জনমনে আতঙ্কের সঙ্গত কারণ ছিল by রাহাত খান
রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা চলছে। সভা-মিছিলে ও গণমাধ্যমে দুই পক্ষের নিত্যদিন প্রবল উপস্থিতি। চলছে রাজনৈতিক আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ। সার্বিক পরিস্থিতিতে জনগণ উদ্বিগ্ন। সংঘাতময় অবস্থা তারা কোনোভাবেই চায় না। বরং বিরোধীয় যে কোনো ইস্যুর নিষ্পত্তি চায় আলোচনার মাধ্যমে।
এ সমাধান আসতে পারে কোন পথে, সেটা নিয়েই আলোচনা করেছেন দু'জন রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বারো মার্চ, বলা যায় মোটামুটি ভালোয় ভালোয় কাটল। অবশ্য রাজধানী ঢাকার নয়াপল্টনের আবহাওয়া সেদিন স্বাভাবিক ছিল না। ছিল উষ্ণতার চেয়েও একটু বেশি উষ্ণ। ছিল বেশি তপ্ত। বেশি শুষ্ক। আবহাওয়ায় সেদিন নয়াপল্টনের জলার্দ্রতাও বোধ করি ৯০ ডিগ্রির কাছাকাছি পেঁৗছে গিয়েছিল। বাতাস, আমার মনে হয় একটু বেশি ব্যস্ত ছিল, ব্যাঘ্র গর্জন, হুশিয়ারি উচ্চারণ এবং ক্ষোভ-জ্বালার শব্দ ও গর্মি শুষে নিতে। অবশ্য এরকমটাই তো হওয়ার কথা ছিল। গত ১২ মার্চ রাজনীতির বিরোধীদলীয় কর্মসূচি যে ক্ষমতা হারাবার হাহাকারে এবং ক্ষমতাসীনদের প্রতি তর্জন-গর্জনে ভরপুর থাকবে সেটা জানাই ছিল। প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন ছিল উদ্দিষ্ট বিরোধীদলীয় জোটটির 'গণতান্ত্রিক' আচরণে সাধারণত নিরীহ পথচারীর গাড়ি ভাংচুর, নগরীর এখানে-সেখানে গ্রেনেড ও বোমাবাজির 'সঙ্গীত-বাদন' প্রকাশ্য রূপ পায়, বিঘোষিত ১২ মার্চের কর্মসূচি সেই ধরনের কিছু একটা হয় কি-না। অস্বীকার করে লাভ নেই, জনমনে যথেষ্টই আতঙ্ক সঞ্চারিত হয়েছিল গত ১২ মার্চকে কেন্দ্র করে।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, সেদিন সেসব কিছু হয়নি। বলা যায় মোটামুটি ভালোয় ভালোয় কেটে গেছে দিনটি। হ্যাঁ, সরকারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা প্রশ্নে বাড়াবাড়ি করার অভিযোগ উঠেছে। দু'একটি বড় পত্রিকা লিখেছে, 'ঢাকা চলো' কর্মসূচি সফল করতে বিএনপি তথা চারদলীয় জোটকে তেমন কিছু করতে হয়নি। নিরাপত্তার নামে সরকার এবং সরকারি দলের বাড়াবাড়িই সেটা করে দিয়েছে। প্রচারমাধ্যমের কোথাও কোথাও প্রশ্ন তোলা হয়েছে বাস-লঞ্চ বন্ধ করে, রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ-র্যাব মোতায়েন করে, জনসমাবেশ লক্ষ্য করে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের বেষ্টনী বসিয়ে সরকার তো স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছে। গণতন্ত্র কোথায়, সেই তো দমন-পীড়নের বাড়াবাড়ি। সেই তো জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা। সরকারের নেওয়া এসব নিরাপত্তামূলক পন্থাকে যদি কোনো নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের আচরণ বলে গণ্য করতে হয়, তাহলে স্বৈরতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন আর কাকে বলব! জনমনেও এ নিয়ে নানা প্রশ্ন। নানা ক্ষোভ। নানা নিন্দা, সমালোচনা।
প্রচারমাধ্যমে যা বলা হয়েছে তা অসত্য নয়। নিরাপত্তা প্রশ্নে গত ১২ মার্চ পুলিশ-র্যাব এবং অন্যান্য স্পেশাল ফোর্সের অতিরিক্ত সতর্কতা ও প্রস্তুতি নিয়ে জনমনের একাংশে যে প্রশ্ন ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে, সেটাকেও আমি অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক বলে মনে করি না। রাস্তাঘাট ও লঞ্চ টার্মিনালে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হওয়ার দরুন সৃষ্ট জনদুর্ভোগকেও দুর্ভাগ্যজনক বলা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
তবে আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের পূর্বাপর রাজনীতিতে যারা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ইটটি ছুড়ে মারতে খুবই পছন্দ করে অথচ পাল্টা পাটকেলটি পাওয়ার ভয়-আশঙ্কা দেখা দিলেই 'কোথায় গণতন্ত্র, কোথায় গণতন্ত্র' বলে চেঁচায়, তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সতর্কতা ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিকে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক আচরণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখাটা কতটা সমীচীন সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। সত্য চক্ষুষ্মান। এক চোখ কানা 'দৈত্য' নয়। পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে তবেই কোনো ঘটনার উপসংহারে যাওয়ার সঙ্গত বলে মনে করি।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছিল দেশ শাসনের দায়িত্বে ন্যস্ত। সে সময় রাজনীতি ও প্রতিপক্ষ দমনের নামে যেসব নৃশংস ও পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছিল সেগুলো এত তাড়াতাড়ি বিস্মৃত হয়ে যাওয়া সঙ্গত নয়। সে সময় যশোরে উদীচীর সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গীতসন্ধ্যায় নৃশংস গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটানো হয়। বেশ কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং দর্শক-শ্রোতা মারা যায়, আহত হয় শতাধিক। কিছুদিন পর একই ধরনের ঘটনা ঘটে পল্টনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জনসভায়। সভার মাঝখানে গোপনে পুঁতে রাখা শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হয়ে হতাহত হয় বহু লোক। রমনা পার্কে, ছায়ানট আয়োজিত বাঙালির আবাহনকালের উৎসব পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানেও চালানো হয় পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা, যে হামলায় ডজনখানেক নিরীহ লোকের প্রাণহানি ঘটে। সে সময় হামলাকারীদের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের প্রতি ঘৃণা, নিন্দা ও ধিক্কারের পাশাপাশি সরকার কেন জনসভা ও অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যথোচিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি, সেই প্রশ্নও কিন্তু প্রচারমাধ্যম, সুশীল সমাজ এবং ক্ষুব্ধ জনমনে উঠেছিল। বলাবাহুল্য, এসব পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের হোতারা বেশিরভাগ এখনও বিচারের বাইরে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারও নিরাপত্তাজনিত ব্যর্থতার জবাব দিতে পারেনি।
তারপর ধরা যাক ২০০১-০৬ শাসনামলের কথা। ২১ আগস্ট কী যে নৃশংস গ্রেনেড হামলা হয়েছিল তা ভাবলে আজও শিউরে উঠতে হয়। গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, তৎসহ শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করা। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। হামলায় নিহত হয়েছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভানেত্রী, বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভী রহমানসহ আরও ২৪ ব্যক্তি। হতাহত হয়েছিল কয়েকশ' লোক। লক্ষ্য করার বিষয়, ক্ষুব্ধ, রুষ্ট জনতা যাতে গ্রেনেট হামলাকারীদের দিকে ধাওয়া করতে না পারে, সে জন্য ওপরের নির্দেশে হামলাকারীদের দিকে ধাওয়া না করে দিকভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে বিষাক্ত কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ জনতার ওপরই। অকুস্থলে হামলা ও হত্যার আলামতও নষ্ট করে দেয় তারাই। বিএনপি স্বৈরতন্ত্র থেকে জন্ম নেওয়া এমনই এক 'গণতান্ত্রিক দল' ও সরকার (২০০১-০৬) যে তারা এই ঘৃণ্য, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করা দূরে থাক, উল্টো গ্রেনেড হামলার জন্য তারা আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেছিল। সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার স্বভাবজাত ক্রোধের ভঙ্গিতে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা যে আওয়ামী লীগের একটা অংশই করেছে, সেই প্রমাণ তার কাছে আছে!
