চারদিক-‘আমি জানি সে আকাশ ছোঁবে’ by নিমাই সরকার
একজন মা কী ভাবেন তাঁর সন্তানকে নিয়ে? কিংবা একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রের কাছ থেকে কী আশা করেন? প্রশ্নটা নিতান্তই সহজ। উত্তরও কঠিন হওয়ার কথা নয়। তবে এ জন্য তত্ত্বগত কোনো ধারণার ওপর নির্ভর না করে সরাসরি যাঁর প্রশ্ন, তাঁর কাছেই যাওয়া শ্রেয়তর।
দশ মাস দশ দিন পেটে ধারণ করার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করতে হয় মাকে। এরপর সন্তানকে লালন করতে গিয়ে মা অর্জন করেন আরও অনেক অভিজ্ঞতা। একইভাবে একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে-পিটে মানুষ করার যে প্রক্রিয়া, তা সম্পন্ন করেন একজন শিক্ষক। সে কারণে সন্তানকে ঘিরে শিক্ষার্থীকে নিয়ে মা কিংবা একজন শিক্ষকের স্বপ্নের আকাশ কতটুকু হবে, তা শোনার জন্য তাঁদের কাছেই যেতে হয়।
সম্প্রতি গিয়েছিলাম আবুধাবির মেরিল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। এখন আবুধাবিতে সার সার রব। স্কুল ছুটি হচ্ছে। শিক্ষক, ছাত্র—সবাই দেশে যাচ্ছেন। এমন একটি পরিবেশে পড়লে বোঝা যায় প্রবাসে যাঁরা থাকেন, দেশের জন্য তাঁদের অনুভূতি কতটা প্রবল। একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রের অভিভাবককে দেখিয়ে দিচ্ছেন রিপোর্ট কার্ডে তাঁর বিগত দিনকার অর্জন। সামনে তাঁকে কতটুকু উৎকর্ষ সাধন করতে হবে, সে ব্যাপারে থাকছে পরামর্শ। এর মধ্যে যে এই স্কুল উৎরে উঁচু কোনো শিক্ষাঙ্গনে যাচ্ছে, তার জন্য থাকছে একেবারেই আলাদা কোনো দিকনির্দেশনা কিংবা শিক্ষার্থীর কাছে তিনি কী আশা করছেন, তা-ও ব্যক্ত হচ্ছে স্নেহের চুম্বনের সঙ্গে। এখানে উচ্চকিত ছিলেন ওই শিক্ষক। মনে করা যায়, তাঁর সামনে তখন শিক্ষার্থীর সিঁড়ি বেয়ে ওই—ওই ওপরে ওঠার চিত্র।
প্রশ্ন হচ্ছে, সব শিশুই কি উঠতে পারবে হিমালয়ের চূড়ায়? কিংবা ছুঁতে পারবে আকাশে ওড়া পাখিটাকে! পারবে—অবশ্যই পারবে। ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সুশীলা জর্জের বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন অভিভাবকদের উদ্দেশে—আপনার এ সন্তান যে কত বড় হবে কিংবা কত দূর ওপরে উঠবে, সেটা আপনি জানেন না। তিনি বলেন, ‘আমি জানি, সে আকাশ ছোঁবে।’ কথাটি স্বপ্নবানদের কেউই অবিশ্বাস করবে না।
দেশপ্রেমের একটি বিষয় এসেছে। সবার কি দেশের জন্য টান থাকবে? থাকবে, সে লক্ষণ তো আজকেই দেখা যাচ্ছে। যেন এই দিনটার প্রতীক্ষায় ছিলেন সবাই। বছর শেষ হবে। জন্মভূমি থেকে ঘুরে আসার এই তো সময়। অনেক দিন আগে কবি মোহাম্মদ রফিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যারা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হচ্ছে, তাদের ওপর তিনি ভরসা পান না। কারণ, তারা কদিন পর দেশ ছেড়ে চলে যাবে। দেশের প্রতি মায়া-মমতা কম তাদের। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই দেশকে গড়বে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল দেশের সাধারণ ছেলেরা। আন্দোলন-সংগ্রাম—সব জায়গাতেই তারা। ফ্রান্সকে তো তার নিষ্কর্মা সন্তানেরাই রক্ষা করেছিল। এই সত্যটি আরও জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন আবুধাবিতে বাংলাদেশ স্কুল ও কলেজের অধ্যাপক আবু তাহের। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
আবার মা—মায়ের প্রসঙ্গ। মেদিনীপুরের এক মা আর তাঁর দেশের কথা বলা যায়। মা দেখতেন বিশাল স্বপ্ন তাঁর সন্তানকে ঘিরে। দেশ-মাটি-মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকবে তাঁর ছেলের। সেখানকার গ্রামেই একবার লোকজ মেলা বসেছিল। মা-ছেলে দুজনে গিয়েছিলেন সেখানে।
মা ছিলেন সাদামাটা বেশভূষায়। ছেলে তাঁকে অলংকার নিতে অনুরোধ জানায়। তখন ছেলে একটি চাকরিতে ঢুকেছে। মা বললেন, তিনটি অলংকার চাই; তবে তা এখন নয়। চাকরিতে উন্নতি হয় ছেলের। মাকে আবার অলংকার নেওয়ার কথা বলা হয়। এবারও সময় নিলেন। ছেলে অনেক বড় পদমর্যাদার একটি চাকরিতে। মা এবার ছেলের প্রস্তাবে সাড়া দিলেন। অজ সেই পাড়াগাঁয়ে চাইলেন একটি স্কুল, একটি চিকিৎসালয়। তৃতীয় অলংকার একেবারেই অন্য রকমের। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং তাঁর মা ভগবতী দেবীর কথাই বলা হচ্ছে। যেমন মা, তেমন না তাঁর ছেলে!
মা বললেন, ‘তুমি পাহাড়সমান সুনাম কুড়াবে। অনেক বড় হবে। কেউ যদি তখন জিজ্ঞেস করে, তোমার মা কে! তখন আমার নামটি বলবে। সন্তানের কাছে এটা তোমার মায়ের চাওয়া।’ মা আরও বললেন, শিক্ষা থেকে তোমার যে অর্জন, তাতে গ্রামের গরিবদের যেন ভাগ থাকে। অর্থ আর সম্পদের পেছনে ছুটবে না। সন্তানের কাছে মায়ের চাওয়া একেবারেই আলাদা ধরনের। সোনাদানা, টাকাপয়সা, হীরা-জহরত, মণিমুক্তা—কোনোটাই তেমন তৃপ্তি আনতে পারে না মায়ের মনে, যেমনটি পারে সন্তান মানুষ হলে। মানুষের মতো মানুষ হলে।
আবুধাবিতে বাঙালি এক ছাত্রী—নাম দূর্বা। তাকে আদর করার সময় সেদিন দক্ষিণ ভারতীয় শিক্ষিকা মিস আনসু তেমন আশাবাদই ব্যক্ত করলেন। তিনি সমাবর্তনী অনুষ্ঠানে দেওয়া সনদের আদলে ডিপ্লোমা কার্ড দিলেন তার হাতে। ক্যামেরার সামনে জ্বলে উঠল দুই প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি। এটা ছিল ছাত্রীর কেজি-টু শেষের বিদায়ী দিন। এবার সে যাবে বৃহৎ ভবন শেরউড একাডেমিতে। শিক্ষিকা বললেন, ‘বড় হওয়ার পর অনেকেই জানতে চাইবে, ছোটবেলায় তোমার শিক্ষক কে ছিলেন! তুমি তখন আমার নামটিই বলবে।’
মা এবং শিক্ষক—দুজনের চাওয়ার মধ্যে অদ্ভুত এক মিল। দুজনেই তৃপ্ত শিক্ষার্থীর সাফল্যে। বিদ্যাসাগরের মা বলেছিলেন, তাঁর সন্তান স্বপ্নকে ছুঁতে পারলে তাঁর আর চাওয়ার কিছু থাকবে না জীবনে। মিস আনসুর কণ্ঠেও এই কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল।
নিমাই সরকার
সম্প্রতি গিয়েছিলাম আবুধাবির মেরিল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। এখন আবুধাবিতে সার সার রব। স্কুল ছুটি হচ্ছে। শিক্ষক, ছাত্র—সবাই দেশে যাচ্ছেন। এমন একটি পরিবেশে পড়লে বোঝা যায় প্রবাসে যাঁরা থাকেন, দেশের জন্য তাঁদের অনুভূতি কতটা প্রবল। একজন শিক্ষক তাঁর ছাত্রের অভিভাবককে দেখিয়ে দিচ্ছেন রিপোর্ট কার্ডে তাঁর বিগত দিনকার অর্জন। সামনে তাঁকে কতটুকু উৎকর্ষ সাধন করতে হবে, সে ব্যাপারে থাকছে পরামর্শ। এর মধ্যে যে এই স্কুল উৎরে উঁচু কোনো শিক্ষাঙ্গনে যাচ্ছে, তার জন্য থাকছে একেবারেই আলাদা কোনো দিকনির্দেশনা কিংবা শিক্ষার্থীর কাছে তিনি কী আশা করছেন, তা-ও ব্যক্ত হচ্ছে স্নেহের চুম্বনের সঙ্গে। এখানে উচ্চকিত ছিলেন ওই শিক্ষক। মনে করা যায়, তাঁর সামনে তখন শিক্ষার্থীর সিঁড়ি বেয়ে ওই—ওই ওপরে ওঠার চিত্র।
প্রশ্ন হচ্ছে, সব শিশুই কি উঠতে পারবে হিমালয়ের চূড়ায়? কিংবা ছুঁতে পারবে আকাশে ওড়া পাখিটাকে! পারবে—অবশ্যই পারবে। ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সুশীলা জর্জের বক্তব্য শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন অভিভাবকদের উদ্দেশে—আপনার এ সন্তান যে কত বড় হবে কিংবা কত দূর ওপরে উঠবে, সেটা আপনি জানেন না। তিনি বলেন, ‘আমি জানি, সে আকাশ ছোঁবে।’ কথাটি স্বপ্নবানদের কেউই অবিশ্বাস করবে না।
দেশপ্রেমের একটি বিষয় এসেছে। সবার কি দেশের জন্য টান থাকবে? থাকবে, সে লক্ষণ তো আজকেই দেখা যাচ্ছে। যেন এই দিনটার প্রতীক্ষায় ছিলেন সবাই। বছর শেষ হবে। জন্মভূমি থেকে ঘুরে আসার এই তো সময়। অনেক দিন আগে কবি মোহাম্মদ রফিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যারা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হচ্ছে, তাদের ওপর তিনি ভরসা পান না। কারণ, তারা কদিন পর দেশ ছেড়ে চলে যাবে। দেশের প্রতি মায়া-মমতা কম তাদের। সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাই দেশকে গড়বে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল দেশের সাধারণ ছেলেরা। আন্দোলন-সংগ্রাম—সব জায়গাতেই তারা। ফ্রান্সকে তো তার নিষ্কর্মা সন্তানেরাই রক্ষা করেছিল। এই সত্যটি আরও জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন আবুধাবিতে বাংলাদেশ স্কুল ও কলেজের অধ্যাপক আবু তাহের। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
আবার মা—মায়ের প্রসঙ্গ। মেদিনীপুরের এক মা আর তাঁর দেশের কথা বলা যায়। মা দেখতেন বিশাল স্বপ্ন তাঁর সন্তানকে ঘিরে। দেশ-মাটি-মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকবে তাঁর ছেলের। সেখানকার গ্রামেই একবার লোকজ মেলা বসেছিল। মা-ছেলে দুজনে গিয়েছিলেন সেখানে।
মা ছিলেন সাদামাটা বেশভূষায়। ছেলে তাঁকে অলংকার নিতে অনুরোধ জানায়। তখন ছেলে একটি চাকরিতে ঢুকেছে। মা বললেন, তিনটি অলংকার চাই; তবে তা এখন নয়। চাকরিতে উন্নতি হয় ছেলের। মাকে আবার অলংকার নেওয়ার কথা বলা হয়। এবারও সময় নিলেন। ছেলে অনেক বড় পদমর্যাদার একটি চাকরিতে। মা এবার ছেলের প্রস্তাবে সাড়া দিলেন। অজ সেই পাড়াগাঁয়ে চাইলেন একটি স্কুল, একটি চিকিৎসালয়। তৃতীয় অলংকার একেবারেই অন্য রকমের। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং তাঁর মা ভগবতী দেবীর কথাই বলা হচ্ছে। যেমন মা, তেমন না তাঁর ছেলে!
মা বললেন, ‘তুমি পাহাড়সমান সুনাম কুড়াবে। অনেক বড় হবে। কেউ যদি তখন জিজ্ঞেস করে, তোমার মা কে! তখন আমার নামটি বলবে। সন্তানের কাছে এটা তোমার মায়ের চাওয়া।’ মা আরও বললেন, শিক্ষা থেকে তোমার যে অর্জন, তাতে গ্রামের গরিবদের যেন ভাগ থাকে। অর্থ আর সম্পদের পেছনে ছুটবে না। সন্তানের কাছে মায়ের চাওয়া একেবারেই আলাদা ধরনের। সোনাদানা, টাকাপয়সা, হীরা-জহরত, মণিমুক্তা—কোনোটাই তেমন তৃপ্তি আনতে পারে না মায়ের মনে, যেমনটি পারে সন্তান মানুষ হলে। মানুষের মতো মানুষ হলে।
আবুধাবিতে বাঙালি এক ছাত্রী—নাম দূর্বা। তাকে আদর করার সময় সেদিন দক্ষিণ ভারতীয় শিক্ষিকা মিস আনসু তেমন আশাবাদই ব্যক্ত করলেন। তিনি সমাবর্তনী অনুষ্ঠানে দেওয়া সনদের আদলে ডিপ্লোমা কার্ড দিলেন তার হাতে। ক্যামেরার সামনে জ্বলে উঠল দুই প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি। এটা ছিল ছাত্রীর কেজি-টু শেষের বিদায়ী দিন। এবার সে যাবে বৃহৎ ভবন শেরউড একাডেমিতে। শিক্ষিকা বললেন, ‘বড় হওয়ার পর অনেকেই জানতে চাইবে, ছোটবেলায় তোমার শিক্ষক কে ছিলেন! তুমি তখন আমার নামটিই বলবে।’
মা এবং শিক্ষক—দুজনের চাওয়ার মধ্যে অদ্ভুত এক মিল। দুজনেই তৃপ্ত শিক্ষার্থীর সাফল্যে। বিদ্যাসাগরের মা বলেছিলেন, তাঁর সন্তান স্বপ্নকে ছুঁতে পারলে তাঁর আর চাওয়ার কিছু থাকবে না জীবনে। মিস আনসুর কণ্ঠেও এই কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল।
নিমাই সরকার
No comments