সাক্ষাৎকার-টেলিযোগাযোগ খাতে আমি লেম্যান by অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এমপি

সাক্ষাৎকার গ্রহণ :সজল জাহিদ সমকাল : এমন সময় টেলিযোগাযোগের দায়িত্ব পেলেন যখন হাতে আর মাত্র এক বছর সময় আছে। আপনার প্রধান পাঁচ অগ্রাধিকার কী? সাহারা খাতুন : প্রধান অগ্রাধিকার টেলিযোগাযোগ খাতে ভিওআইপি নামের যে কলঙ্ক আছে অল্প সময়ের মধ্যেই তা দূর করা।


সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হবো না। তবে এটিও ঠিক যে, মাত্র দায়িত্ব পেয়েছি। এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। প্রতি মুহূর্তে আমাকে শিখতে হচ্ছে। যত দ্রুত সবকিছু শিখে উঠতে পারব তত দ্রুতই এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। তবে এটিও ঠিক যে ইতিমধ্যে ভিওআইপির অবৈধ কলের পরিমাণ অনেকটা কমে এসেছে। ফলে সরকারের আয়ের বিষয়টিও নিশ্চিত হয়েছে।
দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হলো অবহেলিত ডাক বিভাগকে যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের পায়ে দাঁড় করানো। ডাক বিভাগের যে সক্ষমতা ছিল সেটি আবার সবার উপলব্ধির মধ্যে নিয়ে আসতে চাই। দেখাতে চাই যে, ডাক বিভাগও ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কাজের ক্ষেত্রে এখন এই দুটিই আমার অগ্রাধিকার।
সমকাল : সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে আন্তর্জাতিক টেলিফোন কলের অবৈধ টার্মিনেশন নিয়ে। বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিটিআরসি, বিটিসিএলের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত।
সাহারা খাতুন : কারও দিকে এখনই আঙুল দেখিয়ে অভিযুক্ত করতে চাই না। তবে আমি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছি, যাতে কেউ যদি এর সঙ্গে জড়িত থেকেও থাকেন তারা যেন যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের শুধরে নিয়ে অবৈধ ব্যবসা থেকে ফিরে আসেন। আহ্বানে কাজ হয়েছে বলেই মনে হয়। আর প্রমাণসহ অপরাধীকে ধরতে পারলে তার শাস্তি অবধারিত। অহেতুক দোষারোপের খেলায় যেতে চাই না।
সমকাল : ভিওআইপির কারণে সরকারের প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। কীভাবে এর সমাধানে যাবেন? ভিওআইপি বৈধকরণের কাজও কেন বছরের পর বছর ঝুলে আছে?
সাহারা খাতুন : প্রধানমন্ত্রী যখন আমাকে এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন তখনও তার সঙ্গে এটি নিয়ে কথা বলেছি। সব মিলে গত এক মাসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এগুলো নিয়ে কয়েকবার কথা হয়েছে। সরকারের আয়ের সর্বোচ্চ অংশ যাতে নিশ্চিত হয় তার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে আমাকে ব্ল্যাংক চেক দিয়েছেন। আমি যে কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেও তৈরি আছি।
ভিওআইপি উন্মুক্ত করে লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। হাজার দেড়েক আবেদন পড়েছে শুনেছি। যাচাই-বাছাই চলছে।
সমকাল : সরকার বা সরকারি দলের কেউ যদি ভিওআইপির অবৈধ ব্যবসায় জড়িত থেকে থাকে তাহলে কীভাবে ব্যবস্থা নেবেন?
সাহারা খাতুন : টেলিযোগাযোগ খাতে আমি এখনও 'লেম্যান'। জানি না কে কীভাবে এই অবৈধ ব্যবসা থেকে টাকা করছে। তবে আমি যত দ্রুত সম্ভব শিখে ওঠার চেষ্টা করছি। সরকার বা সরকারি দলের কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরাধী যে-ই হোক না কেন তার কোনো ক্ষমা নেই।
সমকাল : হরহামেশাই তো অভিযোগ আসছে, সরকারি প্রভাবশালীরা প্রতিদিন ভিওআইপি থেকে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে। আর সেই টাকার ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে রাতে কোনো ফাইভ স্টার হোটেলে। আবার সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই এই টাকায় ইউরোপ-আমেরিকায় বাড়ি-গাড়ি করেছেন?
