কালান্তরের কড়চা-বিড়ালের গলায় গণতন্ত্রের ঘণ্টা বাঁধবে কে? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়া সম্প্রতি একটি অত্যন্ত খাঁটি কথা বলেছেন। নিজে ক্ষমতায় থাকতে এই খাঁটি কথাটি কখনো স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, 'দেশে এখন চলছে এক ব্যক্তির শাসন।' কথাটি তিনি বলেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু এই এক ব্যক্তির শাসন খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেও সত্য ছিল।
বরং একটু বেশিই সত্য ছিল। বিএনপিনেত্রীর ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত শাসনামলটি ছিল প্রকৃতই এক ব্যক্তির শাসন। সব ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল প্রধানমন্ত্রীর হাতে। মন্ত্রীদের নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ছিল না। কথা বলারও নয়। কথা বলতে গেলে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার পরিণতি বরণ করতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় রাষ্ট্রপতিকেও পদত্যাগ করতে হতো। বড় ছেলে লায়েক হয়ে ওঠায় মা কেবল তার সঙ্গেই ক্ষমতা শেয়ার করতেন।
সেই খালেদা এখন ক্ষমতা হারিয়ে খেদোক্তি করছেন যে, 'দেশে এখন চলছে এক ব্যক্তির শাসন।' আসলে কথাটা হবে, তাঁর আমলে দেশে যে এক ব্যক্তির শাসন চলছিল, এখন সরকার পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও তা অব্যাহত আছে। সম্প্রতি সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদও এই ধরনের একটি খেদোক্তি করেছেন। বলেছেন, মহাজোট এখন আর নেই। জাতীয় পার্টি থেকে তাঁর ভাই জি এম কাদের হাসিনার মন্ত্রিসভায় আছেন বটে, তাঁর একজন পিয়ন নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতাও নেই।'
সাবেক রাষ্ট্রপতিও সঠিক কথাই বলেছেন। তবে ক্ষমতাহীন মন্ত্রিত্বের এই প্রথাটির তিনিই প্রবর্তন করে গেছেন। প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা আতাউর রহমান খানকে তিনিই অনেক সাধ্য-সাধনা করে তাঁর প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়েছিলেন। এই প্রধানমন্ত্রিত্ব করার তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বয়োবৃদ্ধ নেতা তাঁর স্মৃতিচারণামূলক একটি বইয়ে সখেদে লিখেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তাঁর একজন পিয়নকে নিয়োগদানেরও ক্ষমতা ছিল না। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী পদে এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেছে। সেই ব্যক্তি কোনো বেতন পাননি কিংবা তার নিয়োগও স্বীকৃতি পায়নি। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি রাষ্ট্রপতি এরশাদের গোচরে এনেছিলেন, একবার নয়, বহুবার। এরশাদ তাঁর প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ মানা দূরের কথা, তাঁকে কোনোরকম গুরুত্ব দেননি।
সেই জেনারেল এরশাদ এখন হাসিনার মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত দলের নেতা হয়েও খেদোক্তি করছেন, মহাজোট সরকারে তাঁর দলের মন্ত্রীর একজন পিয়ন নিয়োগেরও ক্ষমতা নেই। এই ক্ষমতা এরশাদ সাহেবও তাঁর আমলের মন্ত্রীদের দেননি। দেশে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সরকার পদ্ধতিরও পরিবর্তন হয়েছে (প্রেসিডেন্সিয়াল থেকে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি)। কিন্তু সরকার পরিচালনায় এরশাদ সাহেবরা যে ট্রাডিশন সৃষ্টি করে রেখে গেছেন তা বাংলাদেশে এখনো অব্যাহত রয়ে গেছে। কাঁঠাল গাছে আম ধরেনি। এটাই স্বাভাবিক। জেনারেল এরশাদ, খালেদা জিয়া তাঁদের শাসনামলে দেশে কাঁঠাল গাছ পুুঁতেছেন, এখন তাতে আম ধরবে কী করে?
আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ শাসনের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি পার্লামেন্টারি এবং অন্যটি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি। ব্রিটেন এবং অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে শাসিত হয়। আমেরিকা শাসিত হয় প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে। দুই পদ্ধতিতেই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ব্যাপারে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ব্যবস্থা আছে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নিজেদের খেয়াল খুশিমতো সব কিছু করতে পারেন না। ক্যাবিনেট পদ্ধতির সরকারে প্রত্যেক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের ক্ষমতার নিজস্ব পরিধি আছে এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁর পরামর্শ শোনেন। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট তাঁর পছন্দমতো ক্যাবিনেট গঠন করেন বটে, কিন্তু মন্ত্রীদের হাতে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাও দেন।
বাংলাদেশে মন্ত্রীদের দাপট আছে, ক্ষমতা নেই। ক্যাবিনেট পদ্ধতির সরকার হলে প্রধানমন্ত্রীর এবং প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার হলে তিনি প্রেসিডেন্টের আজ্ঞাবহ। এই ব্যবস্থাটি না ক্যাবিনেট, না প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির। সাবেক তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো দেশে যে ডিকটেটোরিয়াল ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত, বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থাও অনেকটা তা-ই। কখনো সামরিক ডিকটেটর, কখনো গণতান্ত্রিক ডিকটেটর দেশ শাসন করেন। ইংরেজিতে বর্তমানে একটি কথা চালু হয়েছে, ইলেকটিভ ডিকটেটরশিপ বা নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র, বাংলাদেশ যা চলছে, তা অনেকটা তেমনই। জনসাধারণ বারবার রক্তদান করে যে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনে, তাকে সরকারব্যবস্থায় খোলসের মতো ব্যবহার করে সেই খোলসের আড়ালে স্বেচ্ছাতন্ত্রই টিকে থাকে।
এবার মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে অবস্থান করে আমার মনে হয়েছে, ২০০৮ সাল থেকে দেশে সরকারের চেহারা বদল হয়েছে, চরিত্র বদল হয়নি, মন্ত্রিসভায় পুরনো মুখের বদলে নতুন মুখ এসেছে; কিন্তু তাদেরও ক্ষমতা নেই, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনভিজ্ঞতা। তাতে আমলাদের সুবিধা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এই আমলাদের সাহায্যেই দেশ শাসন করেন। মন্ত্রীরা 'নামের খসম আজিজ মেসের'। তাঁদের কেউ কেউ নিয়মিত নিজ মন্ত্রণালয়ের দপ্তরেও যান না। তাঁদের সান্ধ্য দপ্তর ঢাকা ক্লাব। ভাদ্রবৌ যেমন ভাসুরের নাম ভুলেও মুখে আনে না, এই মন্ত্রীরাও তেমনি প্রধানমন্ত্রীর নাম ভুলেও উচ্চারণ করেন না। 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী' কথাটি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতেও তটস্থ হয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান।
এ ধরনের আচরণ আধুনিক যুগের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের মন্ত্রীদের আচরণ নয়, ফিউডাল যুগের রাজা-বাদশাহদের সভাসদ ও মোসাহেবদের আচরণ। ব্রিটেনের মতো রাজতন্ত্রের দেশেও এখন সামন্ত যুগের অলংকার যুক্ত সম্ভাষণগুলো ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। টনি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, 'আমাকে আর অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার বলার দরকার নেই। আমাকে টনি, এই ফার্স্ট নেমে ডাকলেই খুশি হব।' আমেরিকার প্রেসিডেন্ট শুধু মি. প্রেসিডেন্ট। তাঁর নামের আগে-পেছনে কোনো মধ্যযুগীয় বিশেষণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে 'মহামান্য রাষ্ট্রপতি', 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী' সম্ভাষণের অতিব্যবহার দেখলে মনে হয়, আমরা সম্ভবত এখনো মোগল শাহি দরবারের আমলে বাস করছি।
