রাজনৈতিক সংঘাত বাড়লে ক্ষতি দেশের by আকবর আলি খান
রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা চলছে। সভা-মিছিলে ও গণমাধ্যমে দুই পক্ষের নিত্যদিন প্রবল উপস্থিতি। চলছে রাজনৈতিক আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ। সার্বিক পরিস্থিতিতে জনগণ উদ্বিগ্ন। সংঘাতময় অবস্থা তারা কোনোভাবেই চায় না। বরং বিরোধীয় যে কোনো ইস্যুর নিষ্পত্তি চায় আলোচনার মাধ্যমে।
এ সমাধান আসতে পারে কোন পথে, সেটা নিয়েই আলোচনা করেছেন দু'জন রাজনৈতিক বিশ্লেষক
প্রধান দুটি রাজনৈতিক জোটের আহ্বানে একদিনের ব্যবধানে বড় ধরনের দুটি রাজনৈতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল রাজধানীতে। সমাবেশ দুটির আয়োজকরা সরকারের কাছ থেকে সমান নয়, বরং বিপরীতধর্মী আচরণ পেয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালসহ আরও কতিপয় দাবিতে বিএনপি এবং তার মিত্ররা কয়েক মাস ধরেই রাজপথে রয়েছে। ১২ মার্চের সমাবেশের পর তা আরও অনেকদিন চলবে বলেই মনে হয়। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এ বিষয়ে একমত হবেন যে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে যত বেশি রাজপথে রাখা হবে, আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমাধান সূত্র বের করা ততই কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে সাংঘর্ষিক রাজনীতি নতুন নয়। বলতে পারি, দুটি প্রধান জোট প্রায় দুই যুগ ধরেই মুখোমুখি রয়েছে। আশির দশকের প্রায় গোটা সময় ধরে তারা এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে ছিল। ১৯৯১ সালের প্রথমদিকে সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। নিকট ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে, এমন আশা কম। লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বরং বর্তমান প্রেক্ষাপট বিচার করে বলা যায়, সামনের দিনগুলোতে সংঘাত আরও বেড়ে যেতে পারে। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে আমি মনে করি।
প্রথমত, ১২ মার্চ বিএনপি এবং তার মিত্রদের সমাবেশকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে তাতে রাজনীতিতে আরও মেরুকরণ ঘটেছে। সরকার এবং সরকারি জোট এ ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে এবং সেটা বলা যায় কোনো রাখঢাক না করেই করা হয়েছে। নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সমাবেশে বিপুল জনসমাগম হওয়ায় বিএনপি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তাদের মধ্যে যে হতাশা ছিল, তার অনেকটাই এর ফলে কেটে গেছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অভিমত দিতে পারেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্রদের মধ্যেও ১২ মার্চের সমাবেশের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তারা নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য ১৪ মার্চ রাজধানীতে সমাবেশ করেছে। রাজনীতি এভাবে রাজপথে চলে এসেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নেতারা যথাযথ নেতৃত্ব দিতে পারেন না কিংবা সেটা অনেক কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। এ ভূমিকা বহুলাংশে চলে যায় আবেগপ্রবণ জনতার ওপর। এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু পরিবেশে আলোচনার মাধ্যমে বিবদমান ইস্যুগুলোর যৌক্তিক সমাধানের আশা ক্রমশ তিরোহিত হয়ে যেতে থাকে।
তৃতীয় যে সমস্যা তার মূলে রয়েছে সরকার ও সরকারি দল। তারা যেভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তাতে মনে হয় সরকার ও সরকারি দলের মধ্যে সব প্রভেদ ঘুচে গেছে। জনসমাবেশ ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠান সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। সরকারের তরফে এই অধিকার খর্ব করার পক্ষে যুক্তি হলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কিছু প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, ১২ মার্চের সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলোর তরফে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি সবাই স্বীকার করবেন যে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার সরকারের রয়েছে। তবে এমন আশঙ্কা থেকে সরকার নিবৃত্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সেটা শুধু বিএনপি এবং তার মিত্রদের রাজনীতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, কিন্তু সরকারি দলের ক্ষেত্রে হবে না_ এমন পরিস্থিতি মেনে নেওয়া শক্ত। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ করে তা হলে বিএনপির পাশাপাশি সরকারি দলের পাল্টা সমাবেশের ক্ষেত্রেও অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে হতো। কিন্তু কার্যত সেটা ঘটেনি। বলা যায়, সরকার সেটা করেনি। বরং যেটা খোলা চোখে দেখা গেছে সেটা হচ্ছে, বিরোধী দলকে কোণঠাসা করার চেষ্টা এবং সরকারি দলকে সর্বতোভাবে উৎসাহ দেওয়া। এতে সরকারের অবস্থান ও সদিচ্ছা নিয়ে অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার যুক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনেও জাতীয় সংসদের সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু ১২ মার্চের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারি দল এবং প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে নিরাপত্তা বিঘি্নত হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে একযোগে রাজপথে কাজ করেছে তাতে পরবর্তী নির্বাচনের সময়ে তারা ক্ষমতায় থাকলে নিরপেক্ষ পরিবেশ কতটা বজায় থাকবে, সে প্রশ্ন স্বাভাবিক। নির্বাচনের সময়েও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে একইভাবে বিরোধীপক্ষের কর্মতৎপরতা বন্ধ কিংবা তাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এভাবে বলা যায়, ১২ মার্চের পূর্বাপর ঘটনা বিরোধীদের জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার এনে দিল।
১২ মার্চের ঘটনা প্রসঙ্গে বলা যায়, স্বল্পমেয়াদে হয়তো আওয়ামী লীগের লাভ হয়েছে। যদি তারা যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি এবং অন্যান্য পদক্ষেপ না নিত তাহলে হয়তো সমাবেশের আকার আরও বড় হতো। এভাবে একটি সাময়িক বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে পেরেছে ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে লাভ হয়েছে বিএনপির। আর ক্ষতি হয়েছে সরকারের। বিএনপির লাভ এজন্য বলছি যে, বড় ধরনের সমাবেশ আয়োজন থেকে এমন ধারণা করাই যায় যে সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ডে জনমনে যথেষ্ট অসন্তোষ রয়েছে। সফল সমাবেশ করতে পেরে দলের নেতাকর্মী-সমর্থকরা যথেষ্ট উজ্জীবিত হয়েছে। আর সরকারের ক্ষতি বলছি এ কারণে যে, দেশের ভেতরে ও বাইরে তাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে।
অবশ্য বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতা আসা একটি সরকারকে এ মুহূর্তে অস্থিতিশীল করা যাবে_ বিএনপি এবং তাদের মিত্রদের এমন আশা করা ঠিক হবে না। সরকারকে তাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণ নেই। কিন্তু সরকার ও সরকারি দল যদি স্বল্পমেয়াদে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশা থেকে এ ধরনের আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে তাহলে ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হতে তারা ক্রমশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। এ পরিণতিতে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে থাকবে, সংঘাত বাড়বে এবং তাতে সবচেয়ে ক্ষতি দেশের মানুষের।
আমরা প্রকৃতই জানি না যে আমরা কোথায় যাচ্ছি। তবে এটা বলা যায়, রাজনীতি ও অর্থনীতির অঙ্গনে অশুভ শক্তির সক্রিয়তা রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি উদ্যোগ বাঞ্ছনীয়। এক. দেশের মানুষকে বুঝতে হবে যে নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে সেটাসহ অন্যান্য যেসব জরুরি সমস্যা রয়েছে তার সমাধান শুধুু রাজনীতিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এ তাগিদ থেকেই সাধারণ মানুষকে আরও সক্রিয় ও সোচ্চার হতে হবে এবং তাদের সবাইকে বলতে হবে, সংঘাতময় রাজনীতির অবসান চাই। তৃণমূলের এই বক্তব্য বারবার রাজনীতিকদের উদ্দেশ্য করে বলে যেতে হবে।
দুই. রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদেরও বুঝতে হবে যে, সংঘাত থেকে তাদের কোনো লাভ হবে না। বরং এতে দীর্ঘমেয়াদে তাদের নিজেদের ও দেশেরই ক্ষতি। তাদের এটাও বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি প্রধান দল এবং তাদের কেন্দ্র করে যে দুটি জোট সক্রিয় রয়েছে তারা এতই শক্তিশালী যে কোনো দল বা জোটের পক্ষেই অন্য পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব নয়। এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে তাদের উচিত হবে, একে অপরের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ। রাজনৈতিক সংঘাত যদি বাড়তে থাকে তাহলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হবে না। তাছাড়া শুরুতেই যেমনটি বলেছি, রাজপথের কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নেতাদের নিয়ন্ত্রণ কমে যেতে থাকে। এভাবে আবেগপ্রবণ জনতার হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ চলে যেতে থাকলে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
প্রাচীনকাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার চিন্তাবিদরা এ ধরনের নৈরাজ্য নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। এ নৈরাজ্যকে তারা আখ্যায়িত করেছেন মাৎস্যন্যায় বা মাছের মতো পরস্পর হানাহানি, হত্যা ও অরাজকতা হিসেবে। এ ধরনের জগতে বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলে। যখন কোনো দেশে কিংবা সমাজের কোনো অংশে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করে তখন শক্তিধররা প্রান্তিক মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে হলে কোনো পক্ষেরই নৈরাজ্য কাম্য হতে পারে না। সরকারি ও বিরোধী পক্ষ উভয়ের এ ক্ষেত্রে দায় রয়েছে। আমি মনে করি, এখনও আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ঠেকানো সম্ভব। জনগণ একান্তভাবেই কামনা করে, রাজনীতিকদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তারা সংঘর্ষের মাধ্যমে নয়, বরং সমঝোতার মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করবে।
স ড. আকবর আলি খান :তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
প্রধান দুটি রাজনৈতিক জোটের আহ্বানে একদিনের ব্যবধানে বড় ধরনের দুটি রাজনৈতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে গেল রাজধানীতে। সমাবেশ দুটির আয়োজকরা সরকারের কাছ থেকে সমান নয়, বরং বিপরীতধর্মী আচরণ পেয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালসহ আরও কতিপয় দাবিতে বিএনপি এবং তার মিত্ররা কয়েক মাস ধরেই রাজপথে রয়েছে। ১২ মার্চের সমাবেশের পর তা আরও অনেকদিন চলবে বলেই মনে হয়। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এ বিষয়ে একমত হবেন যে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে যত বেশি রাজপথে রাখা হবে, আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমাধান সূত্র বের করা ততই কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে সাংঘর্ষিক রাজনীতি নতুন নয়। বলতে পারি, দুটি প্রধান জোট প্রায় দুই যুগ ধরেই মুখোমুখি রয়েছে। আশির দশকের প্রায় গোটা সময় ধরে তারা এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে ছিল। ১৯৯১ সালের প্রথমদিকে সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। নিকট ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে, এমন আশা কম। লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বরং বর্তমান প্রেক্ষাপট বিচার করে বলা যায়, সামনের দিনগুলোতে সংঘাত আরও বেড়ে যেতে পারে। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে আমি মনে করি।
প্রথমত, ১২ মার্চ বিএনপি এবং তার মিত্রদের সমাবেশকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে তাতে রাজনীতিতে আরও মেরুকরণ ঘটেছে। সরকার এবং সরকারি জোট এ ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে এবং সেটা বলা যায় কোনো রাখঢাক না করেই করা হয়েছে। নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সমাবেশে বিপুল জনসমাগম হওয়ায় বিএনপি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর তাদের মধ্যে যে হতাশা ছিল, তার অনেকটাই এর ফলে কেটে গেছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অভিমত দিতে পারেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্রদের মধ্যেও ১২ মার্চের সমাবেশের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তারা নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য ১৪ মার্চ রাজধানীতে সমাবেশ করেছে। রাজনীতি এভাবে রাজপথে চলে এসেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নেতারা যথাযথ নেতৃত্ব দিতে পারেন না কিংবা সেটা অনেক কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। এ ভূমিকা বহুলাংশে চলে যায় আবেগপ্রবণ জনতার ওপর। এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু পরিবেশে আলোচনার মাধ্যমে বিবদমান ইস্যুগুলোর যৌক্তিক সমাধানের আশা ক্রমশ তিরোহিত হয়ে যেতে থাকে।
তৃতীয় যে সমস্যা তার মূলে রয়েছে সরকার ও সরকারি দল। তারা যেভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে তাতে মনে হয় সরকার ও সরকারি দলের মধ্যে সব প্রভেদ ঘুচে গেছে। জনসমাবেশ ও শোভাযাত্রা অনুষ্ঠান সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। সরকারের তরফে এই অধিকার খর্ব করার পক্ষে যুক্তি হলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কিছু প্রতিবেদন। এতে বলা হয়েছে, ১২ মার্চের সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলোর তরফে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি সবাই স্বীকার করবেন যে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার সরকারের রয়েছে। তবে এমন আশঙ্কা থেকে সরকার নিবৃত্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সেটা শুধু বিএনপি এবং তার মিত্রদের রাজনীতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে, কিন্তু সরকারি দলের ক্ষেত্রে হবে না_ এমন পরিস্থিতি মেনে নেওয়া শক্ত। এ ক্ষেত্রে সরকার যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ করে তা হলে বিএনপির পাশাপাশি সরকারি দলের পাল্টা সমাবেশের ক্ষেত্রেও অনুরূপ পদক্ষেপ নিতে হতো। কিন্তু কার্যত সেটা ঘটেনি। বলা যায়, সরকার সেটা করেনি। বরং যেটা খোলা চোখে দেখা গেছে সেটা হচ্ছে, বিরোধী দলকে কোণঠাসা করার চেষ্টা এবং সরকারি দলকে সর্বতোভাবে উৎসাহ দেওয়া। এতে সরকারের অবস্থান ও সদিচ্ছা নিয়ে অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক।
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার যুক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনেও জাতীয় সংসদের সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু ১২ মার্চের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারি দল এবং প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেভাবে নিরাপত্তা বিঘি্নত হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে একযোগে রাজপথে কাজ করেছে তাতে পরবর্তী নির্বাচনের সময়ে তারা ক্ষমতায় থাকলে নিরপেক্ষ পরিবেশ কতটা বজায় থাকবে, সে প্রশ্ন স্বাভাবিক। নির্বাচনের সময়েও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে একইভাবে বিরোধীপক্ষের কর্মতৎপরতা বন্ধ কিংবা তাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এভাবে বলা যায়, ১২ মার্চের পূর্বাপর ঘটনা বিরোধীদের জন্য একটি কার্যকর হাতিয়ার এনে দিল।
১২ মার্চের ঘটনা প্রসঙ্গে বলা যায়, স্বল্পমেয়াদে হয়তো আওয়ামী লীগের লাভ হয়েছে। যদি তারা যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি এবং অন্যান্য পদক্ষেপ না নিত তাহলে হয়তো সমাবেশের আকার আরও বড় হতো। এভাবে একটি সাময়িক বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে পেরেছে ক্ষমতাসীনরা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে লাভ হয়েছে বিএনপির। আর ক্ষতি হয়েছে সরকারের। বিএনপির লাভ এজন্য বলছি যে, বড় ধরনের সমাবেশ আয়োজন থেকে এমন ধারণা করাই যায় যে সরকারের সার্বিক কর্মকাণ্ডে জনমনে যথেষ্ট অসন্তোষ রয়েছে। সফল সমাবেশ করতে পেরে দলের নেতাকর্মী-সমর্থকরা যথেষ্ট উজ্জীবিত হয়েছে। আর সরকারের ক্ষতি বলছি এ কারণে যে, দেশের ভেতরে ও বাইরে তাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে।
