যৌন নিপীড়ন-আত্মহত্যা নয়, রুখে দাঁড়ানোই সঠিক রাস্তা by নাসরিন সিরাজ ও নাজনীন শিফা
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন শিক্ষকের দ্বারা একই স্কুলের ছাত্রী ধর্ষণ, ধর্ষণের শিকার মেয়েটির ছবি ও ভিডিও ধারণ, সেগুলো ফেসবুকে প্রচারণার হুমকির পাশাপাশি নিপীড়নের অভিযোগ করলে ছাত্রীটির প্রাণনাশের হুমকির খবরে আমরা আঁতকে উঠেছিলাম।
কিন্তু ভয়ে আমাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল তখনই, যখন জানতে পারি ১. ছাত্রীটি অভিযোগ করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বসুন্ধরা শাখাপ্রধান সেটা নিয়ে নিষ্ক্রিয় ছিলেন ২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের গোচরে নিপীড়নের খবরটি এলে তিনি নাকি এর মূল্যায়ন করেন এই বলে যে ‘এটা মিউচুয়াল সেক্স’। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মেয়েদের ওপরে যৌন নিপীড়নের উচ্চ হার বিবেচনা করে ১৪ মে, ২০০৯ সালে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযোগ সেল গঠন, নিপীড়নের ঘটনা তদন্ত ও বিধিসম্মত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। এবং দেশের আইন অনুযায়ী ধর্ষণের যে সংজ্ঞা তাতে বলা আছে যে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো মেয়ের সম্মতি থাকলেও তার যৌনাঙ্গ স্পর্শ ধর্ষণের শামিল। আমাদের আশঙ্কার কারণ দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অজ্ঞতা নয়। বরং আমরা শঙ্কিত ছিলাম এসব জ্ঞানপাপীর হাতে ছাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি অর্পিত আছে বলে।
অন্যায়ের বিপক্ষে না দাঁড়ানো প্রশাসনকে মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়ে সক্রিয় করতে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মেয়েদের সংঘবদ্ধ রূপ দেখে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। আমরা দেখেছি, ভিকির মেয়েরা আদর্শ-বিবর্জিত ‘রাজনীতি’ না করে ন্যায়সংগত দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, মানববন্ধন করেছে, সমাবেশ করেছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে ভিকিরা শপথও করেছে যে বাংলাদেশে যৌন নিপীড়নবিরোধী যেকোনো আন্দোলনে তারা একসঙ্গে দাঁড়াবে। আমরা ভিকারুননিসার ছাত্রী নই। আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী। ১৯৯৮ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রলীগের এক ক্যাডারের শততম ধর্ষণের উদ্যাপনের খবরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধর্ষণ আর যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আমাদের সেই সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকেই আমরা জানি ও বুঝি, ভিকারুননিসার ছাত্রীদের কেন নিরীহ থেকে যোদ্ধা হতে হয়। প্রশাসন যদি বেঠিক পথে থাকে, আর বলাৎ কারের লজ্জায় মেয়েদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে, তাহলে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনই সঠিক পথ।
ভিকিদের আন্দোলনের খবরে আমাদের মনে পড়ে ১৯৯৮ সালে কীভাবে আমরা সাধারণ ছাত্রীরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। কোনো পত্রিকা মেয়েদের পক্ষে, তো কোনো পত্রিকা ধর্ষকদের পক্ষে। ছেলেদের অনেকেই ‘বোনের সম্ভ্রম’ বাঁচাতে এক পা আগায়, আবার অনেকেই ‘মেয়েদেরও দোষ আছে’ বলে দুই পা পেছায়। প্রশাসন থেকে হুমকি, আন্দোলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা তৈরি করে ভিসির পদ দোদুল্যমান করা বরদাশত করা হবে না, আন্দোলনকারীদের পেটানো হবে পুলিশ দিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হুমকি। আন্দোলনের ছাত্রীছাত্রদের সমর্থন করতে গিয়ে আমাদের শিক্ষক রেহনুমা আহমেদ ধর্ষক মানিক ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের দ্বারা লাঞ্ছিত হন। কুৎ সা রটানো হয় সেই সময়ে গঠিত সত্যতা যাচাই কমিটির অন্যতম সদস্য এবং মেয়েদের প্রধান আশ্রয় নাসিম আখতার হোসাইনের বিরুদ্ধে। এত সবের মধ্যে টানা ৪০ দিনের সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। একমাত্র আন্দোলনের চাপেই প্রশাসন বাধ্য হয়েছে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে।
২০১১-এ এসেও আমরা দেখলাম ভিকারুননিসার ছাত্রীদের আন্দোলনের কারণে জানাজানি হয়ে গেছে যে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে ঘটেছে অনিয়ম, দুর্নীতি, সরকারি দলের পক্ষে মোসাহেবি। পূর্বের কর্মস্থল থেকে যৌন নিপীড়নের দায়ে বহিষ্কৃত শিক্ষক এখানে নিয়োগ পেয়েছেন। ছাত্রীদের মূল দাবি ধর্ষকের শাস্তি ছাপিয়ে প্রশাসনের চেয়ার দখল-বেদখলের উৎ কণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে পত্রপত্রিকায়। কোনো মিডিয়া প্রচার করেছে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারবিরোধী তথা বিএনপি ও জামায়াতের আঁতাতের। আমরা অভিযোগ পেয়েছি আন্দোলন চলাকালীন বিভিন্ন সংস্থা হুমকি দিয়েছিল আন্দোলনকারী ছাত্রীদের। আন্দোলনকারী কোনো কোনো ছাত্রীকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে— এ রকম গুজব শোনা যাচ্ছে, আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে ‘অস্থিরতা সৃষ্টিকারী’ হিসেবে।
ধর্ষক শিক্ষককে গ্রেপ্তার, পুলিশি রিমান্ডে তাঁর দোষ স্বীকার, নিপীড়িতের জবানবন্দি গ্রহণ—এগুলো ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলে নিয়ম অনুযায়ী হওয়ার কথা, ছাত্রীদের রাস্তায় নেমে, শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখন অভিযুক্ত শিক্ষক তাঁর স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করতে চাইছেন, আবেদন করছেন জামিনের। এদিকে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির ছবি এবং ধারণকৃত ভিডিওটি পুলিশ এখনো পর্যন্ত উদ্ধার করেনি, নিপীড়নের শিকার মেয়েটির পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মেয়েটি একাধিকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনায় আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আমাদের ভয়, শান্তির ফাঁকে যদি ধর্ষকের শাস্তির বিষয়টি দীর্ঘায়িত হয় বা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়! এমন শান্তি তো আমাদের কাম্য নয়, যেটাতে আমাদের ছোট বোনেরা বা কন্যারা ধর্ষণের ভয়ে ভীত থাকে। আমরা সাহসী উত্তরসূরিই চাই, যারা আমাদের ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মতো ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমরা চাই না, মেয়েরা যৌন নিপীড়নের লজ্জায় আত্মহত্যার পথে হাঁটুক।
নাসরিন সিরাজ, নৃবিজ্ঞানী ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।
নাজনীন শিফা: মানবাধিকার কর্মী ।
অন্যায়ের বিপক্ষে না দাঁড়ানো প্রশাসনকে মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়ে সক্রিয় করতে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মেয়েদের সংঘবদ্ধ রূপ দেখে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। আমরা দেখেছি, ভিকির মেয়েরা আদর্শ-বিবর্জিত ‘রাজনীতি’ না করে ন্যায়সংগত দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমেছে, মানববন্ধন করেছে, সমাবেশ করেছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে ভিকিরা শপথও করেছে যে বাংলাদেশে যৌন নিপীড়নবিরোধী যেকোনো আন্দোলনে তারা একসঙ্গে দাঁড়াবে। আমরা ভিকারুননিসার ছাত্রী নই। আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী। ১৯৯৮ সালে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রলীগের এক ক্যাডারের শততম ধর্ষণের উদ্যাপনের খবরের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ধর্ষণ আর যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। আমাদের সেই সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকেই আমরা জানি ও বুঝি, ভিকারুননিসার ছাত্রীদের কেন নিরীহ থেকে যোদ্ধা হতে হয়। প্রশাসন যদি বেঠিক পথে থাকে, আর বলাৎ কারের লজ্জায় মেয়েদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে, তাহলে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনই সঠিক পথ।
