বাণিজ্যিক ব্যাংকের সিএসআর প্রতিবেদন by সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
সিএসআর হলো ইংরেজি তিনটি শব্দের আদি অক্ষর। একে বলা হয় Corporate Social Responsibility বা বাংলায় করপোরেট সামাজিক দায়িত্ব। সুবিধার জন্য আমরা সিএসআর কথাটা ব্যবহার করব। আমরা জানি, গত শতকের শেষের দিকে মুক্তবাজার অর্থনীতি কথাটা ব্যাপকভাবে চালু হয়।
প্রথমেই আমরা লক্ষ করে দেখব, ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত কী পরিমাণ সিএসআর ব্যয় বেড়েছে।
২০০৮ সালে সিএসআর খাতে ব্যয় হয় ৪১০.৭০ মিলিয়ন টাকা। ২০০৯ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৫৩.৮০ মিলিয়ন টাকায়। ২০১০ সালে এই ব্যয় শিখরে ওঠে। সে বছর ২৩২৯.৮০ মিলিয়ন টাকা ব্যয় হয় সিএসআর-এ। ২০১১ সালে কমে আসে ২১৮৮.৩৩ মিলিয়ন টাকায়। এর পেছনে যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। সিএসআর যেসব খাতে অর্থ ব্যয় করে, এর অন্যতম হলো দুর্যোগ এবং মানবিক সাহায্য। আর এটির পরিমাণ নির্ধারিত হয় দুর্যোগের ওপর। অতএব এ খাতে তারতম্য হবে এবং তা অনেক সময় বড় পার্থক্য ঘটাবে। এমনকি অন্যান্য খাতে ব্যয় কমাতেও বাধ্য করতে পারে। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে শিক্ষা, ক্রীড়া এবং পরিবেশে ব্যয় বেড়েছে। এ তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। তাই এই বৃদ্ধি প্রত্যাশিত। তবে খেলাধুলা সম্পর্কে কিছু বক্তব্য আছে। অতীতে দেখেছিলাম, গলফ খেলার জন্য অর্থ ব্যয় হয়েছিল। এ ধরনের জনবিমুখ খেলার জন্য জনগণের অর্থ ব্যয় হতে পারে না। এটি ধনাঢ্য, উচ্চপদস্থ আমলাদের খেলা। তাঁরা নিজেরাই এই ব্যয় বহন করতে পারেন। জনগণের অর্থের অপচয় করা ঠিক নয়।
২০১০ সালের তুলনায় ২০১১ সালে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বেশ কমেছে। এ কাজটি ঠিক হয়নি। আমাদের দেশে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং হাসপাতালের সংখ্যা পর্যাপ্ত না হলেও কম নয়। কিন্তু চিকিৎসার মান মোটেই সন্তোষজনক নয়। ঠিকমতো ওষুধপত্র পাওয়া যায় না। দু-একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কিছুটা ভালো। তাতে আর কয়জনের চিকিৎসা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার চিকিৎসকদের সতর্ক করে দিয়েছেন নিজ নিজ কর্তব্যস্থলে গিয়ে কাজ করতে; কিন্তু তেমন যে একটা ফলপ্রসূ কিছু হয়েছে, তা মনে হয় না। এখন পর্যন্ত নিভৃত অঞ্চল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী আনা নিশ্চিত করা যায়নি। কোলে-কাঁধে করে রোগী আনা হয়। বেসরকারি উদ্যোগে কিছু উন্নতমানের হাসপাতাল-ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে বটে; কিন্তু তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এসব কারণে বলতে চাই যে সিএসআর কার্যক্রমের অধীনে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ানো প্রয়োজন। সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় করা প্রয়োজন, যাতে রোগীরা ন্যায্যমূল্যে ওষুধ এবং অন্যান্য চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে মুক্তিযুদ্ধে কৃষককুলের অবদান অনন্য ও অপরিসীম। তাই তিনি অসম্ভব কৃষকবান্ধব। এখানে আমি একটু আমার অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের কর্মস্থল থেকে সরে গিয়ে এক বিত্তশালীর গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সদরে সেনাবাহিনী আসার খবর পেয়ে সেই রাতে আমার গর্ভবতী স্ত্রীসহ আমাকে বের করে দেওয়া হয়। আমার এক কর্মচারী তার বাড়িতে নিয়ে যায় এবং এরপর এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তাঁর ছনের ঘর। যা হোক, গভর্নর সাহেব কৃষক সম্প্রদায়ের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন। এত দিন ভূমিহীন বর্গাচাষিরা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পেতেন না। ইতিমধ্যে দুই লাখ ৭০ হাজার ৮০২ জন বর্গাচাষির মধ্যে ৩১০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। কৃষি সরঞ্জাম ও ঋণ ঠিকমতো যেন কৃষকের কাছে পৌঁছে, সে জন্য এক কোটি ৮২ লাখ কৃষকের মধ্যে কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। এসব সুবিধা যাতে ভোগ করতে সুবিধা হয় এর জন্য মাথাপিছু মাত্র ১০ টাকার জামানত দিয়ে এক কোটি কৃষকের সঞ্চয় অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পাইলট প্রকল্পের অধীনে বিনা সুদে কিছু ঋণ প্রদান করেছে, এই তহবিলের ব্যয় সিএসআর কার্যক্রমের অধীনে মেটানো হবে। আলোচ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি ব্যাংকও কৃষিঋণ প্রদানে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তবে যে তথ্যের উল্লেখ করা হয়েছে, তা সন্তোষজনক নয়। ২০০৮ সালে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ১৬.৬৩ বিলিয়ন টাকা। ২০১১ সালে এসে এর পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা তো অনেক। এরা এখনো শহরকেন্দ্রিক। শেয়ার ব্যবসায় বেশি আগ্রহ। শেয়ারবাজার যখন চাঙ্গা হয়েছিল, তখন ব্যাংকের কাজ ফেলে শেয়ার ব্যবসা করতেন। যা হোক, আমাদের মনে রাখতে হবে যে যেসব দেশ খাদ্যে উদ্বৃত্ত, তারা বিশ্ব রাজনীতিতে সহজেই নিয়ামকের ভূমিকায় নামতে পারে। খাদ্যে ঘাটতি থাকলে কী অসহায় ভূমিকায় পড়তে হয়, সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম ১৯৭৪ সালে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানির নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এঙ্চেঞ্জ কমিশন (এসইসি) এবং ই-বীমা কম্পানির নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ইনস্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসরণ করা উচিত, যাতে তাদের সংশ্লিষ্ট কম্পানিগুলো সিএসআর কার্যক্রমের ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। বিক্ষিপ্তভাবে যেন কার্যক্রম না চলে।
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প খাত বেশ উন্নত। বিদেশে বিপুল ওষুধ রপ্তানি করে। তারা অত্যন্ত লাভজনকভাবে শিল্প পরিচালনা করছে। ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির ধারা দেখে বুঝতে পারি যে অত্যন্ত সন্তোষজনক মুনাফা অর্জনের ব্যাপারে তারা কোনো আপস করতে রাজি নয়। এই সেক্টর সিএসআর কার্যক্রমের আওতায় মেডিসিন ব্যাংক এবং চিকিৎসা তহবিল গঠন করতে পারে। কিছু জটিল রোগের ওষুধের দাম অত্যধিক এবং ঠিক তেমনই চিকিৎসা ব্যয়। তবে এ ধরনের কিছু করতে হলে এসইসির একটা সক্রিয় ভূমিকা থাকতে হবে।
বাংলাদেশে বীমা কম্পানির সংখ্যা ৬০-এর ওপর। অনেক তহবিল রয়েছে, যা অলস পড়ে আছে। বীমা কম্পানির কেউ কেউ কিছু সিএসআর কার্যক্রম করছে। তবে তেমন উল্লেখ করার মতো নয়। তা ছাড়া তেমন ধারণাও নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে কয়েক দিন সাগর সৈকতে চিত্তবিনোদন করলে সিএসআর কার্যক্রম হয় না। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রতিবেদনে স্বীকার করেছে যে ব্যাংক ছাড়া অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সিএসআর কার্যক্রম সন্তোষজনক নয় এবং তাদের ধারণারও অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের সাহায্যের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে। এটি একটি যথার্থ প্রতিষ্ঠানের উপযুক্ত কর্তব্যবোধ। এসইসি এবং ইনস্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অথরিটিরও সে রকম দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা
No comments