সাহারা খাতুন : আবারও বলছি, বিষয়গুলো আমি বুঝে ওঠার চেষ্টা করছি। সব দিক থেকে খবর নিচ্ছি। সরকার বা সরকারি দলের কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরাধী যে-ই হোক না কেন তার কোনো ক্ষমা নেই। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখান থেকে টাকা করে বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি-গাড়ি করার বিষয়ে যে অভিযোগ, সে বিষয়ে খোঁজ-খবর করব। তবে ব্যবস্থা নিতে অভিযোগই যথেষ্ট নয়, এর সত্যতারও প্রয়োজন।
সমকাল : তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন ভিন্ন রূপ নিয়েছে। সংখ্যায়ও বেড়েছে। মোবাইলে ভুয়া নিবন্ধনের সিমও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে?
সাহারা খাতুন : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালেও এ বিষয়ে আমার মনোযোগ ছিল। তখনও আমি বলেছি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ আছে। এ ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন অপারেটরদের নিয়ে বারবার বসেছি। তাদের কথা যেমন শুনেছি, আবার আমাদের বাস্তবতাও তাদের বুঝিয়ে বলেছি। তার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে বলেই আমার মনে হয়েছে। সবকিছু একেবারে শেষ হয়ে গেল_ এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
সমকাল : সাইবার ক্রাইম বিষয়ে কি আলাদা আইন প্রয়োজন আছে?
সাহারা খাতুন : প্রাথমিকভাবে আমার মনে হচ্ছে, হয়তো বাড়তি কোনো আইনের প্রয়োজন হবে না। তবে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দেখা যাক, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বা আমার টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা কী বলেন। এ বিষয়ে সবার সঙ্গে কথা বলব।
সমকাল : বিটিআরসি-মন্ত্রণালয় এবং মোবাইল ফোন অপারেটরদের মধ্যে নানা বিষয়ে অনেক দিন থেকে ত্রিপক্ষীয় রশি টানাটানি চলছে। কীভাবে সমাধানে পেঁৗছাবেন?
সাহারা খাতুন : দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো দ্বন্দ্ব তো আমার চোখে পড়েনি। আর দ্বন্দ্ব যদি কিছু হয়েই থাকে তাহলে কী কারণে তা হচ্ছে সেটিও খুঁজে দেখতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব হলেই বরং ভালো। তাতে ভালো কাজটি বেরিয়ে আসতে পারে। তারপরও দেখতে হবে, প্রকৃত দ্বন্দ্ব যতটা তার চেয়ে বেশি অপপ্রচার চালানো হচ্ছে কি-না। আইনের সামান্য সংশোধনীর কারণে যদি কিছু ক্ষেত্রে বিটিআরসির কিছু কাজে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় সেটি তাদের মেনে নিতে হবে। সরকার তো কাজের সুবিধার জন্যই আইনের পরিবর্তন করেছে; অসুবিধা বাড়ানোর জন্য নয়।
সমকাল : অপারেটররা বলছেন, ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার মতো অবস্থায় চলে এসেছেন তারা। গত দেড় দশকে এতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তারা কখনোই হননি।
সাহারা খাতুন : আমি নিজে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলছি। যদিও প্রথম দিকে শুভেচ্ছা বিনিময়ই বেশি হয়েছে। কিন্তু তারা তো তেমন কোনো সমস্যার কথা বলেননি। তারপরও খুব তাড়াতাড়ি আমি তাদের সমস্যা এবং চাহিদা নিয়েও কথা বলব। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আছে তখন এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। এই সরকার সমস্যা বাড়ায় না; বরং সমস্যা কমায়।
সমকাল : থ্রি জি আনল টেলিটক। বাকিদের ক্ষেত্রে কী করবেন?
সাহারা খাতুন : টেলিটকের থ্রি জি চমক দেখাবে। টেলিটকের লোকেরা আমাকে সেভাবেই জানিয়েছে। আমি নিজেও সবকিছু দেখেছি। টেলিটক পরীক্ষামূলকভাবে চালু করলেও জনগণের মধ্যে কিন্তু বড় ধরনের সাড়া পড়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই বাকিদের জন্যও নিলামের মাধ্যমে থ্রি জি উন্মুক্ত করা হবে। তার আগে নীতিমালাও চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। ভয়ের কোনো কারণ নেই, আওয়ামী লীগ কুক্ষিগত করে রাখে না। বরং সবার মধ্যে সেবা ছড়িয়ে দেয়। '৯৬ সালে একসঙ্গে নতুন তিনটি লাইসেন্স দেওয়াই তার প্রমাণ।
সমকাল : ল্যাপটপ নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। ল্যাপটপ তো সবার হাতে পেঁৗছে দেওয়াও সম্ভব হয়নি। ল্যাপটপ নিয়ে তো অনেক সাড়া পড়েছিল?
সাহারা খাতুন : নিজে গিয়ে ল্যাপটপের কার্যক্রম দেখে এসেছি। যা দেখেছি তাতে আমি সন্তুষ্ট। তবে সবার হাতে অল্প দামে কীভাবে উন্নততর প্রযুক্তি পেঁৗছে দেওয়া যায় সেটি নিয়ে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। আর এ বিষয়ে অন্য যেসব অভিযোগ আছে সেগুলো অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। একই সঙ্গে এ-ও মনে রাখতে হবে যে, কাজ করতে গেলে কিছু অভিযোগ থাকতেই পারে।
সমকাল : আইসিটি ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় একত্রিত হওয়ার কথা বেশ পুরনো। এখন কী অবস্থায় আছে এটি?
সাহারা খাতুন : এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। দেখা যাক প্রধানমন্ত্রী কী সিদ্ধান্ত নেন। এ পর্যায়ে আমার কিছু বলা বোধ হয় ঠিক হবে না।
সমকাল : টেলিযোগাযোগ নীতিমালার বয়স ১৪ বছর পেরিয়েছে। নতুন নীতিমালার খবর কী?
সাহারা খাতুন : নীতিমালা সংশোধনের জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) একাধিক পরামর্শক এসে আমাদের সবগুলো বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের মতামত আমাদের জানিয়েছেন। আমরাও ফিরতি বার্তায় তাদের আরও কিছু বিষয় যুক্ত করার কথা বলেছি। খুব তাড়াতাড়ি আধুনিক একটি নীতিমালা পাওয়া যাবে।
সমকাল : কিন্তু আইটিইউ তো টেলিযোগাযোগ খাতে আমাদের হাজারখানেক লাইসেন্স দেখে অবাক হয়েছে?
সাহারা খাতুন : লাইসেন্সের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে প্রতিযোগিতা বাড়াতে এবং পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এড়াতে। তারপরও কিছু সমস্যা যে হচ্ছে সেটি টের পাওয়া যাচ্ছে।
সমকাল : মোবাইল রিচার্জ ব্যবসায়ীরা কমিশন বাড়াতে আন্দোলন করছেন। গ্রাহক ভোগান্তিও বাড়ছে। আবার তারা যে কোনো সময় যে কোনো অপারেটরকে বসিয়েও দিতে পারেন। সমাধান কী?
সাহারা খাতুন : এই বিষয়টি তো অপারেটরদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হতে পারে। বিটিআরসিও এ নিয়ে কাজ করতে পারে। আমার পর্যায় পর্যন্ত আসার আগেই এর সমাধান হয়ে যাবে।
সমকাল : চার বছর তো হয়ে গেল, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে কতটা অগ্রগতি অর্জন হলো?
সাহারা খাতুন : এখানে উল্টো আমি প্রশ্ন করতে চাই। আপনারাই বলুন পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, নাকি অবনতি হয়েছে? আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
সমকাল : আমাদের মনে হয়েছে, চার বছর আগের তুলনায় আমরা অনেকটা এগিয়েছি। কিন্তু যতটা এগোনোর কথা ছিল, এই সরকার যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে আকাশ সমান সাফল্য পেয়েছে, সেই তুলনায় কাজ কম হয়েছে। উত্তরটা আপনার কাছ থেকে পেতে চাই।
সাহারা খাতুন : আমরা ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছি। আমি তো মনে করি, সঠিক পথেই এগোচ্ছে সবকিছু। মোবাইল ফোনে এখন যত কিছু করা হচ্ছে, ততটা কি আগে কখনও করা গেছে? সামনের দিনে মানুষ থ্রি জির মাধ্যমে আরও চমক দেখবে। আগে কি মানুষ কখনও ভেবেছে যে, মোবাইলেই সব বিল দেবে, ট্রেনের টিকিট কাটবে? আমরা এটিকে বাস্তবতার মধ্যে এনেছি। এখন জীবন্ত ছবি দেখবে আর কথা বলবে। দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল আসছে। সামনে নিজস্ব স্যাটেলাইটও থাকবে মহাকাশে। তখন নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন আর আপনাদের করতে হবে না।
সমকাল : আপনাকে ধন্যবাদ।
সাহারা খাতুন : সমকালের পাঠকদের শুভেচ্ছা।

No comments

Powered by Blogger.