সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-এ কিসের অশনিসংকেত by কামাল লোহানী
এত সব কথা বলার পেছনে যুক্তি হলো, মহাজোটকে চোখ মেলে দেখতে বলা। এই তো কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে মমতার নির্বাচনে টাকার খেলা দেখলাম না? যে মমতা বাংলাদেশপ্রীতিতে গদগদ ছিলেন, এমন কী হলো যে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তিস্তামুখ, ফারাক্কা ইত্যাদির জল বণ্টন নিয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন কার স্বার্থে? যাদের টাকায় বা
মদদে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাতের অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছিলেন তিনি কি তাই ঋণ পরিশোধ করতে চেষ্টা করছেন এই বৈরী মনোভাব দেখিয়ে? মার্কিনিদের চোরকে চুরি করতে আর গেরস্তকে সজাগ থাকতে বলার মতো দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ যত্রতত্রই দেখতে পাই। এও একটি নিদর্শন। তাই আমাদেরও সতর্ক হওয়ার সময় এখন। মার্কিননীতি এবং বিশ্বব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে দেশকে দাসানুদাসে পরিণত করতে চাওয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাজউদ্দীন বুঝতে পেরেছিলেন বলেই বিশ্বব্যাংক বা মার্কিনিদের প্রশ্রয়
দিতে রাজি হননি
শ্বেতাঙ্গ মার্কিন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক কৃষ্ণাঙ্গের হোয়াইট হাউসে প্রবেশ ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। আনন্দে উদ্বেল কৃষ্ণাঙ্গ সমর্থকরা ভেবেছিলেন, শ্বেতাঙ্গদের এত বছরের ঋদ্ধশাসন ব্যবস্থাকে ভেঙে কিছু পরিবর্তন আনবেন বা আনার চেষ্টা করবেন নতুন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কিন্তু এ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেই আসুন না কেন, তাকে ওই শ্বেতাঙ্গদের হুকুম তামিল করতেই হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদ ও শিল্পপতি ধনকুবেরাই। তাই প্রচলিত ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসাটা আমার ধারণা কারও পক্ষে সম্ভব নয়, যতক্ষণ ওই ব্যবস্থাকেই পাল্টে না দেওয়া যাচ্ছে।
আমেরিকার পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠী উত্তরাঞ্চলকে নিজেদের খুশিমাফিক শাসন করে যাচ্ছে। আর দক্ষিণাঞ্চলকে মদদ দিয়ে গণবিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে শোষণ করে যাচ্ছে। তাই ক্ষুব্ধ মানুষের গণবিস্ফোরণ সেই পুতুল সরকারকে পাল্টে জনগণের নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছে। এ পরিবর্তনের নেতা কিউবা। তাই তো দেখি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে কিউবা এমন আদর্শকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছে, যার কারণে আজ মানুষই তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে প্রবল উৎসাহী ও সাহসী হয়ে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু মার্কিন শাসকচক্র এই গণঅভিযান এবং প্রতিষ্ঠিত বিজয়াভিযানকে সহ্য করতে পারছে না। কারণ এতে করে যে মার্কিনি শাসকগোষ্ঠীর প্রভুত্ব ও দাপট কমে যাচ্ছে। এসব দেশ যেন সুখে থাকতে না পারে, যথার্থ রাষ্ট্র পরিচালনা কাঠামো গড়ে তুলতে না পারে, তার জন্য নানা ধরনের চক্রান্ত ফেঁদে ওদের মতো গণঅভ্যুত্থানকে প্রতিহত করতে নানা জাল বিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সচেতন জনগণের সমর্থনে এসব চক্রান্ত সফল হতে পারছে না। ফলে পুঁজিবাদী নেতৃত্ব এবং সাম্রাজ্যলোভী ক্ষমতা হিংস্র হয়ে উঠেছে কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, ভেনিজুয়েলার হুগো শাভেজ, বলিভিয়ার ইভা মোরালেস কিংবা নিকারাগুয়ার সব নেতার ওপর। কাস্ত্রোকে হত্যায় কত যে পরিকল্পনা করেছে মার্কিনিরা নানা উপায়ে, তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু কিউবার প্রতিটি মানুষ দেশের অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি কিউবার প্রধান কৃষিপণ্য আখের ক্ষেত যেন দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাই তো জনগণ বলে একেকটি ইক্ষুগাছ যেন একেকটি আগ্নেয়াস্ত্র হয়ে সম্ভাব্য শত্রুকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার লক্ষ্যে তাক করে আছে। তেমনি করেই অন্য রাজ্যগুলোর এমন পরিবর্তনে মার্কিনি প্রশাসন তাদের কর্তৃত্ব হারিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভে দিশেহারা। তার মধ্যে পৃথিবীর বহু দেশ অত্যাচারিত হয়ে আজ মার্কিনবিরোধী ভূমিকা নিয়ে যুদ্ধবাজ ও মারণাস্ত্রের গোলাঘর আমেরিকাকে তোয়াক্কা না করার শক্তি অর্জন করছে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পর যে আমেরিকা দুনিয়াটাকে কব্জা করে ফেলছিল, প্রভুত্ব বিস্তারে যখন বাধা হয়ে জনগণের শক্তির উত্থান ঘটছে তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রবল শক্তির আঁতে ঘা লাগছে। ফলে তারা মারমুখী হয়ে উঠছে। তাই তো দেখছি জনগণতান্ত্রিক কোরিয়া কিংবা জাতীয়তাবাদী ইরান যখন আত্মনির্ভর হতে চাইছে, তখনও ক্ষুব্ধ আমেরিকা তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিচ্ছে। এই তো গত ২ মার্চ একটি সাময়িকীতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বারাক ওবামা বলেছেন গর্বোদ্ধত উচ্চারণে, 'আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, আমি ধোঁকা দেওয়ার জন্য কোনো কথা বলি না।' এই বলে ইরানকে হামলা করার একেবারে সরাসরি হুমকি দিয়েছে। ওবামা সাহেব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন 'আটলান্টিক' সাময়িকীতে। সেখানে ইরানকে হুমকি দিয়েছেন বলে খবর ছেপে কাগজটি বলেছে, 'সব বিকল্পই টেবিলে আছে' এটাও ওবামা বলেছেন। অন্যদিকে ইসরায়েল তো বিশ্বের দুষ্টগ্রহ। তার প্রধানমন্ত্রী কট্টরপন্থি নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন ওবামা। নেতানিয়াহু আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদনকারীদের সঙ্গেই চলেন। আমেরিকা আর ইসরায়েলের এমন আগ্রাসী মানসিকতা তো অতীতেও লক্ষ্য করেছি। এমনকি '৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বিভ্রান্ত ও বেপথু করার ঘৃণ্য উদ্দেশ্য নিয়ে আমেরিকা সরাসরি নৌবহর মোতায়েন করে আমাদের ভয় দেখিয়ে কাবু করতে চেয়েছিল এবং ইসরায়েলকে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করার কম চেষ্টা করেনি! কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসী তাজউদ্দীন আহমদ। ফলে সে ভয়ে কম্পিত হননি মুক্তিফৌজ বা তাদের নেতা তাজউদ্দীন।
আমরা তো দেখতে পাচ্ছি, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ও ইসরায়েল কী ভূমিকা পালন করে চলেছে। ঘৃণ্য এক মানববিধ্বংসী সৃষ্ট যুদ্ধে আমেরিকা কীভাবে সমৃদ্ধ ইরাক ও সাদ্দামকে উৎখাত করে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অমূল্য নিদর্শনগুলো লুটে নিয়ে গেল। গণহত্যা চালান মিত্রদের সৈন্যবাহিনীকেও কাজে লাগিয়ে। দেশটিকে কীভাবে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত করে ছাড়ল। এত বছর পরও ইরাক আরও সোজা হয়ে, আত্মশক্তিকে নির্ভর করে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছে না। কী হলো লিবিয়ায়? স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্ব চলছিল চার দশক ধরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গাদ্দাফিকে কীভাবে হত্যা করা হলো। শুধু কি তাই, তার আত্মীয়-পরিজন-বন্ধুবান্ধব সবাইকে হত্যা করা হচ্ছে। সিরিয়াকে তো আমেরিকা সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিদ্রোহীদের অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এমন তো আরও অনেক দেশই রয়েছে, সেখানে হস্তক্ষেপ করে কী দারুণভাবে জনগণকে বিপদগ্রস্ত করছে।
একবারও তারা পরিণতি ভেবে দেখেনি। এখন তো লিবিয়ার জনগণ আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠছে ক্রমশ। সামনে আসছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওবামা দ্বিতীয় দফা আসার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। তার মধ্যে দেশে দেশে যুদ্ধ, আগ্রাসন, হামলা এবং এর মাধ্যমে নিজের সাফল্যকে পুঁজি করতে চাইবেন। বেশ তো ভালো কথা, তার জন্য মানুষ হত্যার এমন চক্রান্ত করে কি তিনি পার পাবেন?
এত সব কথা বলার পেছনে যুক্তি হলো, মহাজোটকে চোখ মেলে দেখতে বলা। এই তো কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে মমতার নির্বাচনে টাকার খেলা দেখলাম না? যে মমতা বাংলাদেশপ্রীতিতে গদগদ ছিলেন, এমন কী হলো যে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তিস্তামুখ, ফারাক্কা ইত্যাদির জল বণ্টন নিয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন কার স্বার্থে? যাদের টাকায় বা মদদে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাতের অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছিলেন তিনি কি তাই ঋণ পরিশোধ করতে চেষ্টা করছেন এই বৈরী মনোভাব দেখিয়ে? মার্কিনিদের চোরকে চুরি করতে আর গেরস্তকে সজাগ থাকতে বলার মতো দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ যত্রতত্রই দেখতে পাই। এও একটি নিদর্শন। তাই আমাদেরও সতর্ক হওয়ার সময় এখন। মার্কিননীতি এবং বিশ্বব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে দেশকে দাসানুদাসে পরিণত করতে চাওয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাজউদ্দীন বুঝতে পেরেছিলেন বলেই বিশ্বব্যাংক বা মার্কিনিদের প্রশ্রয় দিতে রাজি হননি। অবশ্য সে কারণে তাকে পদই হারাতে হয়েছিল, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া সত্ত্বেও।
মজার ব্যাপার, মার্কিন নৌ কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছেন_ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ এবং শ্রীলংকায় সন্ত্রাস দমনের জন্য বিশেষ মার্কিন বাহিনী রয়েছে। তিনি মার্কিন কংগ্রেস সশস্ত্রবাহিনীর কমিটিতে শুনানির সময় এ তথ্য জানিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেছেন, কোনো মার্কিন ঘাঁটি নেই। ঘাঁটির কথা কমান্ডার উইলার্ড বলেননি। প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে আসেন। কাগজে দেখলাম, সিলেটে এখন এমন একটি বাহিনী প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ৩০ জনকে। ... মজিনা সাহেব দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে এক সিদ্ধান্ত পেঁৗছানোর পরামর্শ দিয়েছেন। যিনি নিজের দেশের ভূমিকা সম্পর্কে সত্য উচ্চারণ করছেন না, তিনি আমাদের যে পরামর্শ দিচ্ছেন, তা কি কূটনৈতিক শিষ্টাচারে পড়ে? তাদের কি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতেই পাঠানো হয়? আর আমরা কি তাদের কথা শুনি? প্রশ্ন জাগছে মনে, না শুনলে বলার সাহসই পায় কেমন করে? পরাশক্তি বলে কথা!
কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
দিতে রাজি হননি
শ্বেতাঙ্গ মার্কিন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক কৃষ্ণাঙ্গের হোয়াইট হাউসে প্রবেশ ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। আনন্দে উদ্বেল কৃষ্ণাঙ্গ সমর্থকরা ভেবেছিলেন, শ্বেতাঙ্গদের এত বছরের ঋদ্ধশাসন ব্যবস্থাকে ভেঙে কিছু পরিবর্তন আনবেন বা আনার চেষ্টা করবেন নতুন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কিন্তু এ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেই আসুন না কেন, তাকে ওই শ্বেতাঙ্গদের হুকুম তামিল করতেই হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদ ও শিল্পপতি ধনকুবেরাই। তাই প্রচলিত ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসাটা আমার ধারণা কারও পক্ষে সম্ভব নয়, যতক্ষণ ওই ব্যবস্থাকেই পাল্টে না দেওয়া যাচ্ছে।
আমেরিকার পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠী উত্তরাঞ্চলকে নিজেদের খুশিমাফিক শাসন করে যাচ্ছে। আর দক্ষিণাঞ্চলকে মদদ দিয়ে গণবিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে শোষণ করে যাচ্ছে। তাই ক্ষুব্ধ মানুষের গণবিস্ফোরণ সেই পুতুল সরকারকে পাল্টে জনগণের নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়েছে। এ পরিবর্তনের নেতা কিউবা। তাই তো দেখি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে কিউবা এমন আদর্শকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছে, যার কারণে আজ মানুষই তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে প্রবল উৎসাহী ও সাহসী হয়ে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু মার্কিন শাসকচক্র এই গণঅভিযান এবং প্রতিষ্ঠিত বিজয়াভিযানকে সহ্য করতে পারছে না। কারণ এতে করে যে মার্কিনি শাসকগোষ্ঠীর প্রভুত্ব ও দাপট কমে যাচ্ছে। এসব দেশ যেন সুখে থাকতে না পারে, যথার্থ রাষ্ট্র পরিচালনা কাঠামো গড়ে তুলতে না পারে, তার জন্য নানা ধরনের চক্রান্ত ফেঁদে ওদের মতো গণঅভ্যুত্থানকে প্রতিহত করতে নানা জাল বিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সচেতন জনগণের সমর্থনে এসব চক্রান্ত সফল হতে পারছে না। ফলে পুঁজিবাদী নেতৃত্ব এবং সাম্রাজ্যলোভী ক্ষমতা হিংস্র হয়ে উঠেছে কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, ভেনিজুয়েলার হুগো শাভেজ, বলিভিয়ার ইভা মোরালেস কিংবা নিকারাগুয়ার সব নেতার ওপর। কাস্ত্রোকে হত্যায় কত যে পরিকল্পনা করেছে মার্কিনিরা নানা উপায়ে, তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু কিউবার প্রতিটি মানুষ দেশের অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। এমনকি কিউবার প্রধান কৃষিপণ্য আখের ক্ষেত যেন দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাই তো জনগণ বলে একেকটি ইক্ষুগাছ যেন একেকটি আগ্নেয়াস্ত্র হয়ে সম্ভাব্য শত্রুকে প্রতিরোধ ও প্রতিহত করার লক্ষ্যে তাক করে আছে। তেমনি করেই অন্য রাজ্যগুলোর এমন পরিবর্তনে মার্কিনি প্রশাসন তাদের কর্তৃত্ব হারিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভে দিশেহারা। তার মধ্যে পৃথিবীর বহু দেশ অত্যাচারিত হয়ে আজ মার্কিনবিরোধী ভূমিকা নিয়ে যুদ্ধবাজ ও মারণাস্ত্রের গোলাঘর আমেরিকাকে তোয়াক্কা না করার শক্তি অর্জন করছে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পর যে আমেরিকা দুনিয়াটাকে কব্জা করে ফেলছিল, প্রভুত্ব বিস্তারে যখন বাধা হয়ে জনগণের শক্তির উত্থান ঘটছে তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রবল শক্তির আঁতে ঘা লাগছে। ফলে তারা মারমুখী হয়ে উঠছে। তাই তো দেখছি জনগণতান্ত্রিক কোরিয়া কিংবা জাতীয়তাবাদী ইরান যখন আত্মনির্ভর হতে চাইছে, তখনও ক্ষুব্ধ আমেরিকা তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিচ্ছে। এই তো গত ২ মার্চ একটি সাময়িকীতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বারাক ওবামা বলেছেন গর্বোদ্ধত উচ্চারণে, 'আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, আমি ধোঁকা দেওয়ার জন্য কোনো কথা বলি না।' এই বলে ইরানকে হামলা করার একেবারে সরাসরি হুমকি দিয়েছে। ওবামা সাহেব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন 'আটলান্টিক' সাময়িকীতে। সেখানে ইরানকে হুমকি দিয়েছেন বলে খবর ছেপে কাগজটি বলেছে, 'সব বিকল্পই টেবিলে আছে' এটাও ওবামা বলেছেন। অন্যদিকে ইসরায়েল তো বিশ্বের দুষ্টগ্রহ। তার প্রধানমন্ত্রী কট্টরপন্থি নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করেছেন ওবামা। নেতানিয়াহু আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদনকারীদের সঙ্গেই চলেন। আমেরিকা আর ইসরায়েলের এমন আগ্রাসী মানসিকতা তো অতীতেও লক্ষ্য করেছি। এমনকি '৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বিভ্রান্ত ও বেপথু করার ঘৃণ্য উদ্দেশ্য নিয়ে আমেরিকা সরাসরি নৌবহর মোতায়েন করে আমাদের ভয় দেখিয়ে কাবু করতে চেয়েছিল এবং ইসরায়েলকে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করার কম চেষ্টা করেনি! কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী ও আত্মবিশ্বাসী তাজউদ্দীন আহমদ। ফলে সে ভয়ে কম্পিত হননি মুক্তিফৌজ বা তাদের নেতা তাজউদ্দীন।
আমরা তো দেখতে পাচ্ছি, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ও ইসরায়েল কী ভূমিকা পালন করে চলেছে। ঘৃণ্য এক মানববিধ্বংসী সৃষ্ট যুদ্ধে আমেরিকা কীভাবে সমৃদ্ধ ইরাক ও সাদ্দামকে উৎখাত করে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অমূল্য নিদর্শনগুলো লুটে নিয়ে গেল। গণহত্যা চালান মিত্রদের সৈন্যবাহিনীকেও কাজে লাগিয়ে। দেশটিকে কীভাবে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত করে ছাড়ল। এত বছর পরও ইরাক আরও সোজা হয়ে, আত্মশক্তিকে নির্ভর করে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছে না। কী হলো লিবিয়ায়? স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্ব চলছিল চার দশক ধরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গাদ্দাফিকে কীভাবে হত্যা করা হলো। শুধু কি তাই, তার আত্মীয়-পরিজন-বন্ধুবান্ধব সবাইকে হত্যা করা হচ্ছে। সিরিয়াকে তো আমেরিকা সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিদ্রোহীদের অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এমন তো আরও অনেক দেশই রয়েছে, সেখানে হস্তক্ষেপ করে কী দারুণভাবে জনগণকে বিপদগ্রস্ত করছে।
একবারও তারা পরিণতি ভেবে দেখেনি। এখন তো লিবিয়ার জনগণ আমেরিকার বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠছে ক্রমশ। সামনে আসছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওবামা দ্বিতীয় দফা আসার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। তার মধ্যে দেশে দেশে যুদ্ধ, আগ্রাসন, হামলা এবং এর মাধ্যমে নিজের সাফল্যকে পুঁজি করতে চাইবেন। বেশ তো ভালো কথা, তার জন্য মানুষ হত্যার এমন চক্রান্ত করে কি তিনি পার পাবেন?
এত সব কথা বলার পেছনে যুক্তি হলো, মহাজোটকে চোখ মেলে দেখতে বলা। এই তো কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে মমতার নির্বাচনে টাকার খেলা দেখলাম না? যে মমতা বাংলাদেশপ্রীতিতে গদগদ ছিলেন, এমন কী হলো যে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তিস্তামুখ, ফারাক্কা ইত্যাদির জল বণ্টন নিয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে চাইছেন কার স্বার্থে? যাদের টাকায় বা মদদে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে উৎখাতের অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছিলেন তিনি কি তাই ঋণ পরিশোধ করতে চেষ্টা করছেন এই বৈরী মনোভাব দেখিয়ে? মার্কিনিদের চোরকে চুরি করতে আর গেরস্তকে সজাগ থাকতে বলার মতো দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ যত্রতত্রই দেখতে পাই। এও একটি নিদর্শন। তাই আমাদেরও সতর্ক হওয়ার সময় এখন। মার্কিননীতি এবং বিশ্বব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে দেশকে দাসানুদাসে পরিণত করতে চাওয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাজউদ্দীন বুঝতে পেরেছিলেন বলেই বিশ্বব্যাংক বা মার্কিনিদের প্রশ্রয় দিতে রাজি হননি। অবশ্য সে কারণে তাকে পদই হারাতে হয়েছিল, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া সত্ত্বেও।
মজার ব্যাপার, মার্কিন নৌ কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছেন_ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ এবং শ্রীলংকায় সন্ত্রাস দমনের জন্য বিশেষ মার্কিন বাহিনী রয়েছে। তিনি মার্কিন কংগ্রেস সশস্ত্রবাহিনীর কমিটিতে শুনানির সময় এ তথ্য জানিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেছেন, কোনো মার্কিন ঘাঁটি নেই। ঘাঁটির কথা কমান্ডার উইলার্ড বলেননি। প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে আসেন। কাগজে দেখলাম, সিলেটে এখন এমন একটি বাহিনী প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ৩০ জনকে। ... মজিনা সাহেব দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে এক সিদ্ধান্ত পেঁৗছানোর পরামর্শ দিয়েছেন। যিনি নিজের দেশের ভূমিকা সম্পর্কে সত্য উচ্চারণ করছেন না, তিনি আমাদের যে পরামর্শ দিচ্ছেন, তা কি কূটনৈতিক শিষ্টাচারে পড়ে? তাদের কি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতেই পাঠানো হয়? আর আমরা কি তাদের কথা শুনি? প্রশ্ন জাগছে মনে, না শুনলে বলার সাহসই পায় কেমন করে? পরাশক্তি বলে কথা!
কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments