কল্পকথার গল্প-অতঃপর 'জয় শ্রীচরণ ভরসা'! by আলী হাবিব

'এই ঢাকা আর সেই ঢাকা নেই'_এ কথা বলে আজকাল ঢাকাবাসী অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। না, ঢাকা যে আর আগের মতো নেই, সেটা মানতেই হচ্ছে। ঢাকার মানচিত্র যেমন বদলে গেছে, তেমনি ভেতরে ভেতরে ঢাকাও অনেকখানি বদলে গেছে। তিলে তিলে তিলোত্তমা হয়ে গড়ে ওঠেনি ঢাকা। তাই বলে চেষ্টার তো অন্ত নেই।

ঢাকাকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা চলছে। ঢাকা বিস্তৃত হয়েছে এবং হচ্ছে। মানুষ বাড়ছে। আজকের ঢাকার সঙ্গে ১০ বছর আগের ঢাকার তুলনা করা চলে না। ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের মানুষের বসবাস। প্রায় সবারই একটা নির্দিষ্ট রুটিন আছে। সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাতে বাড়িতে ফেরা। কারো কর্মক্ষেত্রে যাত্রা, কারো কাজের সন্ধানে ঘর থেকে বের হওয়া। ঘরে ফেরার আগে কোথাও বন্ধুদের সঙ্গে একটু নির্মল আড্ডা, একটু দুঃখ-সুখের গল্প। হাতে পয়সা থাকলে সপ্তাহান্তে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বের হওয়া, কোথাও একটু সময় কাটিয়ে আসা। চীনা রেস্তোরাঁর আলো-আঁধারিতে বসে একটু শখের খাওয়া। আত্মীয় বা বন্ধু কারো বাড়িতে যাওয়া। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় আজকাল ঘরের বাইরে বের হওয়াটাই একটা বড় ধরনের বিড়ম্বনা। কোথাও নির্দিষ্ট সময়ে যাওয়ার কথা এখন কল্পনা করা যায় না। আগে যে পথ যেতে মিনিট তিরিশেক লাগত, সেই পথ পাড়ি দিতে এখন ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। ৩০ মিনিটের পথ এক ঘণ্টায় যাওয়া যাবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। এই অনিচ্ছাকৃত বিলম্বের প্রধান কারণ জ্যাম। ঢাকার রাস্তার পরিচিত এক দৃশ্য জ্যাম। ট্রাফিক জ্যাম নেই, এমন একটি রাস্তা ঢাকা শহরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঘর থেকে বের হয়ে দুই পা বাড়িয়ে কোথাও যাওয়া হয় না। জ্যাম। নাগরিক জীবনে 'জ্যাম' শব্দটি বেশ ভালোভাবেই জুড়ে গেছে। কোথাও যেতে দেরি হচ্ছে? সেলফোন থেকে জানিয়ে দিলেই হলো_জ্যামে আছি। নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে যাওয়া সম্ভব নয়। কেন? রাস্তাজুড়ে জ্যাম ছিল। মার্কেটে যেতে জ্যাম, বাজারে যেতে জ্যাম, স্কুলে যেতে জ্যাম। জ্যাম এখন নাগরিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ। জ্যাম থেকে মুক্তি নেই। রাস্তার সংখ্যা তেমন না বাড়লেও গাড়ি বেড়েছে রাজধানীতে।
প্রথমে একটি বাড়ি, এরপর গাড়ির শখ। রাজধানীর রাস্তাজুড়ে সারি সারি চলছে গাড়ি। এই জ্যাম থেকে মুক্তির একটি সহজ উপায় খুঁজে বের করেছে সরকার। গাড়িতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এমন গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর অন্যতম যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, গ্যাসের দাম বাড়লে রাস্তায় গাড়ির চাপ কমবে। সরেস যুক্তি! এখন থেকে যেকোনো কিছুর ওপর থেকে চাপ কমাতে হলে দাম বাড়ানোটাই মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে তাহলে ব্যবহার করা যাবে। উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, দেশের মানুষ বেশি বেশি ভাত খাচ্ছে। চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া যাক, চালের ওপর থেকে চাপ কমবে। বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ছে, দাম বাড়িয়ে দেওয়া যাক। পানির ব্যবহার বাড়ছে, দাম বাড়িয়ে দেওয়া যাক। যেমন, রাস্তায় গাড়ির চাপ কমাতে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গ্যাসের দাম। কিন্তু সবাইকে বোকা ভাবাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ঘোড়া কেনার আগে সবাইকে যেমন চাবুক সংগ্রহের কথাটি মাথায় রাখতে হয়, তেমনি গাড়ি কেনার আগে খরচের বিষয়টিও নিশ্চয়ই গাড়িওয়ালাদের মাথায় থাকে। কাজেই গ্যাসের দাম শতভাগ বাড়িয়ে দিলেও তা গাড়িওয়ালাদের জন্য বোঝার ওপর শাকের আঁটি কিংবা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো অবস্থা হবে না।
