নোটবই-সৃজনশীলতার হন্তারক by শান্ত নূরুননবী
১১ মার্চ প্রথম আলোর একটি খবরে জানা যায়, গোয়েন্দা পুলিশ রংপুরের একটি বইয়ের দোকান থেকে ১০ লাখ টাকার নোটবই উদ্ধার করেছে এবং নিষিদ্ধ নোটবই বিক্রি ও দোকানে রাখার অপরাধে বইয়ের দোকানের মালিক ও বিক্রয় প্রতিনিধিকে গ্রেপ্তার করেছে। যেসব প্রকাশনা থেকে এই নোটবইগুলো ছাপানো হয়েছে,
সেগুলো হলো: নিউটন, জুপিটার, জননী, পাঞ্জেরী, উৎসব, লেকচার, আদিল ও অনুপম। এ ঘটনা থেকে এটাও বলা যায়, ১৯৮০ সালের নোটবই (নিষিদ্ধকরণ) আইন এবং এ-সংক্রান্ত মামলার সামপ্রতিক উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো একেবারে নিষ্ক্রিয় নয়।
অন্যদিকে, রংপুরের পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির দাবি, যেসব বই আটক করা হয়েছে সেগুলো নোটবই নয়, এগুলো শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্য অনুশীলন বই। পুস্তক ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন, ব্যবসায়ীদের হয়রানি করতেই এ অভিযান চালানো হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে রংপুরের পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতি ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট পালন করেছে। এই ধর্মঘট নিয়ে রংপুর শহরের অভিভাবক ও সচেতন মহল মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একজন সংবাদকর্মী বলেন, ‘আইনে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করার জন্য যদি কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সেই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে যদি আন্দোলন করা হয়, তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এ ধরনের ধর্মঘট অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অন্যায়কে উসকে দেওয়ার শামিল।’ বিপরীতে একজন পুস্তক ব্যবসায়ী বলেছেন, ‘সারা দেশের সব বইয়ের দোকানদারই তো নোটবই বিক্রি করছেন, তাহলে শুধু এক রংপুরের বাণী মঞ্জিলে কেন গভীর রাতে অভিযান চালানো হলো এবং দুজনকে গ্রেপ্তার করা হলো!’ তিনি আরও বলেন, ‘নোটবই তো বেশির ভাগই ছাপা হচ্ছে ঢাকা শহরে, সেই ছাপাখানাও তো বন্ধ করা হচ্ছে না, এমনকি কোনো প্রকাশকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে না।’ কয়েকজন অভিভাবক জানালেন, তাঁরাও চান নোটবই নয়, মূল বই পড়ে ছেলেমেয়েরা নিজেরা বুঝে পরীক্ষার খাতায় নিজেদের উপলব্ধি প্রকাশ করুক। সেই উপলব্ধি প্রকাশের মানদণ্ড সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা যদি শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই পেত, তাহলে নোটবইয়ের চাহিদা আপনাআপনিই মিটে যেত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো পর্যন্ত অনেক শিক্ষক নোটবই, গাইডবই ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে উত্তরপত্রের মান নির্ধারণ করেন। অনেক শিক্ষক তো শিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রকাশনার গাইড কেনার জন্য চাপও প্রয়োগ করেন। অধিকন্তু, নৈর্ব্যক্তিক (অবজেকটিভ টাইপ) প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের আমরা আজও তথাকথিত অনুশীলন বইয়ের কোনো বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করতে শেখাতে পারিনি। শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী—সবার মধ্যে আজকের সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণাই গড়ে ওঠেনি। আমাদের শিক্ষার সার্বিক প্রক্রিয়া এখনো নোটবই (নিষিদ্ধকরণ) আইন বাস্তবায়নের প্রযোজ্য পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। আইনটির সময়োপযোগী সংশোধন দরকার বলে অনেকের অভিমত।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষা—যে পর্যায়ের দিকেই তাকানো যাক না কেন, জনবহুল বাংলাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত মোটেই সৃজনশীলতার সহায়ক নয়। একজন শিক্ষকের পক্ষে শতাধিক শিক্ষার্থীর সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কথা বলতে হলে, তাঁর পক্ষে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে কতটা সহায়তা করা সম্ভব, সেটা বিরাট এক প্রশ্ন। শুধু শিক্ষার্থীদের সংখ্যার তুলনায় শিক্ষকস্বল্পতাই নয়, যোগ্য শিক্ষকের অতি স্বল্পতাও রয়েছে। এখনো পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা-মর্যাদা ইত্যাদি মেধাবীদের এ পেশায় মোটেই আগ্রহী করে না। সামাজিকভাবে শিক্ষকদেরই তো থাকার কথা মর্যাদার শীর্ষে। বাস্তবে শিক্ষকেরা সামাজিকভাবে সম্মানিত নয় বলে মনে করেন রংপুর কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক এ আই এম মুসা। শিক্ষকতা পেশাকে মেধাবী চাকরিপ্রার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৃজনশীল করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হবে। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের উপাধ্যক্ষ রায়হান শরীফ বলেন, ‘শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না দিয়েই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। ফলে, শিক্ষার্থী তো বটেই, শিক্ষকেরাও বাজারের গাইডবইনির্ভর হয়ে পড়েছিলেন। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় মানোন্নয়ন করতে পারলে, নোট-গাইডনির্ভরতা থেকে সহজেই বেরিয়ে আসা সম্ভব।’
দ্বিতীয়ত, আইন করে যেমন নোটবই ছাপানো ও বিপণন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তেমনি যাচ্ছে না শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়েও বিখ্যাত হয়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করা। যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তারা অকৃতকার্য হচ্ছে, ঝরে পড়ছে। মনে রাখতে হবে, নোট-গাইড পড়া আর প্রাইভেট পড়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোতেই মুখস্থ পদ্ধতির প্রয়োগ আছে। মুখস্থ করা নকল করার চেয়েও ভয়ংকর। কেননা, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মুখস্থ করা হলো মগজে করিয়া নকল করা, যা সৃজনশীলতাকে অবরুদ্ধ করে দেয়।’
তবে নোটবই তো গোপনে বিক্রি হচ্ছে না যে, তার জন্য গোয়েন্দা পুলিশের গভীর রাতের বিচ্ছিন্ন অভিযান প্রয়োজন। ১২ মার্চের প্রথম আলোর ‘দেদার বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ গাইডবই’ শিরোনামের খবর পড়লেই এ সত্য বোঝা যায়। সুতরাং, জাতিকে মেধাশূন্যতার চরমে পৌঁছে দেওয়ার আগেই এ ব্যাপারে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের রাজনীতি চর্চার প্রধান লক্ষ্যই হওয়া উচিত শিক্ষার উন্নয়ন, যা সার্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি।
শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।
shantonabi@gmail.com
অন্যদিকে, রংপুরের পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির দাবি, যেসব বই আটক করা হয়েছে সেগুলো নোটবই নয়, এগুলো শিক্ষার্থীদের সহায়তা করার জন্য অনুশীলন বই। পুস্তক ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন, ব্যবসায়ীদের হয়রানি করতেই এ অভিযান চালানো হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে রংপুরের পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতি ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট পালন করেছে। এই ধর্মঘট নিয়ে রংপুর শহরের অভিভাবক ও সচেতন মহল মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একজন সংবাদকর্মী বলেন, ‘আইনে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করার জন্য যদি কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সেই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে যদি আন্দোলন করা হয়, তাহলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। এ ধরনের ধর্মঘট অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অন্যায়কে উসকে দেওয়ার শামিল।’ বিপরীতে একজন পুস্তক ব্যবসায়ী বলেছেন, ‘সারা দেশের সব বইয়ের দোকানদারই তো নোটবই বিক্রি করছেন, তাহলে শুধু এক রংপুরের বাণী মঞ্জিলে কেন গভীর রাতে অভিযান চালানো হলো এবং দুজনকে গ্রেপ্তার করা হলো!’ তিনি আরও বলেন, ‘নোটবই তো বেশির ভাগই ছাপা হচ্ছে ঢাকা শহরে, সেই ছাপাখানাও তো বন্ধ করা হচ্ছে না, এমনকি কোনো প্রকাশকের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে না।’ কয়েকজন অভিভাবক জানালেন, তাঁরাও চান নোটবই নয়, মূল বই পড়ে ছেলেমেয়েরা নিজেরা বুঝে পরীক্ষার খাতায় নিজেদের উপলব্ধি প্রকাশ করুক। সেই উপলব্ধি প্রকাশের মানদণ্ড সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা যদি শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই পেত, তাহলে নোটবইয়ের চাহিদা আপনাআপনিই মিটে যেত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনো পর্যন্ত অনেক শিক্ষক নোটবই, গাইডবই ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে উত্তরপত্রের মান নির্ধারণ করেন। অনেক শিক্ষক তো শিক্ষার্থীদের বিশেষ প্রকাশনার গাইড কেনার জন্য চাপও প্রয়োগ করেন। অধিকন্তু, নৈর্ব্যক্তিক (অবজেকটিভ টাইপ) প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের আমরা আজও তথাকথিত অনুশীলন বইয়ের কোনো বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণ করতে শেখাতে পারিনি। শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থী—সবার মধ্যে আজকের সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণাই গড়ে ওঠেনি। আমাদের শিক্ষার সার্বিক প্রক্রিয়া এখনো নোটবই (নিষিদ্ধকরণ) আইন বাস্তবায়নের প্রযোজ্য পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। আইনটির সময়োপযোগী সংশোধন দরকার বলে অনেকের অভিমত।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষা—যে পর্যায়ের দিকেই তাকানো যাক না কেন, জনবহুল বাংলাদেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত মোটেই সৃজনশীলতার সহায়ক নয়। একজন শিক্ষকের পক্ষে শতাধিক শিক্ষার্থীর সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কথা বলতে হলে, তাঁর পক্ষে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে কতটা সহায়তা করা সম্ভব, সেটা বিরাট এক প্রশ্ন। শুধু শিক্ষার্থীদের সংখ্যার তুলনায় শিক্ষকস্বল্পতাই নয়, যোগ্য শিক্ষকের অতি স্বল্পতাও রয়েছে। এখনো পর্যন্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা-মর্যাদা ইত্যাদি মেধাবীদের এ পেশায় মোটেই আগ্রহী করে না। সামাজিকভাবে শিক্ষকদেরই তো থাকার কথা মর্যাদার শীর্ষে। বাস্তবে শিক্ষকেরা সামাজিকভাবে সম্মানিত নয় বলে মনে করেন রংপুর কলেজের শিক্ষক অধ্যাপক এ আই এম মুসা। শিক্ষকতা পেশাকে মেধাবী চাকরিপ্রার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৃজনশীল করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হবে। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজের উপাধ্যক্ষ রায়হান শরীফ বলেন, ‘শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না দিয়েই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। ফলে, শিক্ষার্থী তো বটেই, শিক্ষকেরাও বাজারের গাইডবইনির্ভর হয়ে পড়েছিলেন। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় মানোন্নয়ন করতে পারলে, নোট-গাইডনির্ভরতা থেকে সহজেই বেরিয়ে আসা সম্ভব।’
দ্বিতীয়ত, আইন করে যেমন নোটবই ছাপানো ও বিপণন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তেমনি যাচ্ছে না শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়েও বিখ্যাত হয়ে ওঠা কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করা। যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তারা অকৃতকার্য হচ্ছে, ঝরে পড়ছে। মনে রাখতে হবে, নোট-গাইড পড়া আর প্রাইভেট পড়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দুটোতেই মুখস্থ পদ্ধতির প্রয়োগ আছে। মুখস্থ করা নকল করার চেয়েও ভয়ংকর। কেননা, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মুখস্থ করা হলো মগজে করিয়া নকল করা, যা সৃজনশীলতাকে অবরুদ্ধ করে দেয়।’
তবে নোটবই তো গোপনে বিক্রি হচ্ছে না যে, তার জন্য গোয়েন্দা পুলিশের গভীর রাতের বিচ্ছিন্ন অভিযান প্রয়োজন। ১২ মার্চের প্রথম আলোর ‘দেদার বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ গাইডবই’ শিরোনামের খবর পড়লেই এ সত্য বোঝা যায়। সুতরাং, জাতিকে মেধাশূন্যতার চরমে পৌঁছে দেওয়ার আগেই এ ব্যাপারে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের রাজনীতি চর্চার প্রধান লক্ষ্যই হওয়া উচিত শিক্ষার উন্নয়ন, যা সার্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি।
শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।
shantonabi@gmail.com
No comments