সিমেন্সের সেই উৎকোচ ॥ খোঁজ মিলেছে পাচারের by খায়রুল হোসেন রাজু
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির
চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো সিমেন্সকে কাজ
পাইয়ে দেবার জন্য ঘুষ গ্রহণ করেছিলেন।
ওই ঘুষের অর্থ
পাচার করেছিলেন। পাচার করা অর্থের খোঁজ পাওয়া গেছে বলে আমেরিকার কর্তৃপক্ষ
বাংলাদেশকে জানিয়েছে এবং কিছু বিধিমালার ভেতর দিয়ে অচিরেই এ অর্থ ফেরত আনার
ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বার্তা সংস্থা এনাকে জানিয়েছেন,
তিনি ওই পাচারকৃত অর্থ ফেরত নেবার জন্য আমেরিকান প্রশাসনের সহায়তা
চেয়েছেন। অন্যদিকে আইনমন্ত্রীর সফরসঙ্গী বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর দেশে
ফিরে এসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন, পাচারকৃত অর্থের খোঁজ পাওয়া
গেছে। ইন্টারন্যাশনাল এগমন্ট গ্রম্নপের সদস্য হবার পরে এ অর্থ ফেরত আনা সহজ
হবে। সদস্য হবার প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, খোঁজ
পাওয়া এ অর্থ জার্মান কোম্পানি সিমেন্সকে কাজ পাইয়ে দেবার জন্য কোকো যে
ঘুষ নিয়েছিল, সেটাই।
সিমেন্স-বাংলাদেশকে কাজ পাইয়ে দিতে কোকো ১ কোটি ২৬ লাখ ডলার ঘুষ গ্রহণ করে পাচার করেন। এ পাচারের সঙ্গে তারেক রহমানও জড়িত রয়েছে। পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের পরেই তাঁদের বিরম্নদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে বলে অইনমন্ত্রী নিশ্চিত করেন।
জানা গেছে, জার্মান বহুজাতিক কোম্পানি সিমেন্স এজির স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সিমেন্স-বাংলাদেশকে কাজ পাইয়ে দিতে কোকো ১ কোটি ২৬ লাখ ডলার ঘুষগ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কোকোর পাচারকৃত এ অর্থের কথা স্বীকার করেছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সফর করে দেশে ফিরে পাচার করা অর্থের খোঁজ পাওয়া গেছে এটা নিশ্চিত করেন। তিনি রবিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের পাচার হওয়া অর্থের কথা তুলে ধরেন।
দেশ থেকে বিভিন্ন সময় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, গবর্নর ড. আতিউর রহমান ও এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। গবর্নর দেশে ফিরলেও আইনমন্ত্রী ও এ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাঁরা তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোসহ আরও অনেক দুনর্ীতিবাজের পাচারকৃত অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আনত্মরিক সহায়তা চেয়েছেন বলেও জানা গেছে। পাচারকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধারের পরেই তারেক রহমান ও কোকোর বিরম্নদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। জানা গেছে, সিমেন্স-বাংলাদেশকে অর্থের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী নির্ধারিত সময় অনুযায়ী কোকোকে টাকা দেয়া হয়নি বলে কোকো অভিযোগ করলে অতিরিক্ত অর্থ হিসেবে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর সিঙ্গাপুরের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে এ অর্থ জমা দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরে কোকোর ব্যাংক হিসেবে যে ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছিল তার মধ্যে এ টাকাও আছে বলে জানা গেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের সরকারী মোবাইল ফোন কোম্পানি টেলিটক প্রকল্পের কাজ পায় সিমেন্স ৫৩ লাখ ডলার ঘুষ দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইতালির তদন্ত এবং সিমেন্স এজির নিজস্ব তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার লৰ্যে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মানিলন্ডারিং পলিসি জোরদার করাসহ ইন্টারন্যাশনাল এগমন্ট গ্রম্নপের সদস্য হওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে। এ লৰ্যে গত সপ্তাহে গবর্নর ড. আতিউর রহমান, এ্যাটর্নি জেনারেল এবং আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। ওই সফর থেকে