বুঝিলেন কেমনে by মহসীন হাবিব
দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রায়ই তাঁর অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলে থাকেন, বেশ কিছুকাল এ দেশে বসবাস করা এক বিদেশি সাংবাদিক নাকি তাঁকে বলেছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এখানে প্রত্যেক মানুষ তার ক্ষমতাকে টাকায় পরিণত করে। ধন্যবাদ দুদক চেয়ারম্যানকে, এই চরম বাস্তব কথাটি মনে ধরার জন্য।
এর চেয়ে বড় বাস্তবতা বোধ হয় বাংলাদেশে আর কিছু নেই। এই একটি বাস্তবতাকে যদি আমাদের মানসিকতা ও চরিত্র থেকে তুলে দেওয়া যেত, তাহলে সোনার দেশ কাকে বলে, তা দেখতে পেতাম।
ক্ষমতার আভিধানিক ইংরেজি প্রতিশব্দ power। ইংরেজিতে এর অনেক ধরনের ব্যবহার আছে। এই পাওয়ার হলো, ঞযব exercise of a faculty, the employment of strength, the exercise of any kind of control, influence, dominion, sway or command.
নাইট গার্ড স্কুলের মাঠে ট্রাক রাখতে দিয়ে ২০ টাকা খান, সিএনজি অটোরিকশাচালক 'যাব না' বলে মিটারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করেন, কারাগারের খাবার বা অবকাঠামো নির্মাণের ঠিকাদার ভেতরে আটক কোনো বড় মাস্তানের জন্য গঞ্জিকা অথবা সুরা উপহার দেওয়ার সুযোগ পান এবং সে সুযোগের 'সদ্ব্যবহার' করেন (আগেই বলে রাখি_সবাই নন, তবে বেশির ভাগ)। ট্রাকচালক তাঁর ট্রাক চালানোর ক্ষমতাবলে 'সাধারণ পরিবহন সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন'কে ২০ টন বানিয়ে ফেলেন। ট্রাফিক পুলিশ মোড়ে দাঁড়িয়ে ওই ২০ টনকে চলে যেতে দেন টু-পাইস নিয়ে_এ সবই তার ক্ষমতাকে টাকায় রূপান্তর করা। আর উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের কথা বলবেন? ক্ষমতার ছাপ দেখতে পাবেন ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা এবং আধুনিক উত্তরার বিলাসবহুল, ব্যয়সাপেক্ষ বাড়ির দিকে তাকালে। ক্ষমতাকে কিভাবে টাকায় রূপান্তর করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তার সহজ চিত্র দেখতে পাবেন।
সরকারি অফিস-আদালত দেখলে ভয় করে, মনে হয় হাবিয়া দোজখ। শুধু একটি অফিসের উদাহরণ দেওয়া যায়। অফিসের নাম এজি। জেলায় জেলায় এর শাখা আছে। এ অফিসে নাগরিকদের মধ্যে সর্বাধিক যাতায়াত করেন পোড় খাওয়া কোনো অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, অথবা সেখানে গমন করেন কোনো বিধবা তাঁর মৃত স্বামীর টাকা পাওয়ার আশায়। গিয়ে থাকেন প্রকল্পে চাকরি করে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত কোনো কর্মচারী। এঁদের কারো ক্ষমতা নেই বিধি মোতাবেক ফাইল বের করে আনার। দয়া, মায়া, সহানুভূতি, অনুকম্পা, চক্ষুলজ্জা_কোনো কিছুর কোনো বালাই নেই। আপনার গর্দানে ওরা ছুরি চালাবেই। ধারণা করি, অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের নিকটাত্মীয় কেউ 'চা-পানি' না খাইয়েও ওই আপিস থেকে ফিরতে পারবেন না।
ক্ষমতাকে অর্থ-সম্পদে রূপান্তর করার একটি খেলা আমার ছোটবেলা থেকে নিবিড়ভাবে দেখে আসছি। সেটি রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার। দেশের সর্বত্র দৃশ্যটি দেখা যায়। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, মন্ত্রী মহোদয়ের পেছনে ছবি তোলার জন্য ধাক্কাধাক্কি চলতে থাকে। মন্ত্রী মহোদয় যখন হাঁটেন তখন কিছু লোককে তাঁর পাশ ধরে হাঁটার জন্য রীতিমতো কঠিন রাজনীতিতে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। এসব লোকের মধ্যে মাঝারি পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, সম্মানিত ব্যবসায়ী, এমনকি শিক্ষকতার পেশায় জড়িত ব্যক্তিদেরও দেখা যায়। স্কুল ও কলেজজীবনে এই কাণ্ড দেখে মুচকি হেসেছি। সামান্য একটি ছবি তোলার জন্য বেচারাদের কী কসরৎ! বহুকাল পরে বুঝতে পেরেছি, হ্যাঁ রে মহসীন, তুই একটা গাধা! তেনারা শুধু ছবি তোলার জন্য ধাক্কাধাক্কি করেন, বিষয়টি মোটেই তা নয়।