বাংলাদেশের বর্তমান মন্ত্রিসভার এক সদস্য আমাকে বলেছেন, 'দয়া করে আমার নাম প্রকাশ করবেন না। যদি লিখতে চান লিখুন, আমরা মন্ত্রীরা হচ্ছি ডাবল স্যান্ডউইচের ভেতরের সিদ্ধ ডিমের পেস্ট। আমাদের ওপরে দুই লেয়ার। উপদেষ্টা পরিষদ এবং শীর্ষে প্রধানমন্ত্রী। নিচে রক্তচক্ষু পাহারাদার আমলাতন্ত্র। আমাদের স্বাধীনভাবে করণীয় কিছু নেই। উপদেষ্টাদের উপদেশ মানি, প্রধানমন্ত্রীর ধমক শুনি এবং আমলাদের হুকুম মান্য করে চলি। আমাদের চেয়ে আমলারা বেশি ক্ষমতাবান। কারণ নামে আমাদের সচিব হলেও তাঁরা অনেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সরাসরি হুকুম নেন। অথবা প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে সচিবরা মন্ত্রীর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নিজেদের হুকুম ও হুকুমাত বহাল রাখেন। ওপরে মন্ত্রী নামের টুপি বদল হয়েছে মাত্র।'
এই অভিযোগ ঢাকায় অবস্থানকালে অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মুখেই শুনেছি। বিএনপি আমলে মন্ত্রী নাজমুল হুদার ভাগ্য এবং বর্তমান আওয়ামী আমলে মন্ত্রী সোহেল তাজের ভাগ্য সম্ভবত অনেকটা এক সুতোয় বাঁধা পড়েছিল। প্রেসিডেন্সিয়াল এবং ক্যাবিনেট পদ্ধতি, দুই ধরনের ব্যবস্থাতেই যদি মন্ত্রিপরিষদ অভিজ্ঞ এবং মন্ত্রীরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী না হন, তাহলে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব দায়িত্ব এসে বর্তায়। তার সুযোগ নেন আমলারা এবং আমলা-শাসনে গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি বারবার ব্যর্থ হয়ে যায়। এই ব্যাপারটি বাংলাদেশে বারবার ঘটছে।
বর্তমান আওয়ামী আমলের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আবার মহাজোটের মন্ত্রিসভার সদস্য জি এম কাদেরের কথায় ফিরে আসতে হলো। আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয়ের আগেই জানতে পেরেছিলাম, তিনি তাঁর ভাই জেনারেল এরশাদের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষ। তিনি অসাধু মন্ত্রী নন, চরিত্রবান এবং নীতিবান মানুষ; তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ যা-ই হোক। তাঁর স্ত্রী একজন সংগীতশিল্পী এবং বিদূষী মহিলা। এবার বাংলাদেশে অবস্থানের সময় সাক্ষাৎ-পরিচয়েও দেখেছি জি এম কাদের সত্যি সত্যি ভালো মন্ত্রী এবং ভালো মানুষও।
কিন্তু তাঁর দায়িত্ব পালনে পদে পদে বাধা পেয়েছেন তাঁর অধীনস্থ আমলাদের কাছ থেকে। তিনি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনের মন্ত্রী। বাংলাদেশ বিমানকে দুর্নীতিমুক্ত করে একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করা এবং হজের মৌসুমে হজযাত্রী বহনের নামে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতানোর একটি কায়েমি স্বার্থের আড্ডা ভাঙতে গিয়ে তিনি তাঁর অধীনস্থ আমলার অবাধ্যতা, চক্রান্ত, এমনকি গোপন অপপ্রচারের মুখে পড়েছেন। আমলাটি তাঁর সচিব পদে ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই নাকি বলতেন, 'আমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ করছি।' মন্ত্রী তাঁকে কোনো ব্যাপারে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠালে তিনি নাকি বলতেন, 'আমাকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ডেকে পাঠানো হয়েছে। এখন মন্ত্রীর কাছে যেতে পারব না।'
এই সচিব বঙ্গবন্ধুর নামে কবিতা লিখে নিজেকে বঙ্গবন্ধুর খাঁটি অনুসারী প্রমাণেরও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। হঠাৎ প্রকাশ পেল বিএনপি আমলের মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের এক চিঠি। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে এই চিঠিটা লিখেছিলেন। তাতে সিরাজ এই আমলার পদোন্নতির জোর সুপারিশ করেছিলেন। লিখেছেন, এই আমলা বিএনপির একজন একনিষ্ঠ অনুসারী।
এই অবাধ্য এবং সুযোগসন্ধানী আমলাকে তাঁর সচিব পদ থেকে সরাতে মন্ত্রী জি এম কাদের অনেক চেষ্টা করেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন। সরাতে পারেননি। দায়িত্ব পালনে পদে পদে বাধা পেয়েছেন। মন্ত্রী হিসেবে তিনি পর্যটন ও সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বোর্ড অব ডিরেক্টর সদস্যদের নমিনেশন দিতেন। সেই নমিনেশন সহজে অনুমোদিত হতো না। আরেক অফিসারকে এই চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে বোর্ডের ডিরেক্টর পদে নমিনেশন দিতে শুরু করেন এবং তা অনুমোদন পেত। জি এম কাদেরের মতে, তাঁর মন্ত্রণালয়ের সব অকাজের জন্য তাঁকে অভিযুক্ত হতে হয়। জাতীয় সংসদেও জবাবদিহি করতে হয়। অথচ এসব কাজর কোনোটার ওপরেই তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি সে কথা প্রকাশ্যে বলতেও পারেন না।
এই মন্ত্রী আমাকে বলেছেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রীকে বারবার বলেছি, আমি আপনার সব কথা মেনে চলতে চেষ্টা করছি। কেবল আমাকে ডিঙিয়ে আমলাদের ছড়ি ঘোরানোর কোনো সুযোগ দয়া করে দেবেন না।' মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কেন মন্ত্রীপদ ছেড়ে দিচ্ছেন না? তিনি বলেছেন, মহাজোট রক্ষার স্বার্থে। আমি এখনো বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী দেশের ভালো করতে চান এবং এই মহাজোট ক্ষমতায় না থাকলে দেশের মহাসর্বনাশ হবে।
ওই মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর (লন্ডনে ফিরে এসে) শুনেছি, তাঁর সেই কবি ও সুযোগসন্ধানী সচিবকে ওই মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়ার বদলে তাঁকে আরো প্রোমোশন দেওয়া হয়েছে কি না তা জানতে পারিনি।
বর্তমান মন্ত্রিসভার সবচেয়ে বড় মন্ত্রণালয়ের যিনি মন্ত্রী এবং যাঁর বিরুদ্ধে দপ্তরে অধিকাংশ সময় গরহাজির থাকা এবং দেশে থেকেও কোনো কোনো সময় নিখোঁজ থাকার অভিযোগ, তিনি নাকি তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেছেন, 'আমি মন্ত্রী বটে, কিন্তু সব সিদ্ধান্ত তো নেয় আমলারা। তাহলে আমার সব সময় অফিসে হাজিরা দিতে হবে কেন? আবার দপ্তরের সচিবরা নাকি বলেছেন, আমাকে ফাইল সই করার জন্য পাওয়া যায় না। ফলে ফাইলের স্তূপ হয়েছে। আমার কথা হলো, সব কাজে সচিবরাই সিদ্ধান্ত নেন ও তা কার্যকর করেন। আমি কেবল সই দেওয়ার সাক্ষী-গোপাল। আমি তো এক দিন অফিসে গিয়ে ১০০টা ফাইলে সই দিয়ে দিতে পারি এবং দিচ্ছিও। তাহলে এত অভিযোগ কিসের?' মন্ত্রীর এই বক্তব্য আমার শোনা কথা। কতটা সঠিক তা হলফ করে বলতে পারব না।
আমার কথা, আমার এবারের বঙ্গদর্শনের অভিজ্ঞতা হলো, বাংলাদেশে নামে গণতন্ত্র ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিকভাবে ও ক্যাবিনেট পদ্ধতিতে দেশ চলছে না। দেশ চালাচ্ছে আমলা, অনির্বাচিত উপদেষ্টা এবং নব্য ও অসাধু ধনীদের একটা বড় অংশ। প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ান। এটা বিএনপির আমলে বেশি করে ঘটেছে এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ আমলেও কমবেশি ঘটছে। এই অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা কখনো ঘটবে না। প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় এই ঘণ্টা কে বাঁধবে?
(সমাপ্ত)
লন্ডন, ১৬ মে, সোমবার, ২০১১
সেই খালেদা এখন ক্ষমতা হারিয়ে খেদোক্তি করছেন যে, 'দেশে এখন চলছে এক ব্যক্তির শাসন।' আসলে কথাটা হবে, তাঁর আমলে দেশে যে এক ব্যক্তির শাসন চলছিল, এখন সরকার পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও তা অব্যাহত আছে। সম্প্রতি সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদও এই ধরনের একটি খেদোক্তি করেছেন। বলেছেন, মহাজোট এখন আর নেই। জাতীয় পার্টি থেকে তাঁর ভাই জি এম কাদের হাসিনার মন্ত্রিসভায় আছেন বটে, তাঁর একজন পিয়ন নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতাও নেই।'
সাবেক রাষ্ট্রপতিও সঠিক কথাই বলেছেন। তবে ক্ষমতাহীন মন্ত্রিত্বের এই প্রথাটির তিনিই প্রবর্তন করে গেছেন। প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা আতাউর রহমান খানকে তিনিই অনেক সাধ্য-সাধনা করে তাঁর প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়েছিলেন। এই প্রধানমন্ত্রিত্ব করার তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বয়োবৃদ্ধ নেতা তাঁর স্মৃতিচারণামূলক একটি বইয়ে সখেদে লিখেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তাঁর একজন পিয়নকে নিয়োগদানেরও ক্ষমতা ছিল না। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী পদে এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মাসের পর মাস কেটে গেছে। সেই ব্যক্তি কোনো বেতন পাননি কিংবা তার নিয়োগও স্বীকৃতি পায়নি। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি রাষ্ট্রপতি এরশাদের গোচরে এনেছিলেন, একবার নয়, বহুবার। এরশাদ তাঁর প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ মানা দূরের কথা, তাঁকে কোনোরকম গুরুত্ব দেননি।
সেই জেনারেল এরশাদ এখন হাসিনার মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত দলের নেতা হয়েও খেদোক্তি করছেন, মহাজোট সরকারে তাঁর দলের মন্ত্রীর একজন পিয়ন নিয়োগেরও ক্ষমতা নেই। এই ক্ষমতা এরশাদ সাহেবও তাঁর আমলের মন্ত্রীদের দেননি। দেশে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সরকার পদ্ধতিরও পরিবর্তন হয়েছে (প্রেসিডেন্সিয়াল থেকে পার্লামেন্টারি পদ্ধতি)। কিন্তু সরকার পরিচালনায় এরশাদ সাহেবরা যে ট্রাডিশন সৃষ্টি করে রেখে গেছেন তা বাংলাদেশে এখনো অব্যাহত রয়ে গেছে। কাঁঠাল গাছে আম ধরেনি। এটাই স্বাভাবিক। জেনারেল এরশাদ, খালেদা জিয়া তাঁদের শাসনামলে দেশে কাঁঠাল গাছ পুুঁতেছেন, এখন তাতে আম ধরবে কী করে?
আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ শাসনের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি পার্লামেন্টারি এবং অন্যটি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি। ব্রিটেন এবং অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে শাসিত হয়। আমেরিকা শাসিত হয় প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতিতে। দুই পদ্ধতিতেই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ব্যাপারে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ব্যবস্থা আছে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নিজেদের খেয়াল খুশিমতো সব কিছু করতে পারেন না। ক্যাবিনেট পদ্ধতির সরকারে প্রত্যেক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের ক্ষমতার নিজস্ব পরিধি আছে এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁর পরামর্শ শোনেন। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট তাঁর পছন্দমতো ক্যাবিনেট গঠন করেন বটে, কিন্তু মন্ত্রীদের হাতে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতাও দেন।
বাংলাদেশে মন্ত্রীদের দাপট আছে, ক্ষমতা নেই। ক্যাবিনেট পদ্ধতির সরকার হলে প্রধানমন্ত্রীর এবং প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার হলে তিনি প্রেসিডেন্টের আজ্ঞাবহ। এই ব্যবস্থাটি না ক্যাবিনেট, না প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির। সাবেক তৃতীয় বিশ্বের কোনো কোনো দেশে যে ডিকটেটোরিয়াল ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত, বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থাও অনেকটা তা-ই। কখনো সামরিক ডিকটেটর, কখনো গণতান্ত্রিক ডিকটেটর দেশ শাসন করেন। ইংরেজিতে বর্তমানে একটি কথা চালু হয়েছে, ইলেকটিভ ডিকটেটরশিপ বা নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র, বাংলাদেশ যা চলছে, তা অনেকটা তেমনই। জনসাধারণ বারবার রক্তদান করে যে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনে, তাকে সরকারব্যবস্থায় খোলসের মতো ব্যবহার করে সেই খোলসের আড়ালে স্বেচ্ছাতন্ত্রই টিকে থাকে।
এবার মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে অবস্থান করে আমার মনে হয়েছে, ২০০৮ সাল থেকে দেশে সরকারের চেহারা বদল হয়েছে, চরিত্র বদল হয়নি, মন্ত্রিসভায় পুরনো মুখের বদলে নতুন মুখ এসেছে; কিন্তু তাদেরও ক্ষমতা নেই, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনভিজ্ঞতা। তাতে আমলাদের সুবিধা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এই আমলাদের সাহায্যেই দেশ শাসন করেন। মন্ত্রীরা 'নামের খসম আজিজ মেসের'। তাঁদের কেউ কেউ নিয়মিত নিজ মন্ত্রণালয়ের দপ্তরেও যান না। তাঁদের সান্ধ্য দপ্তর ঢাকা ক্লাব। ভাদ্রবৌ যেমন ভাসুরের নাম ভুলেও মুখে আনে না, এই মন্ত্রীরাও তেমনি প্রধানমন্ত্রীর নাম ভুলেও উচ্চারণ করেন না। 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী' কথাটি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতেও তটস্থ হয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান।
এ ধরনের আচরণ আধুনিক যুগের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের মন্ত্রীদের আচরণ নয়, ফিউডাল যুগের রাজা-বাদশাহদের সভাসদ ও মোসাহেবদের আচরণ। ব্রিটেনের মতো রাজতন্ত্রের দেশেও এখন সামন্ত যুগের অলংকার যুক্ত সম্ভাষণগুলো ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। টনি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, 'আমাকে আর অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার বলার দরকার নেই। আমাকে টনি, এই ফার্স্ট নেমে ডাকলেই খুশি হব।' আমেরিকার প্রেসিডেন্ট শুধু মি. প্রেসিডেন্ট। তাঁর নামের আগে-পেছনে কোনো মধ্যযুগীয় বিশেষণ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে 'মহামান্য রাষ্ট্রপতি', 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী' সম্ভাষণের অতিব্যবহার দেখলে মনে হয়, আমরা সম্ভবত এখনো মোগল শাহি দরবারের আমলে বাস করছি।
বাংলাদেশের বর্তমান মন্ত্রিসভার এক সদস্য আমাকে বলেছেন, 'দয়া করে আমার নাম প্রকাশ করবেন না। যদি লিখতে চান লিখুন, আমরা মন্ত্রীরা হচ্ছি ডাবল স্যান্ডউইচের ভেতরের সিদ্ধ ডিমের পেস্ট। আমাদের ওপরে দুই লেয়ার। উপদেষ্টা পরিষদ এবং শীর্ষে প্রধানমন্ত্রী। নিচে রক্তচক্ষু পাহারাদার আমলাতন্ত্র। আমাদের স্বাধীনভাবে করণীয় কিছু নেই। উপদেষ্টাদের উপদেশ মানি, প্রধানমন্ত্রীর ধমক শুনি এবং আমলাদের হুকুম মান্য করে চলি। আমাদের চেয়ে আমলারা বেশি ক্ষমতাবান। কারণ নামে আমাদের সচিব হলেও তাঁরা অনেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সরাসরি হুকুম নেন। অথবা প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে সচিবরা মন্ত্রীর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে নিজেদের হুকুম ও হুকুমাত বহাল রাখেন। ওপরে মন্ত্রী নামের টুপি বদল হয়েছে মাত্র।'
এই অভিযোগ ঢাকায় অবস্থানকালে অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মুখেই শুনেছি। বিএনপি আমলে মন্ত্রী নাজমুল হুদার ভাগ্য এবং বর্তমান আওয়ামী আমলে মন্ত্রী সোহেল তাজের ভাগ্য সম্ভবত অনেকটা এক সুতোয় বাঁধা পড়েছিল। প্রেসিডেন্সিয়াল এবং ক্যাবিনেট পদ্ধতি, দুই ধরনের ব্যবস্থাতেই যদি মন্ত্রিপরিষদ অভিজ্ঞ এবং মন্ত্রীরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী না হন, তাহলে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব দায়িত্ব এসে বর্তায়। তার সুযোগ নেন আমলারা এবং আমলা-শাসনে গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি বারবার ব্যর্থ হয়ে যায়। এই ব্যাপারটি বাংলাদেশে বারবার ঘটছে।
বর্তমান আওয়ামী আমলের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আবার মহাজোটের মন্ত্রিসভার সদস্য জি এম কাদেরের কথায় ফিরে আসতে হলো। আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরিচয়ের আগেই জানতে পেরেছিলাম, তিনি তাঁর ভাই জেনারেল এরশাদের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের মানুষ। তিনি অসাধু মন্ত্রী নন, চরিত্রবান এবং নীতিবান মানুষ; তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ যা-ই হোক। তাঁর স্ত্রী একজন সংগীতশিল্পী এবং বিদূষী মহিলা। এবার বাংলাদেশে অবস্থানের সময় সাক্ষাৎ-পরিচয়েও দেখেছি জি এম কাদের সত্যি সত্যি ভালো মন্ত্রী এবং ভালো মানুষও।
কিন্তু তাঁর দায়িত্ব পালনে পদে পদে বাধা পেয়েছেন তাঁর অধীনস্থ আমলাদের কাছ থেকে। তিনি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনের মন্ত্রী। বাংলাদেশ বিমানকে দুর্নীতিমুক্ত করে একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত করা এবং হজের মৌসুমে হজযাত্রী বহনের নামে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতানোর একটি কায়েমি স্বার্থের আড্ডা ভাঙতে গিয়ে তিনি তাঁর অধীনস্থ আমলার অবাধ্যতা, চক্রান্ত, এমনকি গোপন অপপ্রচারের মুখে পড়েছেন। আমলাটি তাঁর সচিব পদে ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই নাকি বলতেন, 'আমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ করছি।' মন্ত্রী তাঁকে কোনো ব্যাপারে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠালে তিনি নাকি বলতেন, 'আমাকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ডেকে পাঠানো হয়েছে। এখন মন্ত্রীর কাছে যেতে পারব না।'
এই সচিব বঙ্গবন্ধুর নামে কবিতা লিখে নিজেকে বঙ্গবন্ধুর খাঁটি অনুসারী প্রমাণেরও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। হঠাৎ প্রকাশ পেল বিএনপি আমলের মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের এক চিঠি। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে এই চিঠিটা লিখেছিলেন। তাতে সিরাজ এই আমলার পদোন্নতির জোর সুপারিশ করেছিলেন। লিখেছেন, এই আমলা বিএনপির একজন একনিষ্ঠ অনুসারী।
এই অবাধ্য এবং সুযোগসন্ধানী আমলাকে তাঁর সচিব পদ থেকে সরাতে মন্ত্রী জি এম কাদের অনেক চেষ্টা করেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন। সরাতে পারেননি। দায়িত্ব পালনে পদে পদে বাধা পেয়েছেন। মন্ত্রী হিসেবে তিনি পর্যটন ও সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বোর্ড অব ডিরেক্টর সদস্যদের নমিনেশন দিতেন। সেই নমিনেশন সহজে অনুমোদিত হতো না। আরেক অফিসারকে এই চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে বোর্ডের ডিরেক্টর পদে নমিনেশন দিতে শুরু করেন এবং তা অনুমোদন পেত। জি এম কাদেরের মতে, তাঁর মন্ত্রণালয়ের সব অকাজের জন্য তাঁকে অভিযুক্ত হতে হয়। জাতীয় সংসদেও জবাবদিহি করতে হয়। অথচ এসব কাজর কোনোটার ওপরেই তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তিনি সে কথা প্রকাশ্যে বলতেও পারেন না।
এই মন্ত্রী আমাকে বলেছেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রীকে বারবার বলেছি, আমি আপনার সব কথা মেনে চলতে চেষ্টা করছি। কেবল আমাকে ডিঙিয়ে আমলাদের ছড়ি ঘোরানোর কোনো সুযোগ দয়া করে দেবেন না।' মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কেন মন্ত্রীপদ ছেড়ে দিচ্ছেন না? তিনি বলেছেন, মহাজোট রক্ষার স্বার্থে। আমি এখনো বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী দেশের ভালো করতে চান এবং এই মহাজোট ক্ষমতায় না থাকলে দেশের মহাসর্বনাশ হবে।
ওই মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর (লন্ডনে ফিরে এসে) শুনেছি, তাঁর সেই কবি ও সুযোগসন্ধানী সচিবকে ওই মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেওয়ার বদলে তাঁকে আরো প্রোমোশন দেওয়া হয়েছে কি না তা জানতে পারিনি।
বর্তমান মন্ত্রিসভার সবচেয়ে বড় মন্ত্রণালয়ের যিনি মন্ত্রী এবং যাঁর বিরুদ্ধে দপ্তরে অধিকাংশ সময় গরহাজির থাকা এবং দেশে থেকেও কোনো কোনো সময় নিখোঁজ থাকার অভিযোগ, তিনি নাকি তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলেছেন, 'আমি মন্ত্রী বটে, কিন্তু সব সিদ্ধান্ত তো নেয় আমলারা। তাহলে আমার সব সময় অফিসে হাজিরা দিতে হবে কেন? আবার দপ্তরের সচিবরা নাকি বলেছেন, আমাকে ফাইল সই করার জন্য পাওয়া যায় না। ফলে ফাইলের স্তূপ হয়েছে। আমার কথা হলো, সব কাজে সচিবরাই সিদ্ধান্ত নেন ও তা কার্যকর করেন। আমি কেবল সই দেওয়ার সাক্ষী-গোপাল। আমি তো এক দিন অফিসে গিয়ে ১০০টা ফাইলে সই দিয়ে দিতে পারি এবং দিচ্ছিও। তাহলে এত অভিযোগ কিসের?' মন্ত্রীর এই বক্তব্য আমার শোনা কথা। কতটা সঠিক তা হলফ করে বলতে পারব না।
আমার কথা, আমার এবারের বঙ্গদর্শনের অভিজ্ঞতা হলো, বাংলাদেশে নামে গণতন্ত্র ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিকভাবে ও ক্যাবিনেট পদ্ধতিতে দেশ চলছে না। দেশ চালাচ্ছে আমলা, অনির্বাচিত উপদেষ্টা এবং নব্য ও অসাধু ধনীদের একটা বড় অংশ। প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ান। এটা বিএনপির আমলে বেশি করে ঘটেছে এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ আমলেও কমবেশি ঘটছে। এই অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রতিষ্ঠা কখনো ঘটবে না। প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় এই ঘণ্টা কে বাঁধবে?
(সমাপ্ত)
লন্ডন, ১৬ মে, সোমবার, ২০১১
No comments