স্মরণ-বুলবুল চৌধুরী : আমাদের নৃত্যগুরু by তামান্না ইসলাম অলি
তাঁর চিন্তা-চেতনা ও মনোভাব প্রকাশের প্রধান হাতিয়ার ছিল নৃত্যকলা। নৃত্যকলাকে অচলাবস্থা থেকে যুগোপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইনিই বুলবুল চৌধুরী। মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই বনে গিয়েছিলেন এ দেশের নৃত্যগুরু। নৃত্য চর্চার চলার পথকে সুগম করেছেন তিনি।
ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে নৃত্যশিল্পের চর্চা, প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন। অবশ্য তিনি শুধু নৃত্যশিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন নাট্যশিল্পী, নাট্য পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং কবি। আজ ১৭ মে, এই প্রতিভাবান মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৫৪ সালের এই দিনে মৃত্যু হয় তাঁর। জন্মেছিলেন ১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারি, বগুড়ায়। জন্ম বগুড়ায় হলেও তাঁর পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার চুনতি গ্রামে। বাবা আজম উল্লাহ ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর। বাবার কর্মসূত্রে তৎকালীন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু পাঁচ বছর বয়সে, গৃহশিক্ষকের কাছে। শুরুতে শেখেন আরবি ও ফারসি। ১৯২৪ সাল থেকে শুরু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা। ১৯৩৪ সালে মানিকগঞ্জ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেন এমএ ডিগ্রি। নাচ, গান, ছবি আঁকা ও গল্প লেখার প্রতি তাঁর প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল ছোটবেলা থেকেই। পড়াশোনার পাশাপাশি নিবিড় সংস্কৃতি চর্চা তাঁকে পেঁৗছে দেয় সাফল্যের শিখরে। কিশোর বয়সে তাঁর নাচ দেখে বিখ্যাত সাহিত্যিক আবুল ফজল মন্তব্য করেছেন, 'নৃত্য দেখা যে কতটা আনন্দের, তা বুলবুলের নাচ না দেখলে বোঝা যাবে না।' আর সংগীত পরিচালক মিহির কিরণের মন্তব্য, 'বুলবুলের মধ্যে আমি আরেকজন উদয় শংকরকে আবিষ্কার করেছি। সে নিজেই নিজের শিক্ষক।' বুলবুল চৌধুরীর নাচের মধ্যে ছিল আবেগ। তাঁর দর্শন ছিল, 'শিল্পের জন্য শিল্পী নয়, শিল্পী মানুষের জন্য। শিল্পকর্ম দেশ ও জাতির। তাই শিল্পীর শৈল্পিক পারদর্শিতা শুধু কারিগরি সীমাবদ্ধতায় থাকাটা অর্থহীন।' তিনি বিশ্বাস করতেন, মানব সভ্যতার উত্তরণে শিল্পীকে সজাগ থাকতে হবে। নৃত্য চর্চার বাইরে 'অজয় কুমার' ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন তিনি। নিজ কাব্যগ্রন্থ 'শেফালিকা' উৎসর্গ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। আসলে বুলবুল চোধুরীও তাঁর পিতৃদত্ত নাম নয়। মা-বাবার দেওয়া নাম ছিল রশীদ আহমদ চৌধুরী। ডাকনাম টুনু। '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বুলবুল চৌধুরী। তাঁর সৃষ্টি সেদিন কথা বলেছিল অন্যায়ের বিপক্ষে। মোটকথা, বুলবুল চৌধুরী এক অন্ধকার রাজনৈতিক আবহে শিল্প চর্চা করতেন, যে সময়কার সমাজব্যবস্থায় শিল্প চর্চা ছিল অনেকটা পাপের মতো। সেই সময় রুখে দাঁড়িয়ে কূপমণ্ডূকতার পাথর ভেঙেছেন। কারণ, তাঁর মন ছিল আলোকিত। তাই আমাদের শিল্পকলা যাঁদের দেখানো পথে হেঁটেছে, বুলবুল চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। তাই আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন।
তামান্না ইসলাম অলি
তামান্না ইসলাম অলি
No comments