সরল গরল-প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমা বৈধ নয় by মিজানুর রহমান খান
‘তিনি একজন আইনজীবী হয়ে কীভাবে একজন আইনজীবীর খুনিকে ক্ষমা করতে পারলেন?’ —বেগম নুরুল ইসলাম
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, আইনজীবী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় দণ্ডিত আসামি বিপ্লবের দণ্ড মওকুফের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত হাটে হাঁড়ি ভেঙেছেন। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, আইনজীবী নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় দণ্ডিত আসামি বিপ্লবের দণ্ড মওকুফের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি।
আইনমন্ত্রী তাঁকে জানিয়েছেন যে এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। সরকার পরিচালনার রুলস অব বিজনেসে লেখা আছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৪৯ অনুচ্ছেদ-সংক্রান্ত বিষয় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করবে। তবে এ ধরনের নথি শুরুতেই ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে যায়। প্রথমেই বলে নিই, এটা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নয়। মন্ত্রিসভার ক্ষমা নয়। ক্ষমাহীন এই ক্ষমার দায় প্রধানমন্ত্রীর। পত্রিকাগুলো যদি বড় বড় শিরোনাম করত কার্যত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা, সেটা বেশ হতো। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ বইয়ের ৩২২ পৃষ্ঠায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বরাতে লিখেছেন, ‘অন্যান্য ক্ষমতার মতো এই ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে প্রয়োগ করতে হয়।’ সুতরাং এই ক্ষমা রাষ্ট্রপতির নয়।
একটি মিল আছে। ২০০৫ সালে সুইডেনপ্রবাসী জিন্টুর মৃত্যুদণ্ড মওকুফের ঘটনায় সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দোহাই দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের আইনমন্ত্রীও তা-ই দিলেন। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রে এভাবে দায় এড়ানো সম্ভব নয়। বিপ্লব ও জিন্টুদের ক্ষমার আসল দায় প্রধানমন্ত্রীর, সংসদের কাছে যৌথভাবে মন্ত্রিসভার।
সুরঞ্জিতের সুরে মওদুদও বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে দায়ী করা যাবে না। এ দাবি সঠিক, কিন্তু নিরঙ্কুশ অর্থে নয়। কারণ, সংবিধান এ-সংক্রান্ত নথিতে ‘মেকানিক্যালি’ সই দিতে তাঁকে বলেনি। যদি জানতাম, তিনি পুনর্বিবেচনার জন্য নথিটি অন্তত একবার ফেরত পাঠিয়েছিলেন কিংবা দ্য স্মিথ বর্ণিত সতর্ক ও পরামর্শ দেওয়ার ঐতিহ্যগত দায়িত্ব পালনে ব্রতী ছিলেন, তাহলে কথা ছিল। অবশ্য এই রাষ্ট্রপতি রাবারস্ট্যাম্প হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন। শপথ নেওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, তাঁর নেত্রী কোনো ভুল করতে পারেন না। তাঁর সামনে বিকল্প ছিল। মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন বা আরও লঘু দণ্ড দিতে পরামর্শ দিতে পারতেন। দোষীসাব্যস্তকরণ ও দণ্ড দুটো আলাদা বিষয়। তাই ক্ষমা শর্ত ও নিঃশর্ত হতে পারে। শুধু দণ্ড ক্ষমা করলে আইনের চোখে দণ্ডিতের ‘কনভিকশন’ থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে কী ঘটেছে, তা জানি না।
এটি মূলত ব্রিটেনের অনুসৃত ‘রয়্যাল প্রিরোগেটিভ’ থেকে এসেছে। ৪৯ অনুচ্ছেদে বাংলায় ‘অধিকার’ লেখা হলেও ইংরেজিতে কথাটি প্রিরোগেটিভ বা বিশেষাধিকার। ব্রিটেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বহু দেশের সংবিধানে এটা আছে এবং মূলত একই অর্থে ও ব্যাপ্তিতে। আমাদের জানামতে, এই বিষয়ে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের কোনো রায় নেই।
ভারতে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট বিপুলসংখ্যক মামলার বৈধতা পরীক্ষা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তা ঘটেনি। আমাদের আদালত সম্ভবত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রথম আলোতে প্রকাশিত বক্তব্যের সূত্র ধরেই সুয়োমোটো রুল জারি করতে পারেন। কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি রিট করতে পারেন। নুরুল ইসলামের স্ত্রীর সেই অধিকার তো অবশ্যই রয়েছে। সেনগুপ্তের ধন্যবাদ প্রাপ্য। কারণ, এই সিদ্ধান্ত যে চ্যালেঞ্জযোগ্য, সেই সত্য তিনি অকপটে উচ্চারণ করেছেন।