সমস্যা সেসব মানুষের, যাঁরা গণপরিবহনে চলাফেরা করেন। আগেই বলে রাখা ভালো, গণপরিবহনে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে যাত্রীরা শুধুই যাত্রী। তাঁদের সুযোগ-সুবিধা, তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্য_এগুলো দেখার দায়িত্ব যে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের, এটা তাঁদের কর্মকাণ্ডে কখনো সম্যক উপলব্ধি করা যায়নি। তাঁরা তাঁদের মতো করেই বাসের ভাড়া বাড়িয়েছেন। সেই বাড়ানোটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে কি না, ভাড়া বৃদ্ধির চাপ সাধারণ যাত্রীরা কতটা সহ্য করতে পারবে, সেটা ভাবার সময়ও তাঁদের নেই। এবার সিএনজির দাম বাড়ানোর পরপরই বাস ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছা হলে যাবেন, নইলে নিজেদের পথ নিজেই দেখতে পারেন। যাঁরা নিজেদের গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন, তাঁরা তো আর পাবলিক বাসের জন্য অপেক্ষা করেন না। পাবলিক বাস পাবলিকের জন্য। পাবলিককে গুঁতিয়ে দেওয়ার জন্য বাসের মালিকরাই যথেষ্ট। বাসের ভাড়া কতটা বাড়বে, কখন বাড়বে_সবকিছু তাঁরা নির্ধারণ করেন। এখানে পাবলিকের কাজ হচ্ছে বাস মালিকদের নির্ধারণ করে দেওয়া ভাড়া মেনে নিয়ে অসহায় যাত্রীদের বাসে উঠতে হয়। রাজপথে বাস মালিকরাই সরকার। তাঁদের ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই কারো। এই যে সিএনজির দাম বাড়ানোর পর বাস ভাড়া বেড়ে গেল, এখানে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করেননি তাঁরা। বাস মালিকরা জানেন, রাস্তায় গোলমাল হবে। হোক। কিন্তু পয়সা তো আসবে।
বিকল্প কী আছে? ধরা যাক সাধারণ একজন মানুষের কথা, যাঁকে রোজ বাইরে বের হতে হয়। তিনি এই বাসের ভাড়া দিতে পারছেন না। গুনতে পারছেন না তিন চাকার অটোরিকশার ভাড়া। আর ট্যাঙ্কি্যাব? ওটার কথা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না তিনি। তাঁর জন্য তো একটা বিকল্প বাহন দরকার। এই শহরের গণপরিবহনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে তো আর এমনটি ছিল না। আগে মানুষের এত গাড়িও ছিল না। ছিল না গাড়ি কেনার মতো ট্যাঁকের জোর। আগের মানুষ কেমন করে চলাফেরা করত? আগে ছিল ঘোড়া এবং ঘোড়ার গাড়ি। এখন ঘোড়া কিংবা ঘোড়ার গাড়ির কথা চিন্তা করা যায় না। ঢাকার দু-একটি রুটে ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম চলে। তাতে শখের বশে এক-দুদিন চড়া যায়। কিন্তু আজকের এই খুপরি ঘরের আধুনিক বাড়িতে তো আর ঘোড়া পোষা যায় না। ঘোড়া দেখলে খোঁড়া হওয়ার কথা যতই বলি না কেন, ঘোড়া পোষার ঝক্কি সামলানো আজকের দিনে একেবারেই ভাবা যায় না। আর এই জ্যামের শহরে ঘাম ঝরিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে দ্রুত কোথাও যাওয়া যাবে না। তাহলে ঘোড়ার গাড়ি বাদ। তো, রিকশায় চলা যাক। এই এক আজব যান। মধ্যবিত্তের একান্ত নিজস্ব বাহন। রাস্তায় বেরিয়ে নিজেদের বাহাদুরি দেখানোর সহজ হাঁক_'অ্যাই রিকশা'। কিন্তু সেই রিকশাও এখন সর্বত্রগামী নয়। না, শহরের সব রাস্তায় রিকশা চলে না। মূল সড়ক থেকে তুলে দেওয়া হচ্ছে রিকশা। রাস্তা কমতে কমতে রিকশা সেঁধিয়ে গেছে মহল্লার ভেতর। যে জ্যাম কমাতে সিএনজির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হলো, সেই জ্যামের প্রথম অপবাদ সইতে হয়েছিল রিকশাকে। রিকশা চলাচল বন্ধ করে সড়ককে ভিআইপি করা হয়েছিল। কাজেই রিকশাও বিকল্প হতে পারছে না। তাহলে উপায়?
উপায় একটা আছে। সেই উপায় একেবারেই নিজের কাছে। ওই যে নজরুল বলেছেন, 'থাকিতে চরণ মরণে কী ভয় নিমেষে যোজন ফরসা/মরণ-হরণ, নিখিল শরণ জয় শ্রীচরণ ভরসা।' শ্রীচরণ ভরসা করলে তো আর কোনো সমস্যাই থাকে না। বাসে ওঠার ঝামেলা নেই, টিকিটের ঝামেলা নেই, জ্যাম আটকে থাকা নেই, অতিরিক্ত ভাড়া নেই, ড্রাইভার-কন্ডাক্টরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি নেই। বাস কোথায় থামছে, অতিরিক্ত যাত্রী তুলছে, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। নিজের পায়ে নিজের মতো চলা। পাবলিক বাসে ওঠা মানেই তো নিজের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়া। শ্রীচরণ ভরসা করলে সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ থাকবে না কারো। অতএব নিজের পায়ে চলাই ভালো। স্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি পকেটের পয়সাও কিছু সাশ্রয় হবে। কাজেই এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কী হতে পারে? চরণ শরণ করে সেটাতেই ভরসা রাখার চেয়ে ভালো বিকল্প আপাতত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অতএব আসুন, সবাই চরণ শরণ করি। ভরসা রাখি চরণে। চরণের জয় হোক।

লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.