চাই সামাজিক সম্পর্কের শৈথিল্যের অবসান by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

কটি সময় ছিল যখন পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে বসে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে গল্পে মেতে উঠত। তখনো টিভির প্রচলন শুরু হয়নি। ঘরোয়া বিনোদনের এটিই ছিল প্রধান মাধ্যম। এরপর টেলিভিশনের প্রচলন শুরু হলো। সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন মাধ্যম হিসেবে আমরা টেলিভিশনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। ঘরের বাইরের বিনোদনের ধরনও কম ছিল না। ফুটবল, হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্দা খেলাগুলো ছিল গ্রামেগঞ্জে জনপ্রিয়।


এমনকি শহরেও এর প্রচলন কমবেশি লক্ষ করা যেত। শহরগুলোতে লোকসমাগম অনেক কম ছিল। ছিল খোলা বা উন্মুক্ত মাঠ। ছেলেমেয়েরা সেই মাঠে খেলাধুলা করে সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরত। এরপর লেখাপড়া ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গল্প করা ছিল নিত্যদিনের বিষয়। পরিবারব্যবস্থাও ছিল মোটামুটি যৌথ। দাদা-দাদির স্নেহ, আদর আর মায়া-মমতা ছেলেমেয়েদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পথকে করত মধুর। পারিবারিক এ ধরনের বিনোদনের মধ্যে শিক্ষণীয় অনেক বিষয়ও ছিল। গল্পের ছলে দাদা-দাদিরা ছোট ছেলেমেয়েদের নৈতিক মূল্যবোধগুলো ভালোভাবে শিখিয়ে দিত। শিশু সামাজিকীকরণের একটি বড় উৎস ছিল ঘরোয়া বিনোদন। আর ছেলেমেয়েদের প্রতি মা-বাবার সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ছিল যেমন কঠোর, তেমনি মধুরও বটে। এখন সময় পাল্টে গেছে। শুধু শহর সমাজই নয়, গ্রাম সমাজেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলের আবির্ভাব, সনাতন বিনোদনব্যবস্থা হারিয়ে যাওয়া, আর বিনোদনের নতুন নতুন ধরনের উদ্ভব আমাদের সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফলে সনাতন বিনোদনের সুফলের পরিবর্তে আধুনিক বিনোদনের ব্যাপক প্রচলন ছেলেমেয়েদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বলতে গেলে বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন। তারা মোবাইল ফোনকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের কাছে মোবাইল ফোন যতটা যোগাযোগ রক্ষা করা, তার চেয়ে বেশি গান শোনা, ভিডিও দেখা ইত্যাদি।
প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে টিকে থাকার জন্যই বলি কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নতির কথাই বলি, ইন্টারনেট ছাড়া এখন চলেই না। তাই কম্পিউটার বা ল্যাপটপ এখন প্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে। মা-বাবারা চান তাঁর ছেলে বা মেয়েটি বিশ্বের নতুন নতুন তথ্যভাণ্ডারে সমৃদ্ধ হোক। এতে কার না ভালো লাগে। তাই কষ্ট করে হলেও কম্পিউটার বা ল্যাপটপ কিনে দিতে দ্বিধাবোধ করেন না। কিন্তু তাঁর সন্তানটি এর কতটুকু সদ্ব্যবহার করছে সে ক্ষেত্রে নজরদারি একটু কমই মনে হয়। অনেক ক্ষেত্রে শত চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব হয় না। ফলে অসদ্ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে গিয়ে বিকৃত মনমানসিকতার আবর্তে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা সামাজিক অপরাধের দিকে অর্থাৎ খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটাতে প্রলুব্ধ হচ্ছে। সামাজিক সম্পর্কের মধ্যকার পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়াস। এর সমাধান এই নয় যে আধুনিক প্রযুক্তিকে বন্ধ করে দেওয়া। কোনো বিবেকবান মানুষ একে সমর্থন করবে না। করতে পারেও না। ক্রমাগত নগরায়ণ এবং প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনে একজনের সঙ্গে অন্যজনের সম্পর্ক তৈরিতে আগেকার নিয়ন্ত্রিত সামাজিক সম্পর্কের দড়ি আর বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। সম্পর্কের মধ্যে ঘটেছে পরিবর্তন। বিবাহপূর্ব প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক আগে ছিল না_এমনটি বলা ঠিক হবে না। তবে সেই সম্পর্কের মধ্যে ছিল না অবাধ মেলামেশা। সময় কাটানো, গল্প করা, নিজের ভালোমন্দের বহিঃপ্রকাশ ছিল প্রধান বিষয়। ছিল আবেগ, তবে তার মধ্যে ছিল ঠিক যৌক্তিক চিন্তা। এখনকার সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক একটু ভিন্নমাত্রায় চলছে। সম্পর্কের মাত্রায় যোগ হয়েছে অবাধ মেলামেশা। ফলে মন দেওয়া-নেওয়ার এই ডামাঢোলে কেউ কেউ হোঁচট খাচ্ছে। নিজেকে সামলাতে না পেরে সম্পর্কের মাত্রা এমন একটি পর্যায়ে পেঁৗছায় যেখান থেকে বেরিয়ে আসাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শুরু হয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের। অপরিপক্ব এ ধরনের সিদ্ধান্তের ফলে কাউকে কাউকে জীবন দিতে হয়। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোটানায় কখনো কখনো বুঝে উঠতে সময় লেগে যায়। কেউ আবার বুঝতেও পারে না। এর মধ্যেই সব কিছু শেষ।
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া আদৃতা এবং ইভা হত্যাকাণ্ডের পেছনে সামাজিক সম্পর্কের উপরিউক্ত পরিবর্তন কমবেশি দায়ী। এ ধরনের ঘটনা আমরা প্রায়ই কমবেশি লক্ষ করি। কোনো মৃত্যুকেই আমরা সমর্থন করি না, যখন মৃত্যুটি অস্বাভাবিক হয়। আদৃতা মডেল হিসেবে পরিচিত ছিল। তার ছেলেবন্ধুও মডেল ছিল। ছিল একের প্রতি অন্যের আকর্ষণ। কিন্তু তার চেয়ে বেশি ছিল তাদের রোমাঞ্চকর অনুভূতিগুলো। এর ভিত্তিতে সম্পর্কের স্থায়িত্ব টিকে রাখা অনেকটা কঠিন। ফলে অনেকের ক্ষেত্রে না হলেও আদৃতার ক্ষেত্রে মৃত্যুকে বরণ করতে হলো। আমাদের দুর্ভাগ্য ইভার মতো ছোট মেয়েটিকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। শুধু ধর্ষণের শিকারই নয়, তাকে বস্তায় ভরে খাটের নিচে লুকিয়ে রেখে ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। দিন দিন বিশ্বাসের আস্থা মানুষের কাছ থেকে উঠে যাচ্ছে। আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন? এখন সময় এসেছে কাউকে বিশ্বাস না করার। নিজের জীবনকে সুন্দর করার জন্য আমরা কত কিছুই না করি। মা-বাবারা কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করে সন্তানদের লালন-পালন করে। জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে দিয়ে এ কাজটি করা অনেকটা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফলে কোনো কোনো মা-বাবা তাঁদের সন্তানদের ভালোভাবে খোঁজখবর রাখতে পারে না। আবার অনেকের সুযোগ থাকলেও ইচ্ছা করে খোঁজখবর রাখে না। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের এ শৈথিল্য আমাদের এমন একটি দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে একসময় বের হয়ে আসা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সামাজিক অপরাধের মাত্রার মধ্যে আধিক্য লক্ষ করা যাবে। আমাদের উচিত, আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া, যেখানে সামাজিক বন্ধন ছিল সুদৃঢ়। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ছিল কঠোর এবং ছিল বহু ব্যক্তির প্রভাব। শুধু মা-বাবাই নয়, অন্যরাও আমাদের ওপর ছায়ার মতো লেগে থাকত। এখন আমরা তা কম লক্ষ করি। আমরা অবশ্যই চাইব সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঠিক ও কার্যকর কর্মকাণ্ড। এতে সামাজিক সম্পর্ক হবে সুন্দর, সুশৃঙ্খল ও পরিশীলিত। আমরা কমাতে পারব আমাদের সামাজিক অপরাধের মাত্রাকেও। সুষ্ঠু ও সুন্দর বিনোদন আমাদের এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে দিতে সহায়তা করতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.