ছয় ছাত্র হত্যা-আইনের শাসনের প্রতি হুমকি by আলী রীয়াজ
আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে ছয়জন তরুণকে ‘ডাকাত সন্দেহে’ পিটিয়ে হত্যার ঘটনা যত মর্মান্তিকই হোক না কেন, তা যে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, গণমাধ্যমের কল্যাণে তা এখন অনেকেই বুঝতে পারছেন। বাংলাদেশে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ সালে কমপক্ষে ১২৬ জনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
এ বছরের ছয় মাসে ৭০ জনেরও বেশি লোককে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন অভিযোগে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, এসব ঘটনার পর কার্যত এ নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি এবং কোনো ব্যক্তির বিচার বা শাস্তির কোনো উদাহরণ সৃষ্টি হয়নি। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, ‘সাধারণ মানুষ’ বুঝতে পারছে যে আইন নিজের হাতে তুলে নিলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা রাষ্ট্র এ বিষয়ে কোনো রকম আপত্তি করবে না। একজন ব্যক্তি যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে, তবে তার বিচারের যে যৎসামান্য সম্ভাবনা থাকে, তাও অপসৃত হয় যদি কোনোভাবে এ হত্যাকাণ্ড ‘ক্ষুব্ধ’ জনতার নামে ঘটানো যায়।
‘গণপিটুনি’ বলে গণমাধ্যমে বর্ণিত এসব আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাংলাদেশে বিরাজমান দুটো প্রবণতার প্রমাণ। প্রথমটি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থার অভাব। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা লক্ষ করেছি, যখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থা হ্রাস পায় এবং প্রচলিত আইনে অপরাধীদের বিচারের সম্ভাবনা না থাকে, তখনই এ ধরনের ঘটনাবলি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশে যখন ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, তখনই এ ধরনের কার্যকলাপের সূচনা হয়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর খুব বেশি আস্থাশীল নয়। বিচার বিভাগ নিয়ে বিশেষত নিম্ন আদালতগুলোয় সুবিচারের সম্ভাবনা বিষয়ে সাধারণ মানুষের আস্থা একেবারেই নেই।
২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপ এবং ২০১১ সালের জুন মাসে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের জরিপেও দেখা গেছে, আদালত মানুষের চোখে ‘অদক্ষ’ ও ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ বলেই চিহ্নিত। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের প্রকাশিত প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘মব জাস্টিস’ (Mob Justice) একটি বড় ধরনের সমস্যা। যদিও ছয়জন তরুণের মৃত্যুর ঘটনা দৈনন্দিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, তথাপি প্রধান বিরোধী দল ইতিমধ্যেই একে বর্তমান সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের অনাস্থা বলে বর্ণনা করেছে। বিএনপির এই বক্তব্যের পেছনে কারণ বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও বলা দরকার যে ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দুই বছরে ঢাকা ও এর আশপাশে বিভিন্ন ঘটনায় ১৫০ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল। ২০০৬ সালে প্রতি মাসে গড়ে ছয়জন লোক ‘ক্ষুব্ধ’ জনতার হাতে নিহত হয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালতের ওপর আস্থার বিষয়টি কেবল বর্তমান সরকারের সমস্যা বলে বিবেচনা করা যথাযথ হবে না। একে দেখা দরকার সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিষয়ে সাধারণ মানুষের গভীর অনাস্থা হিসেবে। দেশে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের গণপিটুনির ঘটনাগুলো বিবেচনা করলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়া বিচিত্র নয়।
সাম্প্রতিক এই ঘটনা দ্বিতীয় যে প্রবণতার প্রমাণ, সেটি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান মিজানুর রহমান। তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের কোনো অবকাশ নেই যে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সামাজিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এ ধরনের ঘটনা। গত বছরগুলোয় বাংলাদেশে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যে কেবল বৈধতাই পেয়েছে, তা নয়, সেগুলোর পক্ষে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল দ্বিধাহীন সমর্থন জুগিয়েছে। র্যাবের হাতে নিহতদের পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তাদের হত্যার জন্য কাউকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। সর্বশেষ লিমন হোসেনকে পঙ্গু করে ফেলার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত যেভাবে র্যাবকে সমর্থন করেছেন, তা এ বিষয়ে যেকোনো আইনি-প্রক্রিয়ার জন্যই অশনিসংকেত। স্মরণে রাখা দরকার যে, র্যাব বর্তমান সরকারের আমলে তৈরি নয়। এও মনে রাখা দরকার, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা কোনো অংশেই র্যাবের হাতে নিহতদের চেয়ে কম মর্মান্তিক বা আইনবহির্ভূত নয়। বিএনপি সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় নিহত ব্যক্তিদের পরিবার সুবিচার পায়নি। উপরন্তু দেশের পার্লামেন্ট আইন করে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ‘দায়মুক্তি’ বা ‘নিরাপত্তা’ দিয়েছে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলা প্রত্যাহারের নামে এমন ব্যক্তিদেরও অভিযোগের দায় থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যা প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে সাধারণের মনে অবিশ্বাস ও অনাস্থাই তৈরি করেছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সরকারদলীয় কর্মীরা তখন সব ধরনের আইনের ঊর্ধ্বে যান—এটি একদিকে যেমন আইনের শাসনের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি তা অন্যদের আইনবহির্ভূত কার্যকলাপে উৎসাহী করে।
২.
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, যে এলাকায় এই ছয়জন তরুণ নিহত হয়েছে, সেটি মাদক ব্যবসার একটি কেন্দ্র বলে পরিচিত। ২০০৭ সালে এখানে অভিযান চালানোর সময় র্যাবের দুজন সদস্য নিহত হন। অভিযোগ রয়েছে, এ এলাকায় এই ব্যবসার সঙ্গে অপরাধী চক্র জড়িত এবং তারা স্থানীয় পুলিশ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমর্থন ও সাহায্য পেয়ে থাকে। এ ধরনের একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ‘অপরাধী’ বলে পরিচিত ১৩ জন গত চার বছরে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। যদিও পুলিশ বলেছে, তারা এ ধরনের মাদক ব্যবসাকে সাহায্য করে না—এ বিষয়ে সাংবাদিক ও স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ খতিয়ে দেখা খুবই জরুরি। সরকার গণপিটুনির ঘটনা তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। আমার আশঙ্কা, গণপিটুনি ও মাদক ব্যবসা দুটো বিষয়কে আলাদাভাবে বিবেচনা না করার ফলে শেষ পর্যন্ত নিহত তরুণেরা মাদকের ব্যবসায়ী বা ডাকাত বলে চিহ্নিত হবে এবং তদন্তকাজ সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। নিহত তরুণেরা যদি কোনো অপরাধমূলক কাজে ব্যাপৃত থেকেও থাকে, সেটা কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দেয় না। ফলে গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে দুটো আলাদা তদন্তের দাবি তোলা দরকার এবং এ বিষয়ে জনমত গঠনের কাজে সুশীল সমাজের এগিয়ে আসা জরুরি।
৩.
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান গণপিটুনির প্রেক্ষাপটে সমাজবিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার তাগিদ তৈরি হয়েছে। গণপিটুনি কার্যত গোষ্ঠীগত সহিংসতা বা গ্রুপ ভায়োলেন্সের একটি দিক। গোষ্ঠীগত আচরণ নিয়ে যাঁরাই পঠন-পাঠন করেছেন, তাঁরা গুস্তাভ লা বনের কাজের সঙ্গে পরিচিত। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী লা বনের তত্ত্বের আলোকে সিড হিল বলেছেন, নেতিবাচক গোষ্ঠীগত আচরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে, দাঙ্গা (রায়ট), গণপিটুনি (লিঞ্চিং) এবং আইনবহির্ভূত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী (ভিজিলাস্টি)। এ তিনটি পর্যায়ের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম সংগঠিত হচ্ছে দাঙ্গা বা রায়ট। অন্যদিকে সবচেয়ে সংগঠিত হচ্ছে ভিজিলাস্টি গ্রুপ। একটি পর্যায় অন্যটিকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে না। কিন্তু গত বছরগুলোয় আমরা ভিজিলাস্টি গোষ্ঠীর উত্থান লক্ষ করেছি {এর মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্দিকুর রহমানের (বাংলা ভাই) গোষ্ঠীটির কথা মনে করা যেতে পারে}। এ ধরনের গোষ্ঠীর উত্থান কেবল আশু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্যই হুমকি, তা নয়; রাষ্ট্রের বৈধতা, সরকারের শাসনক্ষমতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যও তা বড় ধরনের হুমকি। আপাতদৃষ্টে বিচ্ছিন্ন গণপিটুনির ঘটনাগুলোকে সে কারণেই বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত বলে বিবেচনা না করে এগুলোর কারণ অনুসন্ধান খুবই জরুরি; পাশাপাশি এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোন পথে এগোতে পারে, তা উপলব্ধি করার চেষ্টাও দরকার। অন্যথায় এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার বিষয়ে আলোচনা আবেগনির্ভর প্রতিক্রিয়ার বাইরে কোনো রকম স্থায়ী সমাধানের পথ দেখাবে না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
‘গণপিটুনি’ বলে গণমাধ্যমে বর্ণিত এসব আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাংলাদেশে বিরাজমান দুটো প্রবণতার প্রমাণ। প্রথমটি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থার অভাব। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা লক্ষ করেছি, যখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থা হ্রাস পায় এবং প্রচলিত আইনে অপরাধীদের বিচারের সম্ভাবনা না থাকে, তখনই এ ধরনের ঘটনাবলি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশে যখন ছিনতাইয়ের ঘটনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, তখনই এ ধরনের কার্যকলাপের সূচনা হয়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর খুব বেশি আস্থাশীল নয়। বিচার বিভাগ নিয়ে বিশেষত নিম্ন আদালতগুলোয় সুবিচারের সম্ভাবনা বিষয়ে সাধারণ মানুষের আস্থা একেবারেই নেই।
২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের জরিপ এবং ২০১১ সালের জুন মাসে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের জরিপেও দেখা গেছে, আদালত মানুষের চোখে ‘অদক্ষ’ ও ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ বলেই চিহ্নিত। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের প্রকাশিত প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘মব জাস্টিস’ (Mob Justice) একটি বড় ধরনের সমস্যা। যদিও ছয়জন তরুণের মৃত্যুর ঘটনা দৈনন্দিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, তথাপি প্রধান বিরোধী দল ইতিমধ্যেই একে বর্তমান সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের অনাস্থা বলে বর্ণনা করেছে। বিএনপির এই বক্তব্যের পেছনে কারণ বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও বলা দরকার যে ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দুই বছরে ঢাকা ও এর আশপাশে বিভিন্ন ঘটনায় ১৫০ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল। ২০০৬ সালে প্রতি মাসে গড়ে ছয়জন লোক ‘ক্ষুব্ধ’ জনতার হাতে নিহত হয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালতের ওপর আস্থার বিষয়টি কেবল বর্তমান সরকারের সমস্যা বলে বিবেচনা করা যথাযথ হবে না। একে দেখা দরকার সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিষয়ে সাধারণ মানুষের গভীর অনাস্থা হিসেবে। দেশে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার প্রেক্ষাপটে এ ধরনের গণপিটুনির ঘটনাগুলো বিবেচনা করলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়া বিচিত্র নয়।
সাম্প্রতিক এই ঘটনা দ্বিতীয় যে প্রবণতার প্রমাণ, সেটি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান মিজানুর রহমান। তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের কোনো অবকাশ নেই যে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সামাজিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এ ধরনের ঘটনা। গত বছরগুলোয় বাংলাদেশে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড যে কেবল বৈধতাই পেয়েছে, তা নয়, সেগুলোর পক্ষে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল দ্বিধাহীন সমর্থন জুগিয়েছে। র্যাবের হাতে নিহতদের পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তাদের হত্যার জন্য কাউকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। সর্বশেষ লিমন হোসেনকে পঙ্গু করে ফেলার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত যেভাবে র্যাবকে সমর্থন করেছেন, তা এ বিষয়ে যেকোনো আইনি-প্রক্রিয়ার জন্যই অশনিসংকেত। স্মরণে রাখা দরকার যে, র্যাব বর্তমান সরকারের আমলে তৈরি নয়। এও মনে রাখা দরকার, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা কোনো অংশেই র্যাবের হাতে নিহতদের চেয়ে কম মর্মান্তিক বা আইনবহির্ভূত নয়। বিএনপি সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিন হার্টের সময় নিহত ব্যক্তিদের পরিবার সুবিচার পায়নি। উপরন্তু দেশের পার্লামেন্ট আইন করে সেনাবাহিনীর সদস্যদের ‘দায়মুক্তি’ বা ‘নিরাপত্তা’ দিয়েছে। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলা প্রত্যাহারের নামে এমন ব্যক্তিদেরও অভিযোগের দায় থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যা প্রচলিত আইন ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে সাধারণের মনে অবিশ্বাস ও অনাস্থাই তৈরি করেছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সরকারদলীয় কর্মীরা তখন সব ধরনের আইনের ঊর্ধ্বে যান—এটি একদিকে যেমন আইনের শাসনের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি তা অন্যদের আইনবহির্ভূত কার্যকলাপে উৎসাহী করে।
২.
সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, যে এলাকায় এই ছয়জন তরুণ নিহত হয়েছে, সেটি মাদক ব্যবসার একটি কেন্দ্র বলে পরিচিত। ২০০৭ সালে এখানে অভিযান চালানোর সময় র্যাবের দুজন সদস্য নিহত হন। অভিযোগ রয়েছে, এ এলাকায় এই ব্যবসার সঙ্গে অপরাধী চক্র জড়িত এবং তারা স্থানীয় পুলিশ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সমর্থন ও সাহায্য পেয়ে থাকে। এ ধরনের একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ‘অপরাধী’ বলে পরিচিত ১৩ জন গত চার বছরে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। যদিও পুলিশ বলেছে, তারা এ ধরনের মাদক ব্যবসাকে সাহায্য করে না—এ বিষয়ে সাংবাদিক ও স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ খতিয়ে দেখা খুবই জরুরি। সরকার গণপিটুনির ঘটনা তদন্ত করার ঘোষণা দিয়েছে। আমার আশঙ্কা, গণপিটুনি ও মাদক ব্যবসা দুটো বিষয়কে আলাদাভাবে বিবেচনা না করার ফলে শেষ পর্যন্ত নিহত তরুণেরা মাদকের ব্যবসায়ী বা ডাকাত বলে চিহ্নিত হবে এবং তদন্তকাজ সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। নিহত তরুণেরা যদি কোনো অপরাধমূলক কাজে ব্যাপৃত থেকেও থাকে, সেটা কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বৈধতা দেয় না। ফলে গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে দুটো আলাদা তদন্তের দাবি তোলা দরকার এবং এ বিষয়ে জনমত গঠনের কাজে সুশীল সমাজের এগিয়ে আসা জরুরি।
৩.
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান গণপিটুনির প্রেক্ষাপটে সমাজবিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার তাগিদ তৈরি হয়েছে। গণপিটুনি কার্যত গোষ্ঠীগত সহিংসতা বা গ্রুপ ভায়োলেন্সের একটি দিক। গোষ্ঠীগত আচরণ নিয়ে যাঁরাই পঠন-পাঠন করেছেন, তাঁরা গুস্তাভ লা বনের কাজের সঙ্গে পরিচিত। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী লা বনের তত্ত্বের আলোকে সিড হিল বলেছেন, নেতিবাচক গোষ্ঠীগত আচরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে, দাঙ্গা (রায়ট), গণপিটুনি (লিঞ্চিং) এবং আইনবহির্ভূত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী (ভিজিলাস্টি)। এ তিনটি পর্যায়ের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম সংগঠিত হচ্ছে দাঙ্গা বা রায়ট। অন্যদিকে সবচেয়ে সংগঠিত হচ্ছে ভিজিলাস্টি গ্রুপ। একটি পর্যায় অন্যটিকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে না। কিন্তু গত বছরগুলোয় আমরা ভিজিলাস্টি গোষ্ঠীর উত্থান লক্ষ করেছি {এর মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্দিকুর রহমানের (বাংলা ভাই) গোষ্ঠীটির কথা মনে করা যেতে পারে}। এ ধরনের গোষ্ঠীর উত্থান কেবল আশু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্যই হুমকি, তা নয়; রাষ্ট্রের বৈধতা, সরকারের শাসনক্ষমতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যও তা বড় ধরনের হুমকি। আপাতদৃষ্টে বিচ্ছিন্ন গণপিটুনির ঘটনাগুলোকে সে কারণেই বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত বলে বিবেচনা না করে এগুলোর কারণ অনুসন্ধান খুবই জরুরি; পাশাপাশি এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোন পথে এগোতে পারে, তা উপলব্ধি করার চেষ্টাও দরকার। অন্যথায় এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার বিষয়ে আলোচনা আবেগনির্ভর প্রতিক্রিয়ার বাইরে কোনো রকম স্থায়ী সমাধানের পথ দেখাবে না।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments