কূটনীতিকদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য by শাহজাহান মিয়া
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দীর্ঘ ৬৪
কার্যদিবসের পর সংসদে গেলেও না না ছলছুতায় প্রায় নিয়মিত ওয়াকআউট করেছে।
অকারণ ইস্যু সৃষ্টি করে বা ইস্যু তুলে আন্দোলনের নামে রাজনীতির মাঠ গরম
করতে আদা জল খেয়ে লেগেছে।
আর তাদের সব অপকর্মের সাথী ও
বিশ্বস্ত সহচর জামায়াতে ইসলামী অবশ্য দেশে চরম অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা
সৃষ্টি করে এ মুহূর্তে তাদের একমাত্র লক্ষ যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
বাধাগ্রস্ত করা-তা বুঝতে আর কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বিএনপির অবশ্য
তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভাষায় তাঁর 'সোনার ছেলে' এবং বর্তমানে দলের
সিনিয়র সহ-সভাপতি তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত
করাই প্রধান উদ্দেশ্য। তাই দল দু'টি তাদের লক্ষ বাসত্মবায়নে প্রচ-ভাবে
তৎপর হয়ে উঠছে। দেশের পরিস্থিতি টালমাটাল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে তার
সুযোগ নিয়ে যে কোন মূল্যে উদ্দেশ্য হাসিলই তাদেরও প্রধান টার্গেট। খালেদা
জিয়ার গুলশান অফিসের সামনে বোমা ফেলা, দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অরাজক
পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পর পর কয়েকটি হত্যাকা- ঘটানো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে পাহাড়ী-বাঙালী
সংঘর্ষ বাধিয়ে দিয়ে গত বছর বিডিআর সদর দফতর পিলখানায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের
মতো ২০১০ সালেও ফেব্রুয়ারিতেও অনুরূপ কোন হত্যাকা- ঘটিয়ে দিয়ে সরকারকে
বেসামাল অবস্থায় ফেলে দিয়ে তার পুরো ফায়দা লোটাই ছিল তাদের গভীর চক্রান্তের
লক্ষ্য। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, নানামুখী অপতৎরতা ও ঘৃণ্য পরিবেশ
সৃষ্টির অপচেষ্টার মধ্যে বাংলাদেশে পাকিস্তানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের এ
দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য
পরিস্থিতিকে বেশ উত্তেজনাকর করে তুলেছে। কূটনীতির সব আচার-আচরণ, রীতি-নীতি ও
শিষ্টাচার বিবর্জিত বক্তব্য ইতোমধ্যেই দেশের মানুষের মধ্যে তীব্র
প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আশরাফ কোরেইশী গত ২৫
ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল
কায়েসের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ১৯৭৪ সালে
পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বারিত ত্রিপীয় চুক্তির মাধ্যমে
যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, ''এ বিষয়ে
আমরা আগের অবস্থানেই রয়েছি।" আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধীদের
বিচারের বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের কাছে বর্তমান সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা
পাকিসত্মানের হাইকমিশনারকে অত্যনত্ম দৃঢ়ভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরও
বলে দিয়েছেন যে, ''সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান মেনে সুষ্ঠু বিচারিক
প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার নিজ নাগরিকদের বিচার করবে।" আইনমন্ত্রী
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে পাকিস্তানী
রাষ্ট্রদূত আশরাফ কোরেইশীর বক্তব্যকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত এবং
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের শামিল বলে অভিহিত করেছেন।
দেশের দু'জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীই শুধু এ বিষয়ে তাঁদের তীব্র প্রতিক্রিয়া
ব্যক্ত করেননি, দেশের স্বাধীনতার পরে সর্বস্তরের মানুষসহ বিভিন্ন মহলেও
তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতের এ ধরনের বক্তব্যের
জন্য তাকে এ দেশ থেকে বহিষ্কার করার মতো কথাও উঠেছে। তবে এ রকম উস্কানিমূলক
মনত্মব্য সর্বত্র ক্ষেত্রে-বিক্ষোভের সৃষ্টি করলেও এ দেশে পাকিসত্মান ও
পাকিস্তানীদের সব সময়ের পরীতি ও বিশ্বস্ত বন্ধু এবং আস্থাভাজন বলে পরিচিত
দু'টি বিশেষ মহলে এ বিষয়ে কোনরূপ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই। কারণ, এ দেশে
বিএনপি এবং জামায়াত শুধু পাকিস্তানী ধ্যান-ধারণা লালন ও তাদের আদর্শই রা
করছে না তা পরিপূর্ণভাবে ধারণ ও লালন-পালন করে এ দেশের একশ্রেণীর মানুষের
মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে তা মজবুত করার প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে অব্যাহত
ধারায়। এর আগেও ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার
ইরফান-উর-রাজাও ২০০০ সালের ২৭ নবেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব
ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস)-এ বাংলাদেশের
পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক এক সেমিনারে অংশ নিয়ে বাঙালী জাতি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ
এবং জনগণের সর্বোচ্চ ত্যাগ সম্পর্কে চরম অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য করেছিল। সে
বার রাজা বলেছিল, '১৯৭১ সালে পাকিস্তানের এই অংশে পাকিস্তানী সৈন্যদের
নৃশংসতার যে কথা বলা হয়, তা আসলে শুরু করেছিল আওয়ামী লীগের দুষ্কৃতকারীরা।'
সেমিনারে বক্তৃতাকালে বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানী এবং একাত্তরের
বর্বরতার জন্য মা প্রার্থনা প্রশ্নে নির্লজ্জ প্রকৃতির ঐ কূটনীতিক পাল্টা
প্রশ্ন করেছিল, 'কিসের মা?' একাত্তরের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী
সৈন্যদের হাতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ৩০ লাখ বাঙালী হত্যার কথা বেমালুম
অস্বীকার এবং এই সংখ্যা ২৩ হাজার বলে দাবি করেছিল। পাকিস্তানী কূটনীতিকের
এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তিতে সারাদেশে তখন প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কিন্তু
বিএনপিসহ চারদলীয় ঐক্য জোটের অপর তিন দলও ছিল একেবারে নিশ্চুপ। তাদের
রহস্যময় নীরবতায় সবাই হয়েছিল স্তম্ভিত। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করতে
চাই, পাকিস্তানর সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০০ সালের
সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে উন্নত সম্পর্কের শর্তে ১৯৭১
সালের ঘটনাবলী ভুলে যাওয়ার জন্য বাঙালী জাতিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ১৯৭১
সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্মম গণহত্যা, ধর্ষণ ও
আরও অন্যান্য বর্বর কর্মকাণ্ডের জন্য প্রত্যাশিত মা প্রার্থনার কথা তিনি
ভুলে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষকে তিনি সব ভুলে যাওয়ার জন্য অনুরোধও
করেননি। পরামর্শ দিয়েছিলেন। ঐ সময়ে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী
ইরফান রাজা কূটনীতিক পরিচয়ের অন্তরালে পাকিস্তানী আইএসআই-এর একজন এজেন্ট
হিসেবে বিভিন্ন অপতৎপরতায় জড়িয়ে পড়েছিল।
গত বছর মহাজোট সরকার মতা গ্রহণের পর পরই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত সালমান ইস্পাহানি ঢাকায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে পাকিস্তানের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়ে যান। ২০০৯ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের একজন অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ খালিদ বেশ হুঁশিয়ারির সুরেই বলেছিলেন যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এ বিষয়ে তখন এ দেশের পত্র-পত্রিকায় সংবাদ বেরুলেও মন্ত্রিসভার কোন কোন সদস্য তা অস্বীকার করেছিলেন। পাকিস্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল বা ঠাণ্ডা যাই হোক না কেন সে বিষয়ে আমাদের কোন ছাড় দেয়ার অবকাশ আছে কি? এটা এ সরকারও বলছেন। পাকিস্তান জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তদ্বির করে বাংলাদেশের ওপর যত চাপ সৃষ্টিই করম্নক না কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। আমাদের দেশের দু'টি দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত বলতে চেয়েছেন যে, ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা ও সৈন্যকে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদের সিমলা চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। পাকিস্তানী বলেই তাদের পাকিস্তানের কাছে দেয়া হয়েছিল সিমলা চুক্তির আওতায় তাদের বিচার করবে বলে। কিন্তু পাকিসত্মান কর্তৃপ সে বিচারও করেনি। তাই বলে বাংলাদেশের নাগরিক যারা যুদ্ধাপরাধের মতো গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত এদেশে তাদের বিচারে বাধা কোথায়?