মন্ত্রীর পাশাপাশি দুইবার হাঁটতে পারলে আর সেই হাঁটার সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকলে আয়-বরকতের জন্য আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না! ডিসি, এসপি তথা প্রশাসন ধরে নেয়, এ হলো মন্ত্রী মহোদয়ের খাস লোক, মন্ত্রীর অলিখিত স্থানীয় উপদেষ্টা। এই সুবাদে অপরাধী স্বজনকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কোটি কোটি টাকার কাজ 'নিজেদের মধ্যে' ভাগ করে নেওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে। এটি বাংলাদেশের বহুকালের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। আরো মজার ব্যাপার হলো, নিরীহ জনগণ এসব নীরবে দেখে। পরবর্তী নির্বাচনে মন্ত্রী মহোদয়ের সর্বনাশটা এই আশপাশে থাকা লোকগুলোর দ্বারাই মূলত সংঘটিত হয়। অনেক মন্ত্রী বিষয়টি দেখতে পান না, কোনো কোনো মন্ত্রী দেখেও তুচ্ছ বিষয় ভেবে উপেক্ষা করেন। আবার অতি বুদ্ধিমান কোনো মন্ত্রী এই ক্ষমতাকে টাকায় রূপান্তর করার সুযোগটি ইচ্ছা করেই দিয়ে থাকেন।
শুধু টাকায় রূপান্তর নয়, ক্ষমতাকে নিরাপদ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখি আমরা প্রতিনিয়ত। এ দেশে যার যতটুকু ক্ষমতা, সে সেটুকুর পূর্ণ ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে। যেমন ধরুন, ইদানীং গ্রামগঞ্জে স্টুডিওর বেশ কদর। শহরে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা ও ডিজিটাল ক্যামেরা পকেটে পকেটে থাকে বলে আর স্টুডিওর শখ বিশেষ কারো নেই। গ্রামে বতরের সময় ঘরে দুটো পয়সা আসে। তাই শখ করে ঘরের সরল মেয়েরা এবং নবীনা গৃহবধূরা স্টুডিওতে যান ছবি তুলতে। নীরবে, অতি সূক্ষ্ম কায়দায় সেখানে এসব মেয়ের কেউ বা কখনো হন যৌন হয়রানির শিকার।
বাংলাদেশে ক্ষমতার যে কত বড় ক্ষমতা, তা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর হয়ে গেছে। এ দেশে যে কারাগারে ছয় হাজার ধারণক্ষমতা, সেই কারাগারে ১৪ হাজার মানুষ বাস করে। দেশের প্রতিটি জেলখানা ভরে আছে মানুষ দিয়ে। আমরা গণ্ডায় গণ্ডায় নিরপরাধ মানুষকে বছরের পর বছর কারাগারে আটকে থাকতে দেখি। নিরপরাধ ব্যক্তি যৌবনে ঠিকানা হারিয়ে অথবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে জেলখানায় প্রবেশ করেছেন এবং বৃদ্ধ বয়সে কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছেন_এমন ঘটনাও দেখেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত ক্ষমতাবান কোনো মানুষকে আমরা ১০ বছর কারাগারে থাকতে দেখিনি। অনেক ক্ষমতাবান মানুষের বিরুদ্ধে সরাসরি খুন, ধর্ষণ, জোরপূর্বক উচ্ছেদ, মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ, কালোবাজারি, অর্থপাচারসহ অসংখ্য অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ৪০ বছরে লাখ লাখ মানুষ ক্ষমতাশালী হয়েছেন, বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছেন। এঁরা কেউ কোনো অপরাধ করেননি?
