কোথা থেকে ভেসে আসবে ‘খামোশ’ শব্দটি by মিনার রশীদ
সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশ চলচ্চিত্রটিকে এ দেশের মানুষ এখন ঘন ঘন
স্মরণ করছেন। রায় সাহেব আর কিছু দিন বেঁচে থাকলে তার সেই বিখ্যাত সিনেমার
পরের পর্ব অর্থাৎ হীরক রানীর দেশ তৈরির মালমসলা পেয়ে যেতেন।
সিম্পটম বা আলামত অনেকেই টের পেয়েছেন। কিন্তু বিশেষণটির প্রয়োগ হচ্ছে
নিজ নিজ বিশ্বাস ও ধারা অনুযায়ী। যেমন কালো বিড়াল খ্যাত সুরঞ্জিতের
ধারণাÑ ‘বাঘে ধরলে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না’।
এর বাইরে গিয়ে বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, দেশ আজ বাজিকরদের হাতে। আইনের মানুষ পানিকে কখনো সরাসরি পানি বলেন না। তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ডক্টর কামাল হোসেন বলেছেন, দেশ আজ পাগলের হাতে। সরকারপ্রধানকে ‘রং হেডেড’ বলে হাইকোর্টেরও একটা রায় রয়েছে। চরমভাবে হতাশ এবিএম মূসার মতো আওয়ামীপ্রাণ ব্যক্তিত্ব বার্স্ট করেছেন। কেন এমনভাবে বার্স্ট করলেন, তার কারণ আওয়ামী মহল প্রকাশ করলেও তার বক্তব্য খণ্ডাতে পারছেন না কেউ। সর্বশেষ তিনি গরম মাথায় তার মুজিব ভাই সম্পর্কে যা বলেছেন, হেনরি কিসিঞ্জার অনেক আগেই ঠাণ্ডামাথায় কাছাকাছি মন্তব্য করেছিলেন। বিদেশভ্রমণে সঙ্গী করে তার মাথাটি ‘ঠাণ্ডা’ করার চেষ্টা হলেও আশানুরূপ ঠাণ্ডা হয়নি।
কিন্তু ফাঁসির এই আদেশ দিয়েছেন তো আদালত। এর মাধ্যমে অন্য কেউ লৌহমানবী হলেন কিভাবে? তা ছাড়া লৌহমানবী ও হীরকের রানীর মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এ ধরনের উচ্ছ্বাস বর্তমান বিচারব্যবস্থার করুণ চিত্রটি তুলে ধরেছে। আগামী বছর কার কার ফাঁসি হবে তা-ও সুরঞ্জিত বাবু আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে আমরা এক হীরক রাজার শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। হীরকের রাজার অপছন্দের কোনো মানুষ এ দেশে থাকতে পারবে না।
এ যেন বুশের সেই ডকট্রিন। তোমরা হয় আমাদের দলে, নতুবা ওদের দলে। মাঝখানে কেউ নেই। এই রায়ের পর ওদের মতো করে প্রতিক্রিয়া বা উচ্ছ্বাস দেখাতে পারেনি বলে স্বল্পভাষী বিএনপি এবং তার নেত্রীকে যারপরনাই তুলোধুনো করেছে ১৪ দল। মতিয়া চৌধুরী যথারীতি তার সেই বিকট ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘এই রায়ের পর বেগম খালেদা জিয়া অতি শোকে পাথর হয়ে পড়েছেন’। ভাবখানা এমন, এ দেশের রাজনীতিতে বিএনপি যেন কোনো এতিমের মেয়ে। আর তিন কবুল বলে বিয়ে করে এনেছে আওয়ামী লীগ, তবে ‘কিলাইতে’ পারবে ১৪ দলের যে-কেউ। ওরা যখন যে ভঙ্গিতে হাসবে বা কাঁদবে, বিএনপিকে বিনা প্রশ্নে সেই ভঙ্গিতে হাসতে হবে বা কাঁদতে হবে। হাসা, কাঁদা বা নীরব থাকার জন্য বিএনপির আলাদা কোনো ইচ্ছা বা ভঙ্গি থাকতে পারবে না।
বেগম খালেদা জিয়াসহ দেশের বিরাট এক অংশের মতিয়া কথিত এই ‘পাথর হওয়ার পেছনে’ করুণ এক ইতিহাস আছে। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু মূল্যবান ছবি সবার চোখের সামনেই ভাসছে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের নেতাদের একসাথে অনেক ছবি আছে। পরম শত্রুদের পারস্পরিক হ্যান্ডশেকের এ ধরনের অনেক ছবিও আছে। কিন্তু ভুট্টো ও মুজিবের সেই ছবিগুলো ছিল সত্যিই ভিন্ন ব্যঞ্জনার। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার জন্য যে ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ কালপ্রিট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার নাম জুলফিকার আলী ভুট্টো। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে সেই সর্বোচ্চ কালপ্রিটের সাথে স্বাধীনতার স্থপতির এমন অন্তরঙ্গ ছবি যাদের স্মরণে আছে তারা তিন চৌদ্দ বিয়াল্লিশ বছর পরের এই ঘৃণা বা উচ্ছ্বাস দেখে একটু ‘পাথর’ হওয়ারই কথা। রাজাকার হওয়ার ভয়ে হাসতে হলেও তা হয়েছে বিবর্ণ হাসি। প্রজ্ঞাবানেরা তাই চুপ করে থাকাকেই শ্রেয় বলে জ্ঞান করেছেন। বিএনপির সেই চুপ অবস্থা দেখেই এই অগ্নিকন্যারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন।
হবুচন্দ্রের রাজত্বে জনগণ কখন কাঁদবে, কখন হাসবে তা-ও ফরমানের মাধ্যমে ঠিক করা হতো। হীরক রানীরাও মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে এমন ফরমানের আওতায় আনতে চাচ্ছে। এ পরিস্থিতির ভয়ঙ্কর দিকটি হলো, আপনি হাতে চাপা খাচ্ছেন। আপনার আত্মা যখন চাচ্ছে এই চাপাদাতার হাত থেকে নিষ্কৃতি, তখন পাশ থেকে এই মাথাখারাপ চাপাদাতার কাজটির প্রশংসা করছে অন্য কেউ।
আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্কটটি হলো, যখন একজনের সুচিকিৎসা দরকার তখন দু’জনকেই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। কাজেই রাজনীতির এই রোগটি কখনোই আমাদেরকে ছাড়ে না। সঠিক জায়গায় সঠিক মাত্রার ডোজ আমরা কখনোই প্রয়োগ করতে পারি না। পুরো দেশটিই থ্রি স্টুজেস, মিস্টার বিনের কমেডি সিনেমার মতো হয়ে পড়েছে। এক মাঢ়ির একটি দাঁতের ব্যথা, তা না সারিয়ে দুই মাঢ়ির দাঁত ফেলে দেয়ার প্রেসক্রিপশন দিচ্ছে কেউ কেউ। এই সুযোগে এরশাদ গৃহপালিত বিরোধী দল না হয়ে একই টেমপ্লেট বা ছাঁচে কিছু দিনের জন্য ‘গৃহপালিত সরকারি দল’ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এই স্বপ্নে এরশাদ ও জাতীয় পার্টিও খুব উজ্জীবিত। বহুরূপী এরশাদের বর্তমান ভূমিকা ভিশন ২০২১-এর ছকের বাইরে নয়। সব কিছু দেখে এটাকে হীরক রানীর দেশ বলেই মনে হচ্ছে।
তবে হীরক রাজার দেশ থেকে আমাদের দেশটিতে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন হীরক রাজার দেশে কোনো স্বাধীন পত্রপত্রিকা বা মিডিয়া ছিল না। কোনো স্বাধীন বিচার বিভাগ ছিল না। কোনো সুশীলসমাজ ছিল না। এ দেশে এ সব কিছুই রয়েছে।
হীরক রাজার দেশে প্রতিবাদকারীদের মগজ ধোলাইয়ের জন্য ছিল বিশেষ ‘যন্তরমন্তর’ ঘর। কেউ বিরোধিতা করলেই তাকে এই যন্তরমন্তর ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হতো। এই ঘর থেকে বের হওয়ার পর বলতÑ বাকি রাখা খাজনা, মোটেই ভালো কাজ না। ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেওনা চাই। অনাহারে নাই খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ… ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে এই হীরক রাজার দেশে মগজ না কী ধোলাই হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। দেশের স্বনামধন্য কয়েকটি পত্রিকা সরকারের চার বছরের পারফরম্যান্স নিয়ে সার্ভে করেছে। সেই সার্ভেতে জনমত ঠিকভাবে প্রতিফলিত না হলেও পত্রিকাগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। প্রচারসংখ্যায় শীর্ষে দাবিদার পত্রিকাটি এই মুনশিয়ানায় আরো এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। সরকার সব জায়গায় খারাপ করলেও শুধু সরকারপ্রধানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। বিরোধী দলের নেত্রীর চেয়েও তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে!
অর্থাৎ পত্রিকাটি বলতে চাচ্ছে যে মেয়েটি দেখতে কালো, নাক বোঁচা, চোখ ছোট, মাপে খাটো, কণ্ঠস্বর ফ্যাসফেসে। চরিত্রও খুব সুবিধার নয়। ঝগড়াটে স্বভাব। কন্যার সব ইনডেক্স এ ধরনের হলেও সর্বশেষ মতামতটি হলোÑ কইন্যা সবার চেয়ে ভালো। হায়রে সেলুকাস!
যিনি দিনের পর দিন হরতাল করে এবং দেশের মানুষকে জিম্মি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন, তিনিই হীরক রানীর কায়দায় তা বাতিল করে দিলেন। হাইকোর্টের রায়ের অজুহাত দেয়া হলো। কিন্তু তার জন্য পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলো না। ঢাকঢোল পিটিয়ে এ ব্যাপারে পরামর্শের জন্য অনেককে ডাকা হলো। সবার পরামর্শ শোনা হলো। কিন্তু কারো কোনো কথাই রাখা হলো না। বিরোধী পক্ষকে তিনি এক পয়সা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু তাকে ষোল আনা বিশ্বাস করতে হবে। এটা লৌহমানবীর প্রজ্ঞা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা নয়Ñ হীরক রানীর আবদার। লৌহমানবীর চরিত্রের দৃঢ়তা যেখানে এ দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারত, হীরক রানীর এই খামখেয়ালিপনা দেশ ও জাতিকে ভয়াবহ সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার বিপরীতে যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়, পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে ও উন্নত গণতন্ত্রে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাটি নেই। তবে ১৯৯৪-১৯৯৬ সালের সভ্য পৃথিবীতে এই ব্যবস্থাটি ছিল কি না সেই প্রশ্ন করলে তা যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হয়। যে রোগের জন্য আমাদের ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে এই লাইফ সাপোর্টটি দেয়া হয়েছিল, সেই ব্যারামের বর্তমান অবস্থা পরখ না করেই তা খুলে ফেলা হয়েছে। দিন বদলের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এলেও আগের সেই দিন একটুও বদলায়নি। পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে না। অথচ জনগণের চোখে ও উপলব্ধিতে ধরা পড়ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। এমনকি যে অনুষ্ঠানে তিনি এই সুন্দর কথাটি বলেছেন, সেই একই অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট পদক দেয়া হয়েছে এমন এক পুলিশ অফিসারকে, যিনি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে পিটিয়ে কাঁঠাল বানিয়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা সরাসরি স্বীকার করেছেন, জয়নুল আবদিন ফারুককে পেটানোর জন্যই এই পদকটি দেয়া হয়েছে। এই পুলিশ, এই পুলিশের মন্ত্রী এবং সর্বোপরি হীরক রানীর মেজাজে থাকা দলীয় প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কতটুকু সম্ভব হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
একবার এক জাহাজে চিফ কুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে সে হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। প্রমাণ হিসেবে চালের মধ্যে ছোট কয়েকটি তেলাপোকা জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছে হাজির করা হয়। চিফ কুককে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তলব করা হয়। চালের মধ্যে পোকা দেখিয়ে ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করেন, এসব কী চিফ কুক? পোকা দু’টি হাতে নিয়ে ত্বরিত মুখে ঢুকিয়ে গিলে ফেলে এবং বলেÑ ‘কই স্যার, কিছুই তো নেই। দেখেন স্যার কিচ্ছু নেই। আমার বিরুদ্ধে সব মিথ্যা অভিযোগ।’ তার এই কর্ম দেখে ক্যাপ্টেনসহ উপস্থিত সবাই থ।
বর্তমান সরকারের মানসিক ও সাইকোলজিক্যাল সেটআপ হুবহু এই চিফ কুকের মতো। ওই চিফ কুক তবুও তেলাপোকাটি গিলে ফেলার পর বলেছিল যে চালের মধ্যে কোনো তেলাপোকা নেই। বর্তমান সরকার পোকা গেলার সেই কষ্টটুকুও করে না। শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হলমার্ক, কালো বিড়ালসহ অন্য পোকাগুলো চোখের সামনে রেখেই বলছে যে, এখানে কোনো পোকা নেই; আছে সব প্রজাপতি। পদ্মা সেতু প্রজেক্টে চোর নেই, আছে দেশপ্রেমিক। রেলে কোনো কালো বিড়াল নেই, আছে সাদা বিড়াল। শেয়ারবাজারে লুটেরা নেই, আছে দরবেশ বাবাজী। সব কিছু স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হলেও কোথাও পালের গোদাদের কারো কিছুই হয়নি। বিশ্বজিৎ কিভাবে মরেছে, কতগুলো কোপ খেয়েছে তা দেশবাসী দেখেছে। কিন্তু পোস্টমর্টেমে নিয়োজিত ডাক্তার তার শরীরে কোনো কোপ দেখতে পাননি। কাজেই এটা সাধারণ কোনো দেশ নয়Ñ এটা পুরোপুরি হীরক রাজার রাজত্ব।
বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রতিনিধিকে এই দেশে এসে রাজনীতি করার আহ্বান জানিয়েছেন আবুল মাল আব্দুল মুহিত। এ ধরনের ‘রাবিশ’ ও হাস্যকর আহ্বান কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের কর্তাব্যক্তিদের জিহ্বা থেকে বের হতে পারে না। তবে হীরকের রাজা ও তার পরিষদ এ ধরনের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। তারা যা খুশি করতে পারে এবং যা খুশি বলতে পারে। এরা ইচ্ছে হলে ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বকে তার নিজের ব্রেন চাইল্ড নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক থেকে টেনে নামাতে পারে। আবার তাকেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বানানোর হাস্যকর প্রস্তাব রাখতে পারে। আবুলদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বিশ্বব্যাংক যতই বলছেÑ চোর, চোর; তিনি ততই বলছেন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। এটা কখনোই সাধারণ তেজ নয়Ñ এটা হীরক রাজার সর্বনাশা জেদ। এই জেদের মাশুল জাতিকে কত দিন টানতে হবে তা একমাত্র আল্লাহই বলতে পারবেন।
দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করে পদ্মা সেতু তৈরি না হলেও এক বিলিয়ন ডলার খরচ করে রাশিয়ার কাছ থেকে উচ্চ সুদে অস্ত্র কেনা হয়েছে। বাংলাদেশ কী প্রক্রিয়ায় পুরনো বন্ধুত্ব ঝালাই করে নেয় এটি তার সর্বশেষ নমুনা। এ ধরনের হাতেমতাঈদের কখনোই বন্ধুর অভাব হয় না। পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেখানে ০.৫ শতাংশ সুদে এই বন্ধুত্ব ফেরি করত, রাশিয়া করেছে সেখানে ৪.৫ শতাংশ সুদে। এখানেও একাত্তরের আবেগ যথারীতি ভর করেছে অথচ সোভিয়েতের সেই খোলস রাশিয়া অনেক আগেই বদলে ফেলেছে। দেবতার চরণতলে পূজা দিচ্ছে এক পূজারী, কিন্তু দেবতা তার সেই আগের দেবত্ব পরিত্যাগ করেছে।
সাধারণত কোনো দেশ অন্য কোনো দেশ বা রাষ্ট্র থেকে হুমকির সম্মুখীন হলে এ ধরনের বিপুল অস্ত্র কেনে। কোন শত্রুকে টার্গেট করে এই অস্ত্র কেনা হলো তা স্পষ্ট হচ্ছে না। অস্ত্র কেনার অঙ্কটি বিলিয়ন ডলার ছুঁয়ে গেলে সাধারণত প্রতিবেশীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকে। বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনার ঘোষণায় আমাদের কোনো প্রতিবেশীর মাঝে সে ধরনের উদ্বেগ দেখা যায়নি। বর্ডারে পাখির মতো এ দেশের মানুষকে মারলেও যেখানে একটি গুলি ছোড়ার দরকার পড়ে না, সেখানে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনার যৌক্তিকতা বা যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সেনাবাহিনী নিয়ে যখন কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব হয় না, তখন তা ফরেইন মিশনের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এই বিপুল অস্ত্র কেনাকে জাস্টিফাই করার জন্য একই কাজ করা হচ্ছে।
সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত ফরেইন মিশন জনবহুল এ দেশটির কল্যাণে এলেও কিছু ভ্রান্তনীতির কারণে তা দিন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে এই ফরেইন মিশনকে জাতীয় নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে। এক-এগারো সৃষ্টির অজুহাত হিসেবে দেখানো হয়েছে এই ফরেইন মিশন বন্ধের হুমকিকে। আজ কোনো কমিশনখোরের লোভকে এন্টারটেইন করতে ফের ঢাল হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে এই ফরেইন মিশনকে। মনে হচ্ছে, কেনাকাটা বাবদ কিছু কমিশন নয় বরং এই কমিশনের জন্যই এই
বিপুল সামরিক ব্যয়ভার ও উচ্চ সুদের ঋণ জাতির কাঁধে চেপে বসেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় ও লুটপাট হচ্ছে অথচ কিছু টাকার জন্য দেশের শিক্ষকসমাজ খাচ্ছেন মরিচের গুঁড়ার ¯েপ্র।
এই অস্ত্র কেনায় ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ও প্রকৃত প্রয়োজনকে খুব বেশি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এক লোক তার অনেকগুলো স্বর্ণমুদ্রা মাটিতে পুঁতে রাখে। তা দেখে তার এক জ্ঞানী বন্ধু বলেÑ দেখো, মাটিতে পুঁতে রাখা স্বর্ণমুদ্রা আর একইভাবে পুঁতে রাখা ইট তোমার কাছে দুটোই সমান। কারণ তুমি তা কখনোই ব্যবহার করবে না। কাজেই ইটগুলো পুঁতে রেখে স্বর্ণমুদ্রাগুলো আমাকে দিয়ে দাও।’ রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার পেছনে যুক্তি ও পরামর্শ অনেকটা এ রকম। রাশিয়া থেকে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র এবং সমপরিমাণ লোহালক্কড় কেনার মধ্যে খুব বেশি ফারাক এ মুহূর্তে জাতির উপলব্ধিতে ধরা পড়ছে না।
উন্নত বিশ্ব তাদের সেনাবাহিনীকে কখনোই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে না। ওরা কারো জন্য ভাড়ায় খাটে না। নিজেদের আন্তর্জাতিক আধিপত্য কোথাও হুমকির মুখে পড়লে বিভিন্ন দেশে সৈন্য পাঠায়। তাই উন্নয়নশীল দেশের সেনাবাহিনীর জন্য এটা খুবই লোভনীয় মিশন হিসেবে দেখা দিয়েছে। অথচ এ দেশের ফালানীদের রক্তাক্ত লাশ ঝুলে থাকে কাঁটাতারের বেড়ায়। তখন সিয়েরা লিওনে আমাদের সেনাবাহিনী কী করছে সেই বীরত্বের সংবাদ কি আদৌ দরকার রয়েছে?