বিএনপি যে কতটা নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক দল, তার প্রমাণ তো দেশবাসী বারবারই দেখেছে। এখনও দেখছে। দেখেছে ২১ আগস্টের মামলা ভিন্ন খাতে নিয়ে গিয়ে হামলাকারী আততায়ীদের আড়াল এবং জজ মিয়ার হাস্যকর নাটকের অবতারণা করতে। সাম্প্রতিক সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতির হত্যার বিরুদ্ধে সারাদেশে একটা ক্ষুব্ধতা বিরাজ করছে। হত্যাকাণ্ডটি যথেষ্ট জটিল, কেন ও কার বা কাদের দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার ক্লু পাওয়া খুবই কঠিন বলে অনেকেই মনে করি। তবু এই স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ডের দ্রুত সুরাহা ক্রমে ক্রমে গণদাবি হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিদিনকার তদন্ত মনিটর করছেন বলে জানা যায়। এ অবস্থায় বলার মধ্যে তিনি একবার শুধু বলেছিলেন, সরকার তো সর্বতোভাবে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করছে আর সরকার তো কারও বেডরুম পাহারা দিতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য সঠিক হয়েছিল কি-না সেটা অবশ্যই বিচার-বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য শুনে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বাঘিনীর মতো গর্জন করে তার যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, তাতে একটু অবাক না হয়ে পারি না। 'হ্যাঁ, বেডরুম পাহারা দেওয়াও দিতে হবে, ওটাও সরকারের দায়িত্ব।' গণতন্ত্রের বাঘিনীর গর্জন। তা সরকারের দায়িত্ব কতটা বা কদ্দুর, এ নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। আমার শুধু প্রশ্ন, খালেদা জিয়ার সময় (২০০১-০৬) বাংলাদেশের সবচেয়ে যোগ্য (জাতীয় নেতা শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের পর) অর্থমন্ত্রী, সবচেয়ে ভদ্র ও নিরীহ রাজনীতিক শামস কিবরিয়াকে যখন একটি প্রায় ঘরোয়া জনসভায় গ্রেনেড চার্জ করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়, রক্তাক্ত ও মুমূর্ষু কিবরিয়াকে দ্রুত ঢাকা নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে যখন একটি হেলিকপ্টার চাওয়া হয়, কই, তখন তো সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার টনক পর্যন্ত নড়েনি। সহানুভূতির উদ্রেক হয়নি। গণতান্ত্রিক আচরণ ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়টিকে তারা কোনো মূল্য দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি। বরং নিস্পৃহ কণ্ঠে বেগম সাহেবাকে নাকি বলতে শোনা গিয়েছিল, যাকে-তাকে দেওয়ার মতো হেলিকপ্টার সরকারের নেই।
ভাবতে অবাক লাগে। বাংলাদেশের সেরা মেধাবী ব্যক্তিদের একজন, শামস কিবরিয়ার মতো এক লোক বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কাছে হয়ে গিয়েছিলেন যে-সে লোক! সিলেট থেকে ঢাকা আসতে সাত ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার অভাবে কিবরিয়া সাহেব মাঝ রাস্তায় আসার আগেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যে দল/জোট ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না, উন্নয়নের নামগন্ধ থাকে না, কৃষি-শিল্প খাত যথোপযোগী ব্যবস্থা না নেওয়ায় মার খায়, যাদের শাসনামলে হত্যা, গ্রেনেড হামলা, লুণ্ঠন, অবাধ চোরাচালান, যাদের রাজনৈতিক অবৈধ অস্ত্র পাচার, ভারতবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি যাদের ট্রেডমার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই দলের নেত্রীর মুখে সরকারে থাকলে বেডরুমও পাহারা দিতে হবে, এই উক্তি কতটা বৈপরীত্যে ভরা, কতটা নির্মম পরিহাসের মতো শোনায়, সেই বিচারের ভার পাঠককুলের কাছে রইল। আমার এ সম্পর্কে বলার কিছু নেই।
বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিক জোটের এবারকার দাবি নির্বাচনের তিন মাস আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করা। মহাজোট সরকার, মনে হয় নির্বাচনের আগে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সমবায়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার বিষয়টি বিবেচনা করতে রাজি আছে। আওয়ামী লীগ, ১৪ দল এবং মহাজোট সরকার সেই তাগিদেই বোধকরি বারবার বিরোধী দলকে সংসদে এসে তত্ত্বাবধায়ক সম্পর্কিত তাদের বিকল্প প্রস্তাব পেশ করার আহ্বান জানিয়েছে। অনুনয়-বিনয়ের একশেষ করেছে তারা বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলতে। নানা রকম আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে একটা আপস-মীমাংসায় আসতে তারা রাজি, বিরোধী দল শুধু সংসদে এসে তাদের প্রস্তাবটা দিক।
কিন্তু সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে বিরোধী দলের একবিন্দু আগ্রহ নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদই সরকার ও বিরোধী দলের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু বিরোধী দল কিছুতেই সংসদে যাবে না। নিজেরা ক্ষমতায় থাকলে সংসদে যাবে, ক্ষমতার বাইরে থাকলে যাবে না_ এই গণতন্ত্র বিএনপি কোত্থেকে শিখেছে এটা ভাবার বিষয়। সংসদে তাদের এই না যাওয়াটা দুর্জ্ঞেয় রহস্যও বটে। সংসদে যাওয়ার প্রশ্নে তারা বলে, সংসদে যাওয়ার দরকার কী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি সরকার মেনে নিলেই তো হয়।
বিএনপি-জামায়াতের এহেন আচরণের অর্থ কি এই যে, রাজনীতিতে তাদের আর কিছু থাকার দরকার নেই_ গ্রেনেড শিল্পীরা, বোমা শিল্পীরা, জঙ্গি শিল্পীরা তাদের সঙ্গে আছে_ রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে পাল্টা দেওয়ার জন্য সেই 'শক্তিই' যথেষ্ট?
বিএনপি-জামায়াতের অতীত ও বর্তমান রাজনীতি এই অপসত্যটিকেই যেন তুলে ধরে। স্বৈরতন্ত্রের বর্ম ছেড়ে জনগণের সমর্থন আদায়ের রাজনীতি তারা কতটা বিশ্বাস করে_ সেটা এক প্রশ্ন। তাদের সংসদে না যাওয়া, তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে চাইলে সেটা বানচাল করার হুমকি ইত্যাদি যেন প্রমাণ করে, বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা যেন তাদের পছন্দ নয়, বাংলাদেশকে টেনে নিচে নামিয়ে ইথিওপিয়া, পাকিস্তান, সুদান প্রভৃতি ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত করা যেন তাদের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক মিশন।
আমার আলোচনা যে কারও কাছে ধান ভানতে শিবের গীত বলে মনে হতে পারে। মূল আলোচ্য বিষয় যেখানে ছিল গত ১২ মার্চ, নিরাপত্তার নামে সরকারের বাড়াবাড়ি, ঢাকাকে সারাদেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে জনদুর্ভোগের চূড়ান্ত করা, সেখানে বিরোধী দলের অতীত ও বর্তমানের আমলনামা নিয়ে 'অপ্রাসঙ্গিক' কথাবার্তা বলছি কেন?
এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমি মনে করি, অতীতে বিএনপি-জামায়াতের নৃশংসতা-পৈশাচিকতার যে রেকর্ড আছে তাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে সরকার একটু বাড়াবাড়ি রকমের সতর্কতা এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতেই পারে। যথোচিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে রাস্তাঘাটে, লঞ্চে, বাসে, বিএনপির জনসভায় কোনো অঘটন ঘটলে দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হতো। প্রচারমাধ্যম বা আমজনতা কেউই নিরাপত্তা দানে ব্যর্থতাকে তুলাধোনা না করে ছাড়ত না। বিএনপি-জামায়াত জোটের অতীত ও বর্তমান আমলনামা এ জন্যই সামান্য একটু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
দেশের স্বার্থে বিএনপি থেকে শুরু করে দেশের সব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দলেরই ইতিবাচক ভূমিকা আমরা দেখতে চাই। যাদের বিপক্ষে আঙুল তোলা, গণতান্ত্রিক নীতি এবং আচার-আচরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে আমার বক্তব্যটি ভুল ও অসত্য বলে তারা প্রমাণ করুন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হেরে যাওয়াতেও স্বস্তি ও সুখ আছে। আমি হেরে গিয়ে সেই স্বস্তি ও সুখের আস্বাদন করতে চাই।
স রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক
বারো মার্চ, বলা যায় মোটামুটি ভালোয় ভালোয় কাটল। অবশ্য রাজধানী ঢাকার নয়াপল্টনের আবহাওয়া সেদিন স্বাভাবিক ছিল না। ছিল উষ্ণতার চেয়েও একটু বেশি উষ্ণ। ছিল বেশি তপ্ত। বেশি শুষ্ক। আবহাওয়ায় সেদিন নয়াপল্টনের জলার্দ্রতাও বোধ করি ৯০ ডিগ্রির কাছাকাছি পেঁৗছে গিয়েছিল। বাতাস, আমার মনে হয় একটু বেশি ব্যস্ত ছিল, ব্যাঘ্র গর্জন, হুশিয়ারি উচ্চারণ এবং ক্ষোভ-জ্বালার শব্দ ও গর্মি শুষে নিতে। অবশ্য এরকমটাই তো হওয়ার কথা ছিল। গত ১২ মার্চ রাজনীতির বিরোধীদলীয় কর্মসূচি যে ক্ষমতা হারাবার হাহাকারে এবং ক্ষমতাসীনদের প্রতি তর্জন-গর্জনে ভরপুর থাকবে সেটা জানাই ছিল। প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন ছিল উদ্দিষ্ট বিরোধীদলীয় জোটটির 'গণতান্ত্রিক' আচরণে সাধারণত নিরীহ পথচারীর গাড়ি ভাংচুর, নগরীর এখানে-সেখানে গ্রেনেড ও বোমাবাজির 'সঙ্গীত-বাদন' প্রকাশ্য রূপ পায়, বিঘোষিত ১২ মার্চের কর্মসূচি সেই ধরনের কিছু একটা হয় কি-না। অস্বীকার করে লাভ নেই, জনমনে যথেষ্টই আতঙ্ক সঞ্চারিত হয়েছিল গত ১২ মার্চকে কেন্দ্র করে।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবানি, সেদিন সেসব কিছু হয়নি। বলা যায় মোটামুটি ভালোয় ভালোয় কেটে গেছে দিনটি। হ্যাঁ, সরকারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা প্রশ্নে বাড়াবাড়ি করার অভিযোগ উঠেছে। দু'একটি বড় পত্রিকা লিখেছে, 'ঢাকা চলো' কর্মসূচি সফল করতে বিএনপি তথা চারদলীয় জোটকে তেমন কিছু করতে হয়নি। নিরাপত্তার নামে সরকার এবং সরকারি দলের বাড়াবাড়িই সেটা করে দিয়েছে। প্রচারমাধ্যমের কোথাও কোথাও প্রশ্ন তোলা হয়েছে বাস-লঞ্চ বন্ধ করে, রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ-র্যাব মোতায়েন করে, জনসমাবেশ লক্ষ্য করে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের বেষ্টনী বসিয়ে সরকার তো স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছে। গণতন্ত্র কোথায়, সেই তো দমন-পীড়নের বাড়াবাড়ি। সেই তো জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা। সরকারের নেওয়া এসব নিরাপত্তামূলক পন্থাকে যদি কোনো নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের আচরণ বলে গণ্য করতে হয়, তাহলে স্বৈরতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন আর কাকে বলব! জনমনেও এ নিয়ে নানা প্রশ্ন। নানা ক্ষোভ। নানা নিন্দা, সমালোচনা।
প্রচারমাধ্যমে যা বলা হয়েছে তা অসত্য নয়। নিরাপত্তা প্রশ্নে গত ১২ মার্চ পুলিশ-র্যাব এবং অন্যান্য স্পেশাল ফোর্সের অতিরিক্ত সতর্কতা ও প্রস্তুতি নিয়ে জনমনের একাংশে যে প্রশ্ন ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে, সেটাকেও আমি অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক বলে মনে করি না। রাস্তাঘাট ও লঞ্চ টার্মিনালে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হওয়ার দরুন সৃষ্ট জনদুর্ভোগকেও দুর্ভাগ্যজনক বলা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
তবে আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের পূর্বাপর রাজনীতিতে যারা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ইটটি ছুড়ে মারতে খুবই পছন্দ করে অথচ পাল্টা পাটকেলটি পাওয়ার ভয়-আশঙ্কা দেখা দিলেই 'কোথায় গণতন্ত্র, কোথায় গণতন্ত্র' বলে চেঁচায়, তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সতর্কতা ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিকে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক আচরণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখাটা কতটা সমীচীন সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। সত্য চক্ষুষ্মান। এক চোখ কানা 'দৈত্য' নয়। পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে তবেই কোনো ঘটনার উপসংহারে যাওয়ার সঙ্গত বলে মনে করি।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছিল দেশ শাসনের দায়িত্বে ন্যস্ত। সে সময় রাজনীতি ও প্রতিপক্ষ দমনের নামে যেসব নৃশংস ও পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছিল সেগুলো এত তাড়াতাড়ি বিস্মৃত হয়ে যাওয়া সঙ্গত নয়। সে সময় যশোরে উদীচীর সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গীতসন্ধ্যায় নৃশংস গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটানো হয়। বেশ কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মী এবং দর্শক-শ্রোতা মারা যায়, আহত হয় শতাধিক। কিছুদিন পর একই ধরনের ঘটনা ঘটে পল্টনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জনসভায়। সভার মাঝখানে গোপনে পুঁতে রাখা শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরিত হয়ে হতাহত হয় বহু লোক। রমনা পার্কে, ছায়ানট আয়োজিত বাঙালির আবাহনকালের উৎসব পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান চলছিল। সেখানেও চালানো হয় পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা, যে হামলায় ডজনখানেক নিরীহ লোকের প্রাণহানি ঘটে। সে সময় হামলাকারীদের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের প্রতি ঘৃণা, নিন্দা ও ধিক্কারের পাশাপাশি সরকার কেন জনসভা ও অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যথোচিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়নি, সেই প্রশ্নও কিন্তু প্রচারমাধ্যম, সুশীল সমাজ এবং ক্ষুব্ধ জনমনে উঠেছিল। বলাবাহুল্য, এসব পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের হোতারা বেশিরভাগ এখনও বিচারের বাইরে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারও নিরাপত্তাজনিত ব্যর্থতার জবাব দিতে পারেনি।
তারপর ধরা যাক ২০০১-০৬ শাসনামলের কথা। ২১ আগস্ট কী যে নৃশংস গ্রেনেড হামলা হয়েছিল তা ভাবলে আজও শিউরে উঠতে হয়। গ্রেনেড হামলার মূল লক্ষ্য ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, তৎসহ শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা করা। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। হামলায় নিহত হয়েছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভানেত্রী, বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভী রহমানসহ আরও ২৪ ব্যক্তি। হতাহত হয়েছিল কয়েকশ' লোক। লক্ষ্য করার বিষয়, ক্ষুব্ধ, রুষ্ট জনতা যাতে গ্রেনেট হামলাকারীদের দিকে ধাওয়া করতে না পারে, সে জন্য ওপরের নির্দেশে হামলাকারীদের দিকে ধাওয়া না করে দিকভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে বিষাক্ত কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ জনতার ওপরই। অকুস্থলে হামলা ও হত্যার আলামতও নষ্ট করে দেয় তারাই। বিএনপি স্বৈরতন্ত্র থেকে জন্ম নেওয়া এমনই এক 'গণতান্ত্রিক দল' ও সরকার (২০০১-০৬) যে তারা এই ঘৃণ্য, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করা দূরে থাক, উল্টো গ্রেনেড হামলার জন্য তারা আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেছিল। সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার স্বভাবজাত ক্রোধের ভঙ্গিতে সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা যে আওয়ামী লীগের একটা অংশই করেছে, সেই প্রমাণ তার কাছে আছে!
বিএনপি যে কতটা নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক দল, তার প্রমাণ তো দেশবাসী বারবারই দেখেছে। এখনও দেখছে। দেখেছে ২১ আগস্টের মামলা ভিন্ন খাতে নিয়ে গিয়ে হামলাকারী আততায়ীদের আড়াল এবং জজ মিয়ার হাস্যকর নাটকের অবতারণা করতে। সাম্প্রতিক সাগর-রুনি সাংবাদিক দম্পতির হত্যার বিরুদ্ধে সারাদেশে একটা ক্ষুব্ধতা বিরাজ করছে। হত্যাকাণ্ডটি যথেষ্ট জটিল, কেন ও কার বা কাদের দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার ক্লু পাওয়া খুবই কঠিন বলে অনেকেই মনে করি। তবু এই স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ডের দ্রুত সুরাহা ক্রমে ক্রমে গণদাবি হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিদিনকার তদন্ত মনিটর করছেন বলে জানা যায়। এ অবস্থায় বলার মধ্যে তিনি একবার শুধু বলেছিলেন, সরকার তো সর্বতোভাবে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করছে আর সরকার তো কারও বেডরুম পাহারা দিতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য সঠিক হয়েছিল কি-না সেটা অবশ্যই বিচার-বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য শুনে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বাঘিনীর মতো গর্জন করে তার যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, তাতে একটু অবাক না হয়ে পারি না। 'হ্যাঁ, বেডরুম পাহারা দেওয়াও দিতে হবে, ওটাও সরকারের দায়িত্ব।' গণতন্ত্রের বাঘিনীর গর্জন। তা সরকারের দায়িত্ব কতটা বা কদ্দুর, এ নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। আমার শুধু প্রশ্ন, খালেদা জিয়ার সময় (২০০১-০৬) বাংলাদেশের সবচেয়ে যোগ্য (জাতীয় নেতা শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের পর) অর্থমন্ত্রী, সবচেয়ে ভদ্র ও নিরীহ রাজনীতিক শামস কিবরিয়াকে যখন একটি প্রায় ঘরোয়া জনসভায় গ্রেনেড চার্জ করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়, রক্তাক্ত ও মুমূর্ষু কিবরিয়াকে দ্রুত ঢাকা নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে যখন একটি হেলিকপ্টার চাওয়া হয়, কই, তখন তো সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার টনক পর্যন্ত নড়েনি। সহানুভূতির উদ্রেক হয়নি। গণতান্ত্রিক আচরণ ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়টিকে তারা কোনো মূল্য দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি। বরং নিস্পৃহ কণ্ঠে বেগম সাহেবাকে নাকি বলতে শোনা গিয়েছিল, যাকে-তাকে দেওয়ার মতো হেলিকপ্টার সরকারের নেই।
ভাবতে অবাক লাগে। বাংলাদেশের সেরা মেধাবী ব্যক্তিদের একজন, শামস কিবরিয়ার মতো এক লোক বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কাছে হয়ে গিয়েছিলেন যে-সে লোক! সিলেট থেকে ঢাকা আসতে সাত ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার অভাবে কিবরিয়া সাহেব মাঝ রাস্তায় আসার আগেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যে দল/জোট ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না, উন্নয়নের নামগন্ধ থাকে না, কৃষি-শিল্প খাত যথোপযোগী ব্যবস্থা না নেওয়ায় মার খায়, যাদের শাসনামলে হত্যা, গ্রেনেড হামলা, লুণ্ঠন, অবাধ চোরাচালান, যাদের রাজনৈতিক অবৈধ অস্ত্র পাচার, ভারতবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি যাদের ট্রেডমার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই দলের নেত্রীর মুখে সরকারে থাকলে বেডরুমও পাহারা দিতে হবে, এই উক্তি কতটা বৈপরীত্যে ভরা, কতটা নির্মম পরিহাসের মতো শোনায়, সেই বিচারের ভার পাঠককুলের কাছে রইল। আমার এ সম্পর্কে বলার কিছু নেই।
বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিক জোটের এবারকার দাবি নির্বাচনের তিন মাস আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করা। মহাজোট সরকার, মনে হয় নির্বাচনের আগে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সমবায়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার বিষয়টি বিবেচনা করতে রাজি আছে। আওয়ামী লীগ, ১৪ দল এবং মহাজোট সরকার সেই তাগিদেই বোধকরি বারবার বিরোধী দলকে সংসদে এসে তত্ত্বাবধায়ক সম্পর্কিত তাদের বিকল্প প্রস্তাব পেশ করার আহ্বান জানিয়েছে। অনুনয়-বিনয়ের একশেষ করেছে তারা বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলতে। নানা রকম আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে, তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে একটা আপস-মীমাংসায় আসতে তারা রাজি, বিরোধী দল শুধু সংসদে এসে তাদের প্রস্তাবটা দিক।
কিন্তু সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে বিরোধী দলের একবিন্দু আগ্রহ নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদই সরকার ও বিরোধী দলের যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু বিরোধী দল কিছুতেই সংসদে যাবে না। নিজেরা ক্ষমতায় থাকলে সংসদে যাবে, ক্ষমতার বাইরে থাকলে যাবে না_ এই গণতন্ত্র বিএনপি কোত্থেকে শিখেছে এটা ভাবার বিষয়। সংসদে তাদের এই না যাওয়াটা দুর্জ্ঞেয় রহস্যও বটে। সংসদে যাওয়ার প্রশ্নে তারা বলে, সংসদে যাওয়ার দরকার কী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুটি সরকার মেনে নিলেই তো হয়।
বিএনপি-জামায়াতের এহেন আচরণের অর্থ কি এই যে, রাজনীতিতে তাদের আর কিছু থাকার দরকার নেই_ গ্রেনেড শিল্পীরা, বোমা শিল্পীরা, জঙ্গি শিল্পীরা তাদের সঙ্গে আছে_ রাজনীতিতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে পাল্টা দেওয়ার জন্য সেই 'শক্তিই' যথেষ্ট?
বিএনপি-জামায়াতের অতীত ও বর্তমান রাজনীতি এই অপসত্যটিকেই যেন তুলে ধরে। স্বৈরতন্ত্রের বর্ম ছেড়ে জনগণের সমর্থন আদায়ের রাজনীতি তারা কতটা বিশ্বাস করে_ সেটা এক প্রশ্ন। তাদের সংসদে না যাওয়া, তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন করতে চাইলে সেটা বানচাল করার হুমকি ইত্যাদি যেন প্রমাণ করে, বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা যেন তাদের পছন্দ নয়, বাংলাদেশকে টেনে নিচে নামিয়ে ইথিওপিয়া, পাকিস্তান, সুদান প্রভৃতি ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত করা যেন তাদের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক মিশন।
আমার আলোচনা যে কারও কাছে ধান ভানতে শিবের গীত বলে মনে হতে পারে। মূল আলোচ্য বিষয় যেখানে ছিল গত ১২ মার্চ, নিরাপত্তার নামে সরকারের বাড়াবাড়ি, ঢাকাকে সারাদেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে জনদুর্ভোগের চূড়ান্ত করা, সেখানে বিরোধী দলের অতীত ও বর্তমানের আমলনামা নিয়ে 'অপ্রাসঙ্গিক' কথাবার্তা বলছি কেন?
এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমি মনে করি, অতীতে বিএনপি-জামায়াতের নৃশংসতা-পৈশাচিকতার যে রেকর্ড আছে তাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে সরকার একটু বাড়াবাড়ি রকমের সতর্কতা এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতেই পারে। যথোচিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে রাস্তাঘাটে, লঞ্চে, বাসে, বিএনপির জনসভায় কোনো অঘটন ঘটলে দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হতো। প্রচারমাধ্যম বা আমজনতা কেউই নিরাপত্তা দানে ব্যর্থতাকে তুলাধোনা না করে ছাড়ত না। বিএনপি-জামায়াত জোটের অতীত ও বর্তমান আমলনামা এ জন্যই সামান্য একটু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
দেশের স্বার্থে বিএনপি থেকে শুরু করে দেশের সব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দলেরই ইতিবাচক ভূমিকা আমরা দেখতে চাই। যাদের বিপক্ষে আঙুল তোলা, গণতান্ত্রিক নীতি এবং আচার-আচরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে আমার বক্তব্যটি ভুল ও অসত্য বলে তারা প্রমাণ করুন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হেরে যাওয়াতেও স্বস্তি ও সুখ আছে। আমি হেরে গিয়ে সেই স্বস্তি ও সুখের আস্বাদন করতে চাই।
স রাহাত খান :কথাসাহিত্যিক
No comments