চারদিক-আটকেপড়া আলোর মেলা by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
ছবিটির দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমরা আসলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখি। আমাদের দৃষ্টি প্রথমেই আটকে যায় মেঘে। দিনের আলোতে মেঘ ছাড়া আকাশের অসীম নীলে আমরা কিছু খুঁজে পাই না। ধূসর পর্বতচূড়ার অপরূপ ছবিটি আসলে মেঘের। তাকিয়ে আর চোখ ফেরানো যায় না। মেঘের মধ্যেই অনেক কিছু।
শিরোনামহীন এই ছবিটি তুলেছেন জয়দীপ ভাদুড়ী। তিনি কোনো পেশাদার আলোকচিত্রী নন। পেশায় তিনি চিকিৎসক, নেশায় আলোকচিত্রী। রাজশাহী ফটোগ্রাফি সোসাইটি এ রকম ২৫০ জন আলোকচিত্রী তৈরি করেছে। তাঁদেরই একজন তিনি। তাঁর ছবি স্থান পেয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বরে ১৭ জুলাই শেষ হয়েছে তিন দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর। এর নাম দেওয়া হয় ‘ক্যাচ দ্য লাইট’। এতে সোসাইটির ২২ জন আলোকচিত্রীর ৭২টি ছবি স্থান পায়।
প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-উপদেষ্টা গোলাম সাব্বির সাত্তার লিখেছেন, ‘চিত্র প্রদর্শনী দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। আমাদের শিল্পীদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভার স্ফুরণে একদিন এই সমাজ ও দেশ আলোকিত হবে।’ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক সেলিনা পারভীন লিখেছেন, ‘জীবনের পথে পথে ছড়ানো অনেক মণি-মাণিক্য চোখের সামনে ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরার এই প্রচেষ্টা জানিয়ে দিচ্ছে যে এর পেছনে আছে কল্পনা-বাস্তবতা-ভালোবাসা-একাগ্রতা—যার নাম তারুণ্য। ভালো লেগেছে।’ এই বক্তব্যকে সমর্থন করে নাম লিখেছেন একই বিভাগের শিক্ষক রোজিনা লাজ, এ এম সালেহ রেজা, নুজহাত আরা ও সাবিনা সুলতানা।
প্রদর্শনী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বর সব সময়ই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে মুখরিত ছিল। আর বিমূর্ত ছবির ব্যাখ্যা দিতে চোখে পড়ার মতো ব্যস্ততা ছিল আলোকচিত্রীদের। তাঁদের ছোটাছুটিতে ফুটে উঠছিল এই আয়োজনের প্রতি অশেষ মমতা আর দর্শনার্থীদের প্রতি শ্রদ্ধা। গ্রন্থাগারের উত্তর পাশের দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো রাস্তা থেকেই নজরে পড়ার কারণে সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল বেশি। একবার ছবি দেখতে শুরু করলে শেষ না করে আর বের হওয়ার উপায় ছিল না। একটা ছবি দেখার পর পাশের ছবিটি হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কোনোটাই ফেলে আসার নয়। উপভোগ্য এই প্রদর্শনীতে ছবি দেখেন, কথা বলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আতিকুর রহমান, উপ-উপাধ্যক্ষ এম নুরুল্লাহ, শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুসফিক আহামেদ, সাধারণ সম্পাদক ছাদিকুল আরেফিন মাতিন। তাঁরা সবাই নিজ নিজ মুগ্ধতার কথা বলেন। একটি ধানপাতাকে জড়িয়ে আছে একটি লতা। ছবিটির নাম ‘অবলম্বন অতঃপর...’।
ছবিটি তুলেছেন এস এস কৌশিক নবী। দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রাশেদের কথায়, ছবিটি জীবনের জলছবি। গোবরের ঘুঁটে লাগানো একটি মাটির দেয়ালের ফুটোর ভেতর দিয়ে মুখ বের করে হাসছে একটি শিশু। ছবিটি দেখেই মনে হয়, আমাদের চারপাশে অনেক কিছুই আছে, যার প্রতি আমরা উদাসীন। আলোকচিত্রী তানভীর-উল-হোসেইনের এই ছবি যেন আমাদের চোখ খুলে দেয়। ঠিক যেন...‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু’। ফেরদৌস আহাম্মেদের ‘ইন সার্চ অব হেভেন’ যেন কোনো এক মায়াবী নিসর্গের হাতছানি। আলো আর অন্ধকার মিলে যেন অচেনা এক জগৎ তৈরি হয়েছে এই ছবিতে। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অনেক কিছুই নতুন করে চোখে পড়ার মতো। তেমনই একটি অবুঝ শিশুর কান্নাকে ক্যামেরায় বন্দী করেছেন ফয়সাল মুরাদ খান। এক ফোঁটা অশ্রু শিশুটির সারা মুখে কীভাবে যে কষ্ট ছড়িয়ে দিয়েছে; তাকালেই বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। হাসানুল বান্নার ‘বিনিথ দ্য ব্লু’ ছবিটি দেখতে দেখতে মনে হয়, এ যেন বিশাল আকাশের নিচে হারিয়ে যাওয়ার বেলা। অনেক মানুষের ভিড় আকাশের বিশালতার কাছে কেমন যেন তুচ্ছ হয়ে গেছে। আরও আছে আলো আর রঙের খেলা। মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রসংগীত—‘আলো আমার আলো...আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি...’।
ফরিদ আক্তার পরাগের ‘শরতের রং’, আতিকুর রহমানের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, হাসান ইমামের ‘ইলুসন’, রায়হান বিশ্বাসের ‘হারমনি অব রিদম’—কোনোটি থেকেই চোখ ফেরানো যায় না। এ ছাড়া কৌশিক সরকার, জাকির হোসেন, হাসিব আহামেদ, সালাউদ্দিন, রবিউল আনোয়ার, আবু রুবাইয়াত, আরিফ হাসান, ফয়সাল-আল-মাহামুদ, সনত কুমার ও আবদুর রহমান—সবার ছবিই যেন জীবনের প্রতিচ্ছবি। ঐতিহ্য রক্ষা গবেষণা ও প্রকাশনাবিষয়ক সংগঠন বরেন্দ্র পরিষদের আহ্বায়ক রবীন্দ্রগবেষক হাসান রাজার ভাষায়, এই আলোকচিত্রীরা জীবনঘনিষ্ঠ সত্যকে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন। এতে সমকালের সুন্দর সর্বকালের হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানের এই ছবিই বলে দেয়, আমাদের দেখার চেয়ে আলোকচিত্রীদের দেখার ক্ষমতা আরও গভীর এবং শৈল্পিক। দুঃসময়কে জয় করতে এ ধরনের প্রদর্শনী আরও বেশি করে হওয়া প্রয়োজন।
প্রদর্শনী থেকে ফিরতে ফিরতে মনে হলো ক্যাচ দ্য লাইট —ঠিকই আছে। ওরা আসলে ক্যামেরা নয়, আলো ধরার ফাঁদ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের মন থেকে যে আলো মিলিয়ে যায়, তা আটকা পড়ে আলোকচিত্রীদের ফাঁদে।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-উপদেষ্টা গোলাম সাব্বির সাত্তার লিখেছেন, ‘চিত্র প্রদর্শনী দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। আমাদের শিল্পীদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভার স্ফুরণে একদিন এই সমাজ ও দেশ আলোকিত হবে।’ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক সেলিনা পারভীন লিখেছেন, ‘জীবনের পথে পথে ছড়ানো অনেক মণি-মাণিক্য চোখের সামনে ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরার এই প্রচেষ্টা জানিয়ে দিচ্ছে যে এর পেছনে আছে কল্পনা-বাস্তবতা-ভালোবাসা-একাগ্রতা—যার নাম তারুণ্য। ভালো লেগেছে।’ এই বক্তব্যকে সমর্থন করে নাম লিখেছেন একই বিভাগের শিক্ষক রোজিনা লাজ, এ এম সালেহ রেজা, নুজহাত আরা ও সাবিনা সুলতানা।
প্রদর্শনী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার চত্বর সব সময়ই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে মুখরিত ছিল। আর বিমূর্ত ছবির ব্যাখ্যা দিতে চোখে পড়ার মতো ব্যস্ততা ছিল আলোকচিত্রীদের। তাঁদের ছোটাছুটিতে ফুটে উঠছিল এই আয়োজনের প্রতি অশেষ মমতা আর দর্শনার্থীদের প্রতি শ্রদ্ধা। গ্রন্থাগারের উত্তর পাশের দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো রাস্তা থেকেই নজরে পড়ার কারণে সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল বেশি। একবার ছবি দেখতে শুরু করলে শেষ না করে আর বের হওয়ার উপায় ছিল না। একটা ছবি দেখার পর পাশের ছবিটি হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কোনোটাই ফেলে আসার নয়। উপভোগ্য এই প্রদর্শনীতে ছবি দেখেন, কথা বলেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আতিকুর রহমান, উপ-উপাধ্যক্ষ এম নুরুল্লাহ, শিক্ষক সমিতির সভাপতি মুসফিক আহামেদ, সাধারণ সম্পাদক ছাদিকুল আরেফিন মাতিন। তাঁরা সবাই নিজ নিজ মুগ্ধতার কথা বলেন। একটি ধানপাতাকে জড়িয়ে আছে একটি লতা। ছবিটির নাম ‘অবলম্বন অতঃপর...’।
ছবিটি তুলেছেন এস এস কৌশিক নবী। দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রাশেদের কথায়, ছবিটি জীবনের জলছবি। গোবরের ঘুঁটে লাগানো একটি মাটির দেয়ালের ফুটোর ভেতর দিয়ে মুখ বের করে হাসছে একটি শিশু। ছবিটি দেখেই মনে হয়, আমাদের চারপাশে অনেক কিছুই আছে, যার প্রতি আমরা উদাসীন। আলোকচিত্রী তানভীর-উল-হোসেইনের এই ছবি যেন আমাদের চোখ খুলে দেয়। ঠিক যেন...‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু’। ফেরদৌস আহাম্মেদের ‘ইন সার্চ অব হেভেন’ যেন কোনো এক মায়াবী নিসর্গের হাতছানি। আলো আর অন্ধকার মিলে যেন অচেনা এক জগৎ তৈরি হয়েছে এই ছবিতে। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অনেক কিছুই নতুন করে চোখে পড়ার মতো। তেমনই একটি অবুঝ শিশুর কান্নাকে ক্যামেরায় বন্দী করেছেন ফয়সাল মুরাদ খান। এক ফোঁটা অশ্রু শিশুটির সারা মুখে কীভাবে যে কষ্ট ছড়িয়ে দিয়েছে; তাকালেই বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। হাসানুল বান্নার ‘বিনিথ দ্য ব্লু’ ছবিটি দেখতে দেখতে মনে হয়, এ যেন বিশাল আকাশের নিচে হারিয়ে যাওয়ার বেলা। অনেক মানুষের ভিড় আকাশের বিশালতার কাছে কেমন যেন তুচ্ছ হয়ে গেছে। আরও আছে আলো আর রঙের খেলা। মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রসংগীত—‘আলো আমার আলো...আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি...’।
ফরিদ আক্তার পরাগের ‘শরতের রং’, আতিকুর রহমানের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, হাসান ইমামের ‘ইলুসন’, রায়হান বিশ্বাসের ‘হারমনি অব রিদম’—কোনোটি থেকেই চোখ ফেরানো যায় না। এ ছাড়া কৌশিক সরকার, জাকির হোসেন, হাসিব আহামেদ, সালাউদ্দিন, রবিউল আনোয়ার, আবু রুবাইয়াত, আরিফ হাসান, ফয়সাল-আল-মাহামুদ, সনত কুমার ও আবদুর রহমান—সবার ছবিই যেন জীবনের প্রতিচ্ছবি। ঐতিহ্য রক্ষা গবেষণা ও প্রকাশনাবিষয়ক সংগঠন বরেন্দ্র পরিষদের আহ্বায়ক রবীন্দ্রগবেষক হাসান রাজার ভাষায়, এই আলোকচিত্রীরা জীবনঘনিষ্ঠ সত্যকে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন। এতে সমকালের সুন্দর সর্বকালের হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানের এই ছবিই বলে দেয়, আমাদের দেখার চেয়ে আলোকচিত্রীদের দেখার ক্ষমতা আরও গভীর এবং শৈল্পিক। দুঃসময়কে জয় করতে এ ধরনের প্রদর্শনী আরও বেশি করে হওয়া প্রয়োজন।
প্রদর্শনী থেকে ফিরতে ফিরতে মনে হলো ক্যাচ দ্য লাইট —ঠিকই আছে। ওরা আসলে ক্যামেরা নয়, আলো ধরার ফাঁদ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের মন থেকে যে আলো মিলিয়ে যায়, তা আটকা পড়ে আলোকচিত্রীদের ফাঁদে।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ
No comments