এদিকে চট্টগ্রামে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাইকমিশনার একে গোস্বামীর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে অত্যন্ত অনভিপ্রেতভাবে শিষ্টাচার বহির্ভূত ও কদর্য মন্তব্য বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এই কূটনীতিকের কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এখন তোলপাড়। সে ঢেউ সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। এ কূটনীতিককে প্রত্যাহারের দাবিও উঠেছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আঞ্চলিক ও দ্বিপাকি বাণিজ্য প্রসার এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির ল্যে চট্টগ্রাম চেম্বার আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ভারতীয় কূটনীতিক অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এ মন্তব্য করেছিলেন। দু'দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের বৈঠকে সঙ্গতভাবেই ভারতের ভিসা প্রাপ্তি সহজীকরণের জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা দাবি তোলেন। কিন্তু গোস্বামী বাবু বলেন যে, ট্রানজিট আর ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে ভিসার কথা আসবে কেন তিনি বলে ফেলেন, ''শেখ মুজিবের মতো বক্তৃতাবাজি করলে হবে না।" নাম দেখে মনে হয় ভদ্রলোক ভারতীয় বাঙালীই হবেন। এদেশের অনেকেই বিস্ময়ে হতবাক যে এই লোকটি পাকিসত্মানী কায়দায় কি করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এ রকম বালখিল্য মন্তব্য করে বসলেন ! অনেকের মনেই এ প্রশ্নটি প্রচ-ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। সভার সভাপতি চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রধান এমএ লতিফ এমপিসহ উপস্থিত সবাই এ মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সভায় উপস্থিত ভারতের আসাম রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পি বোরদোলই এবং ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী জিতেন্দ্র চৌধুরীর হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত শান্ত হয় বলে জানা যায়। এ কথা তো ঠিক যে ভারতীয় ভিসা পেতে এখন বেশ কষ্ট ও হয়রানির শিকার হতে হয়। বন্ধুপ্রতীম দেশটির ভিসা পেতে এতটা বিড়ম্বনায় পড়তে হবে কেন?
দাতাসংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাঙ্গামাটিতে সহিংসতা ও এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগের দ্রুত, পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন তদন্তে দাবি করেছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে সংস্থাটির মুখপাত্র ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাথরিন এ্যাশটন এক বিবৃতিতে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, রাঙ্গামাটির বাঘাইহাটিতে আদিবাসীদের হত্যা এবং তাদের প্রায় চার শ' ঘর পোড়ানো হয়েছে। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় ঘটনার সঙ্গে সেনাসদস্য ও সেনাবাহিনীর শ্রমিকরা অংশ নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ইইউ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনারও আহ্বান জানায়। কিছু শক্ত শব্দের সমন্বয়ে নির্মিত এবং একটি দাতা সংস্থার তরফ থেকে প্রদত্ত বিবৃতিটিকে নিঃসন্দেহে একটি দেশের অভ্যনত্মরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল বলেই মনে হবে। সঙ্গতকারণেই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত ড. স্টিফেন ফ্রোয়েনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস ঘটনা সম্পর্কে ইইউর মনত্মব্যকে অত্যন্ত দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক অভিহিত করে তাকে একটি প্রতিবাদলিপি প্রদান করেন। আসলে প্রকৃত ঘটনা না জেনে না শুনে কোন ধারণা থেকে ইইউর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা থেকে এরূপ বিবৃতি প্রদান পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের উৎসাহ যোগাবে। যখন বর্তমান সরকার শানত্মি চুক্তি বাস্তবায়নে পদপে নিচ্ছে, ঠিক তখন এ ধরনের বিবৃতি চুক্তি বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি এবং পাহাড়ে জনজীবন অস্থিতিশীল করতে সহায়ক হবে বলেই অনেকের ধারণা। দাতা সংস্থাকে ত্রাতা সংস্থারূপে আবির্ভূত হওয়ার মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়েই সংশিস্নষ্ট দেশে সহায়তাদানে ব্রতী হতে হবে। এটা ঠিক যে বাংলাদেশে পাকিস্তানের কিছু পরীতি বন্ধু রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের এই অংশে পাকিস্তানীদের মার অযোগ্য দুষ্কর্মের বিশ্বস্ত সাথী হয়েছিল।
এদেশে তথাকথিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত একটি দলের অনেক নেতা-নেত্রীও পাকিস্তান পছন্দ রোগে মারাত্মকভাবে আক্রানত্ম। তাই পাকিসত্মানী কূটনীতিকরা কূটনৈতিক রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও শিষ্টাচার ভুলে গিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিতে উৎসাহিত বোধ করতেই পারেন। সেটা অনভিপ্রেত হলেও সবারই বোধগম্য। কিন্তু প্রতিবেশী ভারতীয় কূটনীতিকের কাছ থেকে বাংলাদেশের জাতির জনক সম্পর্কে এ রকম ধৃষ্টতাপূর্ণ মনত্মব্য দেশের মানুষকে হতবাক করেছে। কারণ এদেশের মানুষ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সব সময়ই আগ্রহী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামপ্রতিক ভারত সফরকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দু' দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে মাইলফলক বলে উল্লেখ করেছেন। বর্তমান সরকার নিশ্চয়ই দেশের অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ রয়েছেন। এ বিষয়ে সরকার যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেই সবাই আশাবাদী।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
গত বছর মহাজোট সরকার মতা গ্রহণের পর পরই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত সালমান ইস্পাহানি ঢাকায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে পাকিস্তানের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়ে যান। ২০০৯ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের একজন অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ খালিদ বেশ হুঁশিয়ারির সুরেই বলেছিলেন যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হলে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এ বিষয়ে তখন এ দেশের পত্র-পত্রিকায় সংবাদ বেরুলেও মন্ত্রিসভার কোন কোন সদস্য তা অস্বীকার করেছিলেন। পাকিস্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল বা ঠাণ্ডা যাই হোক না কেন সে বিষয়ে আমাদের কোন ছাড় দেয়ার অবকাশ আছে কি? এটা এ সরকারও বলছেন। পাকিস্তান জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তদ্বির করে বাংলাদেশের ওপর যত চাপ সৃষ্টিই করম্নক না কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠান মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। আমাদের দেশের দু'টি দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত বলতে চেয়েছেন যে, ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা ও সৈন্যকে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদের সিমলা চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। পাকিস্তানী বলেই তাদের পাকিস্তানের কাছে দেয়া হয়েছিল সিমলা চুক্তির আওতায় তাদের বিচার করবে বলে। কিন্তু পাকিসত্মান কর্তৃপ সে বিচারও করেনি। তাই বলে বাংলাদেশের নাগরিক যারা যুদ্ধাপরাধের মতো গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত এদেশে তাদের বিচারে বাধা কোথায়?
এদিকে চট্টগ্রামে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাইকমিশনার একে গোস্বামীর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে অত্যন্ত অনভিপ্রেতভাবে শিষ্টাচার বহির্ভূত ও কদর্য মন্তব্য বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এই কূটনীতিকের কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে এখন তোলপাড়। সে ঢেউ সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। এ কূটনীতিককে প্রত্যাহারের দাবিও উঠেছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আঞ্চলিক ও দ্বিপাকি বাণিজ্য প্রসার এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির ল্যে চট্টগ্রাম চেম্বার আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় ভারতীয় কূটনীতিক অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এ মন্তব্য করেছিলেন। দু'দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধি দলের বৈঠকে সঙ্গতভাবেই ভারতের ভিসা প্রাপ্তি সহজীকরণের জন্য বাংলাদেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা দাবি তোলেন। কিন্তু গোস্বামী বাবু বলেন যে, ট্রানজিট আর ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে ভিসার কথা আসবে কেন তিনি বলে ফেলেন, ''শেখ মুজিবের মতো বক্তৃতাবাজি করলে হবে না।" নাম দেখে মনে হয় ভদ্রলোক ভারতীয় বাঙালীই হবেন। এদেশের অনেকেই বিস্ময়ে হতবাক যে এই লোকটি পাকিসত্মানী কায়দায় কি করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এ রকম বালখিল্য মন্তব্য করে বসলেন ! অনেকের মনেই এ প্রশ্নটি প্রচ-ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। সভার সভাপতি চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রধান এমএ লতিফ এমপিসহ উপস্থিত সবাই এ মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সভায় উপস্থিত ভারতের আসাম রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পি বোরদোলই এবং ত্রিপুরার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী জিতেন্দ্র চৌধুরীর হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত শান্ত হয় বলে জানা যায়। এ কথা তো ঠিক যে ভারতীয় ভিসা পেতে এখন বেশ কষ্ট ও হয়রানির শিকার হতে হয়। বন্ধুপ্রতীম দেশটির ভিসা পেতে এতটা বিড়ম্বনায় পড়তে হবে কেন?
দাতাসংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাঙ্গামাটিতে সহিংসতা ও এর সঙ্গে সেনাবাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগের দ্রুত, পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন তদন্তে দাবি করেছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে সংস্থাটির মুখপাত্র ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাথরিন এ্যাশটন এক বিবৃতিতে ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, রাঙ্গামাটির বাঘাইহাটিতে আদিবাসীদের হত্যা এবং তাদের প্রায় চার শ' ঘর পোড়ানো হয়েছে। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় ঘটনার সঙ্গে সেনাসদস্য ও সেনাবাহিনীর শ্রমিকরা অংশ নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ইইউ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনারও আহ্বান জানায়। কিছু শক্ত শব্দের সমন্বয়ে নির্মিত এবং একটি দাতা সংস্থার তরফ থেকে প্রদত্ত বিবৃতিটিকে নিঃসন্দেহে একটি দেশের অভ্যনত্মরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল বলেই মনে হবে। সঙ্গতকারণেই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত ড. স্টিফেন ফ্রোয়েনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস ঘটনা সম্পর্কে ইইউর মনত্মব্যকে অত্যন্ত দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক অভিহিত করে তাকে একটি প্রতিবাদলিপি প্রদান করেন। আসলে প্রকৃত ঘটনা না জেনে না শুনে কোন ধারণা থেকে ইইউর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা থেকে এরূপ বিবৃতি প্রদান পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারীদের উৎসাহ যোগাবে। যখন বর্তমান সরকার শানত্মি চুক্তি বাস্তবায়নে পদপে নিচ্ছে, ঠিক তখন এ ধরনের বিবৃতি চুক্তি বাস্তবায়নে বাধার সৃষ্টি এবং পাহাড়ে জনজীবন অস্থিতিশীল করতে সহায়ক হবে বলেই অনেকের ধারণা। দাতা সংস্থাকে ত্রাতা সংস্থারূপে আবির্ভূত হওয়ার মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়েই সংশিস্নষ্ট দেশে সহায়তাদানে ব্রতী হতে হবে। এটা ঠিক যে বাংলাদেশে পাকিস্তানের কিছু পরীতি বন্ধু রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের এই অংশে পাকিস্তানীদের মার অযোগ্য দুষ্কর্মের বিশ্বস্ত সাথী হয়েছিল।
এদেশে তথাকথিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত একটি দলের অনেক নেতা-নেত্রীও পাকিস্তান পছন্দ রোগে মারাত্মকভাবে আক্রানত্ম। তাই পাকিসত্মানী কূটনীতিকরা কূটনৈতিক রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও শিষ্টাচার ভুলে গিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিতে উৎসাহিত বোধ করতেই পারেন। সেটা অনভিপ্রেত হলেও সবারই বোধগম্য। কিন্তু প্রতিবেশী ভারতীয় কূটনীতিকের কাছ থেকে বাংলাদেশের জাতির জনক সম্পর্কে এ রকম ধৃষ্টতাপূর্ণ মনত্মব্য দেশের মানুষকে হতবাক করেছে। কারণ এদেশের মানুষ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সব সময়ই আগ্রহী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামপ্রতিক ভারত সফরকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দু' দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে মাইলফলক বলে উল্লেখ করেছেন। বর্তমান সরকার নিশ্চয়ই দেশের অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ রয়েছেন। এ বিষয়ে সরকার যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেই সবাই আশাবাদী।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments