। খুব ছেলেবেলায় গর্ভধারিণীর পর দশভুজা দুর্গাকে মা বলে জেনেছি। জন্মেছি হিন্দুর ঘরে। বাঙালি হিন্দুর শরৎকালের আবহটাই মাতৃবন্দনার। মা-ই শিখিয়ে দিয়েছিলেন দেবী দুর্গা আমাদের দ্বিতীয় মা। মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে এককভাবে শারদ উৎসব দুঃসাধ্য, বস্তুত অসম্ভব এক ব্যাপার। কিন্তু প্রতি পাড়ায়, প্রতি মহল্লায় তার কোনো অভাব নেই, তখনো ছিল না। এককভাবে অসম্ভব বলেই হয়তো বা সর্বজনীন উৎসবের এত ঘনঘটা। আমাদের বাড়ির অনতি দূরের মণ্ডপে দ্বিতীয় মা দর্শনের সেই ভোরবেলাগুলো এখনো জাগরূক। সবুজে সবুজে গাছগাছালিতে ভরা চট্টগ্রামের নিসর্গ বরাবরই আলাদা। প্রকৃতি তখনো এতটা নির্মমতার শিকার হয়নি। আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেনি এতটা। শরৎকালের মেঘপুঞ্জ, আকাশে ভেসে বেড়ানো বালিহাঁসের ঝাঁক আর শিশিরে জীবন ছিল অনিন্দ্যসুন্দর। সকালে কুয়াশার জাল ভেদ করে চাদর মুড়ি দিয়ে দুর্গা-দর্শনের পথযাত্রায় যতটা সম্ভব চোখ মুদে চলতাম আমরা, গলিপথে যানবাহনের ঝুঁকি ছিল না, ছিল পাথরে, ইটে অথবা ঢিবিতে আছাড় খাওয়ার ভয়। তবু যতটা সম্ভব চোখ বেঁধে চলার কারণ, চক্ষু খুলেই যেন দর্শন মেলে জননীর। এই ভক্তিবাদ, প্রাণে প্রাণে ঢুকিয়ে দেওয়া মার জন্য ভালোবাসা, এও এক অদ্ভুত রহস্য, রোমাঞ্চকর মাতৃপ্রেমের মুকুলিত শৈশব।
মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, উচ্চবিত্ত_সব বাঙালির পরিবারে মা যেমন কর্ত্রী, তেমনি স্নেহ আর ভালোবাসার আধার। দরিদ্র দেশে শিক্ষাবঞ্চিত সমাজে, আর্থিকভাবে পশ্চাৎপদ জাতিতে শক্তির প্রয়োজন নিয়ে তর্ক চলে না। প্রশ্নাতীতভাবে মা-ই বাঙালির সবচেয়ে বড় শক্তি। খুব সীমিত পরিসরে দেখুন, পরীক্ষা হলে যাওয়া, ইন্টারভিউতে যাওয়া, চাকরি শুরুর প্রথম দিন অথবা বিয়ে_সবার আগে চাই মায়ের আশীর্বাদ। এই দোয়া নেওয়াটাকে প্রথা মনে করার কারণ নেই। এ কোনো নিছক নিয়মাচারও নয়। বরং বাবাসহ অন্য বয়স্কজনদের কাছ থেকে আশীর্বাদ প্রার্থনা যতটা লোকাচার, মার সাক্ষাৎ বা মাকে ছুঁয়ে যাত্রা ততোটাই মাঙ্গলিক। মা কি পারেন, কি পারেন না, সেটা বড় কথা নয়, অদৃশ্যে অন্তজগতে তিনি বা তাঁর স্থান অনেক উঁচুতে। সামাজিকভাবেও সেটা পরীক্ষিত।
যে দেশে ফতোয়া, মোল্লাতন্ত্র বা বামুনের অত্যাচারে নারীরা হয় অবনত অথবা অপদস্থ। সে দেশেই ২০ বছর ধরে চলছে নারীর শাসন। যে জাতীয় অপরাধ আন্তর্জাতিক বিচার ও সভ্যতার দুয়ারে মাথা কুটছে তার উন্মোচন, তার প্রতিকারও নিশ্চিত হয়েছে সন্তানহারা এক জননীর নেতৃত্বে। জাহানারা ইমামের মতো সাহসিকা না থাকলে ন্যায্যবিচার প্রক্রিয়া কবে কূল পেত কে জানে?
আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে-মফস্বলে নারীর ভূমিকা অবদমিত বা সমাজে কেবলই নিপীড়িত_এটা মানা যায় না। সাহস, শৌর্য ও স্নিগ্ধতায় সমান দীপ্র, সমান উজ্জ্বল নারীরা না থাকলে জীবন এতটা সুন্দর, এতটা সংযত থাকত না। আমরা প্রায়ই বলি, বাংলাদেশ অস্থির দেশ, তার চলমান জীবন-সংসারও সু-স্থির কিছু নয়। যানজট, বিদ্যুৎহীনতা, পানীয় জলের সংকট, সন্ত্রাস, মাস্তানতন্ত্রকে বড় করে দেখিয়ে ১০০ হাজার অভিযোগও প্রমাণ করা সম্ভব। এর বিপরীত চিত্রটি দেখার কথাও যেন ভুলে না যাই। এ দেশে এখনো মানুষ মানুষের জন্য কাঁদে, কারো অসুখে কারো অস্বস্তি, দুর্ভোগে আত্মীয়স্বজন আসে বা না আসে, মানুষ ছুটে আসে, যার যা সাধ্য তা নিয়েই পাশে দাঁড়ায়। খোঁজ নিয়ে দেখুন, এসব সৎ ও ভালো কাজগুলোর পেছনে আছে কোনো না কোনো মায়ের ইন্ধন।
এ দেশের শস্যক্ষেত্রের মতো, ফলবতী বৃক্ষের মতো, নদীর ধারার মতো রমণীরাই মা হন। কেবল কি প্রৌঢ়া আর বৃদ্ধারাই মা? 'নারী' হওয়ার প্রথম পাট চুকানো সদ্যবিবাহিত তরুণী যখন লুকিয়ে টকঝাল খান, গাছের আড়ালে লুকিয়ে বমি করেন, তখন থেকেই তিনি মা। তাঁর নাড়িতে তখন থেকেই পড়ে টান। অতঃপর হামাগুড়ি দিতে দিতে যে শিশুটি ঢলে পড়ে যায়, তাকে কোলে তুলে নির্ভয়দাত্রী নারীও মা। সকালবেলা বাবাকে অফিস যাত্রার টাইয়ের নট বেঁধে দিয়ে সন্তানের জুতোর ফিতে বেঁধে দিতে ব্যস্ত যুবতীটিও মা।
প্রতি দিন, নানাভাবে, নানা বর্ণে রং, রসে, করুণা, বেদনা ও আনন্দে ভরে ওঠে বাংলা ও বাঙালি মায়ের ভুবন। ফলে নতুন করে 'মা দিবস' পালনের প্রয়োজন পড়ে না আমাদের। আমাদের সংস্কৃতিই আলাদা। সেখানে সিঙ্গেল মাদার বলে কিছু নেই, পিতাহীন সন্তানের অস্তিত্বও কল্পনাতীত। দুর্ভোগ আছে, বিবাহবিচ্ছেদ আছে, পরকীয়া আছে, সন্তানহীনা মায়ের আকুতি আছে, নেই মাকে অবহেলা আর অপমানের সামাজিক প্রক্রিয়া। ইংল্যান্ড, গ্রিসে চালু থাকলেও দিবস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উড্রো উইলসনই এর স্বীকৃতিদাতা। তাদের এ জাতীয় দিবসের প্রয়োজন আছে। এখন যদিও তা বাণিজ্য-আক্রান্ত ও বিপণনের এক বিশাল উৎস; তার পরও মা সন্তানের দূরতম, অস্পষ্ট, টাকা ধার দেওয়া-নেওয়া, কার্ড বা ফুল পাঠিয়ে খবর রাখার দেশে এর বিকল্প নেই।
আমাদের মাও খুব ভালো থাকেন না। সংসারে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, সমাজে বৈষম্য_সবই আছে, তবু তিনি চাঁদের মতো। সূর্যের মতো তীব্র তীক্ষ্ন, প্রখর, ঝলসানো নন, বরং তাপে-উষ্ণতায় গলে যাওয়া দিনের পর মমতা মাখানো এক ফালি চাঁদের মতো, ঘুমোতে যাওয়ার আগে প্রতিটি সন্তানের কপাল স্পর্শ করে দিয়ে যাওয়া কিরণের মতো হাত তাঁর। নিরাপত্তা আর শান্তির প্রতীক, সবশেষে তাঁকেও ঘুম পাড়িয়ে জাগিয়ে থাকেন আরেক মা। সে আমাদের জন্মভূমি। অতন্দ্র বিনিদ্র দয়াবতী দেশ জননী, আমরা যাকে বলি 'তোমার পরে ঠেকাই মাথা'। ভূমিষ্ঠ থেকে শেষযাত্রার আশ্রয় প্রতিটি বাঙালির একক ও অভিন্ন মা বাংলাদেশ। সব মায়ের জয়ে জয়ী হোক জগতমাতা ধরিত্রীও।
===========================
গল্পালোচনা- ''বিভীষণ' বিদায় ও হরতাল সমাচার' by শুভ রহমান  খবর- হরতালের বিরুদ্ধে একজোট, উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা  আলোচনা- 'হজ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে কিছু কথা' by এয়ার কমোডর (অব.) মুহম্মদ জাকীউল ইসলাম  শিল্প-অর্থনীতি 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেতন-কাঠামো' by খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ  স্মরণ- 'মীর শওকত আলী বীর উত্তম : একজন বীরের প্রতিকৃতি' by ড. আশকার ইবনে শাইখ  আন্তর্জাতিক- 'মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ' by আহসান হাবীব  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিচিত্র সংকটের আবর্তে একটি বাড়ি' by এবিএম মূসা  ইতিহাস- 'হাজংমাতা শহীদ রাশিমনির স্মৃতিসৌধে' by দীপংকর চন্দ  গল্প- 'ঈর্ষার রং ও রূপ' by আতাউর রহমান  ডিজিটাল-প্রযুক্তি কি মানবতাবিরোধী প্রবণতা তৈরি করে? by মোহীত উল আলম  খবর- এক দশক পর ছেলের সঙ্গে দেখা হলো সু চির  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'ট্রানজিটঃ অর্থের বাইরে বাইরে প্রাপ্তিযোগও ভাবতে হবে' by কে এ এস মুরশিদ  খবর- আমনের বাম্পার ফলনেও বাড়ছে চালের দাম by ইফতেখার মাহমুদ  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি' by ফজলুল বারী  আলোচনা- 'খাদ্যনিরাপত্তা ও পশুসম্পদ' by ড. মো. সিদ আলোচনা- 'আমি বাস্তুহারা'_এ কথার মানে কী?' by এ এন রাশেদা  গল্পালোচনা- 'বাংলাদেশকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র' by মোস্তফা কামাল  রাজনৈতিক আলোচনা- 'যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের যন্ত্রণা এবং নতুন মুক্তিযোদ্ধা সনদ' by হারুন হাবীব



কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ শুভ রহমান


এই গল্পালোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.