গবর্নর দেশে ফিরে এলেও এ্যাটর্নি জেনারেল এবং ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন। নিউইয়র্কে এক মতবিনিময় সমাবেশে বার্তা সংস্থা এনার প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, তারেক রহমান, আরাফাত রহমানসহ আরও অনেক দুনর্ীতিবাজের পাচারকৃত অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আনত্মরিক সহায়তা চাইতে আমি ওয়াশিংটন ডিসি সফর করলাম। এদের পাচারকৃত বিপুল পরিমাণের অর্থ উদ্ধারের পরেই মামলা দায়ের করা হবে। তিনি আরও বলেন, প্রশাসন ও রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করার লৰ্যেই মানুষ মহাজোট সরকারকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। আমরা মানুষের সে আকাঙ্ৰাই বাস্তবায়ন করছি।
এদিকে সিমেন্স ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই টেলিটক মোবাইল ফোন প্রকল্পের কাজ পেতে চেষ্টা করে। এজন্য ফজলে সেলিম ও জুলফিকার নামের দু'জনকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয় সিমেন্স-বাংলাদেশ। ২০০১ সালের ২৭ মার্চ সিমেন্স ইতালির বাণিজ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা এবং ওই দু'পরামর্শকের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সে চুক্তি সফল হয়নি। এক পর্যায়ে বিটিটিবির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে টেলিটক প্রকল্পটির জন্য তিনবার খোলা দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু তিনবারই অংশ নেয় সিমেন্স-বাংলাদেশ। এতে অংশ নিয়ে কারিগরি অযোগ্যতার কারণে বাদ পড়ে সিমেন্স। পরবতর্ী সময়ে পুরো প্রক্রিয়াটিই অবশ্য বাতিল করা হয়। দ্বিতীয়বার ২০০১ সালে দরপত্র আহ্বান করা হলে তালিকায় নাম ওঠে সিমেন্সের। কিন্তু সদ্য ৰমতায় বসা তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার তা বাতিল করে দেয়। অর্থের পরিমাণ পরিবর্তন করে ও সরবরাহকারীর সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে তৃতীয় দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০০২ সালে। কিন্তু ২০০২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সিমেন্স ওই দরপত্রে যথাযথভাবে সনদ দেখাতে না পারায় আবার অকৃতকার্য হয়। ওই সময় সিমেন্স মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তিকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়। একই সঙ্গে আগের দু'পরামর্শককে বাদ দেয়। নতুন পরামর্শক হন তৎকালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের বেয়াই। এরপর ২০০৩ সালের শেষ দিকে ব্যারিস্টার আমিনুল হক বিটিটিবির প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দরপত্র সচল করতে সৰম হন। একই সঙ্গে মন্ত্রী এ সময় সিমেন্সের প্রস্তাব সরাসরি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠাতে বলেন। ২০০৪ সালের ২৬ জানুয়ারি ক্রয় কমিটি সিমেন্সের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ব্যারিস্টার আমিনুল হক এ সময় খালেদ শামসকে জানান, তিনি সিমেন্সকে একটি ভাল অবস্থানে আনার জন্য বিষয়টি দেশের শীর্ষস্তরে নিয়ে যেতে চান।
মার্কিন আইন সংস্থার তদন্তে জানা যায়, ওই সময়ই আরাফাত রহমান কোকো নির্দিষ্ট কমিশনের বিপরীতে সিমেন্সকে ওই অবস্থান থেকে উদ্ধার করার জন্য খালেদ শামসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আর আর্থিক বিষয়টি সুরাহার জন্য সিমেন্স কোকোর প্রতিনিধি সাজিদ করিম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাজিদ করিম দরপত্রে অংশ নেয়া চীনা কোম্পানি হুয়াইয়ের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন বলে ইতালি সরকারের অনুরোধপত্রে জানানো হয়েছে। সিমেন্সের সঙ্গে হুয়াই টেলিটক প্রকল্পের আংশিক কাজ পায়।