অবশ্য বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতা আসা একটি সরকারকে এ মুহূর্তে অস্থিতিশীল করা যাবে_ বিএনপি এবং তাদের মিত্রদের এমন আশা করা ঠিক হবে না। সরকারকে তাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ার কারণ নেই। কিন্তু সরকার ও সরকারি দল যদি স্বল্পমেয়াদে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশা থেকে এ ধরনের আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে তাহলে ভাবমূর্তি আরও ক্ষুণ্ন হতে তারা ক্রমশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন। এ পরিণতিতে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে থাকবে, সংঘাত বাড়বে এবং তাতে সবচেয়ে ক্ষতি দেশের মানুষের।
আমরা প্রকৃতই জানি না যে আমরা কোথায় যাচ্ছি। তবে এটা বলা যায়, রাজনীতি ও অর্থনীতির অঙ্গনে অশুভ শক্তির সক্রিয়তা রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি উদ্যোগ বাঞ্ছনীয়। এক. দেশের মানুষকে বুঝতে হবে যে নির্বাচনকালীন সরকার কী হবে সেটাসহ অন্যান্য যেসব জরুরি সমস্যা রয়েছে তার সমাধান শুধুু রাজনীতিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এ তাগিদ থেকেই সাধারণ মানুষকে আরও সক্রিয় ও সোচ্চার হতে হবে এবং তাদের সবাইকে বলতে হবে, সংঘাতময় রাজনীতির অবসান চাই। তৃণমূলের এই বক্তব্য বারবার রাজনীতিকদের উদ্দেশ্য করে বলে যেতে হবে।
দুই. রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদেরও বুঝতে হবে যে, সংঘাত থেকে তাদের কোনো লাভ হবে না। বরং এতে দীর্ঘমেয়াদে তাদের নিজেদের ও দেশেরই ক্ষতি। তাদের এটাও বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি প্রধান দল এবং তাদের কেন্দ্র করে যে দুটি জোট সক্রিয় রয়েছে তারা এতই শক্তিশালী যে কোনো দল বা জোটের পক্ষেই অন্য পক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব নয়। এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে তাদের উচিত হবে, একে অপরের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ। রাজনৈতিক সংঘাত যদি বাড়তে থাকে তাহলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হবে না। তাছাড়া শুরুতেই যেমনটি বলেছি, রাজপথের কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নেতাদের নিয়ন্ত্রণ কমে যেতে থাকে। এভাবে আবেগপ্রবণ জনতার হাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ চলে যেতে থাকলে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
প্রাচীনকাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার চিন্তাবিদরা এ ধরনের নৈরাজ্য নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। এ নৈরাজ্যকে তারা আখ্যায়িত করেছেন মাৎস্যন্যায় বা মাছের মতো পরস্পর হানাহানি, হত্যা ও অরাজকতা হিসেবে। এ ধরনের জগতে বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে ফেলে। যখন কোনো দেশে কিংবা সমাজের কোনো অংশে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করে তখন শক্তিধররা প্রান্তিক মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে হলে কোনো পক্ষেরই নৈরাজ্য কাম্য হতে পারে না। সরকারি ও বিরোধী পক্ষ উভয়ের এ ক্ষেত্রে দায় রয়েছে। আমি মনে করি, এখনও আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া হলে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ঠেকানো সম্ভব। জনগণ একান্তভাবেই কামনা করে, রাজনীতিকদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। তারা সংঘর্ষের মাধ্যমে নয়, বরং সমঝোতার মাধ্যমে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করবে।
স ড. আকবর আলি খান :তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
No comments