বিশেষ সাক্ষাৎকার-শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ জাতির জন্য অশনিসংকেত by রাশেদা কে চৌধুরী
রাশেদা কে চৌধুরী ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি বেসরকারি উন্নয়ন খাতের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।
নব্বইয়ের দশকে তিনি বাংলাদেশের এনজিওসমূহের শীর্ষ সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন অব ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিজ ইন বাংলাদেশ বা এডাবের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেন। পৃথিবীর শতাধিক দেশের বেসরকারি সংস্থা ও শিক্ষক সমিতির নেটওয়ার্ক গ্লোবাল ক্যাম্পেইন ফর এডুকেশনের (জিসিই) তিনি প্রতিষ্ঠাতা বোর্ড-সদস্য। তিনি এডুকেশন ওয়াচের সদস্য-সচিব ও সমন্বয়ক। ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মহিলা ও শিশু এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষাবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের তিনি নির্বাহী পরিচালক।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার অনেক বেড়েছে, প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়ে এখন ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু পড়াশোনার মাঝখানে ঝরে পড়ার প্রবণতাও বেশ লক্ষণীয়। কেন শিশুদের ঝরে পড়া বন্ধ হচ্ছে না?
রাশেদা কে চৌধুরী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলাদেশের দুটো বড় অর্জন আছে। একটি হচ্ছে, অনেক বেশিসংখ্যক শিশুকে আমরা এই শিক্ষার পরিধির মধ্যে আনতে পেরেছি, তারা স্কুলে আসছে। অন্যটি হচ্ছে, যারা বিদ্যালয়ে আসছে তাদের মধ্যে ছেলেমেয়ে সমতা অর্জিত হয়েছে। এটি একটি বড় অর্জন; দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কার পরই বাংলাদেশ এই সাফল্য অর্জন করেছে। ভারত করেছে বাংলাদেশের পরে। একই সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। যেমন—এই বছর সরকারের একটা লক্ষ্য ছিল, প্রতিবন্ধী ব্যতীত শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা। প্রতিবন্ধী বাদ থাকবে কেন? বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশুদের অন্তত শতকরা ১০ ভাগ প্রতিবন্ধী। এটি একটি বিরাট সংখ্যা, এদের বাদ নিয়ে আমরা নিশ্চয়ই চিন্তা করব না। তাদের নিয়েই আমরা শতভাগ বলব। কাজেই এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঝরে পড়া। এটা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারি হিসাবেই ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ, কোথাও কোথাও ৪০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষাচক্র শেষ করার আগেই বিদ্যালয় থেকে ঝরে যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় কিন্তু লাখ লাখ শিশু।
প্রথম আলো কারণগুলো কী? করণীয় কী?
রাশেদা কে চৌধুরী সরকারকে আমরা সাধুবাদ জানাই যে তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, পরিকল্পনার মধ্যে নিয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঝরে পড়ার কারণগুলো চিহ্নিত করারও উদ্যোগ চলছে। আমরা মাঠপর্যায়ে যে গবেষণা করেছি তাতে দেখা যায়, যারা ঝরে পড়ছে তাদের প্রথমেই রয়েছে একদম হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুরা। তারা বিদ্যালয়ে এলেও তাদের মা-বাবার দারিদ্র্য, বাস্তুচ্যুতি, জীবন-জীবিকার কারণে বিদ্যালয়ে টেকে না। দ্বিতীয় হচ্ছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের মাতৃভাষা আছে; বিদ্যালয়ে এসে যখন দেখে, শিক্ষক অন্য ভাষায় কথা বলেন, তারা একটু ভীত-শঙ্কিত হয়, পরে আর স্কুলে আসে না। ক্ষুধার্ত শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে যায়। তৃতীয় ঝরে পড়া অংশটি হচ্ছে প্রতিবন্ধী। তাদের জন্য বিদ্যালয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই, শিক্ষকেরাও এখন পর্যন্ত সেভাবে তৈরি নন। ফলে এই শিশুরা ঝরে যায়। চর, হাওর, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের মধ্যে ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি। অর্থাৎ ঝরে পড়ার কারণগুলো মোটামুটি চিহ্নিত হয়েছে। এর প্রতিকারে কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়াও হচ্ছে। যেমন—বইপত্র বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। যেসব এলাকায় খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে, সেখানে বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করেছি। কিছু এলাকায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রথম আলো পরীক্ষায় পাসের হার এবং ভালো ফলের হার দুটোই বাড়ছে। একইভাবে কি শিক্ষার মানও বাড়ছে?