উপহাস আরো আছে। যেমন-বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তিন যুগের বেশি সময় পার করে একটি বিচার হয়েছে। এ বিচারকে অনেকটা প্রতীকী বিচার বলে মনে হয়েছে। যখন ফারুক-রশিদদের পেছনে ক্ষমতা ছিল, তখন বিচার তো দূরের কথা, বিদেশে বাংলাদেশের পতাকাবাহী গাড়িতে চড়ে, বাংলাদেশ সরকারের সম্মানী-ভাতা খেয়ে তারা জীবন অতিবাহিত করেছে। সে সময়ও বাংলাদেশের আকাশে সূর্য উঠেছে, নদীর স্রোতোধারা ছিল প্রবহমান। সেই ফারুক-রশিদদের তখনই বিচার হয়েছে, যখন তারা নখদন্তহীন। অপাঙ্ক্তেয়। যৌবনে তারা জঘন্য অপরাধ করে দাপটের সঙ্গে জীবন কাটিয়ে বৃদ্ধাবস্থায় প্রতীকী বিচারের সম্মুখীন হয়েছে (তবু রক্ষা, এ বিচারটুকু করে বিচার বিভাগ ও সরকার দেশ ও জাতিকে বড় কলঙ্কের হাত থেকে মুক্ত করেছে)। এদের জঘন্য অপরাধের বিচার না হওয়ার পেছনেও ছিল পাথরের মতো কঠিন আর পাহাড়ের মতো উঁচু ক্ষমতা।
একটি সমাজে ক্ষমতার বাই-প্রোডাক্ট তখনই হয়, যখন ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার চলতে থাকে। আমাদের জন্য পরিতাপ আরো গভীর। এখানে মূলত বাই-প্রোডাক্ট তৈরির জন্যই ক্ষমতার প্রয়োজন পড়ে, কাড়াকাড়ি চলতে থাকে। এখানে কেউ মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো বলতে পারেন না, I am not interested in power for power's sake, but I'm interested in power that is moral, that is right and that is good.
এসব দুর্বলতা আমরা দেখি আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে। আমাদের যন্ত্রণা দিয়ে। এ দেশের প্রশাসনযন্ত্র থেকে শুরু করে সর্বস্তরে সব পেশার মধ্যে সাপ ও শাপ ঢুকে গেছে। চিকিৎসা, শিক্ষকতা থেকে শুরু করে এমন কোনো পেশা নেই, যাকে নিজে লাভবান হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত চিত্র কতটা ভয়াবহ, সে সম্পর্কে এমনকি অনেক সচেতন মানুষও জানেন না। চাকরির জন্য নয়, 'গুরুত্বপূর্ণ' স্টেশনে থাকার জন্য ২০ লাখ, ৩০ লাখ টাকা ওপর মহলে ঘুষ দেওয়া হয়, এ খোঁজ কজন রাখেন? তাই ভাবি, সম্মানিত দুদক চেয়ারম্যানের উদ্ধৃত সেই বিদেশি সাংবাদিক আমাদের দেশের এসব নিষ্ঠুর বাস্তবতা বুঝলেন কী করে?
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
ক্ষমতার আভিধানিক ইংরেজি প্রতিশব্দ power। ইংরেজিতে এর অনেক ধরনের ব্যবহার আছে। এই পাওয়ার হলো, ঞযব exercise of a faculty, the employment of strength, the exercise of any kind of control, influence, dominion, sway or command.
নাইট গার্ড স্কুলের মাঠে ট্রাক রাখতে দিয়ে ২০ টাকা খান, সিএনজি অটোরিকশাচালক 'যাব না' বলে মিটারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করেন, কারাগারের খাবার বা অবকাঠামো নির্মাণের ঠিকাদার ভেতরে আটক কোনো বড় মাস্তানের জন্য গঞ্জিকা অথবা সুরা উপহার দেওয়ার সুযোগ পান এবং সে সুযোগের 'সদ্ব্যবহার' করেন (আগেই বলে রাখি_সবাই নন, তবে বেশির ভাগ)। ট্রাকচালক তাঁর ট্রাক চালানোর ক্ষমতাবলে 'সাধারণ পরিবহন সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন'কে ২০ টন বানিয়ে ফেলেন। ট্রাফিক পুলিশ মোড়ে দাঁড়িয়ে ওই ২০ টনকে চলে যেতে দেন টু-পাইস নিয়ে_এ সবই তার ক্ষমতাকে টাকায় রূপান্তর করা। আর উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের কথা বলবেন? ক্ষমতার ছাপ দেখতে পাবেন ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা এবং আধুনিক উত্তরার বিলাসবহুল, ব্যয়সাপেক্ষ বাড়ির দিকে তাকালে। ক্ষমতাকে কিভাবে টাকায় রূপান্তর করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তার সহজ চিত্র দেখতে পাবেন।
