জনসংখ্যা-জনসংখ্যাশুমারির স্বাধীনতা ও পরাধীনতা by ফরিদা আখতার
গত ১৬ জুলাই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ ১৯ হাজার। প্রাথমিক ফল প্রকাশ করা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মনে হচ্ছে, যেমন করেই হোক সংখ্যা বাড়বেই। ইতিমধ্যে বিতর্ক এবং বেশ হইচই শুরু হয়ে গেছে।
বিশেষ একটি মহল, যাদের জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ বলা হয়, এখনই বলা শুরু করেছে এই সংখ্যা ঠিক নয়। কেন ঠিক নয় তার ভিত্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, জাতিসংঘের হিসাবের চেয়ে বাংলাদেশের এই হিসাবে দুই কোটি ২১ লাখ মানুষ কম। ব্যবসায়ীরাও নাখোশ এবং বিস্মিত হয়েছেন। রাজনীতিবিদদেরও ঝামেলা কম নয়, তাঁদের বক্তব্যের সময় ১৬ কোটি বলে মুখে ফেনা তোলার আগে এখন একটু ভাবতে হবে।
বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের জনসংখ্যা কত, তা বলার স্বাধীনতাও যেন আমাদের নেই। পরাধীনতার মনোবৃত্তিও আমাদের মধ্যে প্রবল। হতে পারে যে লোকগণনার বিষয়টি ১০০ ভাগ সঠিক করা সম্ভব নয়, কিন্তু তাই বলে একেবারেই কি ভুল? এবং জাতিসংঘ যা বলে, তা-ই ঠিক? তাহলে ভোটার গণনাই বা হয় কেমন করে? আসলে সব সময় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই আপত্তি তোলেন। যেমন, ভোটার তালিকার বেলায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দুটি প্রধান দলের খুশি-অখুশি দিয়েই ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত, সেটা বাংলাদেশ নয়, জাতিসংঘকেই ঠিক করে দিতে হবে। জনসংখ্যা গণনা ছাড়াও তো আরও অনেক শুমারি হয়। কই, সেসব ক্ষেত্রে তো এত প্রশ্ন ওঠে না?
এ কথা ঠিক যে, দেশের মানুষের সংখ্যা কত, তা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ, সরকারি চাকরিতে কোটা নির্ধারণ, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম, খাদ্য উ ৎ পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, বৈদেশিক সাহায্য, খাদ্য আমদানি, খাদ্যসাহায্যসহ বহু কিছুর প্রয়োজনে জানা দরকার। তবে যাঁরা আপত্তি তুলছেন, তাঁদের কথায় মনে হচ্ছে, এই সংখ্যা কত হবে তা আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে নয়, অন্য কারও স্বার্থেই যেন নির্ধারিত হচ্ছে। অতএব অন্যের হিসাবটাই যেন সঠিক হতে হবে। যদি বিবিএস প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি হতো, তাহলে মনে হয় এত কথা উঠত না। আশ্চর্য হলাম যে একই অনুষ্ঠানে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এক তথ্য দিচ্ছেন আর প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলছেন, আদমশুমারির ফলাফলে ভুল থাকতে পারে, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তা কেটে যাবে। অর্থা ৎ আগেভাগেই ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে এই ফলাফল থাকবে না।
যদি জনসংখ্যা ১৬ কোটি হওয়াটা এতই জরুরি ছিল তাহলে এত টাকা খরচ করে গণনার কাজটি না করলেই হতো! যদিও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শাজাহান আলী মোল্লা এবারের শুমারিকে অন্যগুলোর চেয়ে পরিশুদ্ধ বলে দাবি করেছেন এবং বলেছেন যে ‘আগের অনেক ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার কাজ করেছি আমরা’ (বিডিনিউজ২৪ডটকম, জুলাই ১৬, ২০১১)। তিনি আরও বলেছেন, ‘শুমারির পর প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা-ই হুবহু প্রকাশ করা হয়েছে। তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো লুকোচুরি করা হয়নি। আমরা একটি সংখ্যাও বদল করিনি’ (প্রথম আলো, ১৭ জুলাই)। তাহলে নিয়ম অনুযায়ী ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার জন্য শুমারি-পরবর্তী যাচাইয়ের (বা পিইসি) কাজ করলেই হতো এবং তাতে যা ফল আসে তার পরিপ্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিবিএস ১৪ কোটি ফলাফল দিয়ে মহা অন্যায় করেছে। তাই পিইসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থাকে (বিআইডিএস)।
বিবিএসের দেওয়া তথ্য নিয়ে যাঁরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন, তার পেছনে পদ্ধতিগত ত্রুটির চেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, হিসাবটা জাতিসংঘের হিসাবের চেয়ে অনেক কম হয়েছে বলে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ২০১০ সালের অক্টোবরে ‘স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন’ নামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৪ লাখ। তখন আমরা জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের কোনো প্রকার শঙ্কা করতে দেখিনি। তাঁরা এককথায় মেনে নিয়েছেন। শুধু আপত্তি করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছিলেন, নিউইয়র্কের টেবিলে বসে তৈরি করা এই প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য নয় (বণিক বার্তা, জুলাই ১৭, ২০১১)। আর যাঁরা বিবিএসের তথ্য নাকচ করছেন, তাঁরাও বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকারই কোনো বড় অফিসে বসে একই কাজ করছেন। এদিকে বিআইডিএস নিরপেক্ষভাবে তথ্য যাচাই করবে কি না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বিভাগের সাবেক পরিচালক রফিকুল হুদা চৌধুরী যাচাইয়ের আগেই বণিক বার্তার সাক্ষা ৎ কারে বলে দিয়েছেন, ‘জনসংখ্যার সঠিক তথ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কেন, কারও পক্ষেও দেওয়া সম্ভব নয়...। আমেরিকার মতো উন্নত দেশও জনসংখ্যার সঠিক তথ্য দিতে পারে না।’ এই কথার অর্থ কী? তাহলে বিআইডিএসের দেওয়া তথ্য কী করে সঠিক হবে? রফিকুল হুদা চৌধুরীর মতে, বিআইডিএস কমসংখ্যক এলাকা নিয়ে কাজ করছে। তাই তাদের তথ্য বিবিএসের তুলনায় সঠিক হবে। বাহ! এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন-নবী কিছুতেই জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ মানতে রাজি নন। বিভিন্ন পত্রিকায় এবং টেলিভিশন চ্যানেলে তিনি বিবিএসের তথ্য নাকচ করে বলছেন, এই সংখ্যাটা কোনোমতেই সঠিক বলে মেনে নেওয়া যাবে না। তিনি সমকাল পত্রিকাকে বলেছেন, ‘এই তথ্যটি ধাক্কা দেওয়ার মতোই। কারণ, কয়েক বছর ধরে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি বলে আসছে। তথ্য-উপাত্তমতে মানুষ প্রায় দুই কোটি কমে গেছে’ (১৭ জুলাই, ২০১১)। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুই কোটি মানুষ যে বেশি ছিল তার কোনো প্রমাণ নেই। কেবল কাগজে-কলমে এবং মুখে মুখেই এই সংখ্যা ছিল। তাহলে তা শোধরাতে আপত্তি কেন? ডকুমেন্ট থেকে ডিলিট করলেই তো হয়! বেশি জনসংখ্যা দেখিয়ে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশ সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করার কাজটি জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল বা ইউএনএফপিএ এত কাল করে এসেছে এবং সব সমস্যার জন্য জনগণের সংখ্যাকেই দায়ী করেছে। আমাদের দেশের জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের কাজ হচ্ছে ইউএনএফপিএর এই মনোভাবে সমর্থন দিয়ে ভীতি সৃষ্টি করা।