সব ধরনের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সিমেন্সের দরপত্র পাস হয় এবং ২০০৪ সালের ১৪ জুন বিটিটিবির সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। দরপত্র পাস হওয়ার খবরটি কোকোই প্রথম জানান খালেদ শামসকে। মার্কিন আদালতের নথিতে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালের মাঝামাঝি কোকো ও খালেদ শামসের মধ্যে কথা হয়। সে সময় কোকোকে তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা দেয়া হয়নি বলে ৰোভ প্রকাশ করেন। এর প্রেক্ষিতে সিমেন্স কোম্পানি সিঙ্গাপুরে কোকোর ব্যাংক এ্যাকাউন্টে ঘুষের ১ কোটি ২৬ লাখ ডলার জমা প্রদান করে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এক দফায় চেষ্টা চালানো হয়। তবে তাতে কোন সাফল্য আসেনি। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো কর্তৃক পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। পাচারকারীদের মধ্যে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার দু'ছেলের সঙ্গে তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের নামও রয়েছে বলে আইনমন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন।
সিঙ্গাপুরে কোকোর ব্যাংক হিসেব ও সিমেন্সের টাকা ২০০৪ সালের ১২ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের এক নাগরিকের সহযোগিতায় কোকো ওই দেশে জেডএএসজেড ট্রেডিং এ্যান্ড কনসালটিং প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি নিবন্ধন করেন এবং ইউওবি ব্যাংকে হিসেব খোলেন। সিঙ্গাপুরের ওই নাগরিকের সঙ্গে কোকোর পরিচয় করিয়ে দেন কিউনি শিপিংয়ের এক কর্মকর্তা। ব্যাংক হিসেবটি যৌথ হলেও তা থেকে অর্থ তোলার ক্ষমতা ছিল একমাত্র কোকোর। যুক্ত সই কিংবা এককভাবে চেকে কোকো সই করে অর্থ তুলতে পারতেন। সিঙ্গাপুরে ওই ব্যাংকে কোন বিদেশী নাগরিকের হিসেব খোলার নিয়ম নেই। সে কারণেই ওই নাগরিকের সহযোগিতা নেন কোকো। সিঙ্গাপুরের ওই নাগরিক জানিয়েছেন, সিমেন্সের পরামর্শক জুলফিকার আলী ২০০৫ সালের ৬ অক্টোবর কোকোর ওই হিসেবে ১ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার জমা করেন। এর আগে ওই ব্যাংক হিসেব চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০০৫ সালের ৬ মে ও ৩১ মে যথাক্রমে নয় লাখ ২০ হাজার ৯৮৬ এবং আট লাখ ৩০ হাজার ৬৫৬ সিঙ্গাপুরী ডলার জমা করে। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে কন্টেনার টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং। ওই বছর ১৮ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে দুদক জানান, সিঙ্গাপুর সরকার সে দেশের ব্যাংকে জমা কোকোর ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জব্দ করেছে। কোকোর জমা থাকা জব্দ করা টাকার বিশদ বিবরণ সিঙ্গাপুর সরকার বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জানালে ওই অর্থের উৎসের ব্যাপারে দুদক অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে।
সিমেন্স-বাংলাদেশকে কাজ পাইয়ে দিতে কোকো ১ কোটি ২৬ লাখ ডলার ঘুষ গ্রহণ করে পাচার করেন। এ পাচারের সঙ্গে তারেক রহমানও জড়িত রয়েছে। পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের পরেই তাঁদের বিরম্নদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে বলে অইনমন্ত্রী নিশ্চিত করেন।
জানা গেছে, জার্মান বহুজাতিক কোম্পানি সিমেন্স এজির স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সিমেন্স-বাংলাদেশকে কাজ পাইয়ে দিতে কোকো ১ কোটি ২৬ লাখ ডলার ঘুষগ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কোকোর পাচারকৃত এ অর্থের কথা স্বীকার করেছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সফর করে দেশে ফিরে পাচার করা অর্থের খোঁজ পাওয়া গেছে এটা নিশ্চিত করেন। তিনি রবিবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের পাচার হওয়া অর্থের কথা তুলে ধরেন।