স্মরণাতীত কাল থেকে ব্রিটেনে এই রয়্যাল প্রিরোগেটিভের প্রয়োগ ঘটে আসছে। এর মূল ভিত্তি হচ্ছে নৈতিকতা ও জনকল্যাণ। বিপ্লবকে দেওয়া ফাঁসির রায় যে ভুল ছিল, সে দাবি কিন্তু সরকার এখনো করেনি। প্রাচীন ব্রিটেনের এক রাজা ক্ষমার আবেদন পেয়ে ভুলক্রমে তা আদালতে পাঠান। প্রধান বিচারপতি পুনঃ শুনানি করেন। এতে দণ্ডিত ব্যক্তি নির্দোষ প্রমাণিত হন। আদালতের মারাত্মক কোনো বিচ্যুতি বা ভুল শোধরাতেই এই বিধান রাখা। কোনো প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির খেয়ালখুশির প্রতিফলন ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। ভারত বহুকাল এই ঘোরের মধ্যে থেকেছে যে রাষ্ট্রপতির এই বিশেষাধিকার সংসদের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা চলে কি না। আদালত এর বৈধতা পরীক্ষা করতে পারেন কি না। এরপর ১৯৬১ সালে নানাভাতি মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে স্বীকার করেন যে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা বেড়ি পরানোর ঊর্ধ্বে নয়। ব্রিটিশ আইনবিদ ব্লাকস্টোন ও তাঁদের আদালত মেনেছেন যে সংসদ ‘রয়্যাল প্রিরোগেটিভ’ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
আমেরিকান জুরুসপ্রুডেন্স বইয়ে লেখা আছে, ‘প্রত্যেক সভ্য দেশ স্বীকৃতি দেয় যে ক্ষমার ক্ষমতা উপযুক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনুগ্রহ ও মানবতার নিরিখে প্রয়োগ করা হবে। এ ধরনের ক্ষমতার বিধান ছাড়া একটি দেশ তার রাজনৈতিক নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে অযথার্থ ও ঘাটতিপূর্ণ থেকে যাবে।’ বাংলাদেশের নৃপতিরা যখন ৪৯ অনুচ্ছেদের দিকে চোখ তুলে তাকান, তখন তাঁদের বিবেক কী বলে? ‘রাজনৈতিক নৈতিকতা’ বলে কিছু কি অবশিষ্ট আছে?
মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট ১৯২৭ সালে বিডল বনাম পেরোহিচ মামলায় বিচারপতি হোমস এই ক্ষমতার অন্তর্নিহিত দর্শন সম্পর্কে বলেন, ‘ক্ষমা প্রদর্শন ঘটনাচক্রে ক্ষমতায় থাকা কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত করুণা প্রদর্শনের বিষয় নয়। এটা সাংবিধানিক স্কিমের অংশ। যে ক্ষেত্রে এটা মঞ্জুর করা হয়, সে ক্ষেত্রে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষের এই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতে হবে যে একটি রায়ে, যা নির্ধারিত হয়েছে, তার চেয়ে ক্ষমা করার মধ্য দিয়ে জনকল্যাণ অধিকতর উত্তম রূপে নিশ্চিত হবে।’ বিপ্লব-জিন্টুরা যেভাবে ক্ষমা পাচ্ছেন, তার নৈতিকতা ও বৈধতা বিচারপতি হোমসের ওই উক্তির আলোকে যাচাইযোগ্য। এবং আমাদের এটা বিশ্বাস করার সংগত কারণ আছে যে লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের সভাপতির আবেদনে বিপ্লবকে ক্ষমা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ‘ব্যক্তিগত করুণা’। এর সঙ্গে জনকল্যাণের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এই ক্ষমা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তথাকথিত ‘প্রয়োজনীয় অশুভ প্রক্রিয়া’কে আরও ভয়ংকর দিকে ধাবিত করবে। খুনিরা নৃত্য করবে।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী যাঁর মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেছেন, সেটা দৃশ্যত আদালতের ভুল রায়ে একজন নিরীহ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তি নয়। বিপ্লব আরও দুটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। আইনের প্রতি তাঁর কখনো শ্রদ্ধা ছিল, এর কোনো প্রমাণ আমরা পাই না। একটানা ১০ বছরের বেশি সময় বিপ্লব আইনের চোখে পলাতক ছিলেন। আদালতে তাঁর তথাকথিত আত্মসমর্পণের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমার সইয়ের তারিখের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্পষ্ট।
অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, বিএনপি বা পরবর্তী সরকার এই সিদ্ধান্ত উল্টাতে পারবে কি না। নাগরিকের মনে এমন জিজ্ঞাসা খুবই স্বাভাবিক। অন্য ক্ষেত্রে তাঁরা তো এটাই দেখেন। গতকাল কথা হয় বিএনপির নিহত নেতা ও আইনজীবী নুরুল ইসলামের স্ত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আইনগত সুযোগ থাকলে তিনি এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত। তবে তিনি গতকালই টক শোতে শুনেছেন, রাষ্ট্রপতি আইনজীবী ছিলেন। তাই তাঁর আকুল প্রশ্ন, ‘তিনি একজন আইনজীবী হয়ে কীভাবে একজন আইনজীবীর খুনিকে ক্ষমা করতে পারলেন?’