রাশেদা কে চৌধুরী শিশুরা ভালো করছে, একদম গ্রামপর্যায়ের শিশুদের মধ্যেও এটা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক শিশু অকৃতকার্য হচ্ছে। এবারও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় দেড় লাখের মতো শিশু অকৃতকার্য হয়েছে। এখানেই শিক্ষার ও শিক্ষাদানের মানের প্রশ্নটা এসে যায়। অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার পরেও একই বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। এই শিশুদের অধিকাংশই আর পরীক্ষা দেয় না, তারা ঝরে যায়। শিক্ষার মানের প্রসঙ্গে বলতে গেলে শিক্ষার অবাধ বাণিজ্যিকীকরণের বিষয়টিও সামনে আসে। যারা যত বিনিয়োগ করতে পারছেম তাদের সন্তানেরা তত ভালো লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু যে পরিবারটা পারছে না, তাদের সন্তান মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান এখন প্রশ্নবিদ্ধ; এটা নিয়ে সরকার, আমরা সবাই চিন্তিত।
প্রথম আলো এই প্রশ্নটিই গুরুত্বপূর্ণ: শিক্ষার মান কেন প্রশ্নবিদ্ধ?
রাশেদা কে চৌধুরী আমাদের গবেষণায় মোটা দাগে যা দেখা যায়, শ্রেণীকক্ষের পরিবেশ শিক্ষার্থীবান্ধব নয়, সেখানে ঘাটতি আছে এবং পাঠদানের পদ্ধতি শিক্ষার্থীর সৃজনশীল বিকাশের জন্য যথেষ্ট সহায়ক নয়: এখনো শিক্ষার্থীরা মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল, শিক্ষকেরা এখনো সেভাবেই পড়ান। অবশ্য সে জন্য শিক্ষকদের ঢালাওভাবে দায়ী করে লাভ নেই। এ ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা আছে।
প্রথম আলো সমস্যাগুলো সম্পর্কে একটু বলুন, কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকাটাই শিক্ষকদের।
রাশেদা কে চৌধুরী শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা এমন যে কেউ নিজে থেকে আগ্রহী হয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসেন না। আমাদের দেশে শিক্ষকেরা যে বেতন-ভাতা পান, আর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষকেরা যে বেতন-ভাতা পান, তার পার্থক্য অনেক। এই বেতন-ভাতায় শিক্ষকদের পক্ষে পরিবার-পরিজন নিয়ে সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করা সম্ভব হয় না। তাঁরা অন্যদিকে ঝোঁকেন, তাঁরা কোচিং, প্রাইভেট টিউশনিতে নামেন। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষের ভেতরে মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না। বিদ্যালয়ের বাইরে অর্থ দিয়ে শিক্ষকের সহায়তা কিনতে কতজন পারেন? বিদ্যালয়ের বাইরে বাড়তি পারিবারিক বিনিয়োগের কারণে, অথবা ইংলিশ মিডিয়াম ইত্যাদি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সামর্থ্য রয়েছে এমন পরিবারের সন্তানেরাই একসময় বাংলাদেশের প্রশাসনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেবে। এটা নিয়েই আমাদের আশঙ্কা: বিরাট এক বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। যে শিক্ষাকে আমরা বৈষম্য দূরীকরণের হাতিয়ার মনে করতাম, সেই শিক্ষাই এখন বৈষম্য তৈরির বিরাট হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এটাকে আমি বলব জাতির জন্য একটা অশনিসংকেত। এই জায়গাটাতে হাত না দিলে আমাদের বিপদ আছে।
প্রথম আলো শিক্ষকদের বেতন-ভাতার স্বল্পতাই কি একমাত্র সমস্যা? তাঁদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষাদানে দক্ষতা বৃদ্ধি, বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা—এসব ক্ষেত্রের চিত্র কী?
