অরণ্যে রোদন-সবকিছু ভেঙে পড়ে by আনিসুল হক
থিংস ফল অ্যাপার্ট। ‘সবকিছু ভেঙে পড়ছে। কেন্দ্র আর কোনো কিছু ধরে রাখতে পারছে না। জগৎ জোড়া শুধুই নৈরাজ্য।’ লিখেছিলেন কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। বাংলাদেশেও হঠাৎ করে মনে হচ্ছে সবকিছু ভেঙে পড়ছে। চারদিকে কেবল দুঃসংবাদ। দুঃসংবাদের চাপে সুসংবাদ উধাও।
এই মহাজোট সরকার তার আড়াই বছর পার করেছে কেবল। আড়াই বছরের মাথায় এসে মনে হচ্ছে, সরকার যা কিছু করছে, সবই তার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। সরকার যদি বা কিছু না-ও করে, দেশে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে তার দোষ কেবল সরকারের ঘাড়ে নয়, সরকারি দলের ওপরও এসে আছড়ে পড়ছে।
এত তাড়াতাড়ি এমন হওয়ার কথা নয়। কেন এমন ঘটছে? একটা কারণ হতে পারে, সরকার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছে। জনগণ তাদের ওপর বিরক্ত। দেখতে নারি, চলন বাঁকা। সরকারের ভালো কাজগুলোও আর মানুষের চোখে পড়ছে না। ব্যর্থতাগুলোই তাদের চোখে প্রকট হয়ে পড়ছে। সরকারের জনপ্রিয়তা যে কমে গেছে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ফল থেকে তা কিছুটা আঁচ করা যায়। কিন্তু সরকার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে কেন? জনজীবনে সরাসরি আঁচ লাগে, এমন কিছু ব্যর্থতা বড় স্পষ্ট। জিনিসপত্রের দাম আসলেই খুব বেড়ে গেছে। সীমিত আয়ে আর সংসার চলে না। দিন যাপন করা যায় না। শেয়ারবাজারে ধস অসংখ্য পরিবারকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। ছোট ছোট বিনিয়োগকারীর পকেট কেটে কতিপয় বড়লোক হাজার কোটি টাকা নিয়ে সটকে পড়েছেন। এবং এই বিপর্যয়ের জন্য যাঁরা দায়ী বলে মানুষ মনে করে, তাঁরা সরকারের উচ্চমহলের ঘনিষ্ঠ, অথবা সরকারেরই লোক। এসব বড় ঘটনা তো আছেই, নিত্যদিনের পথচলায় মানুষকে একটা বিশেষ প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, তার নাম দলীয়করণ ও রাজনৈতিকীকরণ। যেখানে দলের দরকার নেই, সেখানেও সবকিছু করা হয় দলীয় পরিচয় বিবেচনা করে। যেখানে রাজনীতি টেনে আনার দরকার নেই, সেখানেও রাজনীতি ও রাজনীতিকেরা এসে হাজির হন এবং সবকিছু রাজনীতির ছায়ায় ঢেকে ফেলেন। একটা অজপাড়াগাঁর স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে, সেই নিয়োগের প্রক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রণ করেন এলাকার রাজনীতিকেরা, এমপি, মন্ত্রী, সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক। যাঁকে নেওয়া হয়, টাকা-পয়সা তো তাঁকে দিতে হয়ই, তাঁর দলীয় আনুগত্যও বিচার করা হয়। তারপর ওই শিক্ষক যদি কোনো দুর্নীতি বা অপরাধ করেন? তাহলে তাঁর বিচার করবেন কে? আইন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সর্বত্র দলীয় পরিচয়-বিবেচনা। সবকিছু যদি রাজনীতির মাপকাঠিতে বিচার করা হয়, সবকিছু যদি চলে দলীয় পরিচয়ের যোগ্যতায়, তাহলে সবকিছু ভেঙে পড়তে বাধ্য। ধরা যাক, কথার কথাই বলছি, একজন পকেটমার হাটের মধ্যে পকেট কাটতে গিয়ে ধরা পড়ল। এখন যদি দেখা যায়, সে জবরপুর ইউনিয়ন পকেটমার লীগের বা দলের সভাপতি, আর ওই পকেটমারকে যে চৌকিদারের হাতে তুলে দেওয়া হলো, তিনি ওই এলাকার চৌকিদার লীগের বা দলের সভাপতি, তখন ওই চোরের বিচার কী হবে?
আমাদের নেতা-নেত্রীরা মনে করেন, সর্বত্র দলীয় লোক বসাতে পারলে দেশটা তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকে। আসলে ঘটনা উল্টো। দলের লোকেরও এক ভোট, দলের বাইরে যে ১৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ আছে, তাদের মধ্যে যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক, তাঁদেরও মাথাপিছু এক ভোট। শুধু দলের ক্যাডারদের ভোট পেয়ে কোনো নেতা বা নেত্রী ক্ষমতাসীন হন না। সাধারণ ভোটারদের ভোটেই তাঁরা একবার জেতেন, একবার হারেন। কোনো একটা পদে যখন নির্লজ্জভাবে অযোগ্য কোনো দলীয় কর্মী/এলাকার মানুষ/নেতার আত্মীয়কে চাপিয়ে দেওয়া হয়, ওই পদপ্রত্যাশী আরও ১০০ জনই কেবল বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ বোধ করেন না, ওই ঘটনা যাঁরা জানেন-দেখেন, তেমন হাজার মানুষও ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হন। সেই ক্ষোভ তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে দেখান না। কিন্তু একটা দিন আসে, যখন ওই দলীয় বিচারে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি একটা ভুল বা অন্যায় করে বসেন। ভুল করার আশঙ্কা তাঁর পক্ষে বেশি, কারণ একে তো তাঁর ওই পদে বসার যোগ্যতা নেই, তার ওপর তিনি ভাবেন, আমি দলীয় পরিচয়ে নিযুক্ত হয়েছি, আমি সবকিছুর ঊর্ধ্বে, আমি কাউকে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই। যেই না তিনি একটা ভুল করেন, যার সঙ্গে হয়তো দলের কোনো সম্পর্ক নেই, রাজনীতির কোনো যোগাযোগ নেই, তখন ওই ভুলের সব দায়িত্ব দলের ওপর এসে পড়ে, রাজনীতির ওপর এসে পড়ে।
এবার একটা বাস্তব উদাহরণ দিই। ডেইলি স্টার-এ ২৪ জুলাই ২০১১-এর প্রথম কলামের খবর এটা। চিয়ারস ফর পার্টিজান ট্রেডারস। দলীয় ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো। ঘটনা কী? ঘটনা হচ্ছে, কুড়িগ্রামের বালিয়ামারী সীমান্তে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম সীমান্ত হাট চালু হয়েছে। দুই দেশের মানুষ করতালি দিয়ে এই হাটকে স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী এ উপলক্ষে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। খুবই ইতিবাচক একটা সংবাদ। মানুষের সঙ্গে মানুষকে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখলে, শত্রুতা নয়, বন্ধুত্ব বিনিময় করতে দেখলে কার না ভালো লাগে? কিন্তু ডেইলি স্টার লিখেছে, যে ২৫ জন ব্যবসায়ীকে ওই সীমান্ত হাটে স্টল দেওয়া ও ব্যবসা করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকেই শাসক দলের সুপরিচিত কর্মী। আপনি একটা ব্যবসার সুযোগ যাঁদের দিচ্ছেন, তাঁদের শতকরা ১০০ ভাগই যদি আপনার কর্মী হন, তাহলে ওই এলাকার অ-কর্মী যে হাজার হাজার মানুষ আছেন, তাঁরা আপনার ওপর অনুরাগ দেখাবেন না বিরাগ দেখাবেন? ওই ২৫ জনের কোনো একজন যেদিন কোনো বড় অন্যায় বা ভুল করবে (আমরা চাই তাঁরা কোনো ভুল বা অন্যায় না করুন ও ভালোমতো ব্যবসা করুন), সেদিন হাজার হাজার মানুষ ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নামবে।
সবকিছুর রাজনৈতিকীকরণ ও দলীয়করণ আমাদের বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত করে তুলছে। এটা যে কেবল মহাজোট সরকার করে বা করছে তা নয়, বিএনপি-জামায়াতও তা-ই করেছিল। করেছিল বলেই কানসাট কিংবা যাত্রাবাড়ীর গণ-অসন্তোষ গণবিস্ফোরণে রূপ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে বড়, তার বিস্তার তৃণমূল পর্যন্ত, সংসদে মহাজোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তিন-চতুর্থাংশ, তারা যদি দলীয়করণ করতে চায়, তখন সবকিছুই দলের ছায়ায় ঢেকে যায়। মানুষ শ্বাস নেওয়ার মতো পরিসর পায় না।
এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
উপায়টা জানার জন্য খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না, সামান্য একটু কষ্ট করতে হবে। গত সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রচারিত নির্বাচনী ইশতেহার ২০০৮ একটু কষ্ট করে পাঠ করতে হবে। সবকিছু ওই দলিলে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে। ‘দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে।’ ‘বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে।’ ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে। মানবাধিকার লংঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।’ ‘সংসদকে কার্যকর করা হবে, সরকার সকল কার্যকলাপের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তির বিবরণী প্রতিবছর প্রকাশ করা হবে।’ ‘প্রতিটা নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখা হবে।’ ‘ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদগুলোকে শক্তিশালী করা হবে।’ আর ওই নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান দুটো অঙ্গীকার ছিল, যা অগ্রাধিকার বলে ঘোষিত হয়েছিল—জিনিসপত্রের দাম কমানো এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা, ঘুষ-চাঁদাবাজি ইত্যাদি বন্ধ করা। (আমি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করছি বলে শব্দ এদিক-ওদিক হতে পারে, তবে অর্থের হেরফের হওয়ার আশঙ্কা কম)
এখন জনগণ যদি প্রশ্ন করে, পুলিশ কি রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে? প্রশাসনের নিয়োগ ও পদোন্নতির মাপকাঠি কি মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা? স্থানীয় সরকারকে কি কার্যকর করা হচ্ছে? আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে? বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কি বন্ধ হয়েছে? বিচার বিভাগ কি আগের চেয়ে বেশি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে?
জনতা যখন দেখে, প্রচলিত আইনে বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখনই তারা আইন হাতে তুলে নেয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি যদি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনের আসামিকে ক্ষমা করে দেন, তখন মানুষ দিশেহারা বোধ করে। বলা হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি বরাবর এই মর্মে আবেদন পাঠালে রাষ্ট্রপতির বিকল্প কিছু করার থাকে না। তাহলে আমাদের প্রশ্ন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন এটা পাঠাতে গেল?
সবকিছুতেই দলীয় বিবেচনা, সবকিছুরই রাজনৈতিকীকরণ। খুন ও খুনিরও রাজনৈতিকীকরণ চলছে। আর আছে রাজনীতিতে সমঝোতা ও মতৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা বাদ দিয়ে সংঘাতের পথ বেছে নেওয়া। সংসদকে কার্যকর করার বদলে অকার্যকর করার চেষ্টা। সংবিধানের সংশোধনীতে এমন এক অনুচ্ছেদ যোগ করে দেওয়া, যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২-এর সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমি চাই আমার ফাঁসি হোক, এ সংশোধনীর বিরোধিতার জন্য ফাঁসি হলে তা হবে সম্মানের।’
আজ চারদিকে ভাঙনের সুর। দুঃসংবাদে আকীর্ণ সংবাদপত্রের পাতা। সবকিছু ভেঙে পড়ছে। আরও অনেক কিছুই বোধহয় ভেঙে পড়তে দেখতে হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
এত তাড়াতাড়ি এমন হওয়ার কথা নয়। কেন এমন ঘটছে? একটা কারণ হতে পারে, সরকার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলেছে। জনগণ তাদের ওপর বিরক্ত। দেখতে নারি, চলন বাঁকা। সরকারের ভালো কাজগুলোও আর মানুষের চোখে পড়ছে না। ব্যর্থতাগুলোই তাদের চোখে প্রকট হয়ে পড়ছে। সরকারের জনপ্রিয়তা যে কমে গেছে, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের ফল থেকে তা কিছুটা আঁচ করা যায়। কিন্তু সরকার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে কেন? জনজীবনে সরাসরি আঁচ লাগে, এমন কিছু ব্যর্থতা বড় স্পষ্ট। জিনিসপত্রের দাম আসলেই খুব বেড়ে গেছে। সীমিত আয়ে আর সংসার চলে না। দিন যাপন করা যায় না। শেয়ারবাজারে ধস অসংখ্য পরিবারকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। ছোট ছোট বিনিয়োগকারীর পকেট কেটে কতিপয় বড়লোক হাজার কোটি টাকা নিয়ে সটকে পড়েছেন। এবং এই বিপর্যয়ের জন্য যাঁরা দায়ী বলে মানুষ মনে করে, তাঁরা সরকারের উচ্চমহলের ঘনিষ্ঠ, অথবা সরকারেরই লোক। এসব বড় ঘটনা তো আছেই, নিত্যদিনের পথচলায় মানুষকে একটা বিশেষ প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, তার নাম দলীয়করণ ও রাজনৈতিকীকরণ। যেখানে দলের দরকার নেই, সেখানেও সবকিছু করা হয় দলীয় পরিচয় বিবেচনা করে। যেখানে রাজনীতি টেনে আনার দরকার নেই, সেখানেও রাজনীতি ও রাজনীতিকেরা এসে হাজির হন এবং সবকিছু রাজনীতির ছায়ায় ঢেকে ফেলেন। একটা অজপাড়াগাঁর স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে, সেই নিয়োগের প্রক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রণ করেন এলাকার রাজনীতিকেরা, এমপি, মন্ত্রী, সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক। যাঁকে নেওয়া হয়, টাকা-পয়সা তো তাঁকে দিতে হয়ই, তাঁর দলীয় আনুগত্যও বিচার করা হয়। তারপর ওই শিক্ষক যদি কোনো দুর্নীতি বা অপরাধ করেন? তাহলে তাঁর বিচার করবেন কে? আইন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সর্বত্র দলীয় পরিচয়-বিবেচনা। সবকিছু যদি রাজনীতির মাপকাঠিতে বিচার করা হয়, সবকিছু যদি চলে দলীয় পরিচয়ের যোগ্যতায়, তাহলে সবকিছু ভেঙে পড়তে বাধ্য। ধরা যাক, কথার কথাই বলছি, একজন পকেটমার হাটের মধ্যে পকেট কাটতে গিয়ে ধরা পড়ল। এখন যদি দেখা যায়, সে জবরপুর ইউনিয়ন পকেটমার লীগের বা দলের সভাপতি, আর ওই পকেটমারকে যে চৌকিদারের হাতে তুলে দেওয়া হলো, তিনি ওই এলাকার চৌকিদার লীগের বা দলের সভাপতি, তখন ওই চোরের বিচার কী হবে?
