চরম পন্থা নয়, মধ্যম পন্থা অবলম্বন
ইসলামে চরম পন্থা, বাড়াবাড়ি, সীমা লঙ্ঘন, ফিতনা-ফ্যাসাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা কাম্য নয়। ইসলামি জীবনব্যবস্থায় ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ, জাতি-গোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, সম্প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার, পরমতসহনশীলতার মনোভাব ও মধ্যম পন্থা অবলম্বন মুসলমানদের চরিত্রের অনুপম বৈশিষ্ট্য। ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থায় যখন কেউ গোঁড়ামির মতো একধরনের মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তখন মানুষ সাধারণত অন্যের মত ও পন্থাকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করে না, বরং নিজের মত ও পন্থাকে সঠিক বলে মনে করে এবং সেটাই প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কঠোরতা অবলম্বন ও অহেতুক শক্তি প্রয়োগ করতে চায়। অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ধর্মে কোনো জোর-জবরদস্তি ও কঠোরতা নেই।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৬) মানবসমাজে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, হানাহানি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও জানমালের নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করার মতো ঘৃণ্যতম কাজকে ইসলাম অনুমোদন করে না। ফিতনা-ফ্যাসাদ তৈরি, বাড়াবাড়ি করা, কঠোরতা প্রদর্শন, চরম পন্থা অবলম্বন মূলত বিভ্রান্তদের কারসাজি। সন্ত্রাস, বোমাবাজি ও চোরাগোপ্তা হামলা এবং রক্তপাত করে নিরপরাধ মানুষ হত্যার অপচেষ্টা কোনো পুণ্য কর্ম নয়। বরং যে ব্যক্তি-দল বা সংগঠন একজন নিরীহ মানুষ বা পথচারীকে হত্যা করবে, তার আমলনামায় জগতের সব নরহত্যার গুনাহ বা মহাপাপ লেখা হবে। কেননা, মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আল্লাহর কালামে পাকে ঘোষিত হয়েছে, ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৩২) চরম পন্থা অবলম্বন ইসলামি আকিদা, বিশ্বাস ও চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম হলো মধ্যম পন্থার মানবতাবাদী ধর্ম ও ভারসাম্যপূর্ণ শান্তিময় জীবনব্যবস্থা। ইসলামের অভ্যুদয় থেকে ১৪০০ বছরের ইতিহাসে ইসলামের মূলধারার কোনো আন্দোলন অসি শক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয়নি; বরং ইসলামের আদর্শিক মহানুভবতা, ক্ষমা, উদারতা ও নৈতিক শক্তির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শান্তির ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলাম ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। ইসলাম প্রচার ও প্রসারে কোমল ব্যবহারের দাবি রাখে। কঠোর অবস্থানে জোরপূর্বক দাবি আদায় বা ইসলামি আইন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্যকে বিনষ্ট করে দেয়। তাই সাময়িক উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে চরম পন্থা গ্রহণ বা বাড়াবাড়ির অবকাশ ইসলামে নেই। যে ব্যক্তি বা দল-মত চরম পন্থা অবলম্বন করে, সে ব্যক্তি-দল বা গোষ্ঠী কখনোই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে না। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোমল
ব্যবহার থেকে বঞ্চিত, সে কল্যাণ থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত। কোমলতার ফলে আল্লাহ তাআলা এমন কিছু দান করেন, যা চরম পন্থা অবলম্বনকারীকে দান করেন না।’ (মুসলিম) ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী ও সুমহান আদর্শ প্রচারের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই সন্ত্রাস, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রক্তপাত ও সংঘাতমুক্ত পৃথিবীর প্রয়োজনে পারস্পরিক সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে ইসলামের শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণধর্মী জীবনাদর্শ এখন সময়ের দাবি। ইসলামে চরম পন্থা, জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো একজন মানুষকে গুপ্তহত্যা করেননি; কারও বিরুদ্ধে কঠোরতা, বাড়াবাড়ি বা চরম পন্থার আশ্রয় নেননি। নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তোমরা আগে অস্ত্র উত্তোলন কোরো না বা অস্ত্রের ভয়ভীতিও প্রদর্শন কোরো না।’ পারস্পরিক দয়া, কোমলতা, সরলতা, প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার, উত্তম আদর্শ, সুমধুর বাক্যালাপ ছিল মহানবী (সা.)-এর ইসলাম প্রচারের মূল হাতিয়ার। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘আমাকে সরল পন্থা অবলম্বন করার জন্য পাঠানো হয়েছে, চরম পন্থা অবলম্বনের জন্য নয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সহজ, সরল পন্থা অবলম্বন করবে, কঠোরতা প্রদর্শন করবে না। সুসংবাদ দাও, ঘৃণা ছড়িয়ো না।’ (বুখারি)
বর্তমান বিভিন্ন পর্যায়ে সভ্য সমাজে যেভাবে ফিতনা-ফ্যাসাদ ও সন্ত্রাসবাদ চলছে, সর্বস্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, এতে যেমন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম ব্যাঘাত হয়, তেমনি সামাজিক কর্মকাণ্ডে দারুণভাবে ব্যাঘাত ঘটছে। অথচ উগ্রবাদী, বিপ্লবী ও চরমপন্থীরা বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের সন্ত্রাস, বোমাবাজি, চোরাগোপ্তা হামলাসহ ইসলামবিরোধী মানবতাবিবর্জিত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। চরম পন্থা অবলম্বন বা কঠোরতা প্রদর্শন ইসলামের জন্য শুধু ক্ষতিকর নয়, বরং এটা মানুষের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও সহিংসতা সৃষ্টি করে ইসলামের শান্তির পথকে রুদ্ধ করে দেয়। এ জন্য জোর-জবরদস্তি ও চরম পন্থাকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা এবং ফিতনা-ফ্যাসাদ প্রতিরোধে সাধ্যমতো সমঝোতার প্রচেষ্টা তথা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তধর্মীয় সংলাপ, কথা ও কলমের জিহাদ অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা, সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ, বিপর্যয়, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করাকে হত্যার চেয়েও মহাপাপ সাব্যস্ত করে বলা হয়েছে, ‘ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯১)
ইসলামে চরম পন্থাকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও নবী করিম (সা.)-এর ঘনিষ্ঠ সাহাবি এবং ইসলামের তিনজন বিশিষ্ট খলিফার কাউকে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত অবস্থায়, কাউকে মসজিদের মধ্যে চরমপন্থী আততায়ীরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের আলেমসমাজ, ধর্মীয় নেতা, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও খতিবদের উদ্ভূত সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থী বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে তাঁদের সোচ্চার প্রতিবাদ ও শান্তিপূর্ণ বলিষ্ঠ অবস্থান রেখে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় জনগণকে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সমাধানের একটি সহজ পথ। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ধর্মপ্রাণ মানুষকে চরম পন্থা প্রতিরোধে সজাগ-সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে শান্তির সপক্ষে মধ্যম পন্থা অবলম্বনের ব্যাপক প্রচারণামূলক জাতীয় ঐক্য ও সংলাপের কর্মসূচি হাতে নিয়ে অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ষ ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com
No comments