রাশেদা কে চৌধুরী আমরা গবেষণায় দেখেছি, মূলধারার শিক্ষকদের শতকরা ৯০ ভাগেরই প্রশিক্ষণ রয়েছে। কিন্তু তাঁরা সেই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান শ্রেণীকক্ষের ভেতরে পর্যাপ্তভাবে চর্চা করেন না। তাঁরা নানা কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তা ছাড়া শিক্ষকদের দিয়ে শিশু জরিপ থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যন্ত নানা কাজ করানো হয়। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদানেই শিক্ষকেরা ব্যস্ত থাকবেন। সেই দায়িত্ব যেন তাঁরা ভালোভাবে পালন করতে পারেন, সে জন্য যা যা করা দরকার, তা-ই করতে হবে। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নির্ধারণের জন্য পৃথক বেতন কমিশন করা হবে। মেধাবী মানুষদের শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সে জন্য বেতন-ভাতা বাড়ানো, তাঁদের দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জন করার জন্য উন্নত-আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে যা যা করা দরকার, সরকারকে তা করতেই হবে। বিদ্যালয়ের অবকাঠামোর কথা বলা হয়, পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব আছে, এটা সত্য। কিন্তু শুধু অবকাঠামো থাকাই যথেষ্ট নয়। বিদ্যালয়ের বিশাল ভবন হলো, কম্পিউটার থেকে শুরু করে অনেক কিছু দেওয়া হলো, শিক্ষক মানসম্মত না হলে মূল লক্ষ্যই পূরণ হবে না। মানসম্মত শিক্ষক কীভাবে পাওয়া যাবে? এই জায়গাতেই আমাদের বড় ঘাটতি রয়ে গেছে।
প্রথম আলো শিক্ষকের বেতন-ভাতা বাড়ানো থেকে শুরু করে উন্নত প্রশিক্ষণ ইত্যাদির জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। দরিদ্র দেশের পক্ষে সে অর্থের জোগান দেওয়া কতটা সম্ভব?
রাশেদা কে চৌধুরী গরিব দেশ মানি। কিন্তু জাতির উন্নয়ন ঘটাতে হলে প্রথমে কী কাজে হাত দেওয়া উচিত, সেই অগ্রাধিকারগুলো আগে চিহ্নিত করা দরকার। আমাদের সামনে অনেক উদাহরণ আছে। যেসব জাতি এগিয়ে গেছে, তারা শিক্ষাকে কত গুরুত্ব দিয়েছে, সেদিকে লক্ষ করা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশ জাপান যুদ্ধের পরই শিক্ষার জন্য জাতীয় বাজেটের ৪৭ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দেয়। আর আমরা বাজেটের ১৪ শতাংশেও যেতে পারছি না, ১৩ শতাংশেই ঠেকে আছি। এ বছর কিন্তু শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ কমে গেছে। আগে ছিল জিডিপির ২ দশমিক ২৭ শতাংশ, এবার হয়েছে ২ দশমিক ১২ শতাংশ। শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগই যদি আমরা হ্রাস করে ফেলি, তাহলে তো অন্যান্য খাতের বিনিয়োগের ফসল ঘরে তুলতে পারব না। এই যে এখন জনসংখ্যা নিয়ে কথা হচ্ছে, আমি তো মনে করি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। প্রতিরক্ষা খাতে আমরা বরাদ্দ বাড়ালাম, কিন্তু শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ালাম না। তাহলে আমাদের অগ্রাধিকারটা কোথায়, সে প্রশ্নটা তো এসে যায়। যে জাতি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষার পেছনে পেছনে বেশি বিনিয়োগ করেছে, তারাই উন্নতি করেছে। আফ্রিকার দরিদ্র দেশ কেনিয়া আজ বাজেটের ৪০ শতাংশ বরাদ্দ করছে শিক্ষার পেছনে। কেনিয়া পারছে, আমরা পারছি না কেন? জিডিপির শতকরা অংশ হিসেবে শিক্ষার পেছনে আমাদের বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। এমনকি নেপালও আমাদের চেয়ে বেশি করছে। ভারত তো ৫ শতাংশের কাছাকাছি চলে গেছে। মালদ্বীপ তো জিডিপির ৭ শতাংশের বেশি খরচ করছে শিক্ষার পেছনে। শ্রীলঙ্কাও ৭ শতাংশের কাছাকাছি। আর আমরা ২ দশমিক ৩ শতাংশের কাছাকাছিও উঠতে পারিনি। আমাদের অগ্রাধিকারগুলো কী, সেটা তো আগে ঠিক করতে হবে।
প্রথম আলো শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয়করণের প্রভাব লক্ষ করা যায়; শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নয়; প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়েও। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার ক্ষেত্রেও দলীয়করণের সমস্যা আছে।
রাশেদা কে চৌধুরী শিক্ষক-সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের মঙ্গলচিন্তা, শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের চিন্তা ইত্যাদির প্রতি তাঁদের মনোযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার জন্য দলীয় আনুগত্য তাঁদের পেশাগত জীবনে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলেছে। এটি জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ জন্য শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করলেই চলবে না, শিক্ষকদের দায়ও কম নয়। কারণ তাঁরা দলীয়ভাবে জড়িত হচ্ছেন, পেশার প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার কতটা আন্তরিক থাকছে, সেটা বিবেচনা করার ভার তাঁদেরই। রাজনীতিতে তাঁরা যুক্ত হতেই পারেন, কারণ মানুষ তো রাজনৈতিক জীব। কিন্তু সেই জড়িত হওয়া যেন শিক্ষকের যে মূল দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব পালনে, শিক্ষার উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত না করে।
প্রথম আলো শিক্ষাঙ্গনের ভেতরে মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে; সম্প্রতি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঘটনায় সমাজে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
রাশেদা কে চৌধুরী আগে সমস্যা ছিল মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে নিরাপত্তার অভাব; রাস্তায় মাস্তান, উত্ত্যক্তকারী। কিন্তু কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, দেখছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেও মেয়েরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। ভিকারুননিসার এ ঘটনা তো ভীষণ ন্যক্কারজনক; কিন্তু এর আগেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি বিচলিত হওয়ার বিষয় হচ্ছে শিক্ষকের দ্বারা নারী শিক্ষার্থীর নির্যাতন, অপমান, সম্ভ্রমহানি। নৈতিকতার এই অবক্ষয়ের কত যে নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তা ভেবে বিচলিত হতে হয়। এসব বন্ধ করার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে, সে ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক থাকা প্রয়োজন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মধ্যে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানের দায়িত্বও এ ক্ষেত্রে বিরাট; তাঁকে সব সময় নজর রাখতে হবে, তাঁর প্রতিষ্ঠানে এ রকম আলামত দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাপ্রশাসনের তদারকি বাড়াতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানদের এই বিষয়ে দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দিয়ে নিয়মিত তদারক করতে হবে। যেকোনো মূল্যেই হোক, এসব বন্ধ করতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রাশেদা কে চৌধুরী ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম
প্রথম আলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার অনেক বেড়েছে, প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়ে এখন ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু পড়াশোনার মাঝখানে ঝরে পড়ার প্রবণতাও বেশ লক্ষণীয়। কেন শিশুদের ঝরে পড়া বন্ধ হচ্ছে না?
রাশেদা কে চৌধুরী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলাদেশের দুটো বড় অর্জন আছে। একটি হচ্ছে, অনেক বেশিসংখ্যক শিশুকে আমরা এই শিক্ষার পরিধির মধ্যে আনতে পেরেছি, তারা স্কুলে আসছে। অন্যটি হচ্ছে, যারা বিদ্যালয়ে আসছে তাদের মধ্যে ছেলেমেয়ে সমতা অর্জিত হয়েছে। এটি একটি বড় অর্জন; দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কার পরই বাংলাদেশ এই সাফল্য অর্জন করেছে। ভারত করেছে বাংলাদেশের পরে। একই সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছি। যেমন—এই বছর সরকারের একটা লক্ষ্য ছিল, প্রতিবন্ধী ব্যতীত শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা। প্রতিবন্ধী বাদ থাকবে কেন? বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শিশুদের অন্তত শতকরা ১০ ভাগ প্রতিবন্ধী। এটি একটি বিরাট সংখ্যা, এদের বাদ নিয়ে আমরা নিশ্চয়ই চিন্তা করব না। তাদের নিয়েই আমরা শতভাগ বলব। কাজেই এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঝরে পড়া। এটা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারি হিসাবেই ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ, কোথাও কোথাও ৪০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষাচক্র শেষ করার আগেই বিদ্যালয় থেকে ঝরে যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় কিন্তু লাখ লাখ শিশু।
প্রথম আলো কারণগুলো কী? করণীয় কী?