দেশ থেকে বিভিন্ন সময় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, গবর্নর ড. আতিউর রহমান ও এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। গবর্নর দেশে ফিরলেও আইনমন্ত্রী ও এ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাঁরা তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোসহ আরও অনেক দুনর্ীতিবাজের পাচারকৃত অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আনত্মরিক সহায়তা চেয়েছেন বলেও জানা গেছে। পাচারকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধারের পরেই তারেক রহমান ও কোকোর বিরম্নদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। জানা গেছে, সিমেন্স-বাংলাদেশকে অর্থের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী নির্ধারিত সময় অনুযায়ী কোকোকে টাকা দেয়া হয়নি বলে কোকো অভিযোগ করলে অতিরিক্ত অর্থ হিসেবে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর সিঙ্গাপুরের ব্যাংক এ্যাকাউন্টে এ অর্থ জমা দেয়া হয়। সিঙ্গাপুরে কোকোর ব্যাংক হিসেবে যে ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছিল তার মধ্যে এ টাকাও আছে বলে জানা গেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের সরকারী মোবাইল ফোন কোম্পানি টেলিটক প্রকল্পের কাজ পায় সিমেন্স ৫৩ লাখ ডলার ঘুষ দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইতালির তদন্ত এবং সিমেন্স এজির নিজস্ব তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে।
বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসার লৰ্যে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মানিলন্ডারিং পলিসি জোরদার করাসহ ইন্টারন্যাশনাল এগমন্ট গ্রম্নপের সদস্য হওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করা হয়েছে। এ লৰ্যে গত সপ্তাহে গবর্নর ড. আতিউর রহমান, এ্যাটর্নি জেনারেল এবং আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। ওই সফর থেকে গবর্নর দেশে ফিরে এলেও এ্যাটর্নি জেনারেল এবং ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন। নিউইয়র্কে এক মতবিনিময় সমাবেশে বার্তা সংস্থা এনার প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, তারেক রহমান, আরাফাত রহমানসহ আরও অনেক দুনর্ীতিবাজের পাচারকৃত অর্থ বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আনত্মরিক সহায়তা চাইতে আমি ওয়াশিংটন ডিসি সফর করলাম। এদের পাচারকৃত বিপুল পরিমাণের অর্থ উদ্ধারের পরেই মামলা দায়ের করা হবে। তিনি আরও বলেন, প্রশাসন ও রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করার লৰ্যেই মানুষ মহাজোট সরকারকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। আমরা মানুষের সে আকাঙ্ৰাই বাস্তবায়ন করছি।
এদিকে সিমেন্স ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই টেলিটক মোবাইল ফোন প্রকল্পের কাজ পেতে চেষ্টা করে। এজন্য ফজলে সেলিম ও জুলফিকার নামের দু'জনকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয় সিমেন্স-বাংলাদেশ। ২০০১ সালের ২৭ মার্চ সিমেন্স ইতালির বাণিজ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা এবং ওই দু'পরামর্শকের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সে চুক্তি সফল হয়নি। এক পর্যায়ে বিটিটিবির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে টেলিটক প্রকল্পটির জন্য তিনবার খোলা দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু তিনবারই অংশ নেয় সিমেন্স-বাংলাদেশ। এতে অংশ নিয়ে কারিগরি অযোগ্যতার কারণে বাদ পড়ে সিমেন্স। পরবতর্ী সময়ে পুরো প্রক্রিয়াটিই অবশ্য বাতিল করা হয়। দ্বিতীয়বার ২০০১ সালে দরপত্র আহ্বান করা হলে তালিকায় নাম ওঠে সিমেন্সের। কিন্তু সদ্য ৰমতায় বসা তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার তা বাতিল করে দেয়। অর্থের পরিমাণ পরিবর্তন করে ও সরবরাহকারীর সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে তৃতীয় দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০০২ সালে। কিন্তু ২০০২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সিমেন্স ওই দরপত্রে যথাযথভাবে সনদ দেখাতে না পারায় আবার অকৃতকার্য হয়। ওই সময় সিমেন্স মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তিকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়। একই সঙ্গে আগের দু'পরামর্শককে বাদ দেয়। নতুন পরামর্শক হন তৎকালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের বেয়াই। এরপর ২০০৩ সালের শেষ দিকে ব্যারিস্টার আমিনুল হক বিটিটিবির প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দরপত্র সচল করতে সৰম হন। একই সঙ্গে মন্ত্রী এ সময় সিমেন্সের প্রস্তাব সরাসরি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠাতে বলেন। ২০০৪ সালের ২৬ জানুয়ারি ক্রয় কমিটি সিমেন্সের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ব্যারিস্টার আমিনুল হক এ সময় খালেদ শামসকে জানান, তিনি সিমেন্সকে একটি ভাল অবস্থানে আনার জন্য বিষয়টি দেশের শীর্ষস্তরে নিয়ে যেতে চান।
মার্কিন আইন সংস্থার তদন্তে জানা যায়, ওই সময়ই আরাফাত রহমান কোকো নির্দিষ্ট কমিশনের বিপরীতে সিমেন্সকে ওই অবস্থান থেকে উদ্ধার করার জন্য খালেদ শামসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আর আর্থিক বিষয়টি সুরাহার জন্য সিমেন্স কোকোর প্রতিনিধি সাজিদ করিম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাজিদ করিম দরপত্রে অংশ নেয়া চীনা কোম্পানি হুয়াইয়ের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন বলে ইতালি সরকারের অনুরোধপত্রে জানানো হয়েছে। সিমেন্সের সঙ্গে হুয়াই টেলিটক প্রকল্পের আংশিক কাজ পায়।
সব ধরনের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সিমেন্সের দরপত্র পাস হয় এবং ২০০৪ সালের ১৪ জুন বিটিটিবির সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। দরপত্র পাস হওয়ার খবরটি কোকোই প্রথম জানান খালেদ শামসকে। মার্কিন আদালতের নথিতে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালের মাঝামাঝি কোকো ও খালেদ শামসের মধ্যে কথা হয়। সে সময় কোকোকে তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা দেয়া হয়নি বলে ৰোভ প্রকাশ করেন। এর প্রেক্ষিতে সিমেন্স কোম্পানি সিঙ্গাপুরে কোকোর ব্যাংক এ্যাকাউন্টে ঘুষের ১ কোটি ২৬ লাখ ডলার জমা প্রদান করে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এক দফায় চেষ্টা চালানো হয়। তবে তাতে কোন সাফল্য আসেনি। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো কর্তৃক পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। পাচারকারীদের মধ্যে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার দু'ছেলের সঙ্গে তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের নামও রয়েছে বলে আইনমন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন।
সিঙ্গাপুরে কোকোর ব্যাংক হিসেব ও সিমেন্সের টাকা ২০০৪ সালের ১২ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের এক নাগরিকের সহযোগিতায় কোকো ওই দেশে জেডএএসজেড ট্রেডিং এ্যান্ড কনসালটিং প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি নিবন্ধন করেন এবং ইউওবি ব্যাংকে হিসেব খোলেন। সিঙ্গাপুরের ওই নাগরিকের সঙ্গে কোকোর পরিচয় করিয়ে দেন কিউনি শিপিংয়ের এক কর্মকর্তা। ব্যাংক হিসেবটি যৌথ হলেও তা থেকে অর্থ তোলার ক্ষমতা ছিল একমাত্র কোকোর। যুক্ত সই কিংবা এককভাবে চেকে কোকো সই করে অর্থ তুলতে পারতেন। সিঙ্গাপুরে ওই ব্যাংকে কোন বিদেশী নাগরিকের হিসেব খোলার নিয়ম নেই। সে কারণেই ওই নাগরিকের সহযোগিতা নেন কোকো। সিঙ্গাপুরের ওই নাগরিক জানিয়েছেন, সিমেন্সের পরামর্শক জুলফিকার আলী ২০০৫ সালের ৬ অক্টোবর কোকোর ওই হিসেবে ১ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার জমা করেন। এর আগে ওই ব্যাংক হিসেব চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান ২০০৫ সালের ৬ মে ও ৩১ মে যথাক্রমে নয় লাখ ২০ হাজার ৯৮৬ এবং আট লাখ ৩০ হাজার ৬৫৬ সিঙ্গাপুরী ডলার জমা করে। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে কন্টেনার টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং। ওই বছর ১৮ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে দুদক জানান, সিঙ্গাপুর সরকার সে দেশের ব্যাংকে জমা কোকোর ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জব্দ করেছে। কোকোর জমা থাকা জব্দ করা টাকার বিশদ বিবরণ সিঙ্গাপুর সরকার বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে জানালে ওই অর্থের উৎসের ব্যাপারে দুদক অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে।
No comments