শিক্ষাঙ্গন-অস্ত্র নয়, জ্ঞানের আধার হোক সব বিশ্ববিদ্যালয় by আবদুল মান্নান
গত ৮ ফেব্রুয়ারি এক দুঃখজনক ও বিয়োগান্ত ঘটনার প্রেক্ষাপটে ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে। বাতিল করে দিতে হয় সব পরীক্ষার সময়সূচি আর খালি করে দিতে হয় সব ছাত্রাবাস। যে ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের পদভারে মুখরিত থাকার কথা, তাতে হঠাৎ করেই নেমে আসে এক অদ্ভুত নীরবতা।
এর আগে দুটি ছাত্রসংগঠনের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারণে ঝরে যায় দুটি প্রাণ, খালি হয়ে যায় দুজন মায়ের বুক। সংঘর্ষে নিহত এই দুই শিক্ষার্থীর দুটি পরিবারের সব স্বপ্ন মুহূর্তেই চুরমার হয়ে যায়। নিহত দুজন ছাত্রই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা-মা পাঠিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁদের সন্তান একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে পরিবারের হাল ধরবে। কেউ হয়তো হবে একজন নামকরা শিক্ষক বা গবেষক অথবা কেউ ব্যারিস্টার বা বিচারপতি। না, সেসবের কিছু হওয়ার আগেই এই দুটি পরিবারের সব আশার প্রদীপ ফুৎকারেই নিভে গেল। এরা বলি হলো এক অসুস্থ ছাত্ররাজনীতির।
আমার অনেক প্রাক্তন ছাত্র, অভিভাবক, আমার লেখার পাঠক, আমার কঠোর সমালোচক এবং অনেক সহকর্মী বন্ধু প্রায়ই আমাকে প্রশ্ন করেন, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা উচিত কি না? তাঁদের আমি পরিষ্কার ভাষায় বলি, বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে যা চলছে, তাকে কোনো অবস্থাতেই ছাত্ররাজনীতি বলা যাবে না। এটা কোনো বিবেকবান মানুষ সমর্থন করতে পারে না। এগুলো স্রেফ মতলববাজি, আধিপত্য বিস্তারই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। যারা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকে, তারা কদাচিৎ শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে। বইপুস্তকের সঙ্গে সম্পর্কহীন এসব তথাকথিত ছাত্রনেতার সঙ্গে বাস বা লঞ্চ টার্মিনাল দখলকারীদের কোনো তফাত দেখি না। এদের কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। বেশির ভাগেরই নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেই কোনো যোগ্যতা, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হতে গেলেও হিমশিম খেতে হবে। ঘটনা এখানেই থেমে থাকে না। একদিন দেখা যায়, এদের কেউ কেউ কোনো একটি বড় রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে বনে যান সংসদ সদস্য অথবা কোনো এক বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ববান কর্মকর্তা। এদের খপ্পরে পড়ে রাজনীতি হয় কলুষিত, সমাজে প্রতিপত্তি বাড়ে দুর্বৃত্তদের। এ ধরনের ছাত্ররাজনীতি আমি কেন, কোনো বিবেকবান মানুষ চাইতে পারেন না। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে, তবে তা কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় হিসেবে নয়। কোনো একটা রাজনৈতিক দলের আদর্শের প্রতি তাদের সমর্থন বা আনুগত্য থাকতে পারে, তবে কথায় কথায় তাদের সে রাজনৈতিক দলের বরকন্দাজ সাজার কোনো কারণ নেই। জাতির কোনো সংকট দেখা দিলে তখন তারা জনগণের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে নিশ্চয় সে সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে আর সাধারণ সময়ে তাদের মনোযোগী হওয়ার কথা পড়ালেখার ওপর এবং ছাত্ররাজনীতির কর্মক্ষেত্র হওয়া উচিত শিক্ষাবিষয়ক সমস্যাকেন্দ্রিক।
ছাত্ররাজনীতি সঠিক পথে চললে তারা জাতিকে উপহার দিতে পারে আগামী দিনের যোগ্য রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতৃত্ব। তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে খ্যাত তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক (বর্তমানে প্রয়াত), রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, মঈনুদ্দীন খান বাদল, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান সিরাজ, ওবায়দুল কাদের প্রমুখ ছাত্রজীবনে সুস্থ ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে ধরনের সুস্থ রাজনীতি বর্তমানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বাম ধারার ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে এখনো কিছু সুস্থ রাজনীতির ধারার প্রচলন আছে কিন্তু তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা খুব বেশি দূর যেতে পারে না। যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে প্রাণ হরণকারী ছাত্ররাজনীতির কারণে বন্ধ, সেই ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতি উপহার দিয়েছে কামরুন নাহার লাইলি, মাঈনুদ্দিন হাসান, মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. হাসান মাহমুদ, হান্নানা বেগম, শামসুজ্জামান হিরা, এস এম ফজলুল হক, মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বা মাজহারুল হক শাহ্র মতো ছাত্রনেতা। পরবর্তী জীবনে এঁরা অনেকেই আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেননি, তবে প্রায় সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। এঁরা এই ক্যাম্পাসকে নিয়ে এখনো গর্ব করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৪ বছরে ১৭ জন প্রতিভাবান শিক্ষার্থী ছাত্র নামধারী কিছু সন্ত্রাসীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
যেমনটি বলেছিলাম, এর ফলে ১৭টি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা লেখাপড়া করতে আসেন, তাঁদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। যারা ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তারাও ভিন্ন কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত যা হয় তা হলো, এই ঘাতকদের পরিচয় হয় ভ্রাতৃহত্যাকারী হিসেবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সম্মানিত উপাচার্যকে ১৯৯১ সালে একটি ছাত্রসংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী ১২ দিন তাঁর সরকারি বাসভবনে গ্যাস-পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সপরিবারে বন্দী করে রেখেছিল। যারা এই অপকর্মটি করেছিল, তাদের দু-একজনের সঙ্গে আমার পরবর্তী সময়ে দেখা হলে এ ব্যাপারে আলাপ করতে চাইলে তারা লজ্জিত হয়েছিল এবং আমাকে বলেছিল, স্যার, ওই প্রসঙ্গটি আমরা ভুলে যেতে চাই। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়েছিল একদল ছাত্র। এই হামলায় একজন নিরীহ ছাত্রের মৃত্যু হয়েছিল। শিক্ষকদের অপরাধ, তাঁরা একটি ছাত্রসংগঠনের ডাকা লাগাতার ধর্মঘট আহ্বান উপেক্ষা করে ক্লাসরুমে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। সেই হামলায় আমিসহ আমার অনেক সহকর্মী আহত হয়েছিলেন। হামলাকারীদের দু-একজন পরবর্তী সময়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিলেন। আমার ওপর হামলাকারীদের একজনকে তাঁর পদোন্নতির সাক্ষাৎকারে বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে তিনি মুখ নিচু করে পুরো ঘটনার জন্য লজ্জিত হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁর পদোন্নতি আটকায়নি। কারণ, তিনি ওই পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করেছিলেন।
আগামী ৩ এপ্রিল মুসলিম বিশ্বের একজন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. তুন মাহাথির মোহাম্মদকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করে আনা হয়েছিল। এ-ও প্রত্যাশা করা হয়েছিল এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা আপাতত স্থগিত করতে হলো। কারণ, এখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই শিক্ষাঙ্গনকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। শেষ মুহূর্তে এই বিশেষ সমাবর্তন স্থগিত করাতে নিশ্চয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির কিছুটা হলেও ক্ষতি হয়েছে এবং সেই ক্ষতির আঁচড় বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার গায়ে কম-বেশি লেগেছে। তবে এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্ষুদ্র মহল আছে যারা সব সময় ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। তাঁরা হয়তো মনে করবেন ক্ষতি যদি হয়েই থাকে, তাহলে তা উপাচার্য মহোদয়ের হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ উপাচার্য নয়। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। আজ একজন আছেন কাল অন্যজন আসবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্থায়ী সত্তা। এই ক্ষুদ্র মহল, যাঁরা কয়েমি স্বার্থান্বেষী মহল হিসেবে পরিচিত, তাঁরা মনে করতে পারেন তাঁদের কেউ হয়তো চিনবে না, পরিচয় জানবে না। ধারণাটা একেবারেই ভ্রান্ত। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের বোকা ভাবা ভুল। তার সব জানে এবং বোঝে। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাদের ধারণা আমার চেয়েও অনেক পরিষ্কার। রোটি নামে ১৯৭৪ সালের একটি হিন্দি সিনেমার একটি গান আছে, যার প্রথম লাইনটি হচ্ছে ‘ইয়ে পাবলিক হ্যায় ইয়ে সাব জানতি হ্যায়’ (এরা পাবলিক, এরা সবকিছু জানে)। সুতরাং জনগণ থেকে কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা না করাই ভালো।
আমার চার দশকের শিক্ষকতা জীবনে একটি বিষয় আমাকে সব সময় ব্যথিত করেছে আর তা হচ্ছে, কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাবধারায় বিশ্বাসী কতিপয় শিক্ষক বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের অহেতুক কুমন্ত্রণা বা পরামর্শ দিয়ে বিপথগামী করেন। তাঁরা বুঝতে পারেন না এতে তাঁরা ছাত্রদের লাভের চেয়ে ক্ষতির কারণ হন এবং পরবর্তী সময়ে এই ছাত্রনেতারা তাঁদের বশংবদ হয়ে পড়েন এবং পরবর্তী সময়ে এই শিক্ষকেরাই তাঁদের নিজেদের নানা হীন স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করেন। এসব কু-অভ্যাস বন্ধ না করলে কখনো কোনো ক্যাম্পাসে সুস্থ ছাত্ররাজনীতি ফিরে আসবে না, ক্যাম্পাস জ্ঞানচর্চার জায়গা হবে না। একজন শিক্ষকের কাছে সব ছাত্রই সমান। কে কোন মতাদর্শে বিশ্বাস করে, সেটি তার নিজস্ব ব্যাপার। তার মেধা ও বিচার বুদ্ধি দিয়ে তাকে সামনের দিকে পথ চলতে দেওয়া উচিত।
হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রমের অনেক ক্ষতি সাধনের পর ১৮ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসসমূহ চালু হওয়ার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে ৮ তারিখের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সিন্ডিকেট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আশা করা যায়, তারা এই তদন্তকার্য দ্রুততম সময়ে শেষ করে দোষীদের শনাক্ত করতে সক্ষম হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ তার শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষার্থীদের সহায়তা ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই সুষ্ঠুভাবে তার পঠন-পাঠনের কাজ চালু রাখতে পারে না। সুতরাং, একজন শিক্ষক হিসেবে এই আবেদন তো করতে পারি যে সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয়টাকে আবার সুষ্ঠুভাবে চলতে দিন। শেষ পর্যন্ত লাভ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারেরই। অস্ত্র নয়, জ্ঞানের আধার হোক সব বিশ্ববিদ্যালয়। সব শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কামনা করি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার অনেক প্রাক্তন ছাত্র, অভিভাবক, আমার লেখার পাঠক, আমার কঠোর সমালোচক এবং অনেক সহকর্মী বন্ধু প্রায়ই আমাকে প্রশ্ন করেন, শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা উচিত কি না? তাঁদের আমি পরিষ্কার ভাষায় বলি, বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে যা চলছে, তাকে কোনো অবস্থাতেই ছাত্ররাজনীতি বলা যাবে না। এটা কোনো বিবেকবান মানুষ সমর্থন করতে পারে না। এগুলো স্রেফ মতলববাজি, আধিপত্য বিস্তারই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। যারা এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকে, তারা কদাচিৎ শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করে। বইপুস্তকের সঙ্গে সম্পর্কহীন এসব তথাকথিত ছাত্রনেতার সঙ্গে বাস বা লঞ্চ টার্মিনাল দখলকারীদের কোনো তফাত দেখি না। এদের কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। বেশির ভাগেরই নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেই কোনো যোগ্যতা, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হতে গেলেও হিমশিম খেতে হবে। ঘটনা এখানেই থেমে থাকে না। একদিন দেখা যায়, এদের কেউ কেউ কোনো একটি বড় রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে বনে যান সংসদ সদস্য অথবা কোনো এক বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ববান কর্মকর্তা। এদের খপ্পরে পড়ে রাজনীতি হয় কলুষিত, সমাজে প্রতিপত্তি বাড়ে দুর্বৃত্তদের। এ ধরনের ছাত্ররাজনীতি আমি কেন, কোনো বিবেকবান মানুষ চাইতে পারেন না। ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকবে, তবে তা কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড় হিসেবে নয়। কোনো একটা রাজনৈতিক দলের আদর্শের প্রতি তাদের সমর্থন বা আনুগত্য থাকতে পারে, তবে কথায় কথায় তাদের সে রাজনৈতিক দলের বরকন্দাজ সাজার কোনো কারণ নেই। জাতির কোনো সংকট দেখা দিলে তখন তারা জনগণের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে নিশ্চয় সে সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে আর সাধারণ সময়ে তাদের মনোযোগী হওয়ার কথা পড়ালেখার ওপর এবং ছাত্ররাজনীতির কর্মক্ষেত্র হওয়া উচিত শিক্ষাবিষয়ক সমস্যাকেন্দ্রিক।
ছাত্ররাজনীতি সঠিক পথে চললে তারা জাতিকে উপহার দিতে পারে আগামী দিনের যোগ্য রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতৃত্ব। তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে খ্যাত তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক (বর্তমানে প্রয়াত), রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, মঈনুদ্দীন খান বাদল, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান সিরাজ, ওবায়দুল কাদের প্রমুখ ছাত্রজীবনে সুস্থ ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সে ধরনের সুস্থ রাজনীতি বর্তমানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বাম ধারার ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে এখনো কিছু সুস্থ রাজনীতির ধারার প্রচলন আছে কিন্তু তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা খুব বেশি দূর যেতে পারে না। যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে প্রাণ হরণকারী ছাত্ররাজনীতির কারণে বন্ধ, সেই ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতি উপহার দিয়েছে কামরুন নাহার লাইলি, মাঈনুদ্দিন হাসান, মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. হাসান মাহমুদ, হান্নানা বেগম, শামসুজ্জামান হিরা, এস এম ফজলুল হক, মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বা মাজহারুল হক শাহ্র মতো ছাত্রনেতা। পরবর্তী জীবনে এঁরা অনেকেই আর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেননি, তবে প্রায় সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। এঁরা এই ক্যাম্পাসকে নিয়ে এখনো গর্ব করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৪ বছরে ১৭ জন প্রতিভাবান শিক্ষার্থী ছাত্র নামধারী কিছু সন্ত্রাসীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
যেমনটি বলেছিলাম, এর ফলে ১৭টি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা লেখাপড়া করতে আসেন, তাঁদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। যারা ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তারাও ভিন্ন কিছু নয়। শেষ পর্যন্ত যা হয় তা হলো, এই ঘাতকদের পরিচয় হয় ভ্রাতৃহত্যাকারী হিসেবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সম্মানিত উপাচার্যকে ১৯৯১ সালে একটি ছাত্রসংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী ১২ দিন তাঁর সরকারি বাসভবনে গ্যাস-পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সপরিবারে বন্দী করে রেখেছিল। যারা এই অপকর্মটি করেছিল, তাদের দু-একজনের সঙ্গে আমার পরবর্তী সময়ে দেখা হলে এ ব্যাপারে আলাপ করতে চাইলে তারা লজ্জিত হয়েছিল এবং আমাকে বলেছিল, স্যার, ওই প্রসঙ্গটি আমরা ভুলে যেতে চাই। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়েছিল একদল ছাত্র। এই হামলায় একজন নিরীহ ছাত্রের মৃত্যু হয়েছিল। শিক্ষকদের অপরাধ, তাঁরা একটি ছাত্রসংগঠনের ডাকা লাগাতার ধর্মঘট আহ্বান উপেক্ষা করে ক্লাসরুমে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। সেই হামলায় আমিসহ আমার অনেক সহকর্মী আহত হয়েছিলেন। হামলাকারীদের দু-একজন পরবর্তী সময়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিলেন। আমার ওপর হামলাকারীদের একজনকে তাঁর পদোন্নতির সাক্ষাৎকারে বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে তিনি মুখ নিচু করে পুরো ঘটনার জন্য লজ্জিত হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁর পদোন্নতি আটকায়নি। কারণ, তিনি ওই পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করেছিলেন।
আগামী ৩ এপ্রিল মুসলিম বিশ্বের একজন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. তুন মাহাথির মোহাম্মদকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করে আনা হয়েছিল। এ-ও প্রত্যাশা করা হয়েছিল এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তা আপাতত স্থগিত করতে হলো। কারণ, এখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই শিক্ষাঙ্গনকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। শেষ মুহূর্তে এই বিশেষ সমাবর্তন স্থগিত করাতে নিশ্চয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির কিছুটা হলেও ক্ষতি হয়েছে এবং সেই ক্ষতির আঁচড় বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার গায়ে কম-বেশি লেগেছে। তবে এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্ষুদ্র মহল আছে যারা সব সময় ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। তাঁরা হয়তো মনে করবেন ক্ষতি যদি হয়েই থাকে, তাহলে তা উপাচার্য মহোদয়ের হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ উপাচার্য নয়। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। আজ একজন আছেন কাল অন্যজন আসবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্থায়ী সত্তা। এই ক্ষুদ্র মহল, যাঁরা কয়েমি স্বার্থান্বেষী মহল হিসেবে পরিচিত, তাঁরা মনে করতে পারেন তাঁদের কেউ হয়তো চিনবে না, পরিচয় জানবে না। ধারণাটা একেবারেই ভ্রান্ত। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের বোকা ভাবা ভুল। তার সব জানে এবং বোঝে। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাদের ধারণা আমার চেয়েও অনেক পরিষ্কার। রোটি নামে ১৯৭৪ সালের একটি হিন্দি সিনেমার একটি গান আছে, যার প্রথম লাইনটি হচ্ছে ‘ইয়ে পাবলিক হ্যায় ইয়ে সাব জানতি হ্যায়’ (এরা পাবলিক, এরা সবকিছু জানে)। সুতরাং জনগণ থেকে কোনো কিছু লুকানোর চেষ্টা না করাই ভালো।
আমার চার দশকের শিক্ষকতা জীবনে একটি বিষয় আমাকে সব সময় ব্যথিত করেছে আর তা হচ্ছে, কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ভাবধারায় বিশ্বাসী কতিপয় শিক্ষক বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের অহেতুক কুমন্ত্রণা বা পরামর্শ দিয়ে বিপথগামী করেন। তাঁরা বুঝতে পারেন না এতে তাঁরা ছাত্রদের লাভের চেয়ে ক্ষতির কারণ হন এবং পরবর্তী সময়ে এই ছাত্রনেতারা তাঁদের বশংবদ হয়ে পড়েন এবং পরবর্তী সময়ে এই শিক্ষকেরাই তাঁদের নিজেদের নানা হীন স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করেন। এসব কু-অভ্যাস বন্ধ না করলে কখনো কোনো ক্যাম্পাসে সুস্থ ছাত্ররাজনীতি ফিরে আসবে না, ক্যাম্পাস জ্ঞানচর্চার জায়গা হবে না। একজন শিক্ষকের কাছে সব ছাত্রই সমান। কে কোন মতাদর্শে বিশ্বাস করে, সেটি তার নিজস্ব ব্যাপার। তার মেধা ও বিচার বুদ্ধি দিয়ে তাকে সামনের দিকে পথ চলতে দেওয়া উচিত।
হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রমের অনেক ক্ষতি সাধনের পর ১৮ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসসমূহ চালু হওয়ার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে ৮ তারিখের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সিন্ডিকেট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আশা করা যায়, তারা এই তদন্তকার্য দ্রুততম সময়ে শেষ করে দোষীদের শনাক্ত করতে সক্ষম হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ তার শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষার্থীদের সহায়তা ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই সুষ্ঠুভাবে তার পঠন-পাঠনের কাজ চালু রাখতে পারে না। সুতরাং, একজন শিক্ষক হিসেবে এই আবেদন তো করতে পারি যে সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয়টাকে আবার সুষ্ঠুভাবে চলতে দিন। শেষ পর্যন্ত লাভ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারেরই। অস্ত্র নয়, জ্ঞানের আধার হোক সব বিশ্ববিদ্যালয়। সব শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কামনা করি।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments