চালচিত্র-সময় এসেছে বিএনপির প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘুরে দাঁড়ানোর by শুভ রহমান
বিজয়ের মাসে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টিই জাতির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা জাতির সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়। লাখো-কোটি বাঙালির অশ্রু-হাহাকার-রক্তপাত জড়িয়ে আছে যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে, সেই মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর প্রত্যক্ষ দোসর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদানের বিষয়টি বিজয় সংহত করার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবেই জড়িত। বিজয় অর্থহীন হয়ে যাবে, বিজয় নস্যাৎ হয়ে যাবে, যদি আজ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার করা না হয়। বিচারকে আজ নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে, এমনকি আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম স্থগিত, বন্ধ কিংবা বাতিল করার ধূর্ত কৌশল চালানো হচ্ছে। খোদ বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া বলছেন, আওয়ামী লীগ একটি বর্বর দল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আগে তাদেরই বিচার করা উচিত। গত ৪ ডিসেম্বর বিএনপির হরতালের সময় আহত সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। বিশ্লেষকদের মতে, তিনি এ কথাটি হঠাৎ বলেননি। যেকোনো ছুতা বা সুযোগ পেলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করার, এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে একটা বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করে কার্যত বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করাই যেন এখন দেশের প্রধান বিরোধী দলের মূল রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩ ডিসেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সংবাদ সম্মেলনে এক লিখিত বক্তব্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বাতিলের দাবি জানান। তিনি ওই লিখিত বক্তব্যে ট্রাইব্যুনালকে আজ্ঞাবাহী রাবারস্ট্যাম্প সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, বিচার কার্যক্রমের ওপর তাঁদের আস্থা নেই। তাই এর কার্যক্রম বাতিল করে মার্কিন অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ স্টিফেন র্যাফের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হোক। এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক জেনারেল হারুন অর রশীদ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সুধী সমাজের প্রমুখ প্রতিনিধি তাঁদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তাঁরা ব্যারিস্টার মওদুদের ওই বক্তব্যকে দুর্ভাগ্যজনক ও আইনের শাসনের প্রতি চরম অবজ্ঞা বলে মনে করেন। সুধী সমাজ এবং একই সঙ্গে দলীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানার পর ৫ ডিসেম্বর বিএনপির পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ব্যারিস্টার মওদুদের ওই সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে কিছু 'ভুল' ছাপার জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়। দলের দপ্তর সম্পাদক স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে কথা ঘুরিয়ে বলা হয়, সংবাদ সম্মেলনে কিছু অপঠিত শব্দসংবলিত লিখিত বিবৃতিটি সাংবাদিকদের মধ্যে বিলি করা হয়। ওদিকে বিএনপির বেশ কয়েকজন ক্ষুব্ধ নেতা পত্রিকায় তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, দলের হাইকমান্ড একটি 'গুরুতর ভুল' সিদ্ধান্ত নিয়েছে (সমকাল, ৬ ডিসেম্বর ২০১১)। তাঁরা আরো মন্তব্য করেন, 'যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের বিচারপ্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল বিএনপির। এ সিদ্ধান্তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভিযোগটিই প্রমাণ হলো, বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না।' তাঁরা আরো বলেন, 'এই ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ হয়, বিএনপি জামায়াতের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। কার্যত জামায়াতের ফাঁদে পা দিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। এ জন্য বিএনপিকে অনেক মাসুল দিতে হতে পারে।' দলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মীর মতামত উপেক্ষা করেই জামায়াতে ইসলামীর চাপের কাছে হার মেনে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিল বিএনপি হাইকমান্ড।...আগামী নির্বাচনে জামায়াতের ভোটব্যাংকের প্রতি সুনজর রয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের (একই তারিখের ওই পত্রিকা)।
প্রসঙ্গত, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে এ রকম বক্তব্য দিলে কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি কেউ সমর্থন জানালে তাকে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হতো। বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ দূতের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তো এসব বিষয়ে কথা বলারই অধিকার নেই; কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সদস্য নয় তারা। তাদের বক্তব্য আমাদের বিবেচনায় নেওয়ার দরকার নেই, বরং আমাদের দেশের আইনই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সঠিক পথে চলছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, আমাদের এই কলামে গত ২৪ নভেম্বরের লেখাটায় (যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আরো সতর্কতা জরুরি) আমরা ব্রিটিশ আইনজীবীদের আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার অভিযোগ তুলে ধরেছিলাম, যাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে 'সিভিল ওয়ার' বা 'গৃহযুদ্ধ' বলে অবমূল্যায়ন করে বাইরের মিডিয়ায় প্রচার করছেন এবং এ ট্রাইব্যুনালের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। বিদেশিদের এসব প্রশ্ন আমাদের আমলে নেওয়ার বাস্তবিকই কোনো প্রয়োজন নেই।
ড. মিজানুর রহমান
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান যথার্থই বলেছেন, আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট-১৯৭৩ অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের। তিনি এও বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এখন বাধা হচ্ছে রাজনীতি ও অর্থ। এই বিচারকে দীর্ঘায়িত করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে 'লবিস্ট' নিয়োগ করেছে একটি রাজনৈতিক দল। তাদের প্রচারণায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চলছে।
ওয়ার্কার্স পার্টি
ইতিমধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোও বিএনপির কঠোর সমালোচনা করেছে। ট্রাইব্যুনাল বাতিলের বিএনপির দাবিকে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ, অসংযত ও ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছে।
ইনু
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বলেছেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জাতির জন্য অগি্নপরীক্ষা। এ পরীক্ষায় জিততে না পারলে দেশ গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।' যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার অপরাধে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে গ্রেপ্তার করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন (একই তারিখের সমকাল)।
'অন্ধকারের একশ বছর' পড়ে দেখুন
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ায় আমরা যদি কালক্ষেপণ করি কিংবা বিচারপ্রক্রিয়া যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে আমরা সত্যিই কথাশিল্পী আনিসুল হকের বিখ্যাত উপন্যাস 'অন্ধকারের একশ বছর'-এ প্রদর্শিত ভয়াবহ পরিণতিরই সম্মুখীন হব। উপন্যাসটি এই সংকট-মুহূর্তে পড়ে দেখার জন্য সবার প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।
ইতিহাস সাক্ষী
বিশ্ব ইতিহাসে দেখা যাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল টোকিও ট্রায়ালে ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত রাসেল ট্রায়াল, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল, সাম্প্রতিককালের রুয়ান্ডা ট্রায়াল, বসনিয়া ট্রায়াল, কম্বোডিয়া ট্রায়ালসহ পৃথিবীর কোথাও কোনো যুদ্ধাপরাধ ট্রায়ালেই যুদ্ধাপরাধীরা রেহাই পায়নি। টোকিও ট্রায়ালে সম্রাট হিরোহিতোকে বার্ধক্যহেতু অনুকম্পা প্রদর্শন নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। চিলির একনায়ক অগাস্তো পিনোশের যুদ্ধাপরাধের বিচার করে তাঁকে দণ্ডদানের আগেই আটকাবস্থায় তাঁর মৃত্যু ঘটে। সেখানে একনায়ক ফ্রাঙ্কোর বীভৎস গণহত্যার সাক্ষ্যপ্রমাণ দীর্ঘকাল পর আক্ষরিক অর্থে মাটি খুঁড়ে অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল-করোটি উদ্ধারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করে যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ইতিহাস যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধী, গণহত্যার নায়কদের ক্ষমা করেনি, এখানেও ক্ষমা করা হবে না। সব জায়গায় এভাবেই অর্জিত স্বাধীনতা ও বিজয়কে সংহত করা হয়েছে।
আজ এ দেশের যাঁরাই একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এ দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসলে, এ দেশের স্বাধীনতাকে ভালোবাসলে তাঁদের সামনে, তাঁদের সন্তান-সন্ততির সামনে এ দেশকে যুদ্ধাপরাধমুক্ত করা ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। শুধু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগই নয়, সব বাম সংগঠন, বিএনপিসহ সব জাতীয়তাবাদী সংগঠন, সব দলেরই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের, তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের দেশমাতৃকা ও পূর্বপুরুষের রক্তঋণ শোধ করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদানের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ ও আপসহীন থাকতে হবে। প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়াতে হবে নিজ দলের হাইকমান্ডের, ডাব্ল স্ট্যান্ডার্ড আপসকামিতা ও সুবিধাবাদিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি জাতীয় বিষয়_কোনো দলীয় রাজনৈতিক বিষয় নয়। ভারতসহ সব সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশেই জাতীয় প্রশ্নে সরকারি ও বিরোধী দল_সবাই, গোটা জাতিই একই অবস্থানে এবং ঐক্যবদ্ধ থাকে। এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটলে চলবে না। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সে চেতনা ও উপলব্ধি থেকেই দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম বিএনপির ডাকা হরতাল কিংবা দ্রব্যমূল্য, টিপাইমুখ বাঁধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিক্ষোভ-আন্দোলনের যৌক্তিকতা সত্ত্বেও সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে এখনো বহুলাংশে বিরত রয়েছে। তারা মনে করে, আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করতে দিতে হবে। হরতাল-আন্দোলনের সুযোগ অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমাপ্ত না হলে দেশ ও গণতন্ত্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। তারা তাই দাঁড়াবে ইতিহাসের পক্ষে, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে।
৭.১২.২০১১
প্রসঙ্গত, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে এ রকম বক্তব্য দিলে কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি কেউ সমর্থন জানালে তাকে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন হতে হতো। বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ দূতের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের তো এসব বিষয়ে কথা বলারই অধিকার নেই; কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সদস্য নয় তারা। তাদের বক্তব্য আমাদের বিবেচনায় নেওয়ার দরকার নেই, বরং আমাদের দেশের আইনই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে সঠিক পথে চলছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, আমাদের এই কলামে গত ২৪ নভেম্বরের লেখাটায় (যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আরো সতর্কতা জরুরি) আমরা ব্রিটিশ আইনজীবীদের আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে না দেওয়ার অভিযোগ তুলে ধরেছিলাম, যাঁরা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে 'সিভিল ওয়ার' বা 'গৃহযুদ্ধ' বলে অবমূল্যায়ন করে বাইরের মিডিয়ায় প্রচার করছেন এবং এ ট্রাইব্যুনালের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। বিদেশিদের এসব প্রশ্ন আমাদের আমলে নেওয়ার বাস্তবিকই কোনো প্রয়োজন নেই।
ড. মিজানুর রহমান
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান যথার্থই বলেছেন, আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট-১৯৭৩ অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের। তিনি এও বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এখন বাধা হচ্ছে রাজনীতি ও অর্থ। এই বিচারকে দীর্ঘায়িত করতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে 'লবিস্ট' নিয়োগ করেছে একটি রাজনৈতিক দল। তাদের প্রচারণায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চলছে।
ওয়ার্কার্স পার্টি
ইতিমধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোও বিএনপির কঠোর সমালোচনা করেছে। ট্রাইব্যুনাল বাতিলের বিএনপির দাবিকে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ, অসংযত ও ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছে।
ইনু
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বলেছেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জাতির জন্য অগি্নপরীক্ষা। এ পরীক্ষায় জিততে না পারলে দেশ গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।' যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার অপরাধে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে গ্রেপ্তার করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন (একই তারিখের সমকাল)।
'অন্ধকারের একশ বছর' পড়ে দেখুন
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ায় আমরা যদি কালক্ষেপণ করি কিংবা বিচারপ্রক্রিয়া যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে আমরা সত্যিই কথাশিল্পী আনিসুল হকের বিখ্যাত উপন্যাস 'অন্ধকারের একশ বছর'-এ প্রদর্শিত ভয়াবহ পরিণতিরই সম্মুখীন হব। উপন্যাসটি এই সংকট-মুহূর্তে পড়ে দেখার জন্য সবার প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।
ইতিহাস সাক্ষী
বিশ্ব ইতিহাসে দেখা যাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল টোকিও ট্রায়ালে ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত রাসেল ট্রায়াল, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল, সাম্প্রতিককালের রুয়ান্ডা ট্রায়াল, বসনিয়া ট্রায়াল, কম্বোডিয়া ট্রায়ালসহ পৃথিবীর কোথাও কোনো যুদ্ধাপরাধ ট্রায়ালেই যুদ্ধাপরাধীরা রেহাই পায়নি। টোকিও ট্রায়ালে সম্রাট হিরোহিতোকে বার্ধক্যহেতু অনুকম্পা প্রদর্শন নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। চিলির একনায়ক অগাস্তো পিনোশের যুদ্ধাপরাধের বিচার করে তাঁকে দণ্ডদানের আগেই আটকাবস্থায় তাঁর মৃত্যু ঘটে। সেখানে একনায়ক ফ্রাঙ্কোর বীভৎস গণহত্যার সাক্ষ্যপ্রমাণ দীর্ঘকাল পর আক্ষরিক অর্থে মাটি খুঁড়ে অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল-করোটি উদ্ধারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করে যথাযথ ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ইতিহাস যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধী, গণহত্যার নায়কদের ক্ষমা করেনি, এখানেও ক্ষমা করা হবে না। সব জায়গায় এভাবেই অর্জিত স্বাধীনতা ও বিজয়কে সংহত করা হয়েছে।
আজ এ দেশের যাঁরাই একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, এ দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবাসলে, এ দেশের স্বাধীনতাকে ভালোবাসলে তাঁদের সামনে, তাঁদের সন্তান-সন্ততির সামনে এ দেশকে যুদ্ধাপরাধমুক্ত করা ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। শুধু মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগই নয়, সব বাম সংগঠন, বিএনপিসহ সব জাতীয়তাবাদী সংগঠন, সব দলেরই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের, তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের দেশমাতৃকা ও পূর্বপুরুষের রক্তঋণ শোধ করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিদানের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ ও আপসহীন থাকতে হবে। প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়াতে হবে নিজ দলের হাইকমান্ডের, ডাব্ল স্ট্যান্ডার্ড আপসকামিতা ও সুবিধাবাদিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি জাতীয় বিষয়_কোনো দলীয় রাজনৈতিক বিষয় নয়। ভারতসহ সব সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশেই জাতীয় প্রশ্নে সরকারি ও বিরোধী দল_সবাই, গোটা জাতিই একই অবস্থানে এবং ঐক্যবদ্ধ থাকে। এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটলে চলবে না। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সে চেতনা ও উপলব্ধি থেকেই দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম বিএনপির ডাকা হরতাল কিংবা দ্রব্যমূল্য, টিপাইমুখ বাঁধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিক্ষোভ-আন্দোলনের যৌক্তিকতা সত্ত্বেও সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে এখনো বহুলাংশে বিরত রয়েছে। তারা মনে করে, আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করতে দিতে হবে। হরতাল-আন্দোলনের সুযোগ অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সমাপ্ত না হলে দেশ ও গণতন্ত্রের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। তারা তাই দাঁড়াবে ইতিহাসের পক্ষে, ন্যায় ও সত্যের পক্ষে।
৭.১২.২০১১
No comments