রাশেদা কে চৌধুরী সরকারকে আমরা সাধুবাদ জানাই যে তারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, পরিকল্পনার মধ্যে নিয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঝরে পড়ার কারণগুলো চিহ্নিত করারও উদ্যোগ চলছে। আমরা মাঠপর্যায়ে যে গবেষণা করেছি তাতে দেখা যায়, যারা ঝরে পড়ছে তাদের প্রথমেই রয়েছে একদম হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিশুরা। তারা বিদ্যালয়ে এলেও তাদের মা-বাবার দারিদ্র্য, বাস্তুচ্যুতি, জীবন-জীবিকার কারণে বিদ্যালয়ে টেকে না। দ্বিতীয় হচ্ছে আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের মাতৃভাষা আছে; বিদ্যালয়ে এসে যখন দেখে, শিক্ষক অন্য ভাষায় কথা বলেন, তারা একটু ভীত-শঙ্কিত হয়, পরে আর স্কুলে আসে না। ক্ষুধার্ত শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে যায়। তৃতীয় ঝরে পড়া অংশটি হচ্ছে প্রতিবন্ধী। তাদের জন্য বিদ্যালয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই, শিক্ষকেরাও এখন পর্যন্ত সেভাবে তৈরি নন। ফলে এই শিশুরা ঝরে যায়। চর, হাওর, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের মধ্যে ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি। অর্থাৎ ঝরে পড়ার কারণগুলো মোটামুটি চিহ্নিত হয়েছে। এর প্রতিকারে কিছু কিছু উদ্যোগ নেওয়াও হচ্ছে। যেমন—বইপত্র বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। যেসব এলাকায় খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে, সেখানে বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করেছি। কিছু এলাকায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রথম আলো পরীক্ষায় পাসের হার এবং ভালো ফলের হার দুটোই বাড়ছে। একইভাবে কি শিক্ষার মানও বাড়ছে?
রাশেদা কে চৌধুরী শিশুরা ভালো করছে, একদম গ্রামপর্যায়ের শিশুদের মধ্যেও এটা লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক শিশু অকৃতকার্য হচ্ছে। এবারও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় দেড় লাখের মতো শিশু অকৃতকার্য হয়েছে। এখানেই শিক্ষার ও শিক্ষাদানের মানের প্রশ্নটা এসে যায়। অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার পরেও একই বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। এই শিশুদের অধিকাংশই আর পরীক্ষা দেয় না, তারা ঝরে যায়। শিক্ষার মানের প্রসঙ্গে বলতে গেলে শিক্ষার অবাধ বাণিজ্যিকীকরণের বিষয়টিও সামনে আসে। যারা যত বিনিয়োগ করতে পারছেম তাদের সন্তানেরা তত ভালো লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু যে পরিবারটা পারছে না, তাদের সন্তান মানসম্পন্ন শিক্ষা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান এখন প্রশ্নবিদ্ধ; এটা নিয়ে সরকার, আমরা সবাই চিন্তিত।
প্রথম আলো এই প্রশ্নটিই গুরুত্বপূর্ণ: শিক্ষার মান কেন প্রশ্নবিদ্ধ?