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের প্রতীয়মান হয়, এই ক্ষমা অবৈধ ও গুরুতররূপে সংবিধানের চেতনানাশক। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও ড. আনিসুজ্জামান আইনকোষ-এ লিখেছেন, ‘একবার ক্ষমা মঞ্জুর করা হইলে আসামিকে বিচারের সম্মুখীন করা যায় না এবং দোষী সাব্যস্ত করা হইয়া থাকিলে শাস্তি প্রদান করা যায় না। অভিযুক্ত অথবা শাস্তি প্রদান করিবার বিরুদ্ধে ক্ষমাপ্রদর্শনের অজুহাত খাড়া করিবার দায়িত্ব ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তির। যদি তিনি যতশীঘ্রসম্ভব তাহা না করেন, তবে তিনি তাহা পরিত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া সাব্যস্ত হইবে।’ আমরা মনে করি, বিপ্লবের বাবার আবেদনটি ছিল তামাদি এবং সে কারণেই তা পরিত্যক্ত। কারণ, রায়ের পরে ‘যতশীঘ্রসম্ভব’ বলতে অর্ধযুগ পেরোনো কোনো সময়কে কল্পনাতে আনাও এক কষ্টকল্পনা।
বিপ্লবের দণ্ডের তারিখ ৯ ডিসেম্বর, ২০০৩। গত ৬ এপ্রিল বিপ্লব আত্মসমর্পণ করেন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে আড়াই বছর হয়ে গেছে। কিন্তু বোঝাই যায়, ম্যানেজ করতে সময় লেগেছে। অনুমান করতে পারি, আবেদনটি ৬ এপ্রিলের পর করা হয়েছে। পলাতক অবস্থায় তাঁর আবেদন করার কথা নয়। অবশ্য সেটাও যদি ঘটে, অবাক হব না। জিন্টুর দণ্ড মওকুফের ঘটনায় আমরা ধারণা পেয়েছিলাম যে সুপরিকল্পিতভাবে তথ্য গোপন করা হয়েছিল। বিপ্লবের ক্ষেত্রে সে রকম কিছু শুনতে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু বাংলাভিশনের এক আলোচনায় মাহমুদুর রহমান মান্না আমাকে প্রশ্ন করেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে উল্লেখ করেন যে এই দণ্ড মওকুফে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে একমত হননি। বরং তা ৎ ক্ষণিক তিনি নাকি সিদ্ধান্তের যথার্থতা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, দণ্ড মওকুফের এই সিদ্ধান্ত বাতিল বা প্রত্যাহার করা সম্ভব কি না। দৃষ্টান্ত বিরল। তবু খুঁজে দু-একটি পেয়েছি এবং আমাদের বিবেচনায় তা অকাট্য। ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি। শাহবাজ নামের এক ব্যক্তির খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড হলো। লাহোর হাইকোর্টে আপিল হলো। দণ্ড হ্রাস পেয়ে তিনি যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে অভিযুক্ত ব্যক্তির ভাই পাঞ্জাব সরকারের কাছে দণ্ড মওকুফের আবেদন জানান। ১৯৫৪ সালের আগস্টে প্রাদেশিক সরকারের আদেশে ১৪ আগস্ট থেকে দণ্ড মওকুফ কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ১৩ আগস্ট অর্থা ৎ ওই আদেশ কার্যকর হওয়ার আগেই পাল্টা আদেশ দিয়ে পূর্ববর্তী দণ্ড মওকুফের আদেশ বাতিল করা হয়। ফেডারেল কোর্টের কাছে আবেদনকারী এই নালিশ নিয়ে যান যে প্রাদেশিক সরকার একবার দণ্ড মওকুফ করে তা আর বাতিল করতে পারে না। এই যুক্তির পক্ষে ভেংকট যশোবন্ত দেশপান্ডে বনাম সম্রাট (দ্বিতীয়) মামলার দৃষ্টান্ত হাজির করা হয়। এতে অপরাধীদের দণ্ড মওকুফের ঘোষণা একইভাবে একটি নির্দিষ্ট তারিখ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এ সময়ে নাগপুর সরকারের আইন বিভাগের একজন কর্মকর্তা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে এক চিঠি দিয়ে জানান, ওই দণ্ডিতদের মুক্তি দেওয়া যাবে না। পরে নাগপুরের ফুল বেঞ্চ এ মর্মে একমত হন যে ‘কাউকে ক্ষমা প্রদর্শনের পরে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া যায় কি না, তা সংশয়পূর্ণ। তবে তেমন সুযোগ যদি থাকেও, তাহলে একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের পর সে ক্ষমতা সরকারের থাকে না।’ এ রায়ে দণ্ডিতরা মুক্তি পেয়েছিলেন।
বিপ্লবের ক্ষেত্রে নিশ্চয় ‘সেই নির্দিষ্ট সময়’ পার হয়ে যায়নি। নাগপুরের দণ্ডিতরা বিপ্লবের মতো দুর্ধর্ষও ছিলেন না। তাঁরা জোড়া যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন না। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের ফেডারেল কোর্ট শাহবাজ মামলায় কী বলেছিলেন, সেটা প্রাসঙ্গিক। পাকিস্তানের ফেডারেল কোর্ট দেখেন, পাঞ্জাব সরকার দণ্ড মওকুফের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার নির্দেশও দেয়নি। এমনকি নির্দিষ্ট তারিখের আগেই তারা পুনর্বিবেচনা করেছে। দণ্ড মওকুফের সিদ্ধান্ত বাতিল তাই আইনের চোখে বৈধ।
এই যুক্তির সপক্ষে আমাদের বরেণ্য বিচারকদের রায়ও আছে। বিচারপতি মোর্শেদ, বিচারপতি সাত্তার ও বিচারপতি সায়েমের সমন্বয়ে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের ফুল বেঞ্চ ১৯৬৩ সালে বহুল আলোচিত কর্নেল ভট্টাচার্যের মামলার রায় দিতে গিয়ে ওই শাহবাজ ও দেশপান্ডে মামলার রায় বিবেচনায় নেন। এবং তাঁরা এ সম্পর্কে একটি অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছান। আর তা হলো, সরকার কারও দণ্ড মওকুফ করে তা বাতিল করতে পারে। তবে অসময়ে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। সুতরাং আমরা দেখি রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতার প্রয়োগ প্রত্যাহারযোগ্য। আইনজীবী রাষ্ট্রপতি সেটা অন্তত বুঝবেন।
আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং না থাকা, রায়ের অর্ধযুগ পরে ক্ষমার আবেদন এবং সর্বোপরি রায় প্রদানে কোনো গলদ না থাকা ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্ত বৈধ বলে প্রতীয়মান হয় না। আর সে কারণেই আমরা তা প্রত্যাহারযোগ্য মনে করি। যদি সেটা না করা হয়, তাহলে বাকি রইল আদালতের শরণাপন্ন হওয়া। টিভির টক শোতে অনেককে দেখি এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। মাহমুদুল ইসলামের মতে, ‘মেরিটে সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ বিচারিক তদন্তের বাইরে। কিন্তু আইনের শাসন যখন সাংবিধানিক ম্যান্ডেট, তখন ক্ষমতার কোনো প্রয়োগই একনায়কসুলভ বা বৈষম্যমূলক হতে পারে না। একনায়কসুলভ বা খেয়ালখুশিমতো সিদ্ধান্ত বাতিল।’ এই ক্ষমা সন্দেহাতীতভাবে বৈষম্যমূলক। এবং সে কারণে তা আদালতের তদন্তযোগ্য।
ভারতের খ্যাতিমান বিচারপতি কৃষ্ণা আয়ারের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করি। ১৯৯৮ সালে শরণ সিং বনাম উত্তর প্রদেশ মামলায় তিনি বলেন, ‘কোনো মুখ্যমন্ত্রীর খেয়াল চাপল তিনি তাঁর জন্মদিনে ক্ষমা করে জেলখানা খালি করবেন, সেই পাগলামি মেনে নেওয়া সংবিধানের প্রতি চরম সন্ত্রাস।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
একটি মিল আছে। ২০০৫ সালে সুইডেনপ্রবাসী জিন্টুর মৃত্যুদণ্ড মওকুফের ঘটনায় সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দোহাই দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের আইনমন্ত্রীও তা-ই দিলেন। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রে এভাবে দায় এড়ানো সম্ভব নয়। বিপ্লব ও জিন্টুদের ক্ষমার আসল দায় প্রধানমন্ত্রীর, সংসদের কাছে যৌথভাবে মন্ত্রিসভার।
সুরঞ্জিতের সুরে মওদুদও বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে দায়ী করা যাবে না। এ দাবি সঠিক, কিন্তু নিরঙ্কুশ অর্থে নয়। কারণ, সংবিধান এ-সংক্রান্ত নথিতে ‘মেকানিক্যালি’ সই দিতে তাঁকে বলেনি। যদি জানতাম, তিনি পুনর্বিবেচনার জন্য নথিটি অন্তত একবার ফেরত পাঠিয়েছিলেন কিংবা দ্য স্মিথ বর্ণিত সতর্ক ও পরামর্শ দেওয়ার ঐতিহ্যগত দায়িত্ব পালনে ব্রতী ছিলেন, তাহলে কথা ছিল। অবশ্য এই রাষ্ট্রপতি রাবারস্ট্যাম্প হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন। শপথ নেওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন, তাঁর নেত্রী কোনো ভুল করতে পারেন না। তাঁর সামনে বিকল্প ছিল। মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন বা আরও লঘু দণ্ড দিতে পরামর্শ দিতে পারতেন। দোষীসাব্যস্তকরণ ও দণ্ড দুটো আলাদা বিষয়। তাই ক্ষমা শর্ত ও নিঃশর্ত হতে পারে। শুধু দণ্ড ক্ষমা করলে আইনের চোখে দণ্ডিতের ‘কনভিকশন’ থেকে যাবে। এ ক্ষেত্রে কী ঘটেছে, তা জানি না।
এটি মূলত ব্রিটেনের অনুসৃত ‘রয়্যাল প্রিরোগেটিভ’ থেকে এসেছে। ৪৯ অনুচ্ছেদে বাংলায় ‘অধিকার’ লেখা হলেও ইংরেজিতে কথাটি প্রিরোগেটিভ বা বিশেষাধিকার। ব্রিটেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো বহু দেশের সংবিধানে এটা আছে এবং মূলত একই অর্থে ও ব্যাপ্তিতে। আমাদের জানামতে, এই বিষয়ে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের কোনো রায় নেই।
ভারতে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট বিপুলসংখ্যক মামলার বৈধতা পরীক্ষা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে তা ঘটেনি। আমাদের আদালত সম্ভবত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রথম আলোতে প্রকাশিত বক্তব্যের সূত্র ধরেই সুয়োমোটো রুল জারি করতে পারেন। কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি রিট করতে পারেন। নুরুল ইসলামের স্ত্রীর সেই অধিকার তো অবশ্যই রয়েছে। সেনগুপ্তের ধন্যবাদ প্রাপ্য। কারণ, এই সিদ্ধান্ত যে চ্যালেঞ্জযোগ্য, সেই সত্য তিনি অকপটে উচ্চারণ করেছেন।
স্মরণাতীত কাল থেকে ব্রিটেনে এই রয়্যাল প্রিরোগেটিভের প্রয়োগ ঘটে আসছে। এর মূল ভিত্তি হচ্ছে নৈতিকতা ও জনকল্যাণ। বিপ্লবকে দেওয়া ফাঁসির রায় যে ভুল ছিল, সে দাবি কিন্তু সরকার এখনো করেনি। প্রাচীন ব্রিটেনের এক রাজা ক্ষমার আবেদন পেয়ে ভুলক্রমে তা আদালতে পাঠান। প্রধান বিচারপতি পুনঃ শুনানি করেন। এতে দণ্ডিত ব্যক্তি নির্দোষ প্রমাণিত হন। আদালতের মারাত্মক কোনো বিচ্যুতি বা ভুল শোধরাতেই এই বিধান রাখা। কোনো প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির খেয়ালখুশির প্রতিফলন ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। ভারত বহুকাল এই ঘোরের মধ্যে থেকেছে যে রাষ্ট্রপতির এই বিশেষাধিকার সংসদের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা চলে কি না। আদালত এর বৈধতা পরীক্ষা করতে পারেন কি না। এরপর ১৯৬১ সালে নানাভাতি মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে স্বীকার করেন যে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা বেড়ি পরানোর ঊর্ধ্বে নয়। ব্রিটিশ আইনবিদ ব্লাকস্টোন ও তাঁদের আদালত মেনেছেন যে সংসদ ‘রয়্যাল প্রিরোগেটিভ’ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
