হাজার কোটি টাকা নিয়ে গ্রাহকদের প্লট দিতে পারছে না আশিয়ান

নাকে তেল দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমানোর পরামর্শ যে প্রতারণার কৌশলমাত্র_এমনটা আগে বুঝতে পারেননি সাধারণ গ্রাহকরা। যখন বুঝতে পারলেন, তত দিনে পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়। আজ তাঁরা নাকে তেল দিয়েও ঘুমাতে পারছেন না। কারণ, সারা জীবনের সঞ্চয় আর সহায়-সম্বলের বিনিময়ে এক চিলতে জমির মালিক হওয়ার যে স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন, তা ফিকে হয়ে গেছে। প্লট তো দূরের কথা, এখন জমার টাকাটা ফিরে পাওয়ার আশাও দুরাশায়


পরিণত হতে চলেছে। কেননা যেই আশিয়ান সিটি তাঁদেরকে নানা বাক্য-বুলির ফুলঝুড়িতে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটি নিজেই আজ প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত। তবে গ্রাহকরা প্লট না পেলেও হাওয়ায় প্লট দেখিয়ে ইতিমধ্যে আশিয়ান হাতিয়ে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, ঢাকার বরুয়া-ডুমনি এলাকায় প্রতারণার মাধ্যমে জাল দলিল-দস্তাবেজ তৈরি করে আশিয়ান সিটি মানুষের সম্পদ অবৈধভাবে দখল করে চলেছে। অন্যদিকে মিথ্যা আশ্বাসে সাধারণ গ্রাহকদের থেকে হাজার কোটি টাকা পকেটে পুরে এখন তাঁদেরকে প্লট বুঝিয়ে দিতে পারছে না। এ অবস্থায় গ্রাহকদের মাথায় হাত। আশিয়ান সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে বছরের পর বছর ঘুরে তাঁরা আজ ক্লান্ত। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে কেউ কেউ আদালতে মামলা করতে বাধ্য হচ্ছেন।
জোরপূর্বক জমি দখল ও জলাশয় ভরাটের অভিযোগে রাজধানীর দক্ষিণখানে আশকোনা এলাকায় আশিয়ান সিটির আবাসন প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। একই সঙ্গে প্রকল্পটিকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আশিয়ান সিটি প্রকল্পের প্লট বিক্রির পরিমাণ প্রায় চার হাজার ৩৭০টি। প্রতিটি প্লট গড়ে পাঁচ কাঠা করে ধরলে বিক্রি করা জমির পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার ৮৫০ কাঠা। অথচ এ এলাকায় আশিয়ান সিটি প্রকল্পের কেনা জমির পরিমাণ মাত্র ১৫৯ বিঘা। যা মাত্র তিন হাজার ১৮০ কাঠা। বাকি ১৮ হাজারের বেশি গ্রাহক আশিয়ানের প্রতারণার জালে পড়েছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে_আশিয়ান কোনো দিন এখানে কাউকে প্লট দিতে পারবে না।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যান, রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী রাস্তাঘাট ও নাগরিক সুবিধা যেমন_স্কুল, হাসপাতাল, কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ, খেলার মাঠ, বাজার, কাঁচাবাজার ইত্যাদির জন্য নূ্যনতম জমি ছাড়ার প্রয়োজন হয় ৩০ শতাংশ। আশিয়ান সিটির বরুয়া-ডুমনি এলাকায় ক্রয়কৃত জমি পরিমাণ মাত্র তিন হাজার ১৮০ কাঠা। এই জমি থেকে রাস্তাঘাট ও নাগরিক সুবিধার জন্য জমি ছাড়ার পর অবশিষ্ট থাকে মাত্র দুই হাজার ২২৬ কাঠা। এ জমিতে প্লট হবে ৪৪৫টি। অথচ তারা নাকে শর্ষের তেল দিয়ে ঘুমানোর চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে হাজার হাজার প্লট বিক্রি করে চলেছে। বর্তমান অবস্থায় তাদের ক্রয়কৃত জমির পরিমাণ বিক্রয়কৃত জমির মাত্র ১০ শতাংশ।
বাস্তবতা বুঝতে পেরে কিছুদিন থেকে গ্রাহকরা জমি বুঝিয়ে দিতে আশিয়ান অফিসে দিনের পর দিন ধরনা দিচ্ছেন। কিন্তু আশিয়ান প্লট বুঝিয়ে দিতে পারছে না। কারণ বিক্রির তুলনায় ৯০ শতাংশ জমি তারা এখনো কিনতেই পারেনি। এ অবস্থায় তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রভাব খাটিয়ে, জোর করে স্থানীয় মানুষের জমি দখল করে নিচ্ছে। রাজউকে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন অভিযোগ জমা হচ্ছে। অভিযোগের পাহাড় জমছে পরিবেশ অধিদপ্তরেও।
জানা গেছে, আশিয়ান সিটির বর্তমান অরাজকতার কারণে কষ্টার্জিত টাকায় এ প্রকল্পে প্লট কিনে প্রবাসীরা আজ দিশেহারা। প্লট রেজিস্ট্রি ও হস্তান্তর যথাসময়ে হবে কি না_তা নিয়ে দেশি-প্রবাসী গ্রাহকরা সন্দিহান।
ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অনেকের অভিযোগ, অনেক চেষ্টা করেও তাঁরা কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নজরুলের সাক্ষাৎ পান না। অন্য কর্মচারীরা গ্রাহকদের জানান, আশিয়ান সিটির ক্রয়কৃত পর্যাপ্ত জমি রয়েছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ প্রকল্প অনুমোদনের জন্য রাজউকের যে শর্ত রয়েছে, তা পূরণ করতে অক্ষম আশিয়ান। তা ছাড়া ওই প্রকল্পের জমি নিয়ে আশিয়ান সিটির বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। মামলাটি দায়ের করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। ওই মামলা বর্তমানে গতিহারা হলেও অন্যের জমি জোর-দখল করার ব্যাপারে আশিয়ানের বিরুদ্ধে রয়েছে অগণিত মামলা ও সাধারণ ডায়েরি।
একটি সূত্রে জানা যায়, আশিয়ানের মালিক নজরুল প্রভাবশালীদের নাম ভাঙিয়ে সরকারি-বেসরকারি জমি অবৈধভাবে দখল করে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই তাঁর বাহিনী ক্ষতিগ্রস্তদের জমির কাছে আসতে দিচ্ছে না। তাঁর অত্যাচার-নির্যাতন থেকে আত্মীয়-স্বজনরাও রেহাই পাচ্ছেন না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মুনীর চৌধুরী আশিয়ান সিটি প্রকল্পে অভিযানে গেলে শত শত ভুক্তভোগী মানুষ কান্নাজড়িত কণ্ঠে অভিযোগ করেন। মুনীর চৌধুরী ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্বাস দেন, অবৈধ দখল, ভূমিদস্যুতা ও পরিবেশগত ক্ষতিসাধনের জন্য দায়ী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে আইনসঙ্গত শাস্তি দেওয়া হবে। যাঁরা জমির মূল্য পেতে চান, তাঁদের জন্য উপযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত মূল্য আদায়ের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর যাঁরা জমি দিতে অনিচ্ছুক তাঁদের জমি পুনরুদ্ধার করা হবে। এলাকার ভূমি-মালিক ও সর্বস্তরের মানুষ পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, নজরুলের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের আরেকটি অভিযোগ সংরক্ষিত জলাশয় ভরাট। এভাবে জলাধার ভরাট হতে থাকলে ভবিষ্যতে রাজধানীর পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। রাজধানী পড়বে ঝুঁকির মুখে। এমনিতে রাজধানীর অগণিত খাল ও জলাশয় ভরাটের ফলে একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বরুয়া-ডুমনি এলাকার জলাশয় যেভাবে ভরাট করা হচ্ছে, তাতে রাজধানীর জলাবদ্ধতা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। নগরবাসী কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হয়। বিমানবন্দরের কাছাকাছি আশিয়ান সিটির খাল ও জলাশয় ভরাট আর সরকারি জমি দখলের কারণে শুধু ডুমনি নয়, পুরো এলাকায় সমস্যা তৈরি হয়। এমনকি রেললাইন ও বিমানবন্দর সড়কও হুমকির মুখে।
আশিয়ান সিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে শুধু জমি দখলের অভিযোগ নয়, জালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে কোটি টাকা ঋণ তুলতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল খাটতে হয় তাঁকে। ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে জালিয়াতি করে ১০ কোটি টাকা ঋণ নিতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন। ওই ঘটনায় নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। মামলা নম্বর-৭৬/১২৬ (সিআর নম্বর-১৭৫/০৭)। ওই মামলায় তাঁকে জেলখানায় থাকতে হয় দীর্ঘদিন। এ ছাড়া জমি দখল করতে গিয়ে মানিক মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে ফাঁসাতে গিয়ে র‌্যাবের হাতে নজরুল নিজেই ফেঁসে যান। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
আশিয়ান সিটির মালিক নজরুল ইসলামের সঙ্গে কালের কণ্ঠের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। সহকারী মহাব্যবস্থাপক জহিরুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'ভূমি-মালিকদের সঙ্গে আমাদের একটা সমঝোতা হয়ে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছিল না বলে জরিমানা করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.