মনে হচ্ছে, জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ১৬ কোটি করাই লাগবে। কারণ আর কিছুই নয়, জাতিসংঘ ১৬ কোটি বলেছে। তাদের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ ভুল হতে পারে না! সম্ভবত তারা ইতিমধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সরবরাহের হিসাব কষে রেখেছে, ১৪ কোটি হলে তাতে সমস্যা হবে। জনসংখ্যার তথ্য ব্যবসায়ীদের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, আমদানিকারকদের এই সংখ্যা জেনে আমদানির হিসাব করতে হয়। ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকেরা বিবিএসের তথ্যের অপেক্ষায় না থেকে জনসংখ্যা ১৫ থেকে ১৬ কোটি ধরে নিয়ে এত দিন আমদানি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমরা আমাদের হিসাবে আমদানি করব, সরকারের হিসাবে নয়।’ সরকার যা-ই বলুক না কেন, দেশের মোট জনসংখ্যা সাড়ে ১৫ কোটি বলেই ধরেন তাঁরা।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। এর প্রাথমিক ফল ছিল সাত কোটি ১৩ লাখ। এই ফল গ্রহণ করা হয়নি। পরে যাচাই করে সাত কোটি ৬৩ লাখ করা হয়েছিল। পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক ডেপুটি কমিশনার (১৯৭২ থেকে ১৯৭৫) নুরুল ইসলাম Development Planning in Bangladesh : A Study in Political Economy (১৯৭৯) গ্রন্থে এর কারণ উল্লেখ করে জানিয়েছেন, দাতা সংস্থা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে খাদ্যসাহায্য আসছিল, তার সঙ্গে আদমশুমারির সংখ্যা সংগতিপূর্ণ ছিল না। দাতা সংস্থাগুলো তাদের বাড়তি উ ৎ পাদন গরিব দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যে নীতি অনুসরণ করে, সেদিক থেকে জনসংখ্যা কম হলে অসুবিধা। অতএব খাদ্যসাহায্যের জন্য যে সংখ্যা দরকার, সেই সংখ্যাই সাব্যস্ত হলো। জনসংখ্যা বেড়ে গেল। পর পর কয়েকটি শুমারিতে একইভাবে সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এভাবে প্রথম তিনটি শুমারিতে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পার্থক্য প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ। জানার উপায় নেই এই সংখ্যার মানুষ কি আদৌ জন্মেছিল নাকি কাগুজে হিসাবেই রয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গণনা ছাড়াই আমরা গান গেয়ে ফেলেছিলাম, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম...।’ অথচ সেই সংখ্যা হয়েছে ১৯৭৪ সালে এসে আদমশুমারি যাচাইয়ের পর। এখন গণনা ছাড়াই জাতিসংঘের বরাতে মানুষের মুখে মুখে ১৬ কোটি হয়ে গেছে। কাজেই এই সংখ্যা থেকে মনে হয় আর রেহাই নেই। তাহলে কি আমরা কখনোই জানতে পারব না আসলেই দেশের মানুষের সংখ্যা কত?
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের জনসংখ্যা কত, তা বলার স্বাধীনতাও যেন আমাদের নেই। পরাধীনতার মনোবৃত্তিও আমাদের মধ্যে প্রবল। হতে পারে যে লোকগণনার বিষয়টি ১০০ ভাগ সঠিক করা সম্ভব নয়, কিন্তু তাই বলে একেবারেই কি ভুল? এবং জাতিসংঘ যা বলে, তা-ই ঠিক? তাহলে ভোটার গণনাই বা হয় কেমন করে? আসলে সব সময় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই আপত্তি তোলেন। যেমন, ভোটার তালিকার বেলায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দুটি প্রধান দলের খুশি-অখুশি দিয়েই ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হতে পারে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত, সেটা বাংলাদেশ নয়, জাতিসংঘকেই ঠিক করে দিতে হবে। জনসংখ্যা গণনা ছাড়াও তো আরও অনেক শুমারি হয়। কই, সেসব ক্ষেত্রে তো এত প্রশ্ন ওঠে না?
এ কথা ঠিক যে, দেশের মানুষের সংখ্যা কত, তা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ, সরকারি চাকরিতে কোটা নির্ধারণ, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম, খাদ্য উ ৎ পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, বৈদেশিক সাহায্য, খাদ্য আমদানি, খাদ্যসাহায্যসহ বহু কিছুর প্রয়োজনে জানা দরকার। তবে যাঁরা আপত্তি তুলছেন, তাঁদের কথায় মনে হচ্ছে, এই সংখ্যা কত হবে তা আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে নয়, অন্য কারও স্বার্থেই যেন নির্ধারিত হচ্ছে। অতএব অন্যের হিসাবটাই যেন সঠিক হতে হবে। যদি বিবিএস প্রকাশিত প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি হতো, তাহলে মনে হয় এত কথা উঠত না। আশ্চর্য হলাম যে একই অনুষ্ঠানে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এক তথ্য দিচ্ছেন আর প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলছেন, আদমশুমারির ফলাফলে ভুল থাকতে পারে, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তা কেটে যাবে। অর্থা ৎ আগেভাগেই ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে এই ফলাফল থাকবে না।
যদি জনসংখ্যা ১৬ কোটি হওয়াটা এতই জরুরি ছিল তাহলে এত টাকা খরচ করে গণনার কাজটি না করলেই হতো! যদিও পরিসংখ্যান ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শাজাহান আলী মোল্লা এবারের শুমারিকে অন্যগুলোর চেয়ে পরিশুদ্ধ বলে দাবি করেছেন এবং বলেছেন যে ‘আগের অনেক ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার কাজ করেছি আমরা’ (বিডিনিউজ২৪ডটকম, জুলাই ১৬, ২০১১)। তিনি আরও বলেছেন, ‘শুমারির পর প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা-ই হুবহু প্রকাশ করা হয়েছে। তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো লুকোচুরি করা হয়নি। আমরা একটি সংখ্যাও বদল করিনি’ (প্রথম আলো, ১৭ জুলাই)। তাহলে নিয়ম অনুযায়ী ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার জন্য শুমারি-পরবর্তী যাচাইয়ের (বা পিইসি) কাজ করলেই হতো এবং তাতে যা ফল আসে তার পরিপ্রেক্ষিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বিবিএস ১৪ কোটি ফলাফল দিয়ে মহা অন্যায় করেছে। তাই পিইসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থাকে (বিআইডিএস)।
বিবিএসের দেওয়া তথ্য নিয়ে যাঁরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন, তার পেছনে পদ্ধতিগত ত্রুটির চেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, হিসাবটা জাতিসংঘের হিসাবের চেয়ে অনেক কম হয়েছে বলে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ২০১০ সালের অক্টোবরে ‘স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন’ নামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৪ লাখ। তখন আমরা জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের কোনো প্রকার শঙ্কা করতে দেখিনি। তাঁরা এককথায় মেনে নিয়েছেন। শুধু আপত্তি করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেছিলেন, নিউইয়র্কের টেবিলে বসে তৈরি করা এই প্রতিবেদন গ্রহণযোগ্য নয় (বণিক বার্তা, জুলাই ১৭, ২০১১)। আর যাঁরা বিবিএসের তথ্য নাকচ করছেন, তাঁরাও বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ঢাকারই কোনো বড় অফিসে বসে একই কাজ করছেন। এদিকে বিআইডিএস নিরপেক্ষভাবে তথ্য যাচাই করবে কি না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বিভাগের সাবেক পরিচালক রফিকুল হুদা চৌধুরী যাচাইয়ের আগেই বণিক বার্তার সাক্ষা ৎ কারে বলে দিয়েছেন, ‘জনসংখ্যার সঠিক তথ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কেন, কারও পক্ষেও দেওয়া সম্ভব নয়...। আমেরিকার মতো উন্নত দেশও জনসংখ্যার সঠিক তথ্য দিতে পারে না।’ এই কথার অর্থ কী? তাহলে বিআইডিএসের দেওয়া তথ্য কী করে সঠিক হবে? রফিকুল হুদা চৌধুরীর মতে, বিআইডিএস কমসংখ্যক এলাকা নিয়ে কাজ করছে। তাই তাদের তথ্য বিবিএসের তুলনায় সঠিক হবে। বাহ! এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম নূর-উন-নবী কিছুতেই জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লাখ মানতে রাজি নন। বিভিন্ন পত্রিকায় এবং টেলিভিশন চ্যানেলে তিনি বিবিএসের তথ্য নাকচ করে বলছেন, এই সংখ্যাটা কোনোমতেই সঠিক বলে মেনে নেওয়া যাবে না। তিনি সমকাল পত্রিকাকে বলেছেন, ‘এই তথ্যটি ধাক্কা দেওয়ার মতোই। কারণ, কয়েক বছর ধরে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি বলে আসছে। তথ্য-উপাত্তমতে মানুষ প্রায় দুই কোটি কমে গেছে’ (১৭ জুলাই, ২০১১)। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুই কোটি মানুষ যে বেশি ছিল তার কোনো প্রমাণ নেই। কেবল কাগজে-কলমে এবং মুখে মুখেই এই সংখ্যা ছিল। তাহলে তা শোধরাতে আপত্তি কেন? ডকুমেন্ট থেকে ডিলিট করলেই তো হয়! বেশি জনসংখ্যা দেখিয়ে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশ সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করার কাজটি জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল বা ইউএনএফপিএ এত কাল করে এসেছে এবং সব সমস্যার জন্য জনগণের সংখ্যাকেই দায়ী করেছে। আমাদের দেশের জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের কাজ হচ্ছে ইউএনএফপিএর এই মনোভাবে সমর্থন দিয়ে ভীতি সৃষ্টি করা।
মনে হচ্ছে, জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ১৬ কোটি করাই লাগবে। কারণ আর কিছুই নয়, জাতিসংঘ ১৬ কোটি বলেছে। তাদের যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ ভুল হতে পারে না! সম্ভবত তারা ইতিমধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সরবরাহের হিসাব কষে রেখেছে, ১৪ কোটি হলে তাতে সমস্যা হবে। জনসংখ্যার তথ্য ব্যবসায়ীদের জন্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, আমদানিকারকদের এই সংখ্যা জেনে আমদানির হিসাব করতে হয়। ভোগ্যপণ্য আমদানিকারকেরা বিবিএসের তথ্যের অপেক্ষায় না থেকে জনসংখ্যা ১৫ থেকে ১৬ কোটি ধরে নিয়ে এত দিন আমদানি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তাঁরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমরা আমাদের হিসাবে আমদানি করব, সরকারের হিসাবে নয়।’ সরকার যা-ই বলুক না কেন, দেশের মোট জনসংখ্যা সাড়ে ১৫ কোটি বলেই ধরেন তাঁরা।
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে। এর প্রাথমিক ফল ছিল সাত কোটি ১৩ লাখ। এই ফল গ্রহণ করা হয়নি। পরে যাচাই করে সাত কোটি ৬৩ লাখ করা হয়েছিল। পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক ডেপুটি কমিশনার (১৯৭২ থেকে ১৯৭৫) নুরুল ইসলাম Development Planning in Bangladesh : A Study in Political Economy (১৯৭৯) গ্রন্থে এর কারণ উল্লেখ করে জানিয়েছেন, দাতা সংস্থা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে খাদ্যসাহায্য আসছিল, তার সঙ্গে আদমশুমারির সংখ্যা সংগতিপূর্ণ ছিল না। দাতা সংস্থাগুলো তাদের বাড়তি উ ৎ পাদন গরিব দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার যে নীতি অনুসরণ করে, সেদিক থেকে জনসংখ্যা কম হলে অসুবিধা। অতএব খাদ্যসাহায্যের জন্য যে সংখ্যা দরকার, সেই সংখ্যাই সাব্যস্ত হলো। জনসংখ্যা বেড়ে গেল। পর পর কয়েকটি শুমারিতে একইভাবে সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এভাবে প্রথম তিনটি শুমারিতে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত প্রতিবেদনের পার্থক্য প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ। জানার উপায় নেই এই সংখ্যার মানুষ কি আদৌ জন্মেছিল নাকি কাগুজে হিসাবেই রয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গণনা ছাড়াই আমরা গান গেয়ে ফেলেছিলাম, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম...।’ অথচ সেই সংখ্যা হয়েছে ১৯৭৪ সালে এসে আদমশুমারি যাচাইয়ের পর। এখন গণনা ছাড়াই জাতিসংঘের বরাতে মানুষের মুখে মুখে ১৬ কোটি হয়ে গেছে। কাজেই এই সংখ্যা থেকে মনে হয় আর রেহাই নেই। তাহলে কি আমরা কখনোই জানতে পারব না আসলেই দেশের মানুষের সংখ্যা কত?
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
No comments