আমেরিকান জুরুসপ্রুডেন্স বইয়ে লেখা আছে, ‘প্রত্যেক সভ্য দেশ স্বীকৃতি দেয় যে ক্ষমার ক্ষমতা উপযুক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনুগ্রহ ও মানবতার নিরিখে প্রয়োগ করা হবে। এ ধরনের ক্ষমতার বিধান ছাড়া একটি দেশ তার রাজনৈতিক নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে অযথার্থ ও ঘাটতিপূর্ণ থেকে যাবে।’ বাংলাদেশের নৃপতিরা যখন ৪৯ অনুচ্ছেদের দিকে চোখ তুলে তাকান, তখন তাঁদের বিবেক কী বলে? ‘রাজনৈতিক নৈতিকতা’ বলে কিছু কি অবশিষ্ট আছে?
মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট ১৯২৭ সালে বিডল বনাম পেরোহিচ মামলায় বিচারপতি হোমস এই ক্ষমতার অন্তর্নিহিত দর্শন সম্পর্কে বলেন, ‘ক্ষমা প্রদর্শন ঘটনাচক্রে ক্ষমতায় থাকা কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত করুণা প্রদর্শনের বিষয় নয়। এটা সাংবিধানিক স্কিমের অংশ। যে ক্ষেত্রে এটা মঞ্জুর করা হয়, সে ক্ষেত্রে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষের এই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতে হবে যে একটি রায়ে, যা নির্ধারিত হয়েছে, তার চেয়ে ক্ষমা করার মধ্য দিয়ে জনকল্যাণ অধিকতর উত্তম রূপে নিশ্চিত হবে।’ বিপ্লব-জিন্টুরা যেভাবে ক্ষমা পাচ্ছেন, তার নৈতিকতা ও বৈধতা বিচারপতি হোমসের ওই উক্তির আলোকে যাচাইযোগ্য। এবং আমাদের এটা বিশ্বাস করার সংগত কারণ আছে যে লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের সভাপতির আবেদনে বিপ্লবকে ক্ষমা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ‘ব্যক্তিগত করুণা’। এর সঙ্গে জনকল্যাণের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এই ক্ষমা দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তথাকথিত ‘প্রয়োজনীয় অশুভ প্রক্রিয়া’কে আরও ভয়ংকর দিকে ধাবিত করবে। খুনিরা নৃত্য করবে।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী যাঁর মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেছেন, সেটা দৃশ্যত আদালতের ভুল রায়ে একজন নিরীহ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তি নয়। বিপ্লব আরও দুটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত। আইনের প্রতি তাঁর কখনো শ্রদ্ধা ছিল, এর কোনো প্রমাণ আমরা পাই না। একটানা ১০ বছরের বেশি সময় বিপ্লব আইনের চোখে পলাতক ছিলেন। আদালতে তাঁর তথাকথিত আত্মসমর্পণের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমার সইয়ের তারিখের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্পষ্ট।
অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, বিএনপি বা পরবর্তী সরকার এই সিদ্ধান্ত উল্টাতে পারবে কি না। নাগরিকের মনে এমন জিজ্ঞাসা খুবই স্বাভাবিক। অন্য ক্ষেত্রে তাঁরা তো এটাই দেখেন। গতকাল কথা হয় বিএনপির নিহত নেতা ও আইনজীবী নুরুল ইসলামের স্ত্রীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আইনগত সুযোগ থাকলে তিনি এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত। তবে তিনি গতকালই টক শোতে শুনেছেন, রাষ্ট্রপতি আইনজীবী ছিলেন। তাই তাঁর আকুল প্রশ্ন, ‘তিনি একজন আইনজীবী হয়ে কীভাবে একজন আইনজীবীর খুনিকে ক্ষমা করতে পারলেন?’
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের প্রতীয়মান হয়, এই ক্ষমা অবৈধ ও গুরুতররূপে সংবিধানের চেতনানাশক। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও ড. আনিসুজ্জামান আইনকোষ-এ লিখেছেন, ‘একবার ক্ষমা মঞ্জুর করা হইলে আসামিকে বিচারের সম্মুখীন করা যায় না এবং দোষী সাব্যস্ত করা হইয়া থাকিলে শাস্তি প্রদান করা যায় না। অভিযুক্ত অথবা শাস্তি প্রদান করিবার বিরুদ্ধে ক্ষমাপ্রদর্শনের অজুহাত খাড়া করিবার দায়িত্ব ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তির। যদি তিনি যতশীঘ্রসম্ভব তাহা না করেন, তবে তিনি তাহা পরিত্যাগ করিয়াছেন বলিয়া সাব্যস্ত হইবে।’ আমরা মনে করি, বিপ্লবের বাবার আবেদনটি ছিল তামাদি এবং সে কারণেই তা পরিত্যক্ত। কারণ, রায়ের পরে ‘যতশীঘ্রসম্ভব’ বলতে অর্ধযুগ পেরোনো কোনো সময়কে কল্পনাতে আনাও এক কষ্টকল্পনা।
বিপ্লবের দণ্ডের তারিখ ৯ ডিসেম্বর, ২০০৩। গত ৬ এপ্রিল বিপ্লব আত্মসমর্পণ করেন। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে আড়াই বছর হয়ে গেছে। কিন্তু বোঝাই যায়, ম্যানেজ করতে সময় লেগেছে। অনুমান করতে পারি, আবেদনটি ৬ এপ্রিলের পর করা হয়েছে। পলাতক অবস্থায় তাঁর আবেদন করার কথা নয়। অবশ্য সেটাও যদি ঘটে, অবাক হব না। জিন্টুর দণ্ড মওকুফের ঘটনায় আমরা ধারণা পেয়েছিলাম যে সুপরিকল্পিতভাবে তথ্য গোপন করা হয়েছিল। বিপ্লবের ক্ষেত্রে সে রকম কিছু শুনতে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু বাংলাভিশনের এক আলোচনায় মাহমুদুর রহমান মান্না আমাকে প্রশ্ন করেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে উল্লেখ করেন যে এই দণ্ড মওকুফে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে একমত হননি। বরং তা ৎ ক্ষণিক তিনি নাকি সিদ্ধান্তের যথার্থতা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, দণ্ড মওকুফের এই সিদ্ধান্ত বাতিল বা প্রত্যাহার করা সম্ভব কি না। দৃষ্টান্ত বিরল। তবু খুঁজে দু-একটি পেয়েছি এবং আমাদের বিবেচনায় তা অকাট্য। ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি। শাহবাজ নামের এক ব্যক্তির খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড হলো। লাহোর হাইকোর্টে আপিল হলো। দণ্ড হ্রাস পেয়ে তিনি যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে অভিযুক্ত ব্যক্তির ভাই পাঞ্জাব সরকারের কাছে দণ্ড মওকুফের আবেদন জানান। ১৯৫৪ সালের আগস্টে প্রাদেশিক সরকারের আদেশে ১৪ আগস্ট থেকে দণ্ড মওকুফ কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ১৩ আগস্ট অর্থা ৎ ওই আদেশ কার্যকর হওয়ার আগেই পাল্টা আদেশ দিয়ে পূর্ববর্তী দণ্ড মওকুফের আদেশ বাতিল করা হয়। ফেডারেল কোর্টের কাছে আবেদনকারী এই নালিশ নিয়ে যান যে প্রাদেশিক সরকার একবার দণ্ড মওকুফ করে তা আর বাতিল করতে পারে না। এই যুক্তির পক্ষে ভেংকট যশোবন্ত দেশপান্ডে বনাম সম্রাট (দ্বিতীয়) মামলার দৃষ্টান্ত হাজির করা হয়। এতে অপরাধীদের দণ্ড মওকুফের ঘোষণা একইভাবে একটি নির্দিষ্ট তারিখ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এ সময়ে নাগপুর সরকারের আইন বিভাগের একজন কর্মকর্তা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে এক চিঠি দিয়ে জানান, ওই দণ্ডিতদের মুক্তি দেওয়া যাবে না। পরে নাগপুরের ফুল বেঞ্চ এ মর্মে একমত হন যে ‘কাউকে ক্ষমা প্রদর্শনের পরে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া যায় কি না, তা সংশয়পূর্ণ। তবে তেমন সুযোগ যদি থাকেও, তাহলে একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ের পর সে ক্ষমতা সরকারের থাকে না।’ এ রায়ে দণ্ডিতরা মুক্তি পেয়েছিলেন।
বিপ্লবের ক্ষেত্রে নিশ্চয় ‘সেই নির্দিষ্ট সময়’ পার হয়ে যায়নি। নাগপুরের দণ্ডিতরা বিপ্লবের মতো দুর্ধর্ষও ছিলেন না। তাঁরা জোড়া যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন না। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের ফেডারেল কোর্ট শাহবাজ মামলায় কী বলেছিলেন, সেটা প্রাসঙ্গিক। পাকিস্তানের ফেডারেল কোর্ট দেখেন, পাঞ্জাব সরকার দণ্ড মওকুফের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার নির্দেশও দেয়নি। এমনকি নির্দিষ্ট তারিখের আগেই তারা পুনর্বিবেচনা করেছে। দণ্ড মওকুফের সিদ্ধান্ত বাতিল তাই আইনের চোখে বৈধ।
এই যুক্তির সপক্ষে আমাদের বরেণ্য বিচারকদের রায়ও আছে। বিচারপতি মোর্শেদ, বিচারপতি সাত্তার ও বিচারপতি সায়েমের সমন্বয়ে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের ফুল বেঞ্চ ১৯৬৩ সালে বহুল আলোচিত কর্নেল ভট্টাচার্যের মামলার রায় দিতে গিয়ে ওই শাহবাজ ও দেশপান্ডে মামলার রায় বিবেচনায় নেন। এবং তাঁরা এ সম্পর্কে একটি অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছান। আর তা হলো, সরকার কারও দণ্ড মওকুফ করে তা বাতিল করতে পারে। তবে অসময়ে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। সুতরাং আমরা দেখি রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতার প্রয়োগ প্রত্যাহারযোগ্য। আইনজীবী রাষ্ট্রপতি সেটা অন্তত বুঝবেন।
আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং না থাকা, রায়ের অর্ধযুগ পরে ক্ষমার আবেদন এবং সর্বোপরি রায় প্রদানে কোনো গলদ না থাকা ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা ঘোষণার সিদ্ধান্ত বৈধ বলে প্রতীয়মান হয় না। আর সে কারণেই আমরা তা প্রত্যাহারযোগ্য মনে করি। যদি সেটা না করা হয়, তাহলে বাকি রইল আদালতের শরণাপন্ন হওয়া। টিভির টক শোতে অনেককে দেখি এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। মাহমুদুল ইসলামের মতে, ‘মেরিটে সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ বিচারিক তদন্তের বাইরে। কিন্তু আইনের শাসন যখন সাংবিধানিক ম্যান্ডেট, তখন ক্ষমতার কোনো প্রয়োগই একনায়কসুলভ বা বৈষম্যমূলক হতে পারে না। একনায়কসুলভ বা খেয়ালখুশিমতো সিদ্ধান্ত বাতিল।’ এই ক্ষমা সন্দেহাতীতভাবে বৈষম্যমূলক। এবং সে কারণে তা আদালতের তদন্তযোগ্য।
ভারতের খ্যাতিমান বিচারপতি কৃষ্ণা আয়ারের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করি। ১৯৯৮ সালে শরণ সিং বনাম উত্তর প্রদেশ মামলায় তিনি বলেন, ‘কোনো মুখ্যমন্ত্রীর খেয়াল চাপল তিনি তাঁর জন্মদিনে ক্ষমা করে জেলখানা খালি করবেন, সেই পাগলামি মেনে নেওয়া সংবিধানের প্রতি চরম সন্ত্রাস।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments