সন্তানসহ মায়ের আত্মহত্যা-সালিশের নামে এসব কী হচ্ছে?
রংপুরের বদরগঞ্জে গ্রাম সালিশে শাস্তি দিয়ে এক নারীকে নির্যাতনের ঘটনা পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ৩১ জুলাই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এ ধরনের সালিশ ব্যবসা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। গ্রাম্য সালিশ বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে পুলিশের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ নির্দেশনার ১৫ দিনের মাথায় হবিগঞ্জে গ্রাম্য সালিশের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করলেন এক গৃহবধূ। স্বার্থান্বেষী গ্রাম্য মাতবরদের সালিশ ও একঘরে করে দেওয়ার ঘোষণার পর ওই গৃহবধূ তার চার সন্তানকে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে লাফিয়ে পড়েন। দু'সন্তান আহত অবস্থায় বেঁচে গেলেও বাকি দু'সন্তানসহ মা মারা গেছেন। হাইকোর্টের কঠোর নির্দেশনার পর এমন ঘটনা ঘটায় অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তৎপরতা কি সন্তোষজনক? গ্রাম্য মাতবর, নির্যাতক ও স্বার্থান্বেষীদের রোখার কোনো উপায় কি নেই? মঙ্গলবারের পত্রিকায় হবিগঞ্জের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর হাইকোর্ট মাধবপুর থানার ওসিসহ ৯ জনকে তলব করেছেন। ২৩ আগস্ট তলবকৃতদের হাইকোর্টে হাজির হতে হবে। হাইকোর্টের এ ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরই সংবাদমাধ্যম বা কোর্টের পক্ষে কোনো ভূমিকা গ্রহণ করার সুযোগ থাকে। তাতে হয়তো অপরাধীরা শনাক্ত ও শাস্তি পেতে পারে কিন্তু মূল্যবান প্রাণের অপচয় রোধ হয় না। গ্রামে গ্রামে মাতবর নামধারী স্বার্থান্বেষী মানুষগুলো অসহায় পরিবার পেলেই তাদের ওপর নানা উপায়ে হামলা করে। বিশেষত কোনো পরিবারের কর্তা যদি প্রবাসী হয়, তবে সে পরিবারের বধূকে এমন তুচ্ছ কারণেও টার্গেট করা হয়। হবিগঞ্জের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, প্রবাসীর বাড়িতে একান্ত নিকটাত্মীয়ের প্রবেশকেও ভালো চোখে দেখতে পারছে না এই অপরাধীর দল। তারা পরিবারটিকে শায়েস্তা করার জন্য সালিশের পথ বেছে নিচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, সালিশের মাধ্যমে পরিবারটিকে একঘরে করে দিচ্ছে। এমন অপমান মেনে নেওয়া যে কারও জন্য কঠিন। এমন শাস্তি যে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো তা বলাই বাহুল্য। যারা ওই গ্রাম্য সালিশের সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা তাই আশু কর্তব্য। পাশাপাশি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে তৎপর হতে হবে। এ ধরনের সালিশের সঙ্গে স্থানীয় নেতা, রাজনৈতিক কর্মীদের অংশগ্রহণ থাকে। পাশাপাশি এ ঘটনাগুলোর পেছনে বিশেষ প্রস্তুতিও থাকে। ফলে এমন ঘটনা ঘটার আগেই পুলিশ এ সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু জেনেশুনে নিষ্ক্রিয় বসে থাকলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে হবে আমাদের। ভবিষ্যতে এমন ঘটবে না বলেই আমরা আশা করি। সালিশ বন্ধে সরকারকে হাইকোর্টের নির্দেশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। যে এলাকায় সালিশ হবে সেখানকার পুলিশ যদি শাস্তি পায় তবে পুলিশি তৎপরতা নিশ্চিত হতে পারে। এসব তৎপরতার পাশাপাশি, সামাজিক আন্দোলনকেও বেগবান করা উচিত। স্থানীয় তরুণ ও শিক্ষিত মানুষরা পারে সহজেই স্বার্থান্বেষী মহলের তৎপরতা রুখতে। প্রত্যেক অঞ্চলে সমাজের এ অংশগুলোকে সংগঠিত করতে সামাজিক ও নাগরিক সংস্থাগুলো তৎপর হবে। সকলের চেষ্টায় সালিশ ও সালিশের ফলে অপমানিত ও নির্যাতিত মানুষের মৃত্যু বন্ধ হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
No comments