বুদ্ধপূর্ণিমা : এক অনাবিল সুখের দিন by শতদল বড়ুয়া
আবার আমাদের মধ্যে এসেছে ত্রিস্মৃতিবিজড়িত শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা বা বৈশাখী পূর্ণিমা। বুদ্ধের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ এবং মহাপরিনির্বাণ এই বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতেই ঘটেছিল। এ কারণে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য আজকের দিনটি খুবই তাৎপর্যহ। তবে একটি কথা সত্যি যে সব পূর্ণিমা তিথি কোনো না কোনো কারণে বিশেষ গুরুত্ববহ।
মানবজাতির কল্যাণে সিদ্ধার্থ তথা মহাপুরুষ গৌতম যখন বুদ্ধত্ব লাভ করলেন, এর পর থেকে তিনি মানবহিতের জন্য নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। তাঁর কাছে কোনো জাতি ভেদাভেদ ছিল না। আজকের শুভক্ষণ উপলক্ষে বুদ্ধের একটা হিত কাজের ছোট্ট বর্ণনা দিচ্ছি। রাজগৃহের বেশ কিছু তফাতে ছিল একটা ছোট্ট পল্লী। তখনকার সময় এ পল্লীর নাম ছিল 'ধাঙর'। এখানে জীর্ণশীর্ণ অতি ছোট কুটিরে বাস করতেন সুনীত নামের এক লোক। সংসারে তাঁর আপন বলতে কেউ না থাকলেও পোষ্যবর্গের কোনো অভাব ছিল না। প্রতিদিন ভোররাতেই যিনি শয্যা ত্যাগ করে ঘরের নিজ নিত্যকর্ম সেরে পূর্ব আকাশে সূর্য ওঠার আগেই ঝাড়ু এবং ঝুড়ি হাতে উপস্থিত হতেন রাজগৃহের প্রকাণ্ড সদর রাস্তায়। ওই রাস্তার বেশ কিছু জায়গা প্রতিদিন তাঁকেই পরিষ্কার করতে হতো। পথ ঝাড়ু দিয়ে ময়লা ঝুড়িতে পুরে তিনি নিজে বয়ে নিয়ে যেতেন নগরের বাইরে নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার জায়গায়। কাজের কোনো কৈফিয়ত না থাকা সত্ত্বেও তিনি কোনো দিন তাঁর ওপরওয়ালার কাছ থেকে প্রশংসা তো পানইনি, বরং মাঝেমধ্যে শুনতে হতো অকথ্য ভাষায় গালাগাল। পথের আশপাশের লোকেরাও তাঁকে নানাভাবে তিরস্কার করত। নগরবাসীর নানা মন্তব্য শুনেও তিনি কোনো জবাব দিতেন না। কারণ তিনি যে 'অস্পৃশ্য'। তাঁর প্রতিবাদের অধিকার কোথায়? তাঁর জন্ম তো উচ্চ বংশের সেবা করার জন্য। শাস্ত্র শ্রবণ তাঁর জন্য নিষিদ্ধ। বিদ্যা অর্জন তো কল্পনাই করা যাবে না। পেশাই হলো তাঁর একমাত্র কর্ম।
সুনীত সংসারী হলেও তাঁর কোনো দিনই সংসারে মন ছিল না। পাঁচ-দশজনের মতো সংসারের লাভক্ষতি নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতেন না। অবসর সময়ে নিরিবিলি নির্জন জায়গায় চলে যেতেন। আপন মনে বসে ভাবতেন। সন্ন্যাসের মুক্তি বন্ধনহীন জীবন তাঁকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকত। তাই তিনি সাধু-সন্ন্যাসী দেখলে বিচলিত হয়ে উঠতেন এবং নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান গ্রহণ করে আপন মনে সব কিছু চেয়ে থাকতেন। একদিন ভোরবেলা বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘসহ বেরিয়ে পড়লেন রাজগৃহের পল্লীতে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে। যে পথে ঝাড়ুদার সুনীত আবর্জনার ভার কাঁধে নিয়ে আসছিলেন, সে পথ ধরেই বুদ্ধ সামনের দিকে এগোচ্ছিলেন। তাঁর পেছনে ভিক্ষুসংঘের দল। সুনীত দূর থেকে তাঁদের দেখতে পেলেন। ভার কাঁধেই সুনীত পথের ধারে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে বুদ্ধ ও তাঁর দলের সবার দিকে চেয়ে থাকলেন। বুদ্ধ নিজ গতিতে প্রায় সুনীতের কাছাকাছি এসে গেলেন। সুনীতও পেছনে সরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে পাছে আর কোনো জায়গা অবশিষ্ট থাকল না। বুদ্ধ একেবারে সুনীতের সামনাসামনি গিয়ে ধীরগতিতে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সুনীতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সুনীত চোখ নত করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। বুদ্ধ এবার মায়াবী কণ্ঠে সুনীতকে বললেন_বৎস সুনীত, তুমি ভয় পেয়ো না। তোমার খোঁজেই আমি এখানে এসেছি। বুদ্ধের সুললিত কণ্ঠের মধুর বাণী শুনে সুনীতের সর্বাঙ্গ পুলকে শিউরে উঠল।
