পবিত্র হজ-শান্তি, শৃঙ্খলা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় হজ by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

আজ পবিত্র হজ। হজ উপলক্ষে পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত হজযাত্রীরা আরাফার ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন। ৮ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা অভিমুখে রওনা হওয়া সুন্নত। কিন্তু মুআলি্লমরা সাধারণত ৭ জিলহজ রাতেই হাজিদের মিনায় পেঁৗছে দেন।


মিনায় ৮ তারিখ জোহরের নামাজের আগেই পেঁৗছতে হয়। মিনায় জোহর, আসর, মাগরিব, এশার নামাজ আদায়ান্তে রাতযাপন শেষে পরদিন ফজরের নামাজ সেখানেই আদায় করা সুন্নত। মিনায় অবস্থান শেষে আজ হাজিরা তালবিয়া তথা_ 'লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নিমাতা লাকা ওয়াল মুল্ক লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক' পড়তে পড়তে আরাফা অভিমুখে রওনা হবেন।
৯ জিলহজ দুপুরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফার ময়দানে অবস্থান করবেন হাজিরা। ইহরামের দুই টুকরো সাদা কাপড় পরিধান করে হাজিরা এখানে সময় কাটাবেন জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল ও কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে। আরাফার দিনটিই মূলত হজের দিন। আর আরাফার ময়দানে অবস্থান করাই হলো হজ। এ দিনের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'আরাফায় অবস্থান করাই হলো হজ।' (সুনানে নাসাঈ)
আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য এমন কিছু দিন বা স্থানকে বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ করেছেন, যাতে বান্দারা নিজেদের গুনাহমুক্ত করতে পারে। এ রকম একটি দিন হলো আরাফার দিন। আর এমনই একটি স্থান হলো আরাফার ময়দান। আরাফার ময়দানে অবস্থান করা হজ পালনকারীদের জন্য অবশ্য পালনীয় বিষয়গুলোর একটি। আরাফার ময়দান ক্ষমা পাওয়ার ময়দান হিসেবেও পরিচিত। এই আরাফার ময়দানে শেষ নবী হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হজ উপলক্ষে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরামদের সম্বোধন করে সমকালীন ও অনাগত মুসলিম উম্মাহর জন্য শেষ ভাষণ প্রদান করেছিলেন; যা বিদায় হজের ভাষণ নামে সমধিক পরিচিত। সেই ভাষণের অনুকরণে আজ দুপুরে খুতবা প্রদান করবেন সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ। প্রদত্ত খুতবায় তিনি মুসলমানদের শরিয়াহ মোতাবেক জীবন যাপনের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম উম্মাহকে এক হয়ে কাজ করার কথা বলবেন।
নিয়মানুসারে হজের খুতবায় মুসলিম উম্মাহর জন্য দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়। এ খুতবা অতীব গুরুত্বপূর্ণও বটে। গত হজে খতিব তার ঘণ্টাব্যাপী খুতবায় বলেছিলেন, বিশ্বব্যাপী আজ যে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ইসলামে সন্ত্রাসবাদের কোনো স্থান নেই। যারা ইসলামের নাম করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায় তাদের এ কাজের সঙ্গে আমাদের এ পবিত্র আদর্শের নূ্যনতম কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে ইসলামের দূরত্ব আসমান-জমিনের দূরত্বের চেয়ে আরও অনেক বেশি। আজকে আফসোস, কিছু বিভ্রান্ত মানুষ ইসলামের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। আমরা সতর্ক থাকব, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, মুসলিম জাতির সতর্ক থাকতে হবে। মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের সতর্ক থাকতে হবে। ইমামদের সতর্ক থাকতে হবে। কেউ যাতে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে ইসলামের নামে তাদের সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারে।
