মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল : যেতে হবে বহু দূর by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
১২ মে দেশের আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, একটি কারিগরি এবং একটি মাদ্রাসা মিলিয়ে মোট ১০টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন অনুষ্ঠিত এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। ফল পেয়ে পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা বেশ খুশি। এ বছর ১০টি শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার ৮২.৩১ শতাংশ।
বরাবরের মতো সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যেই পাসের হারে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সর্বনিম্নে এবারের পাসের হার দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে ৭৭.৪৮ শতাংশ। সর্বোচ্চ পাসের হার কুমিল্লা বোর্ডে ৮৫.৮৫ শতাংশ। ঢাকা বোর্ডে তিন লাখ ৫৭১ জন পরীক্ষার্থী ছিল, অথচ সিলেট বোর্ডে ছিল ৪৮ হাজার ৪৭৮ জন পরীক্ষার্থী। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে এবার পরীক্ষা দিয়েছে ৮২ হাজার ৯৮১ জন, এখানে পাসের হার ৮১.৩৭ শতাংশ। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে পরীক্ষা দিয়েছে দুই লাখ ৩৭ হাজার ৫২৪ জন, তাদের পাসের হার ৮৩.২৩ শতাংশ। এ বছর জিপিএ ৫ পেয়েছে সর্বমোট ৭৬ হাজার ৭৪৯ জন। সৃজনশীল প্রশ্নের কারণে এবার এমন ভালো ফল করেছে বলে পত্রপত্রিকাগুলো উল্লেখ করেছে। মাদ্রাসাগুলো এ প্রক্রিয়ায় সবেমাত্র যুক্ত হয়েছে, সে কারণে তারা কিছুটা পিছিয়ে আছে বলে কোনো কোনো পত্রিকা উল্লেখ করেছে। পত্রিকাগুলোতে ফলাফল নিয়ে বেশ কিছু বিশ্লেষণ ছাপা হয়েছে। তবে প্রতিবারের মতো এবারও দুটি পরস্পরবিরোধী মত লক্ষ করা যাচ্ছে। একটি মত হচ্ছে, পাসের হার বাড়লেও মান বাড়েনি। অন্য মতটি হচ্ছে, পাসের হার এবং মান উভয়ই বাড়ছে, আরো বাড়বে। তবে শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার ৮২.৩১ শতাংশকে কেউ কেউ যথার্থ মনে করছেন না, আবার আরেকটি অংশ মনে করছেন যে পাসের হার শতভাগে উন্নীত হতে আপত্তি থাকা উচিত নয়। কেননা ছাত্রছাত্রীরা ১০ বছর পড়াশোনা করে অকৃতকার্য হবে, কোনো সনদ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে না, তা মেনে নেওয়া যায় না। বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর নানা ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এভাবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। একসময় ফল বিপর্যয় নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হতো। এখন ঘটছে উল্টো। কেউ কেউ পাসের হারের এমন উন্নতি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছেন, উদারভাবে নম্বর দেওয়ারও কথা বলছেন। পক্ষে-বিপক্ষের এমন বিতর্কের অবসান খুব সহজে হওয়ার নয়, তবে যুক্তি এবং বাস্তবতার ভিত্তি উভয় পক্ষেই রয়েছে। মূল সমস্যার সমাধান রাতারাতি হবে না, সময়ের প্রয়োজন রয়েছে, তবে ভেতরে-বাইরে পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হচ্ছে_এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। নানা সমস্যা, বৈষম্য, অসমতা ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়েই আমাদের শিক্ষা বোর্ডগুলোর পাবলিক পরীক্ষা দেশে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এটিকে আরো কিভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায়, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা লাভে যে ব্যাপক বৈষম্য বিরাজ করছে, তা কিভাবে দূর করা যায়_সে চেষ্টাই করা হচ্ছে, আরো করতে হবে।
দেশের মোট শিক্ষার্থীর তিন ভাগের এক ভাগ এখন মাদ্রাসায় ভর্তি হচ্ছে। খুব সামান্যসংখ্যক মাদ্রাসায় লেখাপড়ার মান ধরে রাখা সম্ভব হলেও বেশির ভাগেই দক্ষ শিক্ষকের ব্যাপক অভাব রয়েছে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের বেশির ভাগই সাধারণ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সমপর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সমাজ জ্ঞানে সক্ষম হয়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে না। যতই এগুলোতে আমরা পাসের হার প্রায় সমান সমান বা অনেক ক্ষেত্রে বেশি দেখি না কেন, বাস্তবে প্রতিযোগিতার আসল জায়গায় এদের উত্তীর্ণ হওয়ার হার তত বেশি নয়। এখানেও মূল সমস্যা হচ্ছে, মানসম্মত পঠনপাঠনের দীর্ঘদিনের বিরাজমান সমস্যা থেকে এত বিপুলসংখ্যক মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বের হয়ে আসতে পারছে না। যদিও চেষ্টা করা হচ্ছে দেশের মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূল ধারার সঙ্গে মানের সমতা এবং সক্ষমতায় তুলে আনার, সে ক্ষেত্রে সাফল্য আসতে আরো অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। একইভাবে গ্রামাঞ্চলের স্কুলশিক্ষার প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার তাগিদ অনুভূত হচ্ছে।
দেশে শিক্ষা বোর্ডের সংখ্যা যা-ই থাক না কেন, অচিরেই প্রতিবছর অভিন্ন প্রশ্নপত্রে দেশব্যাপী পরীক্ষা অনুষ্ঠানের বিধান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে পাসের হারের বৈষম্য সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। ফলে এর অবসান হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
আমরা অবশ্যই সেদিন খুশি হব, যেদিন আমাদের শতভাগ ছাত্রছাত্রীকে পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দেখব। একই সঙ্গে তাদের প্রাপ্ত সনদে যেন প্রতিফলিত হয় শিক্ষার মান জ্ঞানের অন্বেষণ, দক্ষতার ছোঁয়া, শিখন ফল ইত্যাদি। এ জন্য শুধু পাবলিক পরীক্ষার মানদণ্ডের ওপর গুরুত্ব দিলেই চলবে না, মূল চেষ্টাটা থাকতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠনের দক্ষতা ও মানের ওপর, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর। সে জন্য দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক শৃঙ্খলা ও নিয়ম-নীতি, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, পাঠদান, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সামগ্রিক মান বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, সে ধরনের প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও পরিবেশ গড়ে তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। আসলে একুশ শতকে উন্নত দুনিয়ায় পাবলিক পরীক্ষার কোনো ধারণা নেই। সেসব দেশে বিদ্যালয় শিক্ষকরাই ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করে থাকেন। সেটি তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে প্রায় অভিন্ন মানের প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক নিশ্চিত করার কারণে। একটি গ্রহণযোগ্য নৈতিক মান শিক্ষক এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ধরে রাখতে পারার কারণে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার মান নিয়ে পরবর্র্তী স্তরে তেমন কোনো প্রশ্ন ওঠে না। হোক না সেটি শহর বা গ্রামের কোনো বিদ্যালয়। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এটির মান নিয়ে সচরাচর কোনো প্রশ্ন ওঠে না, তেমন ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ থাকে না। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈতিক এমন অবস্থান অর্জিত হতে পারে কেবল মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমেই। নৈতিক সেই মান আমাদের কাছে এখনো স্বপ্নের দূরের বিষয় হয়ে আছে। আসলে লেখাপড়ার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মানবজীবনের মহৎ গুণাবলির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটানো, সেগুলোর অর্জন, মেধা, মনন ও নৈতিকতার বিকাশ ঘটিয়ে প্রকৃত স্বাবলম্বী মানুষ হিসেবে সবাইকে গড়ে তোলা। কিন্তু এগুলো এখনো আমাদের জীবনে কেবলই উচ্চারিত শব্দ বা বাণী হিসেবেই শুনতে হচ্ছে। আমরা ভরসা পাচ্ছি না, আস্থা রাখতে পারছি না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপর। সে কারণেই পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে নিরন্তর লড়াই করে যেতে হচ্ছে আমাদের। এগুলোর ওপর এতটাই আমাদের নির্ভরতা বেড়েছে যে স্বাধীন, মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষক, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মানুষের ধারণাই আমাদের চিন্তার জগৎ থেকে হারিয়ে গেছে। এটি ব্যক্তি ও ছোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বয়ম্ভরতা। সম্ভাবনাকে সমূলেই নষ্ট করে দেয়। সে কারণেই উন্নত দুনিয়া পাবলিক পরীক্ষা বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বয়ম্ভরতার সংস্কৃতিতে চলে এসেছে, সে ক্ষেত্রে তারা সফল হচ্ছে, আমরা সাহস করতে পারছি না। অধিকন্তু আমাদের প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত 'ছোটদের পাবলিক পরীক্ষায়' নামতে হয়েছে। হয়তো কিছুকাল এটি চলতে পারে। কিন্তু অনন্তকাল নয়। কেননা শিক্ষার আসল অর্জন তো দুনিয়াজুড়েই আমরা দেখছি। আমরা সেসব দেশ থেকে অর্থ, প্রশিক্ষক, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি ইত্যাদির অনেক কিছুই ধারদেনা করে আনছি; কিন্তু আসল অথচ নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করছি না। আজ হোক, কাল হোক_আমাদেরও শিক্ষার অভিন্ন সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে। সেই পথ বেশ দূরে হলেও সেখানেই যেতে হবে, অর্জন করতে হবে।
লেখক : ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের মোট শিক্ষার্থীর তিন ভাগের এক ভাগ এখন মাদ্রাসায় ভর্তি হচ্ছে। খুব সামান্যসংখ্যক মাদ্রাসায় লেখাপড়ার মান ধরে রাখা সম্ভব হলেও বেশির ভাগেই দক্ষ শিক্ষকের ব্যাপক অভাব রয়েছে। ফলে ছাত্রছাত্রীদের বেশির ভাগই সাধারণ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সমপর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সমাজ জ্ঞানে সক্ষম হয়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে না। যতই এগুলোতে আমরা পাসের হার প্রায় সমান সমান বা অনেক ক্ষেত্রে বেশি দেখি না কেন, বাস্তবে প্রতিযোগিতার আসল জায়গায় এদের উত্তীর্ণ হওয়ার হার তত বেশি নয়। এখানেও মূল সমস্যা হচ্ছে, মানসম্মত পঠনপাঠনের দীর্ঘদিনের বিরাজমান সমস্যা থেকে এত বিপুলসংখ্যক মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বের হয়ে আসতে পারছে না। যদিও চেষ্টা করা হচ্ছে দেশের মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূল ধারার সঙ্গে মানের সমতা এবং সক্ষমতায় তুলে আনার, সে ক্ষেত্রে সাফল্য আসতে আরো অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে। একইভাবে গ্রামাঞ্চলের স্কুলশিক্ষার প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার তাগিদ অনুভূত হচ্ছে।
দেশে শিক্ষা বোর্ডের সংখ্যা যা-ই থাক না কেন, অচিরেই প্রতিবছর অভিন্ন প্রশ্নপত্রে দেশব্যাপী পরীক্ষা অনুষ্ঠানের বিধান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে পাসের হারের বৈষম্য সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। ফলে এর অবসান হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
আমরা অবশ্যই সেদিন খুশি হব, যেদিন আমাদের শতভাগ ছাত্রছাত্রীকে পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দেখব। একই সঙ্গে তাদের প্রাপ্ত সনদে যেন প্রতিফলিত হয় শিক্ষার মান জ্ঞানের অন্বেষণ, দক্ষতার ছোঁয়া, শিখন ফল ইত্যাদি। এ জন্য শুধু পাবলিক পরীক্ষার মানদণ্ডের ওপর গুরুত্ব দিলেই চলবে না, মূল চেষ্টাটা থাকতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পঠনপাঠনের দক্ষতা ও মানের ওপর, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর। সে জন্য দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক শৃঙ্খলা ও নিয়ম-নীতি, অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, পাঠদান, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সামগ্রিক মান বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, সে ধরনের প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও পরিবেশ গড়ে তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়। আসলে একুশ শতকে উন্নত দুনিয়ায় পাবলিক পরীক্ষার কোনো ধারণা নেই। সেসব দেশে বিদ্যালয় শিক্ষকরাই ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করে থাকেন। সেটি তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে প্রায় অভিন্ন মানের প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষক নিশ্চিত করার কারণে। একটি গ্রহণযোগ্য নৈতিক মান শিক্ষক এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ধরে রাখতে পারার কারণে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার মান নিয়ে পরবর্র্তী স্তরে তেমন কোনো প্রশ্ন ওঠে না। হোক না সেটি শহর বা গ্রামের কোনো বিদ্যালয়। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এটির মান নিয়ে সচরাচর কোনো প্রশ্ন ওঠে না, তেমন ব্যত্যয় ঘটার সুযোগ থাকে না। শিক্ষাক্ষেত্রে নৈতিক এমন অবস্থান অর্জিত হতে পারে কেবল মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমেই। নৈতিক সেই মান আমাদের কাছে এখনো স্বপ্নের দূরের বিষয় হয়ে আছে। আসলে লেখাপড়ার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর মধ্যে মানবজীবনের মহৎ গুণাবলির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটানো, সেগুলোর অর্জন, মেধা, মনন ও নৈতিকতার বিকাশ ঘটিয়ে প্রকৃত স্বাবলম্বী মানুষ হিসেবে সবাইকে গড়ে তোলা। কিন্তু এগুলো এখনো আমাদের জীবনে কেবলই উচ্চারিত শব্দ বা বাণী হিসেবেই শুনতে হচ্ছে। আমরা ভরসা পাচ্ছি না, আস্থা রাখতে পারছি না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপর। সে কারণেই পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে নিরন্তর লড়াই করে যেতে হচ্ছে আমাদের। এগুলোর ওপর এতটাই আমাদের নির্ভরতা বেড়েছে যে স্বাধীন, মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষক, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মানুষের ধারণাই আমাদের চিন্তার জগৎ থেকে হারিয়ে গেছে। এটি ব্যক্তি ও ছোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বয়ম্ভরতা। সম্ভাবনাকে সমূলেই নষ্ট করে দেয়। সে কারণেই উন্নত দুনিয়া পাবলিক পরীক্ষা বাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বয়ম্ভরতার সংস্কৃতিতে চলে এসেছে, সে ক্ষেত্রে তারা সফল হচ্ছে, আমরা সাহস করতে পারছি না। অধিকন্তু আমাদের প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত 'ছোটদের পাবলিক পরীক্ষায়' নামতে হয়েছে। হয়তো কিছুকাল এটি চলতে পারে। কিন্তু অনন্তকাল নয়। কেননা শিক্ষার আসল অর্জন তো দুনিয়াজুড়েই আমরা দেখছি। আমরা সেসব দেশ থেকে অর্থ, প্রশিক্ষক, সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি ইত্যাদির অনেক কিছুই ধারদেনা করে আনছি; কিন্তু আসল অথচ নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজগুলো করছি না। আজ হোক, কাল হোক_আমাদেরও শিক্ষার অভিন্ন সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে। সেই পথ বেশ দূরে হলেও সেখানেই যেতে হবে, অর্জন করতে হবে।
লেখক : ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক,
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
No comments