আমাদের দেশাত্মবোধক গান, কবিতা ও সিনেমার সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু ভূরাজনৈতিক প্রতিরক্ষা বোধটি দিন দিন খালি হয়ে যাচ্ছে। চার দিকে মিথ্যা স্তুতি স্তূপীকৃত হচ্ছে। হীরকের রাজারা লৌহমানব বনে যাচ্ছেন। নির্লজ্জ দালালেরা বিতরণ করছে দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেট। করপোরেট শকুনেরা খামচে ধরছে বিভিন্ন জাতীয় আবেগ। জাতির বিবেক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেখে এবিএম মূসাকে পাগল সাব্যস্ত করছেন কোনো এক হাইব্রিড নেতা। ভাসানীর জীবনী পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
অশান্ত মন ও আত্মা চাচ্ছে ভাসানীর সেই গগনবিদারী শব্দ। কিন্তু কোথা থেকে ভেসে আসবে সেই ‘খামোশ’ শব্দটি, তার কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছি না।
minarrashid@yahoo.com
এর বাইরে গিয়ে বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, দেশ আজ বাজিকরদের হাতে। আইনের মানুষ পানিকে কখনো সরাসরি পানি বলেন না। তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ডক্টর কামাল হোসেন বলেছেন, দেশ আজ পাগলের হাতে। সরকারপ্রধানকে ‘রং হেডেড’ বলে হাইকোর্টেরও একটা রায় রয়েছে। চরমভাবে হতাশ এবিএম মূসার মতো আওয়ামীপ্রাণ ব্যক্তিত্ব বার্স্ট করেছেন। কেন এমনভাবে বার্স্ট করলেন, তার কারণ আওয়ামী মহল প্রকাশ করলেও তার বক্তব্য খণ্ডাতে পারছেন না কেউ। সর্বশেষ তিনি গরম মাথায় তার মুজিব ভাই সম্পর্কে যা বলেছেন, হেনরি কিসিঞ্জার অনেক আগেই ঠাণ্ডামাথায় কাছাকাছি মন্তব্য করেছিলেন। বিদেশভ্রমণে সঙ্গী করে তার মাথাটি ‘ঠাণ্ডা’ করার চেষ্টা হলেও আশানুরূপ ঠাণ্ডা হয়নি।
কিন্তু ফাঁসির এই আদেশ দিয়েছেন তো আদালত। এর মাধ্যমে অন্য কেউ লৌহমানবী হলেন কিভাবে? তা ছাড়া লৌহমানবী ও হীরকের রানীর মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এ ধরনের উচ্ছ্বাস বর্তমান বিচারব্যবস্থার করুণ চিত্রটি তুলে ধরেছে। আগামী বছর কার কার ফাঁসি হবে তা-ও সুরঞ্জিত বাবু আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছেন। কাজেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে আমরা এক হীরক রাজার শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। হীরকের রাজার অপছন্দের কোনো মানুষ এ দেশে থাকতে পারবে না।
এ যেন বুশের সেই ডকট্রিন। তোমরা হয় আমাদের দলে, নতুবা ওদের দলে। মাঝখানে কেউ নেই। এই রায়ের পর ওদের মতো করে প্রতিক্রিয়া বা উচ্ছ্বাস দেখাতে পারেনি বলে স্বল্পভাষী বিএনপি এবং তার নেত্রীকে যারপরনাই তুলোধুনো করেছে ১৪ দল। মতিয়া চৌধুরী যথারীতি তার সেই বিকট ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘এই রায়ের পর বেগম খালেদা জিয়া অতি শোকে পাথর হয়ে পড়েছেন’। ভাবখানা এমন, এ দেশের রাজনীতিতে বিএনপি যেন কোনো এতিমের মেয়ে। আর তিন কবুল বলে বিয়ে করে এনেছে আওয়ামী লীগ, তবে ‘কিলাইতে’ পারবে ১৪ দলের যে-কেউ। ওরা যখন যে ভঙ্গিতে হাসবে বা কাঁদবে, বিএনপিকে বিনা প্রশ্নে সেই ভঙ্গিতে হাসতে হবে বা কাঁদতে হবে। হাসা, কাঁদা বা নীরব থাকার জন্য বিএনপির আলাদা কোনো ইচ্ছা বা ভঙ্গি থাকতে পারবে না।
বেগম খালেদা জিয়াসহ দেশের বিরাট এক অংশের মতিয়া কথিত এই ‘পাথর হওয়ার পেছনে’ করুণ এক ইতিহাস আছে। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু মূল্যবান ছবি সবার চোখের সামনেই ভাসছে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের নেতাদের একসাথে অনেক ছবি আছে। পরম শত্রুদের পারস্পরিক হ্যান্ডশেকের এ ধরনের অনেক ছবিও আছে। কিন্তু ভুট্টো ও মুজিবের সেই ছবিগুলো ছিল সত্যিই ভিন্ন ব্যঞ্জনার। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার জন্য যে ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ কালপ্রিট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার নাম জুলফিকার আলী ভুট্টো। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে সেই সর্বোচ্চ কালপ্রিটের সাথে স্বাধীনতার স্থপতির এমন অন্তরঙ্গ ছবি যাদের স্মরণে আছে তারা তিন চৌদ্দ বিয়াল্লিশ বছর পরের এই ঘৃণা বা উচ্ছ্বাস দেখে একটু ‘পাথর’ হওয়ারই কথা। রাজাকার হওয়ার ভয়ে হাসতে হলেও তা হয়েছে বিবর্ণ হাসি। প্রজ্ঞাবানেরা তাই চুপ করে থাকাকেই শ্রেয় বলে জ্ঞান করেছেন। বিএনপির সেই চুপ অবস্থা দেখেই এই অগ্নিকন্যারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন।
হবুচন্দ্রের রাজত্বে জনগণ কখন কাঁদবে, কখন হাসবে তা-ও ফরমানের মাধ্যমে ঠিক করা হতো। হীরক রানীরাও মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে এমন ফরমানের আওতায় আনতে চাচ্ছে। এ পরিস্থিতির ভয়ঙ্কর দিকটি হলো, আপনি হাতে চাপা খাচ্ছেন। আপনার আত্মা যখন চাচ্ছে এই চাপাদাতার হাত থেকে নিষ্কৃতি, তখন পাশ থেকে এই মাথাখারাপ চাপাদাতার কাজটির প্রশংসা করছে অন্য কেউ।
আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সঙ্কটটি হলো, যখন একজনের সুচিকিৎসা দরকার তখন দু’জনকেই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। কাজেই রাজনীতির এই রোগটি কখনোই আমাদেরকে ছাড়ে না। সঠিক জায়গায় সঠিক মাত্রার ডোজ আমরা কখনোই প্রয়োগ করতে পারি না। পুরো দেশটিই থ্রি স্টুজেস, মিস্টার বিনের কমেডি সিনেমার মতো হয়ে পড়েছে। এক মাঢ়ির একটি দাঁতের ব্যথা, তা না সারিয়ে দুই মাঢ়ির দাঁত ফেলে দেয়ার প্রেসক্রিপশন দিচ্ছে কেউ কেউ। এই সুযোগে এরশাদ গৃহপালিত বিরোধী দল না হয়ে একই টেমপ্লেট বা ছাঁচে কিছু দিনের জন্য ‘গৃহপালিত সরকারি দল’ হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এই স্বপ্নে এরশাদ ও জাতীয় পার্টিও খুব উজ্জীবিত। বহুরূপী এরশাদের বর্তমান ভূমিকা ভিশন ২০২১-এর ছকের বাইরে নয়। সব কিছু দেখে এটাকে হীরক রানীর দেশ বলেই মনে হচ্ছে।
তবে হীরক রাজার দেশ থেকে আমাদের দেশটিতে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন হীরক রাজার দেশে কোনো স্বাধীন পত্রপত্রিকা বা মিডিয়া ছিল না। কোনো স্বাধীন বিচার বিভাগ ছিল না। কোনো সুশীলসমাজ ছিল না। এ দেশে এ সব কিছুই রয়েছে।
হীরক রাজার দেশে প্রতিবাদকারীদের মগজ ধোলাইয়ের জন্য ছিল বিশেষ ‘যন্তরমন্তর’ ঘর। কেউ বিরোধিতা করলেই তাকে এই যন্তরমন্তর ঘরে পাঠিয়ে দেয়া হতো। এই ঘর থেকে বের হওয়ার পর বলতÑ বাকি রাখা খাজনা, মোটেই ভালো কাজ না। ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেওনা চাই। অনাহারে নাই খেদ, বেশি খেলে বাড়ে মেদ… ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে এই হীরক রাজার দেশে মগজ না কী ধোলাই হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। দেশের স্বনামধন্য কয়েকটি পত্রিকা সরকারের চার বছরের পারফরম্যান্স নিয়ে সার্ভে করেছে। সেই সার্ভেতে জনমত ঠিকভাবে প্রতিফলিত না হলেও পত্রিকাগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। প্রচারসংখ্যায় শীর্ষে দাবিদার পত্রিকাটি এই মুনশিয়ানায় আরো এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। সরকার সব জায়গায় খারাপ করলেও শুধু সরকারপ্রধানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে। বিরোধী দলের নেত্রীর চেয়েও তার জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে!
অর্থাৎ পত্রিকাটি বলতে চাচ্ছে যে মেয়েটি দেখতে কালো, নাক বোঁচা, চোখ ছোট, মাপে খাটো, কণ্ঠস্বর ফ্যাসফেসে। চরিত্রও খুব সুবিধার নয়। ঝগড়াটে স্বভাব। কন্যার সব ইনডেক্স এ ধরনের হলেও সর্বশেষ মতামতটি হলোÑ কইন্যা সবার চেয়ে ভালো। হায়রে সেলুকাস!
যিনি দিনের পর দিন হরতাল করে এবং দেশের মানুষকে জিম্মি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন, তিনিই হীরক রানীর কায়দায় তা বাতিল করে দিলেন। হাইকোর্টের রায়ের অজুহাত দেয়া হলো। কিন্তু তার জন্য পূর্ণাঙ্গ রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলো না। ঢাকঢোল পিটিয়ে এ ব্যাপারে পরামর্শের জন্য অনেককে ডাকা হলো। সবার পরামর্শ শোনা হলো। কিন্তু কারো কোনো কথাই রাখা হলো না। বিরোধী পক্ষকে তিনি এক পয়সা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু তাকে ষোল আনা বিশ্বাস করতে হবে। এটা লৌহমানবীর প্রজ্ঞা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা নয়Ñ হীরক রানীর আবদার। লৌহমানবীর চরিত্রের দৃঢ়তা যেখানে এ দেশের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে পারত, হীরক রানীর এই খামখেয়ালিপনা দেশ ও জাতিকে ভয়াবহ সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থার বিপরীতে যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়, পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে ও উন্নত গণতন্ত্রে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থাটি নেই। তবে ১৯৯৪-১৯৯৬ সালের সভ্য পৃথিবীতে এই ব্যবস্থাটি ছিল কি না সেই প্রশ্ন করলে তা যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হয়। যে রোগের জন্য আমাদের ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে এই লাইফ সাপোর্টটি দেয়া হয়েছিল, সেই ব্যারামের বর্তমান অবস্থা পরখ না করেই তা খুলে ফেলা হয়েছে। দিন বদলের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এলেও আগের সেই দিন একটুও বদলায়নি। পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে না। অথচ জনগণের চোখে ও উপলব্ধিতে ধরা পড়ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। এমনকি যে অনুষ্ঠানে তিনি এই সুন্দর কথাটি বলেছেন, সেই একই অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট পদক দেয়া হয়েছে এমন এক পুলিশ অফিসারকে, যিনি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে পিটিয়ে কাঁঠাল বানিয়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা সরাসরি স্বীকার করেছেন, জয়নুল আবদিন ফারুককে পেটানোর জন্যই এই পদকটি দেয়া হয়েছে। এই পুলিশ, এই পুলিশের মন্ত্রী এবং সর্বোপরি হীরক রানীর মেজাজে থাকা দলীয় প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কতটুকু সম্ভব হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
একবার এক জাহাজে চিফ কুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে সে হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। প্রমাণ হিসেবে চালের মধ্যে ছোট কয়েকটি তেলাপোকা জাহাজের ক্যাপ্টেনের কাছে হাজির করা হয়। চিফ কুককে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তলব করা হয়। চালের মধ্যে পোকা দেখিয়ে ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করেন, এসব কী চিফ কুক? পোকা দু’টি হাতে নিয়ে ত্বরিত মুখে ঢুকিয়ে গিলে ফেলে এবং বলেÑ ‘কই স্যার, কিছুই তো নেই। দেখেন স্যার কিচ্ছু নেই। আমার বিরুদ্ধে সব মিথ্যা অভিযোগ।’ তার এই কর্ম দেখে ক্যাপ্টেনসহ উপস্থিত সবাই থ।
বর্তমান সরকারের মানসিক ও সাইকোলজিক্যাল সেটআপ হুবহু এই চিফ কুকের মতো। ওই চিফ কুক তবুও তেলাপোকাটি গিলে ফেলার পর বলেছিল যে চালের মধ্যে কোনো তেলাপোকা নেই। বর্তমান সরকার পোকা গেলার সেই কষ্টটুকুও করে না। শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, হলমার্ক, কালো বিড়ালসহ অন্য পোকাগুলো চোখের সামনে রেখেই বলছে যে, এখানে কোনো পোকা নেই; আছে সব প্রজাপতি। পদ্মা সেতু প্রজেক্টে চোর নেই, আছে দেশপ্রেমিক। রেলে কোনো কালো বিড়াল নেই, আছে সাদা বিড়াল। শেয়ারবাজারে লুটেরা নেই, আছে দরবেশ বাবাজী। সব কিছু স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হলেও কোথাও পালের গোদাদের কারো কিছুই হয়নি। বিশ্বজিৎ কিভাবে মরেছে, কতগুলো কোপ খেয়েছে তা দেশবাসী দেখেছে। কিন্তু পোস্টমর্টেমে নিয়োজিত ডাক্তার তার শরীরে কোনো কোপ দেখতে পাননি। কাজেই এটা সাধারণ কোনো দেশ নয়Ñ এটা পুরোপুরি হীরক রাজার রাজত্ব।
বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রতিনিধিকে এই দেশে এসে রাজনীতি করার আহ্বান জানিয়েছেন আবুল মাল আব্দুল মুহিত। এ ধরনের ‘রাবিশ’ ও হাস্যকর আহ্বান কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের কর্তাব্যক্তিদের জিহ্বা থেকে বের হতে পারে না। তবে হীরকের রাজা ও তার পরিষদ এ ধরনের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। তারা যা খুশি করতে পারে এবং যা খুশি বলতে পারে। এরা ইচ্ছে হলে ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বকে তার নিজের ব্রেন চাইল্ড নোবেলজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক থেকে টেনে নামাতে পারে। আবার তাকেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বানানোর হাস্যকর প্রস্তাব রাখতে পারে। আবুলদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বিশ্বব্যাংক যতই বলছেÑ চোর, চোর; তিনি ততই বলছেন সাচ্চা দেশপ্রেমিক। এটা কখনোই সাধারণ তেজ নয়Ñ এটা হীরক রাজার সর্বনাশা জেদ। এই জেদের মাশুল জাতিকে কত দিন টানতে হবে তা একমাত্র আল্লাহই বলতে পারবেন।
দুই বিলিয়ন ডলার খরচ করে পদ্মা সেতু তৈরি না হলেও এক বিলিয়ন ডলার খরচ করে রাশিয়ার কাছ থেকে উচ্চ সুদে অস্ত্র কেনা হয়েছে। বাংলাদেশ কী প্রক্রিয়ায় পুরনো বন্ধুত্ব ঝালাই করে নেয় এটি তার সর্বশেষ নমুনা। এ ধরনের হাতেমতাঈদের কখনোই বন্ধুর অভাব হয় না। পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেখানে ০.৫ শতাংশ সুদে এই বন্ধুত্ব ফেরি করত, রাশিয়া করেছে সেখানে ৪.৫ শতাংশ সুদে। এখানেও একাত্তরের আবেগ যথারীতি ভর করেছে অথচ সোভিয়েতের সেই খোলস রাশিয়া অনেক আগেই বদলে ফেলেছে। দেবতার চরণতলে পূজা দিচ্ছে এক পূজারী, কিন্তু দেবতা তার সেই আগের দেবত্ব পরিত্যাগ করেছে।
সাধারণত কোনো দেশ অন্য কোনো দেশ বা রাষ্ট্র থেকে হুমকির সম্মুখীন হলে এ ধরনের বিপুল অস্ত্র কেনে। কোন শত্রুকে টার্গেট করে এই অস্ত্র কেনা হলো তা স্পষ্ট হচ্ছে না। অস্ত্র কেনার অঙ্কটি বিলিয়ন ডলার ছুঁয়ে গেলে সাধারণত প্রতিবেশীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকে। বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনার ঘোষণায় আমাদের কোনো প্রতিবেশীর মাঝে সে ধরনের উদ্বেগ দেখা যায়নি। বর্ডারে পাখির মতো এ দেশের মানুষকে মারলেও যেখানে একটি গুলি ছোড়ার দরকার পড়ে না, সেখানে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনার যৌক্তিকতা বা যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সেনাবাহিনী নিয়ে যখন কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব হয় না, তখন তা ফরেইন মিশনের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এই বিপুল অস্ত্র কেনাকে জাস্টিফাই করার জন্য একই কাজ করা হচ্ছে।
সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত ফরেইন মিশন জনবহুল এ দেশটির কল্যাণে এলেও কিছু ভ্রান্তনীতির কারণে তা দিন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে এই ফরেইন মিশনকে জাতীয় নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে। এক-এগারো সৃষ্টির অজুহাত হিসেবে দেখানো হয়েছে এই ফরেইন মিশন বন্ধের হুমকিকে। আজ কোনো কমিশনখোরের লোভকে এন্টারটেইন করতে ফের ঢাল হিসেবে সামনে আনা হচ্ছে এই ফরেইন মিশনকে। মনে হচ্ছে, কেনাকাটা বাবদ কিছু কমিশন নয় বরং এই কমিশনের জন্যই এই
বিপুল সামরিক ব্যয়ভার ও উচ্চ সুদের ঋণ জাতির কাঁধে চেপে বসেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় ও লুটপাট হচ্ছে অথচ কিছু টাকার জন্য দেশের শিক্ষকসমাজ খাচ্ছেন মরিচের গুঁড়ার ¯েপ্র।
এই অস্ত্র কেনায় ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ও প্রকৃত প্রয়োজনকে খুব বেশি বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এক লোক তার অনেকগুলো স্বর্ণমুদ্রা মাটিতে পুঁতে রাখে। তা দেখে তার এক জ্ঞানী বন্ধু বলেÑ দেখো, মাটিতে পুঁতে রাখা স্বর্ণমুদ্রা আর একইভাবে পুঁতে রাখা ইট তোমার কাছে দুটোই সমান। কারণ তুমি তা কখনোই ব্যবহার করবে না। কাজেই ইটগুলো পুঁতে রেখে স্বর্ণমুদ্রাগুলো আমাকে দিয়ে দাও।’ রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনার পেছনে যুক্তি ও পরামর্শ অনেকটা এ রকম। রাশিয়া থেকে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র এবং সমপরিমাণ লোহালক্কড় কেনার মধ্যে খুব বেশি ফারাক এ মুহূর্তে জাতির উপলব্ধিতে ধরা পড়ছে না।
উন্নত বিশ্ব তাদের সেনাবাহিনীকে কখনোই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে না। ওরা কারো জন্য ভাড়ায় খাটে না। নিজেদের আন্তর্জাতিক আধিপত্য কোথাও হুমকির মুখে পড়লে বিভিন্ন দেশে সৈন্য পাঠায়। তাই উন্নয়নশীল দেশের সেনাবাহিনীর জন্য এটা খুবই লোভনীয় মিশন হিসেবে দেখা দিয়েছে। অথচ এ দেশের ফালানীদের রক্তাক্ত লাশ ঝুলে থাকে কাঁটাতারের বেড়ায়। তখন সিয়েরা লিওনে আমাদের সেনাবাহিনী কী করছে সেই বীরত্বের সংবাদ কি আদৌ দরকার রয়েছে?
আমাদের দেশাত্মবোধক গান, কবিতা ও সিনেমার সংখ্যা বাড়ছে; কিন্তু ভূরাজনৈতিক প্রতিরক্ষা বোধটি দিন দিন খালি হয়ে যাচ্ছে। চার দিকে মিথ্যা স্তুতি স্তূপীকৃত হচ্ছে। হীরকের রাজারা লৌহমানব বনে যাচ্ছেন। নির্লজ্জ দালালেরা বিতরণ করছে দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেট। করপোরেট শকুনেরা খামচে ধরছে বিভিন্ন জাতীয় আবেগ। জাতির বিবেক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেখে এবিএম মূসাকে পাগল সাব্যস্ত করছেন কোনো এক হাইব্রিড নেতা। ভাসানীর জীবনী পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।
অশান্ত মন ও আত্মা চাচ্ছে ভাসানীর সেই গগনবিদারী শব্দ। কিন্তু কোথা থেকে ভেসে আসবে সেই ‘খামোশ’ শব্দটি, তার কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছি না।
minarrashid@yahoo.com
No comments