উন্নয়নের নতুন শক্তি by কনিকা হক

ছেলেকে স্কুল গেটে নামিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সময়টায় কাঁচা-পাকা চুলের একজন মহিলা সব সময় আমার নজর কাড়ত। আন্দাজ করি আমার মায়ের বয়েসী হবেন। সত্তরের কাছাকাছি! হালকা করে ঘোমটা টানা, পরিপাটি সাজে রুচিশীলতার সুস্পষ্ট ছাপ। মুখে হাসি লেগেই থাকে। লক্ষ্য করি আরও বেশ কিছু অভিভাবকের সঙ্গে বন্ধুত্বের একটা গ্রুপ তৈরি করে ফেলেছেন তিনি। আমার অফিসের তাড়ায় কথা বলি বলি করে বলা হয় না।


ওনাকে দেখে ভীষণ শান্তি পাই। কারণ বয়স তাকে কাবু করতে পারেনি খুব একটা। ছেলের ঘরের নাতিকে স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজে ব্যস্ত থেকে যেন নিজের হারিয়ে ফেলা সময়ে আবার ফিরে গেছেন তিনি। মাঝে মধ্যে দেখি ওনার হাতে টিফিনক্যারিয়ার। অনুমান করি আজ তার খাওয়ানোর পালা। এই সেদিন সাদা বেগুনি পাড়ের সুন্দর শাড়িতে শরতের শুভ্র সাজ দিয়ে এসেছিলেন তিনি। আমার পাশেই দাঁড়িয়েছেন। কথা বলার আকুলতায় বললাম, খুব সুন্দর লাগছে আপনাকে। এভাবে শুরু হয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। বললেন, বউমা চাকরি করে। নাতির স্কুলে ভর্তির সময় হলে বউমা চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। প্রেসার, ডায়াবেটিস নিয়ে আমি তখন কিছুটা অসুস্থ। তার ওপর বয়স হয়েছে বলে মনের শক্তিও হারিয়ে ফেলছিলাম। আমার ছেলে বলল, মা তুমি কি চেষ্টা করবে, আমিও মনের জোর নিয়ে বলি আমি তোমার ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়া করব, তুমি চাকরি ছেড়ো না। এখন আমার নাতির দেখাশোনা আমিই করি। খুব ভালো আছি মা। শরীর কোনো ঝামেলা করছে না। এখন আর নিজেকে অকেজো বা বোঝা মনে হয় না।
আসলে, এই মানুষগুলো পরিবার বা সমাজের বোঝা! তার ওপর এই আধুনিক সময়ে! দেশ বা সমাজের নিয়ন্ত্রণ তো তাদের হাতেই। আমাদের দেশেই সত্তরোর্ধ্ব নারী বেগম মতিয়া চৌধুরী দাপটের সঙ্গে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে কি প্রবীণ বলা যায়! বরং তিনি তো অনেক তরুণের চেয়ে তরুণ, দৃষ্টান্ত আমাদের কাছে। ওল্ড ইজ গোল্ড_ এই সত্যটি প্রমাণ করছেন প্রতিনিয়ত, তাদের মতো মানুষেরা। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষের বয়স বাড়ে। বয়স বাড়লেই জীবন শেষ কিংবা তিনি অকেজো মানুষ নন। সব বয়সেরই নির্দিষ্ট কাজ আছে, দায়িত্ব আছে। ঘরের যে প্রবীণ ব্যক্তি নারী কিংবা পুরুষ, তিনি পরিবারের শক্তি এবং বটবৃক্ষের ছায়া। তাদের ছায়াতলে পরিবারের মানুষগুলো একতাবদ্ধ। ৭০-৮০ বছর বয়স হয়ে গেলে কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে থাকলেও সমাজের প্রতিষ্ঠিত সন্তানটি বাবা-মায়ের কাছেই আশ্রয় খোঁজে।
প্রবীণের বয়সসীমা আসলে কত? আন্তর্জাতিকভাবে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিকে প্রবীণ ধরা হয়। কিন্তু প্রবীণ মানেই তিনি দুর্বল মানুষ_ তা মনে করা হয় না। বরং বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে তার অভিজ্ঞতাকে পরবর্তী প্রজন্মকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি হিসেবে ধরা হয়। এ বছরের প্রবীণ দিবসে প্রবীণ ব্যক্তিকে উন্নয়নের নতুন শক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। সারা বিশ্বে বর্তমানে ৬০০ মিলিয়ন ব্যক্তি আছেন যাদের বয়স ষাট এবং ষাটোর্ধ্ব। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ২ বিলিয়নে এবং তা হবে উন্নত বিশ্বে। বলা হচ্ছে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ, তাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান বিনিময়, পরিবারের দেখাশোনার কাজে তারা হয়ে উঠতে পারেন উন্নয়নের হাতিয়ার। আফ্রিকাতে এরই মধ্যে প্রবীণদের অবদান চোখে পড়ার মতো। প্রায় ১০ লাখ এইডস রোগীর সেবা শুশ্রূষার দায়িত্ব পালন করছেন পরিবারের বাবা-মা। আক্রান্ত সন্তানটি মারা গেলে তার এতিম বাচ্চাদের দায়িত্ব নিচ্ছেন গ্র্যান্ড প্যারেন্ট হিসেবে। আর এ ক্ষেত্রে পরিবারের প্রবীণ নারীর ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।
আমাদের দেশে পরিবারের প্রবীণ নারী অর্থাৎ মা, খালা, চাচিদের সেবামূলক ভূমিকা আদিকালের বৈশিষ্ট্য। বর্তমান সময়ে বিয়ের পর মেয়েদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে, কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে মায়েদের সহযোগিতার হাত যে কতটা প্রসারিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু আমরা তাদের প্রতি কতটা যত্নশীল? তাদের কাছ থেকে আমরা যা নিচ্ছি, বিনিময়ে দিচ্ছি কতটুকু? ভালোবাসার বিনিময়মূল্য নেই। ভালোবাসা দিয়েই ভালোবাসা শোধ করতে হয়। আমরা কি গভীরভাবে ভাবব কথাটি? আমাদের কোনো মা-বাবার আশ্রয় যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়। যে পরিবার ঘিরে তাদের জীবন সেই পরিবারই যেন হয় তাদের শেষ জীবনের আশ্রয়স্থল। আমাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর যত্নে তারা যেন স্বপ্নের বীজ বুনতে পারেন নতুন করে আমাদের মনে। আর সেই স্বপ্নে পল্লবিত হয়ে উঠতে পারি আমরা সবাই।
 

No comments

Powered by Blogger.