সরকারি অফিস-আদালত দেখলে ভয় করে, মনে হয় হাবিয়া দোজখ। শুধু একটি অফিসের উদাহরণ দেওয়া যায়। অফিসের নাম এজি। জেলায় জেলায় এর শাখা আছে। এ অফিসে নাগরিকদের মধ্যে সর্বাধিক যাতায়াত করেন পোড় খাওয়া কোনো অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী, অথবা সেখানে গমন করেন কোনো বিধবা তাঁর মৃত স্বামীর টাকা পাওয়ার আশায়। গিয়ে থাকেন প্রকল্পে চাকরি করে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত কোনো কর্মচারী। এঁদের কারো ক্ষমতা নেই বিধি মোতাবেক ফাইল বের করে আনার। দয়া, মায়া, সহানুভূতি, অনুকম্পা, চক্ষুলজ্জা_কোনো কিছুর কোনো বালাই নেই। আপনার গর্দানে ওরা ছুরি চালাবেই। ধারণা করি, অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের নিকটাত্মীয় কেউ 'চা-পানি' না খাইয়েও ওই আপিস থেকে ফিরতে পারবেন না।
ক্ষমতাকে অর্থ-সম্পদে রূপান্তর করার একটি খেলা আমার ছোটবেলা থেকে নিবিড়ভাবে দেখে আসছি। সেটি রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহার। দেশের সর্বত্র দৃশ্যটি দেখা যায়। লক্ষ করলেই দেখা যাবে, মন্ত্রী মহোদয়ের পেছনে ছবি তোলার জন্য ধাক্কাধাক্কি চলতে থাকে। মন্ত্রী মহোদয় যখন হাঁটেন তখন কিছু লোককে তাঁর পাশ ধরে হাঁটার জন্য রীতিমতো কঠিন রাজনীতিতে অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। এসব লোকের মধ্যে মাঝারি পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, সম্মানিত ব্যবসায়ী, এমনকি শিক্ষকতার পেশায় জড়িত ব্যক্তিদেরও দেখা যায়। স্কুল ও কলেজজীবনে এই কাণ্ড দেখে মুচকি হেসেছি। সামান্য একটি ছবি তোলার জন্য বেচারাদের কী কসরৎ! বহুকাল পরে বুঝতে পেরেছি, হ্যাঁ রে মহসীন, তুই একটা গাধা! তেনারা শুধু ছবি তোলার জন্য ধাক্কাধাক্কি করেন, বিষয়টি মোটেই তা নয়।
মন্ত্রীর পাশাপাশি দুইবার হাঁটতে পারলে আর সেই হাঁটার সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকলে আয়-বরকতের জন্য আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না! ডিসি, এসপি তথা প্রশাসন ধরে নেয়, এ হলো মন্ত্রী মহোদয়ের খাস লোক, মন্ত্রীর অলিখিত স্থানীয় উপদেষ্টা। এই সুবাদে অপরাধী স্বজনকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কোটি কোটি টাকার কাজ 'নিজেদের মধ্যে' ভাগ করে নেওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে। এটি বাংলাদেশের বহুকালের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। আরো মজার ব্যাপার হলো, নিরীহ জনগণ এসব নীরবে দেখে। পরবর্তী নির্বাচনে মন্ত্রী মহোদয়ের সর্বনাশটা এই আশপাশে থাকা লোকগুলোর দ্বারাই মূলত সংঘটিত হয়। অনেক মন্ত্রী বিষয়টি দেখতে পান না, কোনো কোনো মন্ত্রী দেখেও তুচ্ছ বিষয় ভেবে উপেক্ষা করেন। আবার অতি বুদ্ধিমান কোনো মন্ত্রী এই ক্ষমতাকে টাকায় রূপান্তর করার সুযোগটি ইচ্ছা করেই দিয়ে থাকেন।
শুধু টাকায় রূপান্তর নয়, ক্ষমতাকে নিরাপদ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখি আমরা প্রতিনিয়ত। এ দেশে যার যতটুকু ক্ষমতা, সে সেটুকুর পূর্ণ ব্যবহার করে ফায়দা লুটছে। যেমন ধরুন, ইদানীং গ্রামগঞ্জে স্টুডিওর বেশ কদর। শহরে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা ও ডিজিটাল ক্যামেরা পকেটে পকেটে থাকে বলে আর স্টুডিওর শখ বিশেষ কারো নেই। গ্রামে বতরের সময় ঘরে দুটো পয়সা আসে। তাই শখ করে ঘরের সরল মেয়েরা এবং নবীনা গৃহবধূরা স্টুডিওতে যান ছবি তুলতে। নীরবে, অতি সূক্ষ্ম কায়দায় সেখানে এসব মেয়ের কেউ বা কখনো হন যৌন হয়রানির শিকার।
বাংলাদেশে ক্ষমতার যে কত বড় ক্ষমতা, তা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করি। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর হয়ে গেছে। এ দেশে যে কারাগারে ছয় হাজার ধারণক্ষমতা, সেই কারাগারে ১৪ হাজার মানুষ বাস করে। দেশের প্রতিটি জেলখানা ভরে আছে মানুষ দিয়ে। আমরা গণ্ডায় গণ্ডায় নিরপরাধ মানুষকে বছরের পর বছর কারাগারে আটকে থাকতে দেখি। নিরপরাধ ব্যক্তি যৌবনে ঠিকানা হারিয়ে অথবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে জেলখানায় প্রবেশ করেছেন এবং বৃদ্ধ বয়সে কারাগার থেকে বের হয়ে এসেছেন_এমন ঘটনাও দেখেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত ক্ষমতাবান কোনো মানুষকে আমরা ১০ বছর কারাগারে থাকতে দেখিনি। অনেক ক্ষমতাবান মানুষের বিরুদ্ধে সরাসরি খুন, ধর্ষণ, জোরপূর্বক উচ্ছেদ, মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ, কালোবাজারি, অর্থপাচারসহ অসংখ্য অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ৪০ বছরে লাখ লাখ মানুষ ক্ষমতাশালী হয়েছেন, বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছেন। এঁরা কেউ কোনো অপরাধ করেননি?
উপহাস আরো আছে। যেমন-বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তিন যুগের বেশি সময় পার করে একটি বিচার হয়েছে। এ বিচারকে অনেকটা প্রতীকী বিচার বলে মনে হয়েছে। যখন ফারুক-রশিদদের পেছনে ক্ষমতা ছিল, তখন বিচার তো দূরের কথা, বিদেশে বাংলাদেশের পতাকাবাহী গাড়িতে চড়ে, বাংলাদেশ সরকারের সম্মানী-ভাতা খেয়ে তারা জীবন অতিবাহিত করেছে। সে সময়ও বাংলাদেশের আকাশে সূর্য উঠেছে, নদীর স্রোতোধারা ছিল প্রবহমান। সেই ফারুক-রশিদদের তখনই বিচার হয়েছে, যখন তারা নখদন্তহীন। অপাঙ্ক্তেয়। যৌবনে তারা জঘন্য অপরাধ করে দাপটের সঙ্গে জীবন কাটিয়ে বৃদ্ধাবস্থায় প্রতীকী বিচারের সম্মুখীন হয়েছে (তবু রক্ষা, এ বিচারটুকু করে বিচার বিভাগ ও সরকার দেশ ও জাতিকে বড় কলঙ্কের হাত থেকে মুক্ত করেছে)। এদের জঘন্য অপরাধের বিচার না হওয়ার পেছনেও ছিল পাথরের মতো কঠিন আর পাহাড়ের মতো উঁচু ক্ষমতা।
একটি সমাজে ক্ষমতার বাই-প্রোডাক্ট তখনই হয়, যখন ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার চলতে থাকে। আমাদের জন্য পরিতাপ আরো গভীর। এখানে মূলত বাই-প্রোডাক্ট তৈরির জন্যই ক্ষমতার প্রয়োজন পড়ে, কাড়াকাড়ি চলতে থাকে। এখানে কেউ মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো বলতে পারেন না, I am not interested in power for power's sake, but I'm interested in power that is moral, that is right and that is good.
এসব দুর্বলতা আমরা দেখি আমাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে। আমাদের যন্ত্রণা দিয়ে। এ দেশের প্রশাসনযন্ত্র থেকে শুরু করে সর্বস্তরে সব পেশার মধ্যে সাপ ও শাপ ঢুকে গেছে। চিকিৎসা, শিক্ষকতা থেকে শুরু করে এমন কোনো পেশা নেই, যাকে নিজে লাভবান হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত চিত্র কতটা ভয়াবহ, সে সম্পর্কে এমনকি অনেক সচেতন মানুষও জানেন না। চাকরির জন্য নয়, 'গুরুত্বপূর্ণ' স্টেশনে থাকার জন্য ২০ লাখ, ৩০ লাখ টাকা ওপর মহলে ঘুষ দেওয়া হয়, এ খোঁজ কজন রাখেন? তাই ভাবি, সম্মানিত দুদক চেয়ারম্যানের উদ্ধৃত সেই বিদেশি সাংবাদিক আমাদের দেশের এসব নিষ্ঠুর বাস্তবতা বুঝলেন কী করে?
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
No comments