বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩২২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবিদুর রহমান, বীর বিক্রম সাহসী ও কুশলী এক নৌ-কমান্ডো গোপন ক্যাম্প থেকে সহযোদ্ধা নৌ-কমান্ডোদের নিয়ে আবিদুর রহমান বেরিয়ে পড়লেন। আবছা আলো, আবছা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে নিঃশব্দে হেঁটে পৌঁছালেন নদীর পাড়ে।


অবস্থান নিলেন সারিবদ্ধ দোকানের পেছনে। অদূরে নৌবন্দর। সেখানে তীব্র আলো। সেই আলোর কিছুটা তাঁরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানেও পড়েছে। আলো-আঁধারির মধ্যে তাঁরা দ্রুত অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। এমন সময় ঘটল এক বিপত্তি। দলনেতা আবিদুর রহমান কৌশলে সেই বাধা উপেক্ষা করে অপারেশন সফল করলেন। তোলপাড় পড়ে গেল বন্দরে। এ ঘটনা নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরের। ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ১৬ আগস্ট)।
মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা দেশের বিভিন্ন নৌবন্দরে একযোগে অপারেশন চালিয়ে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এই অপারেশনের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’।
নির্ধারিত দিন নৌ-কমান্ডোরা আবিদুর রহমানের নেতৃত্বে গোপন ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে অবস্থান নেন নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরের অপর পাড়ে। তাঁরা ছিলেন মোট ২০ জন। ১৫ জন নদীতে নেমে অপারেশন করেন। দলনেতা আবিদুর রহমানসহ পাঁচজন থাকেন স্থলভাগের নিরাপত্তায়।
১৫ জনের দলটি তিনজন করে পাঁচটি দলে বিভক্ত ছিল। তিনটি দল পানিতে নামার পর সেখানে হঠাৎ এক অস্ত্রধারী রাজাকার এসে হাজির হয়। নৌ-কমান্ডোরা তাকে গুলি করে হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু কৌশলগত কারণে তখন তা করা সম্ভব ছিল না। কারণ কাছাকাছিই পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান। এদিকে ওই রাজাকার সেখান থেকে আর সরছিল না। বিপজ্জনক এক অবস্থা।
এ অবস্থায় দলনায়ক আবিদুর রহমান ওই রাজাকারকে নিঃশব্দে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ছুরি হাতে একাই ক্রলিং করে ওই রাজাকারের কাছে গিয়ে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তার ওপর। আবিদুর রহমান রাজাকারের রাইফেলটি ছিনিয়ে নিয়ে তাকে বন্দী করেন। এরপর নৌ-কমান্ডোদের বাকি দুটি দল পানিতে নামে।
যে তিনটি দল আগে পানিতে নেমেছিল তাঁরা যে যাঁর টার্গেটে (জাহাজ, পন্টুন বা টাগ) মাইন লাগান। পরের দুটি দলও নির্দিষ্ট টার্গেটে মাইন লাগাতে সক্ষম হয়। তারপর তাঁরা দ্রুত ফিরে আসেন আগের স্থানে। একটু পর শুরু হয় বিস্ফোরণ। বন্দরের সমুদয় জলরাশি ও দুই পাড় কেঁপে পরপর ১৫টি মাইন বিস্ফোরিত হয়।
আবিদুর রহমান চাকরি করতেন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে ফ্রান্সের তুলন নৌঘাঁটিতে সাব মেরিনার হিসেবে প্রশিক্ষণে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও ১২ জন বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁদের মধ্যে আবিদুর রহমানসহ আটজন ৩১ মার্চ তুলন থেকে পালিয়ে যান। কয়েক দিন পর ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। আবিদুর রহমান ১৬ আগস্টের পর আরও কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য তারাবো ফেরিঘাট, সিদ্ধিরগঞ্জে খাদ্যগুদামে আক্রমণ, রসদবাহী জাহাজ ‘তুরাগে’ আক্রমণ প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবিদুর রহমানকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩২। গেজেটে নাম মো. আবদুল রহমান।
আবিদুর রহমান ২০১০ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার সলিমাবাদ গ্রামে। তবে তিনি ঢাকায় বসবাস করতেন। ঢাকার ঠিকানা ৩১ প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার। তাঁর বাবার নাম শফিকুর রহমান, মা আনোয়ারা বেগম। স্ত্রী হামিদা রহমান। তাঁর দুই মেয়ে ও এক ছেলে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ১০।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.