ভিকিদের আন্দোলনের খবরে আমাদের মনে পড়ে ১৯৯৮ সালে কীভাবে আমরা সাধারণ ছাত্রীরা মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। কোনো পত্রিকা মেয়েদের পক্ষে, তো কোনো পত্রিকা ধর্ষকদের পক্ষে। ছেলেদের অনেকেই ‘বোনের সম্ভ্রম’ বাঁচাতে এক পা আগায়, আবার অনেকেই ‘মেয়েদেরও দোষ আছে’ বলে দুই পা পেছায়। প্রশাসন থেকে হুমকি, আন্দোলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা তৈরি করে ভিসির পদ দোদুল্যমান করা বরদাশত করা হবে না, আন্দোলনকারীদের পেটানো হবে পুলিশ দিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হুমকি। আন্দোলনের ছাত্রীছাত্রদের সমর্থন করতে গিয়ে আমাদের শিক্ষক রেহনুমা আহমেদ ধর্ষক মানিক ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের দ্বারা লাঞ্ছিত হন। কুৎ সা রটানো হয় সেই সময়ে গঠিত সত্যতা যাচাই কমিটির অন্যতম সদস্য এবং মেয়েদের প্রধান আশ্রয় নাসিম আখতার হোসাইনের বিরুদ্ধে। এত সবের মধ্যে টানা ৪০ দিনের সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়নি। একমাত্র আন্দোলনের চাপেই প্রশাসন বাধ্য হয়েছে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করতে।
২০১১-এ এসেও আমরা দেখলাম ভিকারুননিসার ছাত্রীদের আন্দোলনের কারণে জানাজানি হয়ে গেছে যে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে ঘটেছে অনিয়ম, দুর্নীতি, সরকারি দলের পক্ষে মোসাহেবি। পূর্বের কর্মস্থল থেকে যৌন নিপীড়নের দায়ে বহিষ্কৃত শিক্ষক এখানে নিয়োগ পেয়েছেন। ছাত্রীদের মূল দাবি ধর্ষকের শাস্তি ছাপিয়ে প্রশাসনের চেয়ার দখল-বেদখলের উৎ কণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে পত্রপত্রিকায়। কোনো মিডিয়া প্রচার করেছে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারবিরোধী তথা বিএনপি ও জামায়াতের আঁতাতের। আমরা অভিযোগ পেয়েছি আন্দোলন চলাকালীন বিভিন্ন সংস্থা হুমকি দিয়েছিল আন্দোলনকারী ছাত্রীদের। আন্দোলনকারী কোনো কোনো ছাত্রীকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে— এ রকম গুজব শোনা যাচ্ছে, আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে ‘অস্থিরতা সৃষ্টিকারী’ হিসেবে।
ধর্ষক শিক্ষককে গ্রেপ্তার, পুলিশি রিমান্ডে তাঁর দোষ স্বীকার, নিপীড়িতের জবানবন্দি গ্রহণ—এগুলো ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলে নিয়ম অনুযায়ী হওয়ার কথা, ছাত্রীদের রাস্তায় নেমে, শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনের কথা নয়। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখন অভিযুক্ত শিক্ষক তাঁর স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করতে চাইছেন, আবেদন করছেন জামিনের। এদিকে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির ছবি এবং ধারণকৃত ভিডিওটি পুলিশ এখনো পর্যন্ত উদ্ধার করেনি, নিপীড়নের শিকার মেয়েটির পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মেয়েটি একাধিকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনায় আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আমাদের ভয়, শান্তির ফাঁকে যদি ধর্ষকের শাস্তির বিষয়টি দীর্ঘায়িত হয় বা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়! এমন শান্তি তো আমাদের কাম্য নয়, যেটাতে আমাদের ছোট বোনেরা বা কন্যারা ধর্ষণের ভয়ে ভীত থাকে। আমরা সাহসী উত্তরসূরিই চাই, যারা আমাদের ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মতো ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আমরা চাই না, মেয়েরা যৌন নিপীড়নের লজ্জায় আত্মহত্যার পথে হাঁটুক।
নাসরিন সিরাজ, নৃবিজ্ঞানী ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা।
নাজনীন শিফা: মানবাধিকার কর্মী ।
No comments