হাজি সাহেবদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা কেউ খুতবা শুনছেন, কেউ আল্লাহর দরবারে দোয়া করছেন, কেউ তাসবিহ-তাহলিল পড়ছেন, কেউ আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করছেন। এই নেক কাজগুলো সবসময়ই করবেন। নিজের জন্য দোয়া করবেন, নিজ পরিবারের জন্য দোয়া করবেন, নিজ দেশের জন্য দোয়া করবেন, মুসলিম উম্মাহর জন্য দোয়া করবেন।
খতিব সাহেব আরও বলেন, মুসলমানরা আজ ঐক্যবদ্ধ নয়। আর এ কারণেই তারা যেখানে-সেখানে মার খাচ্ছে। অথচ কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, 'তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।' দুঃখজনক হলেও সত্য মুসলমান আজ শতধা বিভক্ত। আল্লাহ এবং হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যেটা চাননি; এটা কাঙ্ক্ষিত বিষয় নয়। মুসলমান একটা দেহের মতো। সে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক অন্য প্রান্তে কোনো মুসলমান যদি আক্রান্ত হয়, যদি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তার সে কষ্টটা সে ততটুকুই অনুভব করবে। পৃথিবীর বিপরীত প্রান্ত থেকেও আমাকে ততটুকু ব্যথিত হতে হবে। এটাই ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ।
নেক আমলের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, মুসলমান হওয়ার পর, ইমান আনার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নেক আমল, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তাসবিহ, তাহলিল, কোরআন তেলাওয়াত, দ্বিনের দাওয়াত, ইলম শিক্ষা_ এসব কিছুই হচ্ছে নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত। নেক আমলের গুরুত্ব অপরিসীম। যারা ইমান আনবে তাদের জন্য অপরিহার্য হচ্ছে নেক আমল করা। নেক আমলের মাধ্যমেই মুসলমানের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। নেক আমলশূন্য মুসলমান ফলশূন্য গাছের মতো। তার দিকে কেউ তাকায় না। কারণ, সেখান থেকে কেউ ফল পায় না। খুতবা শেষে বিশ্ব শান্তি কামনা ও মানবকল্যাণে আল্লাহর রহমত চেয়ে মোনাজাত করেন তিনি।
হাজিরা আজই জোহর ও আসরের নামাজ একত্রে আদায় করে সূর্যাস্তের আগেই মুজদালিফার উদ্দেশে আরাফার ময়দান ত্যাগ করবেন। রাতে হাজিরা বালু ও কঙ্করময় মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করবেন এশার ওয়াক্তে। এ ছাড়া কোরআনে কারিম তেলাওয়াতসহ ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে রাত কাটাবেন। এখান থেকে তারা ছোট আকারের পাথর সংগ্রহ করে বৃহস্পতিবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মুজদালিফা থেকে আবার মিনার তাঁবুতে ফিরে গিয়ে অদূরে নির্মিত শয়তানের তিনটি প্রতিকৃতিতে কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। এরপর হাজিরা মক্কায় ফিরে তাওয়াফ, জমজম কূপের পানি পান, সাফা-মারওয়ায় সায়ি করার পর মাথা মুণ্ডন ও কোরবানি করে হজের অত্যাবশ্যকীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করবেন। এরপর যারা মদিনায় যাননি তারা মদিনায় গিয়ে হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) রওজা মোবারক জিয়ারত করবেন।
বস্তুত হজের মাধ্যমে মুসলমানরা তাওহিদি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রে ইসলামী বিধিবিধান মেনে চলার শপথ নেয়। আল্লাহর বাণীর ধারক-বাহক হয়। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজের জানমাল ত্যাগ করার মানসিকতা তৈরি করে, নিজেকে পাপমুক্ত করতে চায়। এবারের হজের মাধ্যমে বিশ্ব মুসলিমের মধ্যে সংঘাত-অশান্তির পরিবর্তে সৌভ্রাতৃত্ব-শৃঙ্খলা এবং ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠিত হোক_ এটাই কামনা করছি।
muftianaet@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.