সাইদের মৃত্যুরহস্য তদন্ত করবে গোয়েন্দা পুলিশ-স্বামীর মৃত্যুতে রুমানা শোকাহত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমানা মনজুরের স্বামী হাসান সাইদের মৃত্যুর রহস্য কাটেনি এখনো। সাইদের শরীরে দাগ, পরিবারের অভিযোগ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্যে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। তবে এ মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করে দেখবে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ জন্য কারা কর্তৃপক্ষের কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠাবে ডিবি। এদিকে রুমানার ওপর নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা আলোচিত মামলাটি গুরুত্ব হারিয়েছে একমাত্র আসামি হাসান সাইদের মৃত্যুর


কারণে। শিগগিরই মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ওদিকে হাসান সাইদের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, কারা হেফাজতে হাসান সাইদের রহস্যজনক মৃত্যুর রাতে কয়েকজন ব্যক্তি প্রিজন সেলে প্রবেশ করেছিল। কারাগারে সব সময় লুঙ্গি পরে থাকা সাইদের লাশ মিলেছে প্যান্ট পরা অবস্থায়। হাতে রশির বাঁধনের দাগ কিভাবে এল, সে প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা। প্রিজন সেলে তাঁর এ মৃত্যু হত্যা নাকি আত্মহত্যা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল বুধবার এ রকম নানা প্রশ্ন উত্থাপনের পাশাপাশি স্বজনরা জানিয়েছেন, কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা।
পুলিশ ও কারা সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার ভোরে হাসান সাইদের মৃত্যু নিয়ে কিছু রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। সুরক্ষিত ওই স্থানে সাইদকে কেউ হত্যা করেনি বলে অনেকটাই নিশ্চিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে সাইদের আত্মহত্যা করার মতো বেশ কিছু আলামত আছে। চিকিৎসক ও স্বজনরা অবশ্য বলছেন, সাইদের আত্মহত্যা করার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না। তাই আলামতের কারণে তৈরি হওয়া ধূম্রজাল ভেদ করতে মাঠে নামছে ডিবি। জানা গেছে, ময়নাতদন্ত রিপোর্টের জন্যও অপেক্ষা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, হাসান সাইদের মৃত্যুর ঘটনাটি ডিবি তদন্ত করে দেখবে। এ জন্য কারা অধিদপ্তরের অনুমতি ও সহায়তা চেয়ে চিঠি পাঠানো হবে। চলমান একটি মামলার তদন্তের স্বার্থেই মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। মনিরুল ইসলাম আরো জানান, রুমানা মনজুরের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি গুরুত্ব হারালেও এর তদন্ত প্রতিবেদন শিগগিরই জমা দেওয়া হবে।
এদিকে সাইদের ছোট ভাই ফারুক হাসান শাওন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, রবিবার রাত ২টার দিকে প্রিজন সেলে সাইদ হাসানের কক্ষে কয়েকজন লোক প্রবেশ করেছিল। তাঁদের মধ্যে হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্ট জালাল ছিলেন। তাঁরা প্রায় এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে চলে যান। তাঁরা কোন উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিলেন, তা পরিষ্কার নয়। কারা কর্তৃপক্ষের হেফাজতেই আমার ভাইয়ের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। তাই প্রাথমিকভাবে তারাই দোষী। কোনো চক্র কারা কর্তৃপক্ষকে ব্যবহার করেছে কি না, তা মামলার তদন্তেই বেরিয়ে আসবে। কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রথমে থানায় মামলা করতে যাব। থানার পুলিশ মামলা না নিলে আদালতে দায়ের করব।'
সাইদের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'আমার ছেলে প্রিজন সেলে বন্দি ছিল। সেখানে সে লুঙ্গি পরে থাকত। ওই রাতে সাইদকে প্যান্ট পরিয়েছিল কারা, তা জানা দরকার। কখনোই আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না। চোখের সমস্যা ছাড়া তার কোনো রোগবালাই ছিল না। মৃত্যুর দুই দিন আগেও আমি ওর সঙ্গে কথা বলেছি।'
স্বজনরা অভিযোগ করেন, বিভিন্ন নারী সংগঠন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক রুমানার চোখের সর্বশেষ পরিস্থিতির তথ্যসংবলিত কাগজপত্র সরবরাহ করেনি। এতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতে বিলম্ব করে। আদালত আগামী ১০ জানুয়ারি জামিন আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে সাইদ চলে গেছেন।
সাইদের বোন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সামিরা হক বলেন, 'কারাবিধি অনুযায়ী হাজতি বাথরুমে গেলেও তাঁকে অনুসরণ করার কথা। অথচ দীর্ঘক্ষণ ধরে সাইদ বাথরুমে পড়ে ছিলেন, কিন্তু কেউ টের পেলেন না_এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোন উদ্দেশ্যে সাঈদের চারপাশে দাগী আসামি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের রাখা হয়েছিল, কারা কর্তৃপক্ষকে তা পরিষ্কার করতে হবে।' বিডিআর বিদ্রোহ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছাড়াও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী অপুকে তাঁর কাছাকাছি রাখা হয়েছিল বলে তিনি অভিযোগ করেন।
স্ত্রী রুমানাকে নির্যাতন ও চোখ উপড়ে ফেলার অভিযোগে গত ১৫ জুন রাজধানীর উত্তর মুগদার একটি বাসা থেকে হাসান সাইদকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গত ২৩ নভেম্বর কারাগার থেকে চোখের চিকিৎসার জন্য সাইদকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।
গত সোমবার প্রিজন সেলের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের কাছে সাইদের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বললেও, পরে কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম প্রিজন সেলের চিকিৎসকদের উদ্ধৃতি দিয়ে সাংবাদিকদের জানান, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সাইদের মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শামীমা খন্দকার সাইদের মৃত্যুকে রহস্যজনক বলে আখ্যা দেন। আবার কারারক্ষীরা জানান, চারতলার প্রিজন সেল ভবনে একজন হাবিলদারের নেতৃত্বে ১১ জন কারারক্ষী ও চারজন পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। হাসান সাইদ (হাজতি নম্বর ২০৪৯৬/১১) ও ইউসুফ নামের বিডিআরের এক সাজাপ্রাপ্ত আসামি দোতলার একটি কক্ষে একসঙ্গেই ছিলেন। সোমবার ভোরে সাইদকে না দেখে খোঁজ করলে ইউসুফ কারারক্ষীদের বলেন, অনেকক্ষণ আগে বাথরুমে ঢুকেছেন, কিন্তু বের হচ্ছেন না। পরে বাথরুমের দরজা ধাক্কা দিলে তা খুলে যায়। দেখা যায়, সাইদের মৃতদেহ মেঝেতে পড়ে আছে। সাইদের মুখে পলিথিন প্যাঁচানো ছিল। হাতে একটি দাগ ছিল। প্রাথমিকভাবে কারারক্ষীরা এ বক্তব্য দেন এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে সাইদের লাশ পাঠানো হয় এই রহস্য দেখেই।
কারা অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) গোলাম হায়দার কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা গোয়েন্দা পুলিশের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছেন। সেখানে সাইদের মৃত্যুর সনদ চাওয়া হয়েছে। মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে ডিবি সহায়তা চাইলেও তাঁরা তা করবেন বলে জানান তিনি।
দাফন আজিমপুরে : গতকাল বাদ জোহর হাসান সাইদের লাশ দাফন করা হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে। বোন সামিরা হক গতকাল সকালে দেশে ফেরার পর দুপুরে রাজধানীর পরীবাগ জামে মসজিদে সাইদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

রুমানা শোকাহত : স্বামী হাসান সাইদের মৃত্যুর ঘটনায় শোকাহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক রুমানা মনজুর। গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'এ মুহূর্তে মন্তব্য করার জন্য যথেষ্ট তথ্য আমার কাছে নেই, কিন্তু খবরটি আমার জন্য শোকের।'
প্রসঙ্গত, গত ৫ জুন রাজধানীর ধানমণ্ডির বাসায় স্বামী হাসান সাইদের নির্যাতনের শিকার হন রুমানা মনজুর। পরে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসায় তাঁর দুটি চোখ নষ্ট হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে।
রুমানাকে নির্যাতন ও চোখ উপড়ে ফেলার ঘটনায় গত ১৫ জুন রাজধানীর উত্তর মুগদার একটি বাসা থেকে সাইদকে গ্রেপ্তার করা হয়। গত সোমবার ভোরের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজনসেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
বর্তমানে ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকের শিক্ষার্থী রুমানা মনজুর বিবৃতিতে আরো বলেন, 'বিগত ছয় মাস ধরে আমি খুব কঠিন সময় পার করছি এবং এই সংবাদ আমার অবস্থার আদৌও কোনো উন্নতি করতে পারছে না। কঠিন সময় থেকে উত্তরণ এবং আমার একমাত্র মেয়ের প্রতি যত্ন নেওয়ার বিষয়ে এখন আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ রয়েছে।'

No comments

Powered by Blogger.