বাঙালীর দেশপ্রেম জাতীয় অসত্মিত্ব চেতনার প্রতীক- ভাষার মর্যাদায় দেশে-বিদেশে by শহীদ মিনার
সৈয়দ সোহরাব আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি... এই গানের পেছনে লুকিয়ে আছে অনেক ইতিহাস। যে ইতিহাস অনেক নির্মম ও নিষ্ঠুর, আবার গৌরবেরও।
মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বায়ান্নর একুশে ফেব্রম্নয়ারি এ দেশের ছাত্র-জনতা ঢেলে দিয়েছিল বুকের তাজা রক্ত। ভাষা শহীদের রক্তে সেদিন রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। তাঁদের আত্মদানকে চির অমস্নান করে রাখতে তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে নির্মিত হয় এক স্মৃতিসৌধ, যা 'শহীদ মিনার' নামে এখন পরিচিত। কালের প্রবাহে সেই শহীদ মিনারই বাঙালীর দেশপ্রেম, জাতীয় অসত্মিত্ব ও চেতনাবোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। সেই চেতনাবোধের মাসটিই ফিরে এসেছে আবার। কাল বাদে পরশুই শুরম্ন হচ্ছে বাঙালীর কাঙ্ৰিত সেই মাস, ভাষার মাস ফেব্রম্নয়ারি। বাঙালীর কাছে এই মর্যাদা অনেকটা ধর্মের মতোই পবিত্র। কারণ ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, তারপর স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম। তাই বাঙালী যে কোন সঙ্কটে, সংগ্রামে ছুটে যায় শহীদ মিনারে, সঞ্জয় করে সাহস ও প্রেরণা।আত্ম পরিচয়ের সোপান এই শহীদ মিনার সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র শহীদ মিনার, যার অনুরূপ মিনার গড়ে উঠেছে শ' শ', হাজার হাজার। শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের যেখানে বাঙালী আছে সেখানেই গড়ে উঠেছে এই শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান একুশে ফেব্রম্নয়ারি আনত্মর্জাতিকতা লাভের পর থেকে তা আরও গতি পেয়েছে। জাতীয়তাবোধ ও দ্রোহের প্রতীক হয়ে ওঠা এই শহীদ মিনার পাওয়া যাবে না এমন কোন পাড়া-মহলস্না নেই দেশে। শিৰা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তো বাধ্যতামূলকই। যদিও এখন রাজধানীতে এক বাড়ি এক শিৰা প্রতিষ্ঠান হওয়ায়, স্থান সঙ্কুলানের কারণে স্থায়ী শহীদ মিনার থাকে না। তার পরও এই ফেব্রম্নয়ারি মাসে দিবসটি পালনের লৰ্যে এসব প্রতিষ্ঠান অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে থাকে। শুধু শিৰা প্রতিষ্ঠানেই নয়, দিবসটি পালনে বিভিন্ন বাসাবাড়ির উঠানে, ছাদে শিশু-যুবারা নির্মাণ করে অস্থায়ী শহীদ মিনার। এভাবে এখন শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও শহীদ মিনার গড়ে পালন করা হয় দিবসটি। বিশ্বের যেখানে যেখানে রয়েছে বাঙালী বসতি, সেখানেই গড়ে উঠেছে শহীদ মিনার। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অনুরূপ আদলে স্থায়ী শহীদ মিনার গড়ে উঠেছে ব্রিটেনের ওল্ডহ্যাম এবং নর্থ-ওয়েস্ট শহরে, জাপানের টোকিওতে, কানাডার টরন্টোতে, মধ্যপ্রাচ্যের ওমানে, অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে, ভারতের কলকাতা শহরসহ আরও অনেক স্থানে।
আমাদের মাতৃভাষা দাবির ত্যাগ স্বীকারকে মর্যাদা জানিয়ে এখন আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় বিশ্বের ১৮৮টি দেশে। এই একুশ উপলৰে বিশ্বের দেশে দেশে স্থায়ীভাবে গড়ে উঠছে শহীদ মিনার। যেসব দেশের স্থায়ী শহীদ মিনার নেই, সে সব দেশ দিবসটি পালনে নির্মাণ করছে অস্থায়ী শহীদ মিনার। বাংলাদেশের বাইরে প্রথম স্থায়ী শহীদ মিনার গড়ে ওঠে লন্ডনের ওল্ডহ্যাম শহরে ১৯৯৭ সালে। স্থানীয় বাঙালী কাউন্সিলরদের দাবির মুখে, ওল্ডহ্যাম কাউন্সিল জমি ও নগদ অর্থ বরাদ্দের প্রেৰিতে এবং স্থানীয় বাঙালীদের কয়েকটি সংগঠনের সহায়তায় নির্মিত হয় এই শহীদ মিনার। যা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদোলেই তৈরি হয়। এর ঠিক তিন বছর পর ইংল্যান্ডের সর্ববৃহৎ বাঙালী অধু্যষিত এলাকা নর্থ-ওয়েস্টে গড়ে ওঠে আরেকটি শহীদ মিনার। বাঙালীদের উদ্যোগেই গড়ে ওঠে এটি। জাপানের রাজধানী টোকিওর প্রাণকেন্দ্র তোসিমা সিটিতে জাপানের ন্যাশনাল থিয়েটার হলের পাশে ২০০৬ সালে গড়ে ওঠে আরও একটি শহীদ মিনার। জাপান সরকারে বরাদ্দ দেয়া জমিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলেই এটি তৈরি হয় বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে। একই সময়ে একই ডিজাইন নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্র ওমানে তৈরি হয় শহীদ মিনার। এটি তখন নির্মিত হয় সেখানকার তৎকালীন রাষ্ট্রদূত গোলাম আকবর খন্দকারের উদ্যোগে। একুশ একাডেমী অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগে সিডনির বিখ্যাত এ্যাশফিল্ড পার্কে নির্মিত হয় শহীদ মিনার। তবে এটির নামকরণ করা হয়েছে 'মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ।' কারণ দাবি করা হয় এটিই প্রথম আনত্মর্জাতিক স্মৃতিসৌধ। এটি আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নয়, আলাদাভাবে নকশা আহ্বান করে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। কানাডার টরন্টোর মিনার আমাদের শহীদ মিনারের আদলে না হলেও, এই ডিজাইনই অনুসরণ করা হয়েছে নির্মাণে। কলকাতার ধর্মতলায়ও রয়েছে শহীদ মিনার। এ ছাড়া আসামের শিলচরে ভাষা শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার রয়েছে, যা সেখানকার বাংলা ভাষার অধিকার রৰার দাবিতে শহীদ ১১ জনের স্মরণে নির্মিত।
তবে আমাদের এই মহান অর্জনের এই স্মৃতিসৌধের প্রতি আমাদের নেই যথেষ্ট শ্রদ্ধা। যখন তখন জুতা পায়ে উঠে পড়ি এর বেদীতে। চারপাশ অরৰিত থাকায় যত্রতত্র নোংরা, আর্বজনা ও মলমূত্রেরও অসত্মিত্ব লৰ্য করা যায়। বিশিষ্টজনদের বক্তব্য এর মর্যাদা আমাদের সকলের সচেষ্ট হওয়া উচিত। আর সরকারের উচিত শহীদ মিনারে চারপাশের নিরাপত্তা জোরদার করা।
No comments