রাশেদা কে চৌধুরী আমাদের গবেষণায় মোটা দাগে যা দেখা যায়, শ্রেণীকক্ষের পরিবেশ শিক্ষার্থীবান্ধব নয়, সেখানে ঘাটতি আছে এবং পাঠদানের পদ্ধতি শিক্ষার্থীর সৃজনশীল বিকাশের জন্য যথেষ্ট সহায়ক নয়: এখনো শিক্ষার্থীরা মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল, শিক্ষকেরা এখনো সেভাবেই পড়ান। অবশ্য সে জন্য শিক্ষকদের ঢালাওভাবে দায়ী করে লাভ নেই। এ ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা আছে।
প্রথম আলো সমস্যাগুলো সম্পর্কে একটু বলুন, কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকাটাই শিক্ষকদের।
রাশেদা কে চৌধুরী শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা এমন যে কেউ নিজে থেকে আগ্রহী হয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসেন না। আমাদের দেশে শিক্ষকেরা যে বেতন-ভাতা পান, আর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষকেরা যে বেতন-ভাতা পান, তার পার্থক্য অনেক। এই বেতন-ভাতায় শিক্ষকদের পক্ষে পরিবার-পরিজন নিয়ে সম্মানের সঙ্গে জীবন যাপন করা সম্ভব হয় না। তাঁরা অন্যদিকে ঝোঁকেন, তাঁরা কোচিং, প্রাইভেট টিউশনিতে নামেন। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষের ভেতরে মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না। বিদ্যালয়ের বাইরে অর্থ দিয়ে শিক্ষকের সহায়তা কিনতে কতজন পারেন? বিদ্যালয়ের বাইরে বাড়তি পারিবারিক বিনিয়োগের কারণে, অথবা ইংলিশ মিডিয়াম ইত্যাদি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সামর্থ্য রয়েছে এমন পরিবারের সন্তানেরাই একসময় বাংলাদেশের প্রশাসনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেবে। এটা নিয়েই আমাদের আশঙ্কা: বিরাট এক বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। যে শিক্ষাকে আমরা বৈষম্য দূরীকরণের হাতিয়ার মনে করতাম, সেই শিক্ষাই এখন বৈষম্য তৈরির বিরাট হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এটাকে আমি বলব জাতির জন্য একটা অশনিসংকেত। এই জায়গাটাতে হাত না দিলে আমাদের বিপদ আছে।
প্রথম আলো শিক্ষকদের বেতন-ভাতার স্বল্পতাই কি একমাত্র সমস্যা? তাঁদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষাদানে দক্ষতা বৃদ্ধি, বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা—এসব ক্ষেত্রের চিত্র কী?
রাশেদা কে চৌধুরী আমরা গবেষণায় দেখেছি, মূলধারার শিক্ষকদের শতকরা ৯০ ভাগেরই প্রশিক্ষণ রয়েছে। কিন্তু তাঁরা সেই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান শ্রেণীকক্ষের ভেতরে পর্যাপ্তভাবে চর্চা করেন না। তাঁরা নানা কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তা ছাড়া শিক্ষকদের দিয়ে শিশু জরিপ থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যন্ত নানা কাজ করানো হয়। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদানেই শিক্ষকেরা ব্যস্ত থাকবেন। সেই দায়িত্ব যেন তাঁরা ভালোভাবে পালন করতে পারেন, সে জন্য যা যা করা দরকার, তা-ই করতে হবে। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নির্ধারণের জন্য পৃথক বেতন কমিশন করা হবে। মেধাবী মানুষদের শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সে জন্য বেতন-ভাতা বাড়ানো, তাঁদের দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জন করার জন্য উন্নত-আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে যা যা করা দরকার, সরকারকে তা করতেই হবে। বিদ্যালয়ের অবকাঠামোর কথা বলা হয়, পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব আছে, এটা সত্য। কিন্তু শুধু অবকাঠামো থাকাই যথেষ্ট নয়। বিদ্যালয়ের বিশাল ভবন হলো, কম্পিউটার থেকে শুরু করে অনেক কিছু দেওয়া হলো, শিক্ষক মানসম্মত না হলে মূল লক্ষ্যই পূরণ হবে না। মানসম্মত শিক্ষক কীভাবে পাওয়া যাবে? এই জায়গাতেই আমাদের বড় ঘাটতি রয়ে গেছে।
প্রথম আলো শিক্ষকের বেতন-ভাতা বাড়ানো থেকে শুরু করে উন্নত প্রশিক্ষণ ইত্যাদির জন্য প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। দরিদ্র দেশের পক্ষে সে অর্থের জোগান দেওয়া কতটা সম্ভব?
রাশেদা কে চৌধুরী গরিব দেশ মানি। কিন্তু জাতির উন্নয়ন ঘটাতে হলে প্রথমে কী কাজে হাত দেওয়া উচিত, সেই অগ্রাধিকারগুলো আগে চিহ্নিত করা দরকার। আমাদের সামনে অনেক উদাহরণ আছে। যেসব জাতি এগিয়ে গেছে, তারা শিক্ষাকে কত গুরুত্ব দিয়েছে, সেদিকে লক্ষ করা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশ জাপান যুদ্ধের পরই শিক্ষার জন্য জাতীয় বাজেটের ৪৭ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দেয়। আর আমরা বাজেটের ১৪ শতাংশেও যেতে পারছি না, ১৩ শতাংশেই ঠেকে আছি। এ বছর কিন্তু শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ কমে গেছে। আগে ছিল জিডিপির ২ দশমিক ২৭ শতাংশ, এবার হয়েছে ২ দশমিক ১২ শতাংশ। শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগই যদি আমরা হ্রাস করে ফেলি, তাহলে তো অন্যান্য খাতের বিনিয়োগের ফসল ঘরে তুলতে পারব না। এই যে এখন জনসংখ্যা নিয়ে কথা হচ্ছে, আমি তো মনে করি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। প্রতিরক্ষা খাতে আমরা বরাদ্দ বাড়ালাম, কিন্তু শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ালাম না। তাহলে আমাদের অগ্রাধিকারটা কোথায়, সে প্রশ্নটা তো এসে যায়। যে জাতি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষার পেছনে পেছনে বেশি বিনিয়োগ করেছে, তারাই উন্নতি করেছে। আফ্রিকার দরিদ্র দেশ কেনিয়া আজ বাজেটের ৪০ শতাংশ বরাদ্দ করছে শিক্ষার পেছনে। কেনিয়া পারছে, আমরা পারছি না কেন? জিডিপির শতকরা অংশ হিসেবে শিক্ষার পেছনে আমাদের বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। এমনকি নেপালও আমাদের চেয়ে বেশি করছে। ভারত তো ৫ শতাংশের কাছাকাছি চলে গেছে। মালদ্বীপ তো জিডিপির ৭ শতাংশের বেশি খরচ করছে শিক্ষার পেছনে। শ্রীলঙ্কাও ৭ শতাংশের কাছাকাছি। আর আমরা ২ দশমিক ৩ শতাংশের কাছাকাছিও উঠতে পারিনি। আমাদের অগ্রাধিকারগুলো কী, সেটা তো আগে ঠিক করতে হবে।
প্রথম আলো শিক্ষাক্ষেত্রে দলীয়করণের প্রভাব লক্ষ করা যায়; শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নয়; প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়েও। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার ক্ষেত্রেও দলীয়করণের সমস্যা আছে।
রাশেদা কে চৌধুরী শিক্ষক-সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, শ্রেণীকক্ষে শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের মঙ্গলচিন্তা, শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের চিন্তা ইত্যাদির প্রতি তাঁদের মনোযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার জন্য দলীয় আনুগত্য তাঁদের পেশাগত জীবনে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলেছে। এটি জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ জন্য শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করলেই চলবে না, শিক্ষকদের দায়ও কম নয়। কারণ তাঁরা দলীয়ভাবে জড়িত হচ্ছেন, পেশার প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার কতটা আন্তরিক থাকছে, সেটা বিবেচনা করার ভার তাঁদেরই। রাজনীতিতে তাঁরা যুক্ত হতেই পারেন, কারণ মানুষ তো রাজনৈতিক জীব। কিন্তু সেই জড়িত হওয়া যেন শিক্ষকের যে মূল দায়িত্ব, সেই দায়িত্ব পালনে, শিক্ষার উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত না করে।
প্রথম আলো শিক্ষাঙ্গনের ভেতরে মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে; সম্প্রতি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ঘটনায় সমাজে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
রাশেদা কে চৌধুরী আগে সমস্যা ছিল মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে নিরাপত্তার অভাব; রাস্তায় মাস্তান, উত্ত্যক্তকারী। কিন্তু কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, দেখছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেও মেয়েরা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। ভিকারুননিসার এ ঘটনা তো ভীষণ ন্যক্কারজনক; কিন্তু এর আগেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি বিচলিত হওয়ার বিষয় হচ্ছে শিক্ষকের দ্বারা নারী শিক্ষার্থীর নির্যাতন, অপমান, সম্ভ্রমহানি। নৈতিকতার এই অবক্ষয়ের কত যে নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তা ভেবে বিচলিত হতে হয়। এসব বন্ধ করার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার। এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে, সে ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক থাকা প্রয়োজন, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মধ্যে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানের দায়িত্বও এ ক্ষেত্রে বিরাট; তাঁকে সব সময় নজর রাখতে হবে, তাঁর প্রতিষ্ঠানে এ রকম আলামত দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাপ্রশাসনের তদারকি বাড়াতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানদের এই বিষয়ে দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দিয়ে নিয়মিত তদারক করতে হবে। যেকোনো মূল্যেই হোক, এসব বন্ধ করতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রাশেদা কে চৌধুরী ধন্যবাদ।
No comments