আমাদের নেতা-নেত্রীরা মনে করেন, সর্বত্র দলীয় লোক বসাতে পারলে দেশটা তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকে। আসলে ঘটনা উল্টো। দলের লোকেরও এক ভোট, দলের বাইরে যে ১৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ আছে, তাদের মধ্যে যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক, তাঁদেরও মাথাপিছু এক ভোট। শুধু দলের ক্যাডারদের ভোট পেয়ে কোনো নেতা বা নেত্রী ক্ষমতাসীন হন না। সাধারণ ভোটারদের ভোটেই তাঁরা একবার জেতেন, একবার হারেন। কোনো একটা পদে যখন নির্লজ্জভাবে অযোগ্য কোনো দলীয় কর্মী/এলাকার মানুষ/নেতার আত্মীয়কে চাপিয়ে দেওয়া হয়, ওই পদপ্রত্যাশী আরও ১০০ জনই কেবল বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ বোধ করেন না, ওই ঘটনা যাঁরা জানেন-দেখেন, তেমন হাজার মানুষও ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হন। সেই ক্ষোভ তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে দেখান না। কিন্তু একটা দিন আসে, যখন ওই দলীয় বিচারে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি একটা ভুল বা অন্যায় করে বসেন। ভুল করার আশঙ্কা তাঁর পক্ষে বেশি, কারণ একে তো তাঁর ওই পদে বসার যোগ্যতা নেই, তার ওপর তিনি ভাবেন, আমি দলীয় পরিচয়ে নিযুক্ত হয়েছি, আমি সবকিছুর ঊর্ধ্বে, আমি কাউকে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই। যেই না তিনি একটা ভুল করেন, যার সঙ্গে হয়তো দলের কোনো সম্পর্ক নেই, রাজনীতির কোনো যোগাযোগ নেই, তখন ওই ভুলের সব দায়িত্ব দলের ওপর এসে পড়ে, রাজনীতির ওপর এসে পড়ে।
এবার একটা বাস্তব উদাহরণ দিই। ডেইলি স্টার-এ ২৪ জুলাই ২০১১-এর প্রথম কলামের খবর এটা। চিয়ারস ফর পার্টিজান ট্রেডারস। দলীয় ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো। ঘটনা কী? ঘটনা হচ্ছে, কুড়িগ্রামের বালিয়ামারী সীমান্তে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রথম সীমান্ত হাট চালু হয়েছে। দুই দেশের মানুষ করতালি দিয়ে এই হাটকে স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী এ উপলক্ষে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। খুবই ইতিবাচক একটা সংবাদ। মানুষের সঙ্গে মানুষকে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখলে, শত্রুতা নয়, বন্ধুত্ব বিনিময় করতে দেখলে কার না ভালো লাগে? কিন্তু ডেইলি স্টার লিখেছে, যে ২৫ জন ব্যবসায়ীকে ওই সীমান্ত হাটে স্টল দেওয়া ও ব্যবসা করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের প্রত্যেকেই শাসক দলের সুপরিচিত কর্মী। আপনি একটা ব্যবসার সুযোগ যাঁদের দিচ্ছেন, তাঁদের শতকরা ১০০ ভাগই যদি আপনার কর্মী হন, তাহলে ওই এলাকার অ-কর্মী যে হাজার হাজার মানুষ আছেন, তাঁরা আপনার ওপর অনুরাগ দেখাবেন না বিরাগ দেখাবেন? ওই ২৫ জনের কোনো একজন যেদিন কোনো বড় অন্যায় বা ভুল করবে (আমরা চাই তাঁরা কোনো ভুল বা অন্যায় না করুন ও ভালোমতো ব্যবসা করুন), সেদিন হাজার হাজার মানুষ ঝাড়ু হাতে রাস্তায় নামবে।
সবকিছুর রাজনৈতিকীকরণ ও দলীয়করণ আমাদের বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত করে তুলছে। এটা যে কেবল মহাজোট সরকার করে বা করছে তা নয়, বিএনপি-জামায়াতও তা-ই করেছিল। করেছিল বলেই কানসাট কিংবা যাত্রাবাড়ীর গণ-অসন্তোষ গণবিস্ফোরণে রূপ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে বড়, তার বিস্তার তৃণমূল পর্যন্ত, সংসদে মহাজোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তিন-চতুর্থাংশ, তারা যদি দলীয়করণ করতে চায়, তখন সবকিছুই দলের ছায়ায় ঢেকে যায়। মানুষ শ্বাস নেওয়ার মতো পরিসর পায় না।
এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
উপায়টা জানার জন্য খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না, সামান্য একটু কষ্ট করতে হবে। গত সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রচারিত নির্বাচনী ইশতেহার ২০০৮ একটু কষ্ট করে পাঠ করতে হবে। সবকিছু ওই দলিলে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে। ‘দলীয়করণমুক্ত অরাজনৈতিক গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে।’ ‘বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে।’ ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, শক্তিশালী স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে। মানবাধিকার লংঘন কঠোরভাবে বন্ধ করা হবে।’ ‘সংসদকে কার্যকর করা হবে, সরকার সকল কার্যকলাপের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সম্পত্তির বিবরণী প্রতিবছর প্রকাশ করা হবে।’ ‘প্রতিটা নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখা হবে।’ ‘ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদগুলোকে শক্তিশালী করা হবে।’ আর ওই নির্বাচনী ইশতেহারের প্রধান দুটো অঙ্গীকার ছিল, যা অগ্রাধিকার বলে ঘোষিত হয়েছিল—জিনিসপত্রের দাম কমানো এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা, ঘুষ-চাঁদাবাজি ইত্যাদি বন্ধ করা। (আমি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করছি বলে শব্দ এদিক-ওদিক হতে পারে, তবে অর্থের হেরফের হওয়ার আশঙ্কা কম)
এখন জনগণ যদি প্রশ্ন করে, পুলিশ কি রাজনৈতিক প্রভাবের ঊর্ধ্বে? প্রশাসনের নিয়োগ ও পদোন্নতির মাপকাঠি কি মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা? স্থানীয় সরকারকে কি কার্যকর করা হচ্ছে? আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে? বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কি বন্ধ হয়েছে? বিচার বিভাগ কি আগের চেয়ে বেশি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে?
জনতা যখন দেখে, প্রচলিত আইনে বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তখনই তারা আইন হাতে তুলে নেয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি যদি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনের আসামিকে ক্ষমা করে দেন, তখন মানুষ দিশেহারা বোধ করে। বলা হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি বরাবর এই মর্মে আবেদন পাঠালে রাষ্ট্রপতির বিকল্প কিছু করার থাকে না। তাহলে আমাদের প্রশ্ন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন এটা পাঠাতে গেল?
সবকিছুতেই দলীয় বিবেচনা, সবকিছুরই রাজনৈতিকীকরণ। খুন ও খুনিরও রাজনৈতিকীকরণ চলছে। আর আছে রাজনীতিতে সমঝোতা ও মতৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা বাদ দিয়ে সংঘাতের পথ বেছে নেওয়া। সংসদকে কার্যকর করার বদলে অকার্যকর করার চেষ্টা। সংবিধানের সংশোধনীতে এমন এক অনুচ্ছেদ যোগ করে দেওয়া, যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২-এর সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘আমি চাই আমার ফাঁসি হোক, এ সংশোধনীর বিরোধিতার জন্য ফাঁসি হলে তা হবে সম্মানের।’
আজ চারদিকে ভাঙনের সুর। দুঃসংবাদে আকীর্ণ সংবাদপত্রের পাতা। সবকিছু ভেঙে পড়ছে। আরও অনেক কিছুই বোধহয় ভেঙে পড়তে দেখতে হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments