গোধূলির ছায়াপথে-যদি লেখার টেবিল পেতাম by মুস্তাফা জামান আব্বাসী
চেষ্টা করছি প্রথম আলো অথবা অন্য কোনো অফিসে একটি আলোকসজ্জিত টেবিলের, যেখানে রাজ্যের খবরের কাগজ উপস্থিত, মাঝেমধ্যে চা-কফি। প্রথম আলো ছাড়াও পড়তাম ঢাকায় ছাপা আরও নিরানব্বইটি পত্রিকা ও রোজই লিখতাম মনের আনন্দে, যা কিছু মনে আসে।
যা লিখব তা হবে না পড়ার মতো, হবে পড়ে ফেলে দেওয়ার মতো। লিখতাম ও ছাপা হতো।
কলামিস্ট হিসেবে নাম করেছেন এমন দু-একজনের সঙ্গে আমার পরিচয়। বিয়েবাড়ির টেবিলে একসঙ্গে খেতে বসেছি। কলামিস্ট বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হয়, কারণ কলাম লেখার দিন।’ জিজ্ঞেস করলাম, কী নিয়ে লিখবেন? বললেন, ‘সেটাই ভাবছি, এক্ষুনি আইডিয়া মাথায় এল যে কলামিস্ট না থাকলে এই পৃথিবীর কী হবে।’ বললাম, আর্টিকেলটা আমার পড়া খুব প্রয়োজন। দিন সাতেক অপেক্ষা, এ রকম কোনো লেখা ছাপা হয়নি। ভাবলাম, এটিকে আমার জন্যই রাখা হয়েছে।
কলামিস্ট আছে, তাই পত্রিকা চলছে—লেখকদের ধারণা। এক শ লোকের সঙ্গে আলাপ করে পেয়েছি ভিন্ন ভিন্ন মত। বাড়ির গিন্নি বলছেন, সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয়র ধার দিয়েও যাননি। এক কুড়ি মন্ত্রী বলেছেন, ওটি পড়েন পিআরও। যেখানে প্রশংসাবাক্য উচ্চারিত, কেটেকুটে সাফ করে ‘স্ক্র্যাপবুক’ হাজির করা হয়। ছাত্রছাত্রীদের কাছে জানলাম, তারা খোঁজ করেন স্পোর্টস ও তারুণ্য। শিল্পীরা বলছেন, তাঁরা পড়েন টিভি পেজ ও খোঁজেন নিজের ছবি, সঙ্গে মডেলদের ছবি। গিন্নিরা রান্নার খবর, সাহিত্যিকেরা সাহিত্যের খুঁটিনাটি। তাহলে চব্বিশ পাতার পত্রিকাটি কে পড়বে? কেন, ট্রেনে যাঁরা সফর করেন, বিজ্ঞাপনসমেত কয়েকবার পড়বেন অথবা পড়তে বাধ্য হবেন। আর পড়বেন পড়ুয়ারা, পত্রিকাটির অভাব যেখানে। একটি পত্রিকা পড়ছেন এক শ লোক। সন্ধেবেলায় পত্রিকাটির দিকে আর তাকানো যায় না।
টেবিল ছাড়া লেখা কষ্টসাধ্য। টেবিলের খোঁজ করছি, যেখানে পাশাপাশি কয়েকজন প্রতিযোগিতার স্টাইলে লিখে চলেছেন। সাহিত্যিক আনিসুল হককে জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা ভালো—সাংবাদিকতা, না সাহিত্য? বললেন, ‘শুধু সাহিত্যিককে খেতে দেবে কে? সাংবাদিক বলেই লেখার সুযোগ পাই।’
কাজী নজরুল থেকে আবুল মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, রাহাত খান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, আল মুজাহিদী টেবিল পেয়েছিলেন বলেই সাহিত্যের সুনীল গগনে ডানা মেলতে পেরেছিলেন। সাংবাদিকতাই সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অনেক দিন আগে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অফিসে গিয়ে বসেছি। না চাইতেই চা পেলাম, আর উনি না চাইতেই পেলেন আমার কবিতা। বললেন, ‘আমি কবিতা বুঝি না, তবে তোমার কবিতা আমার মন ছুঁয়ে গেছে।’ পরের দিনই সংবাদ-এ কবিতাটি ছাপা হলো। উনি বললেন, ‘যদি সাংবাদিক না হতাম, তাহলে উঁচুদরের সাহিত্যিক হতাম।’ কথাটি মাঝেমধ্যে মনে হয়।
তরিকুল আলম নামের আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু এক ঘণ্টায় কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলতে পারতেন এবং তা নানা পত্রিকায় অনবরত ছাপা হতো। একদিন তাঁকে বললাম, শামসুর রাহমানের তিন-চারটি বই বেরিয়েছে, আপনার একটিও নয়। কারণ কী? বললেন, ‘যে সাদা কাগজে লিখেছি, সেইটি খবরের কাগজে পৌঁছে দিয়েছি, কপি রাখিনি। তাই আমার বই কোনো দিন বেরোবে না।’
হঠাৎ মনে পড়ল কাজী নজরুলের কথা। তিনি তাঁর লেখার কপি সচরাচর রাখতেন না। অনুরাগী বন্ধুরা না থাকলে তাঁর কবিতাও খুঁজে পাওয়া যেত কি না, সন্দেহ। গানের ক্ষেত্রেও তাই, মাত্র তিন হাজার গান খুঁজে পাওয়া গেছে। নজরুল বলতেন, ‘সমুদ্রের ঢেউয়ের যেমন গণনা হয় না, তেমনি আমার কবিতা ও গানের গণনা করতে যেয়ো না।’ ১০টি বছর তাঁর সাহিত্যকর্মের বয়স, সুস্থ থাকলে সমুদ্রসম হতো বৈকি। কয়েক দিন আগে এবিএম মূসার ‘আরও ভালো নয়, আরও মন্দ চাই না’ কলামটি কয়েকবার পড়লাম। যদি আমিই হতাম কলামে বর্ণিত প্রাপক, প্রতিটি কথা মান্য করতাম। মূসা ভাইকে চিনি দীর্ঘকাল। গোধূলি অপরাহ্নে তাঁর নেই কোনো চাওয়া-পাওয়া, সাংবাদিকতার টেবিলটিও নেই। পুরোনো অভ্যাসে দিকনির্দেশনার মন্ত্রটি তাঁর জানা। তাঁর অফিসে অনেক দিন গিয়ে তাঁকে কলাম লিখতে দেখেছি। তখন বুঝিনি, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা একজন সম্পাদককে কত উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
একদিন মেইল-এর সম্পাদক আজিজুর রহমানের সঙ্গে ইত্তেফাক অফিসে গিয়ে হাজির। যিনি উবু হয়ে কলাম লিখছিলেন, তিনিই যে ‘মুসাফির’, তা জানব কেমন করে। অজস্র পান খাচ্ছেন, আর চা। ডিক্টেট করছেন পরের দিনের ‘মুসাফির’। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, যাঁর আর কোনো দ্বিতীয় নেই।
মূসা ভাই নির্ভয়, তাই বলতে পেরেছেন অনেক কথা, যা বলার সময়ের আগে কেউ বলতে সাহস পান না। লিখছেন, ‘আপনার খালু-কামালু হাজারো কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে, সিঙ্গাপুর জুরিখে তাদের ব্যাংকের হিসাবের খোঁজ হয় না। আমরা আরও মন্দ চাই না।’
মূসা ভাইকে বলি, হয়তো আজ আপনার টেবিল নেই, তাই টেবিল চাপড়িয়ে কথা বলতে পারছেন না। জেনে রাখবেন, আপনাদের সম্মিলিত মেধায় দেশের মানুষ সঠিক নির্দেশনা পেয়ে যাচ্ছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। সম্পাদকদের মন্তব্য দেশবাসী গভীর মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেন। দেশের নানা সমস্যা নানা দিক দিয়ে পরিমাপ করে তাঁরা যে মন্তব্য দেন, তা ফেলে দেওয়ার নয়। আপনারা আছেন বলেই প্রগতির সারথি দেশ।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য ও সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
কলামিস্ট হিসেবে নাম করেছেন এমন দু-একজনের সঙ্গে আমার পরিচয়। বিয়েবাড়ির টেবিলে একসঙ্গে খেতে বসেছি। কলামিস্ট বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হয়, কারণ কলাম লেখার দিন।’ জিজ্ঞেস করলাম, কী নিয়ে লিখবেন? বললেন, ‘সেটাই ভাবছি, এক্ষুনি আইডিয়া মাথায় এল যে কলামিস্ট না থাকলে এই পৃথিবীর কী হবে।’ বললাম, আর্টিকেলটা আমার পড়া খুব প্রয়োজন। দিন সাতেক অপেক্ষা, এ রকম কোনো লেখা ছাপা হয়নি। ভাবলাম, এটিকে আমার জন্যই রাখা হয়েছে।
কলামিস্ট আছে, তাই পত্রিকা চলছে—লেখকদের ধারণা। এক শ লোকের সঙ্গে আলাপ করে পেয়েছি ভিন্ন ভিন্ন মত। বাড়ির গিন্নি বলছেন, সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয়র ধার দিয়েও যাননি। এক কুড়ি মন্ত্রী বলেছেন, ওটি পড়েন পিআরও। যেখানে প্রশংসাবাক্য উচ্চারিত, কেটেকুটে সাফ করে ‘স্ক্র্যাপবুক’ হাজির করা হয়। ছাত্রছাত্রীদের কাছে জানলাম, তারা খোঁজ করেন স্পোর্টস ও তারুণ্য। শিল্পীরা বলছেন, তাঁরা পড়েন টিভি পেজ ও খোঁজেন নিজের ছবি, সঙ্গে মডেলদের ছবি। গিন্নিরা রান্নার খবর, সাহিত্যিকেরা সাহিত্যের খুঁটিনাটি। তাহলে চব্বিশ পাতার পত্রিকাটি কে পড়বে? কেন, ট্রেনে যাঁরা সফর করেন, বিজ্ঞাপনসমেত কয়েকবার পড়বেন অথবা পড়তে বাধ্য হবেন। আর পড়বেন পড়ুয়ারা, পত্রিকাটির অভাব যেখানে। একটি পত্রিকা পড়ছেন এক শ লোক। সন্ধেবেলায় পত্রিকাটির দিকে আর তাকানো যায় না।
টেবিল ছাড়া লেখা কষ্টসাধ্য। টেবিলের খোঁজ করছি, যেখানে পাশাপাশি কয়েকজন প্রতিযোগিতার স্টাইলে লিখে চলেছেন। সাহিত্যিক আনিসুল হককে জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা ভালো—সাংবাদিকতা, না সাহিত্য? বললেন, ‘শুধু সাহিত্যিককে খেতে দেবে কে? সাংবাদিক বলেই লেখার সুযোগ পাই।’
কাজী নজরুল থেকে আবুল মনসুর আহমেদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, রাহাত খান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, আল মুজাহিদী টেবিল পেয়েছিলেন বলেই সাহিত্যের সুনীল গগনে ডানা মেলতে পেরেছিলেন। সাংবাদিকতাই সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অনেক দিন আগে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অফিসে গিয়ে বসেছি। না চাইতেই চা পেলাম, আর উনি না চাইতেই পেলেন আমার কবিতা। বললেন, ‘আমি কবিতা বুঝি না, তবে তোমার কবিতা আমার মন ছুঁয়ে গেছে।’ পরের দিনই সংবাদ-এ কবিতাটি ছাপা হলো। উনি বললেন, ‘যদি সাংবাদিক না হতাম, তাহলে উঁচুদরের সাহিত্যিক হতাম।’ কথাটি মাঝেমধ্যে মনে হয়।
তরিকুল আলম নামের আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু এক ঘণ্টায় কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলতে পারতেন এবং তা নানা পত্রিকায় অনবরত ছাপা হতো। একদিন তাঁকে বললাম, শামসুর রাহমানের তিন-চারটি বই বেরিয়েছে, আপনার একটিও নয়। কারণ কী? বললেন, ‘যে সাদা কাগজে লিখেছি, সেইটি খবরের কাগজে পৌঁছে দিয়েছি, কপি রাখিনি। তাই আমার বই কোনো দিন বেরোবে না।’
হঠাৎ মনে পড়ল কাজী নজরুলের কথা। তিনি তাঁর লেখার কপি সচরাচর রাখতেন না। অনুরাগী বন্ধুরা না থাকলে তাঁর কবিতাও খুঁজে পাওয়া যেত কি না, সন্দেহ। গানের ক্ষেত্রেও তাই, মাত্র তিন হাজার গান খুঁজে পাওয়া গেছে। নজরুল বলতেন, ‘সমুদ্রের ঢেউয়ের যেমন গণনা হয় না, তেমনি আমার কবিতা ও গানের গণনা করতে যেয়ো না।’ ১০টি বছর তাঁর সাহিত্যকর্মের বয়স, সুস্থ থাকলে সমুদ্রসম হতো বৈকি। কয়েক দিন আগে এবিএম মূসার ‘আরও ভালো নয়, আরও মন্দ চাই না’ কলামটি কয়েকবার পড়লাম। যদি আমিই হতাম কলামে বর্ণিত প্রাপক, প্রতিটি কথা মান্য করতাম। মূসা ভাইকে চিনি দীর্ঘকাল। গোধূলি অপরাহ্নে তাঁর নেই কোনো চাওয়া-পাওয়া, সাংবাদিকতার টেবিলটিও নেই। পুরোনো অভ্যাসে দিকনির্দেশনার মন্ত্রটি তাঁর জানা। তাঁর অফিসে অনেক দিন গিয়ে তাঁকে কলাম লিখতে দেখেছি। তখন বুঝিনি, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা একজন সম্পাদককে কত উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।
একদিন মেইল-এর সম্পাদক আজিজুর রহমানের সঙ্গে ইত্তেফাক অফিসে গিয়ে হাজির। যিনি উবু হয়ে কলাম লিখছিলেন, তিনিই যে ‘মুসাফির’, তা জানব কেমন করে। অজস্র পান খাচ্ছেন, আর চা। ডিক্টেট করছেন পরের দিনের ‘মুসাফির’। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, যাঁর আর কোনো দ্বিতীয় নেই।
মূসা ভাই নির্ভয়, তাই বলতে পেরেছেন অনেক কথা, যা বলার সময়ের আগে কেউ বলতে সাহস পান না। লিখছেন, ‘আপনার খালু-কামালু হাজারো কোটি টাকা শেয়ারবাজার থেকে তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে, সিঙ্গাপুর জুরিখে তাদের ব্যাংকের হিসাবের খোঁজ হয় না। আমরা আরও মন্দ চাই না।’
মূসা ভাইকে বলি, হয়তো আজ আপনার টেবিল নেই, তাই টেবিল চাপড়িয়ে কথা বলতে পারছেন না। জেনে রাখবেন, আপনাদের সম্মিলিত মেধায় দেশের মানুষ সঠিক নির্দেশনা পেয়ে যাচ্ছেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। সম্পাদকদের মন্তব্য দেশবাসী গভীর মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করেন। দেশের নানা সমস্যা নানা দিক দিয়ে পরিমাপ করে তাঁরা যে মন্তব্য দেন, তা ফেলে দেওয়ার নয়। আপনারা আছেন বলেই প্রগতির সারথি দেশ।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য ও সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net
No comments