সুনীত এ মহাপুরুষকে রাজগৃহের পথে দেখেছেন বহুবার। হৃদয় থেকে তাঁর চরণে জানিয়েছেন নীরবে অসংখ্য প্রণাম। তিনি শুনেছেন এ মহাপুরুষের অনেক পুণ্যময় কাহিনী। মন চেয়েছে তাঁর পায়ে নিজেকে নিবেদন করতে। তাঁর এ গোপন বাসনা বামনের হাতে চাঁদ ধরার মতোই অলীক মনে হয়েছে। এমনি করে তিনি আসবেন তাঁর কাছে_এ কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। বুদ্ধ বললেন_সুনীত, আর কত দিন সংসারের এ দুঃখভার বইবে, তুমি এসো আমার সঙ্গে, তুমি হবে মাঠের ভিক্ষু। তথাগত বুদ্ধের এই কথাগুলো সুনীতের জীবনগতিতে সজোরে আঘাত করল। তিনি যেন বুঝতে পারেন তাঁর মর্ম। সমাজে যার কোনো অধিকার নেই, যাকে দেখলে লোকেরা চোখ ফিরিয়ে নেয়, যে ঝাড়ুদার সবার অবজ্ঞার পাত্র, সে ভিক্ষু হয়ে সঙ্গারামের পবিত্র পরিবেশে থাকবে, জনগণের পূজ্য হবে, এটি কখনো সম্ভব? সুনীত নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকলেন বুদ্ধের মুখপানে। এভাবে খানিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সুনীত বুদ্ধের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বুদ্ধের আশ্রয়ে চলে যাওয়ার করুণ আর্তি করলেন। দুঃখ-দুর্দশাময় বংশের পেশা পরিত্যাগ করে সুনীত ভিক্ষু হলেন। মাঠে সুশীতল পরশে এসে জীবনের গতি পুরোপুরি পাল্টে গেল। সংঘে সবার অধিকার সমান।
আজকের দিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো 'রক্তদান' কর্মসূচি। শহরকেন্দ্রিক কোনো কোনো বিহারে এ ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়ে থাকে। মানবতাবাদী এই কর্মসূচির সফলতা কামনা করছি আজকের শুভ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে। এতেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে 'ত্যাগেই সুখ'। আমরা কয়জন ত্যাগে প্রস্তুত আছি? নানা ভোগবিলাসে ডুবে আছি বিধায় ত্যাগ আমাদের কাছে মহার্ঘ্য। ধর্মের মূল কথা_'সুশৃঙ্খল জীবন যাপন'। সমাজ তথা দেশ নানা কারণে বর্তমানে মুমূর্ষু। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই যার যার ধর্মীয় বিধানমতে আত্মসংযমী হয়ে চলা। না হয় দুঃখ-ভারাক্রান্ত জীবনে শুধু দুঃখেরই শিকড় গজাবে। একে সমূলে উৎপাটন করা যাবে না। আজকের পুণ্যময় দিনে সবার জন্য নেমে আসুক অপার আনন্দ এবং অনাবিল সুখ। সংঘাতময় বিশ্বে শান্তি বর্ষিত হোক। সবাইকে জানাই বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা। 'জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।'
লেখক : ধর্মতাত্ত্বিক ও গবেষক
সুনীত সংসারী হলেও তাঁর কোনো দিনই সংসারে মন ছিল না। পাঁচ-দশজনের মতো সংসারের লাভক্ষতি নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতেন না। অবসর সময়ে নিরিবিলি নির্জন জায়গায় চলে যেতেন। আপন মনে বসে ভাবতেন। সন্ন্যাসের মুক্তি বন্ধনহীন জীবন তাঁকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকত। তাই তিনি সাধু-সন্ন্যাসী দেখলে বিচলিত হয়ে উঠতেন এবং নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান গ্রহণ করে আপন মনে সব কিছু চেয়ে থাকতেন। একদিন ভোরবেলা বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘসহ বেরিয়ে পড়লেন রাজগৃহের পল্লীতে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে। যে পথে ঝাড়ুদার সুনীত আবর্জনার ভার কাঁধে নিয়ে আসছিলেন, সে পথ ধরেই বুদ্ধ সামনের দিকে এগোচ্ছিলেন। তাঁর পেছনে ভিক্ষুসংঘের দল। সুনীত দূর থেকে তাঁদের দেখতে পেলেন। ভার কাঁধেই সুনীত পথের ধারে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে বুদ্ধ ও তাঁর দলের সবার দিকে চেয়ে থাকলেন। বুদ্ধ নিজ গতিতে প্রায় সুনীতের কাছাকাছি এসে গেলেন। সুনীতও পেছনে সরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে পাছে আর কোনো জায়গা অবশিষ্ট থাকল না। বুদ্ধ একেবারে সুনীতের সামনাসামনি গিয়ে ধীরগতিতে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সুনীতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সুনীত চোখ নত করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। বুদ্ধ এবার মায়াবী কণ্ঠে সুনীতকে বললেন_বৎস সুনীত, তুমি ভয় পেয়ো না। তোমার খোঁজেই আমি এখানে এসেছি। বুদ্ধের সুললিত কণ্ঠের মধুর বাণী শুনে সুনীতের সর্বাঙ্গ পুলকে শিউরে উঠল।
সুনীত এ মহাপুরুষকে রাজগৃহের পথে দেখেছেন বহুবার। হৃদয় থেকে তাঁর চরণে জানিয়েছেন নীরবে অসংখ্য প্রণাম। তিনি শুনেছেন এ মহাপুরুষের অনেক পুণ্যময় কাহিনী। মন চেয়েছে তাঁর পায়ে নিজেকে নিবেদন করতে। তাঁর এ গোপন বাসনা বামনের হাতে চাঁদ ধরার মতোই অলীক মনে হয়েছে। এমনি করে তিনি আসবেন তাঁর কাছে_এ কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। বুদ্ধ বললেন_সুনীত, আর কত দিন সংসারের এ দুঃখভার বইবে, তুমি এসো আমার সঙ্গে, তুমি হবে মাঠের ভিক্ষু। তথাগত বুদ্ধের এই কথাগুলো সুনীতের জীবনগতিতে সজোরে আঘাত করল। তিনি যেন বুঝতে পারেন তাঁর মর্ম। সমাজে যার কোনো অধিকার নেই, যাকে দেখলে লোকেরা চোখ ফিরিয়ে নেয়, যে ঝাড়ুদার সবার অবজ্ঞার পাত্র, সে ভিক্ষু হয়ে সঙ্গারামের পবিত্র পরিবেশে থাকবে, জনগণের পূজ্য হবে, এটি কখনো সম্ভব? সুনীত নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকলেন বুদ্ধের মুখপানে। এভাবে খানিক সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সুনীত বুদ্ধের পায়ে লুটিয়ে পড়ে বুদ্ধের আশ্রয়ে চলে যাওয়ার করুণ আর্তি করলেন। দুঃখ-দুর্দশাময় বংশের পেশা পরিত্যাগ করে সুনীত ভিক্ষু হলেন। মাঠে সুশীতল পরশে এসে জীবনের গতি পুরোপুরি পাল্টে গেল। সংঘে সবার অধিকার সমান।
আজকের দিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো 'রক্তদান' কর্মসূচি। শহরকেন্দ্রিক কোনো কোনো বিহারে এ ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়ে থাকে। মানবতাবাদী এই কর্মসূচির সফলতা কামনা করছি আজকের শুভ বৈশাখী পূর্ণিমার দিনে। এতেই প্রতীয়মান হচ্ছে যে 'ত্যাগেই সুখ'। আমরা কয়জন ত্যাগে প্রস্তুত আছি? নানা ভোগবিলাসে ডুবে আছি বিধায় ত্যাগ আমাদের কাছে মহার্ঘ্য। ধর্মের মূল কথা_'সুশৃঙ্খল জীবন যাপন'। সমাজ তথা দেশ নানা কারণে বর্তমানে মুমূর্ষু। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই যার যার ধর্মীয় বিধানমতে আত্মসংযমী হয়ে চলা। না হয় দুঃখ-ভারাক্রান্ত জীবনে শুধু দুঃখেরই শিকড় গজাবে। একে সমূলে উৎপাটন করা যাবে না। আজকের পুণ্যময় দিনে সবার জন্য নেমে আসুক অপার আনন্দ এবং অনাবিল সুখ। সংঘাতময় বিশ্বে শান্তি বর্ষিত হোক। সবাইকে জানাই বৈশাখী পূর্ণিমা উপলক্ষে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা। 'জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক।'
লেখক : ধর্মতাত্ত্বিক ও গবেষক
No comments