ভবিষ্যতে যে রায়ই আসুক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিষয়ে
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশের বিরুদ্ধে
সরকারের আপিল করার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন বিশিষ্ট আইনজীবীরা।
তারা
বলেন, কাদের মোল্লাকে যে অপরাধের বিষয়ে খালাস দেয়া হয়েছে সরকার ইচ্ছা
করলে তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। আলোচনায় অংশ নেন দেশবরেণ্য আইনজীবী
ব্যারিস্টার রফিক- উল হক এবং বিশিষ্ট ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বার
কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন। তবে টক শোতে
টেলিফোনে অংশ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন টিমের প্রধান সমন্বয়কারী এম
কে রহমান বলেছেন, বিদ্যমান আইনানুযায়ী সরকার খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করতে
পারবে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিরুদ্ধেও সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী
আপিলের সুযোগ রয়েছে। টেলিফোনে অংশ নিয়ে ট্রাইব্যুনালের ডিফেন্স টিমের
প্রধান সমন্বয়কারী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ট্রাইব্যুনালে সরকার
পরে একজন সাীও বলেননি যে আবদুল কাদের মোল্লাকে তিনি অপরাধ করতে দেখেছেন।
সবাই শোনা কথার ওপর ভিত্তি করেই জবানবন্দী দিয়েছেন। আমরা এ রায়কে যৌক্তিক
মনে করি না বিধায় এর বিরুদ্ধে আপিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গতকাল সন্ধ্যায়
দিগন্ত টেলিভিশনে টক শোতে অংশ নিয়ে তারা এ মতামত তুলে ধরেন।
রফিক-উল হক : আবদুল কাদের মোল্লাকে দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় প্রত্যাখ্যান করে তার ফাঁসির দাবিতে সরকারি দলের আন্দোলন ও বিােভের বিষয়ে প্রথিতযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক- উল হক বলেন, আইন ও আদালতকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত। আন্দোলন, বিােভ ও সংগ্রাম করে আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা মোটেও কাম্য নয়। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন। সরকারি দল এখন তার ফাঁসির দাবিতে বিােভ করছে। ওই বিােভে কেন্দ্রীয় নেতারা এমনকি মন্ত্রীরাও গিয়ে ফাঁসির দাবিতে বক্তব্য দিচ্ছেন। সামনে আরো মামলার রায় অপেমাণ। এই অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কাছে একটি মেসেজ যাচ্ছে। সামনে যদি কাউকে ফাঁসি দেয়া হয়, তাহলে এটা মনে করা খুবই স্বাভাবিক হবে যে, বিচারকরা সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের ভয়ে এই রায় দিয়েছেন। মন্ত্রী ও সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে রাস্তায় নেমেছেন, তাতে বিচারকদের মাথায় কয়টা ঘাড় যে তারা ফাঁসি ছাড়া অন্য রায় দেবেন? কাজেই আমি বলব, ফাঁসির দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন এমনকি ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতেও যারা আন্দোলন করছেন তারা ঠিক কাজটি করছেন না। এতে করে দেশ ভয়ানক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা কারো জন্যই কাম্য হতে পারে না। আইনকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্যেই আদালত গঠন করুক না কেন, বিচারকরা ‘নিউট্রাল’ বিচার করবেন, এটাই জাতি প্রত্যাশা করে। আদালত রায় দিয়েছেন। সংসদে সরকারি দলের এমপিরাও এ নিয়ে এ কথা বলছেন। এটা বড়ই দুঃখজনক। একজন দর্শকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদালত বা রায় নিয়ে হরতাল ও অবরোধ করা উচিত হচ্ছে না। হরতাল বা অবরোধ করে ফাঁসি দেয়া যাবে না। এতে দেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। বিচারকরা সব সময় ভয়ে থাকবেন। এসব করে যদি আদালতের কাছ থেকে ফাঁসি আদায় করা হয়, সেটা হবে দুঃখজনক। ব্যারিস্টার হক বলেন, রায়ের পর পুলিশ প্রটেকশনে বিােভ হচ্ছে। মন্ত্রীরা সেখানে গিয়ে বলেছেন, এ রায় মানি না। তাহলে বিচারকরা কী করে তাদের রায় দেবেন? যেভাবে ফাঁসির দাবি উঠেছে, বিচারকদের তো ফাঁসি না দিয়ে কোনো উপায় নেই। ভবিষ্যতে যে রায় দেবেন তাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ফাঁসির আদেশ না দিলে, যে বিচারক ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি। তার কী অবস্থা হবে। তার ফ্যামিলির কী অবস্থা। কে তাদের প্রটেকশন দেবে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশকে একটা আইডিয়েল সিচুয়েশন এ আসতে হবে। এবনরমাল সিচুয়েশনে থাকবে তা কিন্তু কেউ চায় না। এবনরমাল অবস্থা আছে এটা অবশ্যই নরমাল হবে।
খন্দকার মাহবুব হোসেন : রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের বিষয়ে তিনি বলেন, সাজার বিরুদ্ধে আসামিপ আপিল করতে পারবে। সরকারপরে আপিলের কোনো সুযোগ নেই। এটাই হচ্ছে আইনের স্পষ্ট বিধান। তবে কোনো অপরাধের জন্য কাউকে খালাস দেয়া হলে বাদিপ বা সরকার তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে। এখানে একটি অপরাধের অভিযোগ থেকে যেহেতু কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হয়েছে, সে েেত্র সরকার আপিল করতে পারবে। খন্দকার মাহবুব হোসেনের এ বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হকও।
একজন দর্শকের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনপ্রক্রিয়ার সমালোচনা করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সরকার এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। যদি তাই না হতো তাহলে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নাম দিয়ে দলীয় আইনজীবী, দলীয় তদন্ত কর্মকর্তা ও দেশীয় বিচারকদের নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হতো না। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে নিয়ে শুরুতেই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সক্রিয়ভাবে আন্দোলন করেছেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তিনিই একবার এর বিচারও করেছেন। এ ধরনের বিতর্কিত লোক দিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকারই বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এখানে ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটি ছাড়া আর কিছুই আন্তর্জাতিক মানের নেই। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারে বাধা প্রদানকারীরাও সমান অপরাধী’Ñ এই বক্তব্যকে সমর্থন করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমানে যে আইনে জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের বিচার হচ্ছেÑ এই আইনটি ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তান আর্মির ৪৫ হাজার সেনাসদস্যের ভেতর থেকে গুরুতর অপরাধী হিসেবে ওই ১৯৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুই তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। মুল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার অপরাধে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শেখ মুজিবেরও মরণোত্তর বিচার দাবি করতে পারে।
অপর একজন দর্শকের প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর ছিলাম। ওই সময় দালাল আইনে বিচারের জন্য এ দেশীয় ২৮ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাদের আটক করা হয়েছে ওই ২৮ হাজার বন্দীর মধ্যে এরা কেউ ছিলেন না। এরা যদি এতই ভয়ঙ্কর অপরাধী হতেন তাহলে এদের একজনকেও ওই সময় গ্রেফতার তো দূরের কথা এদের কারো বিরুদ্ধে দেশের কোনো একটি থানায় একটি জিডিও করা হলো না কেন? তিনি বলেন, যে কাদের মোল্লাকে এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, তিনিই স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন আবার বিশ^বিদ্যালয় এলাকার ভেতরে উদয়ন স্কুলে শিকতা করেছেন। তিনি যদি ‘কসাই কাদের কিংবা জল্লাদ কাদের’ হন তাহলে আজকে যারা তার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা কেন তাকে ওই সময় আটক করে পুলিশে দিলেন না? এ ধরনের অনেক প্রশ্ন আজ সাধারণ জনগণের মাঝে। ফজলুল কাদের চৌধুরীকে দালাল আইনে আটক করা হয়েছিল। এখন তার ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই সময় তার বাবার সাথে তাকেও কেন গ্রেফতার করা হলো না কংবা তার নামে একটি মামলা বা জিডি করা হলো না? মূলত সরকারের কিছু লোক তাদের রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের এ প্রক্রিয়ার সাথে নেই। মানুষ চায় এখন তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হোক।
অপর একজন দর্শকের প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকার সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছে। বিরোধী দল বলছে যে নামেই হোক নিরপে ও নির্দলীয় সরকারপদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। এখন সরকার বলছে বিরোধী দল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এ দাবি করছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির দাবি মেনে বিরোধী দলের মুখ বন্ধ করছে না? আমি মনে করি, সরকার নিজেই ইচ্ছাকৃতভাবে দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল ও স্বাধীনতার ৫১ বছর পর এসে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আয়োজন করেছে।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক : আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিষয়ে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, এই রায় ন্যায়ভ্রষ্ট। এর বিরুদ্ধে আমরা আপিল করব। তার বিরুদ্ধে সরকারের উত্থাপিত অভিযোগের পে কোনো চাুষ সাী ছিল না। যারাই সাী দিয়েছেন, তারা সবাই অপরের কাছ থেকে ঘটনা শুনেছেন বলে আদালতকে জানান। সরকারপরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাী হচ্ছেন কবি রোজি। তিনি যুদ্ধের ৯ মাসই ভারতে ছিলেন। ভারত থেকে দেশে এসে তিনি শুনেছেন যে আবদুল কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন নেছাকে হত্যা করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, কবি রোজি ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ২০১১ সালে একটি বই লিখেছেন। যা ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। ওই বইয়ে আবদুল কাদের মোল্লার নামটিও উল্লেখ নেই। সেখানে অনেক হত্যাকারীর নামই উল্লেখ রয়েছে। জেরার সময় তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি ভয়ে বইটিতে আবদুল কাদের মোল্লার নাম উল্লেখ করিনি। পরের প্রশ্নে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কাদের মোল্লা তো ২০১০ সাল থেকেই কারাগারে। আপনি কার ভয়ে তার নামটি উল্লেখ করেননি। তিনি এ প্রশ্নের জবাব দেননি। খন্দকার আবুল হাসান নামে আরেকজন প্রত্যদর্শী সাী রয়েছেন। তিনিও আদালতে বলেছেন, তিনি তার গাড়িচালকের কাছ থেকে শুনেছেন যে, আবদুল কাদের মোল্লা তার বাবাকে হত্যা করেছেন। এসব সাীর জবানবন্দীর ভিত্তিতে আইনের দৃষ্টিতে এ বিচার চলতে পারে না। জনগণের আদালতে হতে পারে। এ কারণেই আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। আশা করছি আপিল বিভাগে আবদুল কাদের মোল্লা বেকসুর খালাস পাবেন।
এম কে রহমান : অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন টিমের প্রধান সমন্বয়কারী এম কে রহমান উপস্থাপকের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরাতো প্রত্যাশিত রায় পাইনি। যেহেতু পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাই মৃত্যুদণ্ড আশা করেছিলাম। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন। একটা অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আমরা এখন আপিল করব। আশা করি আপিল বিভাগে ন্যায় বিচার পাবো। ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য অনেক হুমকি দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ভেঙে না দিলে উড়িয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবেই চলছে। এটা একটা অবিশ^াস্য ব্যাপার যে ৪০ বছর পর একটি অপরাধের বিচার হচ্ছে। জনপ্রত্যাশার একটা ব্যাপার আছে।
এম কে রহমান বলেন, খালাস দিলে আপিলের বিধান আছে। আপিল করার পর আমরা ন্যায়বিচার পেতে পারি। আদালত বলেছেন, পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত। তাই প্রসিকিউশন ব্যর্থ হয়েছে বলা যায় না।
রফিক-উল হক : আবদুল কাদের মোল্লাকে দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় প্রত্যাখ্যান করে তার ফাঁসির দাবিতে সরকারি দলের আন্দোলন ও বিােভের বিষয়ে প্রথিতযশা আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক- উল হক বলেন, আইন ও আদালতকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত। আন্দোলন, বিােভ ও সংগ্রাম করে আদালতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা মোটেও কাম্য নয়। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন। সরকারি দল এখন তার ফাঁসির দাবিতে বিােভ করছে। ওই বিােভে কেন্দ্রীয় নেতারা এমনকি মন্ত্রীরাও গিয়ে ফাঁসির দাবিতে বক্তব্য দিচ্ছেন। সামনে আরো মামলার রায় অপেমাণ। এই অবস্থায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের কাছে একটি মেসেজ যাচ্ছে। সামনে যদি কাউকে ফাঁসি দেয়া হয়, তাহলে এটা মনে করা খুবই স্বাভাবিক হবে যে, বিচারকরা সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীদের ভয়ে এই রায় দিয়েছেন। মন্ত্রী ও সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে রাস্তায় নেমেছেন, তাতে বিচারকদের মাথায় কয়টা ঘাড় যে তারা ফাঁসি ছাড়া অন্য রায় দেবেন? কাজেই আমি বলব, ফাঁসির দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন এমনকি ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবিতেও যারা আন্দোলন করছেন তারা ঠিক কাজটি করছেন না। এতে করে দেশ ভয়ানক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা কারো জন্যই কাম্য হতে পারে না। আইনকে তার নিজস্ব গতিতেই চলতে দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্যেই আদালত গঠন করুক না কেন, বিচারকরা ‘নিউট্রাল’ বিচার করবেন, এটাই জাতি প্রত্যাশা করে। আদালত রায় দিয়েছেন। সংসদে সরকারি দলের এমপিরাও এ নিয়ে এ কথা বলছেন। এটা বড়ই দুঃখজনক। একজন দর্শকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আদালত বা রায় নিয়ে হরতাল ও অবরোধ করা উচিত হচ্ছে না। হরতাল বা অবরোধ করে ফাঁসি দেয়া যাবে না। এতে দেশের পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। বিচারকরা সব সময় ভয়ে থাকবেন। এসব করে যদি আদালতের কাছ থেকে ফাঁসি আদায় করা হয়, সেটা হবে দুঃখজনক। ব্যারিস্টার হক বলেন, রায়ের পর পুলিশ প্রটেকশনে বিােভ হচ্ছে। মন্ত্রীরা সেখানে গিয়ে বলেছেন, এ রায় মানি না। তাহলে বিচারকরা কী করে তাদের রায় দেবেন? যেভাবে ফাঁসির দাবি উঠেছে, বিচারকদের তো ফাঁসি না দিয়ে কোনো উপায় নেই। ভবিষ্যতে যে রায় দেবেন তাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ফাঁসির আদেশ না দিলে, যে বিচারক ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি। তার কী অবস্থা হবে। তার ফ্যামিলির কী অবস্থা। কে তাদের প্রটেকশন দেবে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশকে একটা আইডিয়েল সিচুয়েশন এ আসতে হবে। এবনরমাল সিচুয়েশনে থাকবে তা কিন্তু কেউ চায় না। এবনরমাল অবস্থা আছে এটা অবশ্যই নরমাল হবে।
খন্দকার মাহবুব হোসেন : রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের বিষয়ে তিনি বলেন, সাজার বিরুদ্ধে আসামিপ আপিল করতে পারবে। সরকারপরে আপিলের কোনো সুযোগ নেই। এটাই হচ্ছে আইনের স্পষ্ট বিধান। তবে কোনো অপরাধের জন্য কাউকে খালাস দেয়া হলে বাদিপ বা সরকার তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে। এখানে একটি অপরাধের অভিযোগ থেকে যেহেতু কাদের মোল্লাকে খালাস দেয়া হয়েছে, সে েেত্র সরকার আপিল করতে পারবে। খন্দকার মাহবুব হোসেনের এ বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হকও।
একজন দর্শকের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনপ্রক্রিয়ার সমালোচনা করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সরকার এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। যদি তাই না হতো তাহলে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল নাম দিয়ে দলীয় আইনজীবী, দলীয় তদন্ত কর্মকর্তা ও দেশীয় বিচারকদের নিয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হতো না। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে নিয়ে শুরুতেই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সক্রিয়ভাবে আন্দোলন করেছেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে তিনিই একবার এর বিচারও করেছেন। এ ধরনের বিতর্কিত লোক দিয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সরকারই বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এখানে ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটি ছাড়া আর কিছুই আন্তর্জাতিক মানের নেই। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারে বাধা প্রদানকারীরাও সমান অপরাধী’Ñ এই বক্তব্যকে সমর্থন করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমানে যে আইনে জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের বিচার হচ্ছেÑ এই আইনটি ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তান আর্মির ৪৫ হাজার সেনাসদস্যের ভেতর থেকে গুরুতর অপরাধী হিসেবে ওই ১৯৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুই তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। মুল যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার অপরাধে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শেখ মুজিবেরও মরণোত্তর বিচার দাবি করতে পারে।
অপর একজন দর্শকের প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর ছিলাম। ওই সময় দালাল আইনে বিচারের জন্য এ দেশীয় ২৮ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাদের আটক করা হয়েছে ওই ২৮ হাজার বন্দীর মধ্যে এরা কেউ ছিলেন না। এরা যদি এতই ভয়ঙ্কর অপরাধী হতেন তাহলে এদের একজনকেও ওই সময় গ্রেফতার তো দূরের কথা এদের কারো বিরুদ্ধে দেশের কোনো একটি থানায় একটি জিডিও করা হলো না কেন? তিনি বলেন, যে কাদের মোল্লাকে এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, তিনিই স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন আবার বিশ^বিদ্যালয় এলাকার ভেতরে উদয়ন স্কুলে শিকতা করেছেন। তিনি যদি ‘কসাই কাদের কিংবা জল্লাদ কাদের’ হন তাহলে আজকে যারা তার ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা কেন তাকে ওই সময় আটক করে পুলিশে দিলেন না? এ ধরনের অনেক প্রশ্ন আজ সাধারণ জনগণের মাঝে। ফজলুল কাদের চৌধুরীকে দালাল আইনে আটক করা হয়েছিল। এখন তার ছেলে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই সময় তার বাবার সাথে তাকেও কেন গ্রেফতার করা হলো না কংবা তার নামে একটি মামলা বা জিডি করা হলো না? মূলত সরকারের কিছু লোক তাদের রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের এ প্রক্রিয়ার সাথে নেই। মানুষ চায় এখন তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হোক।
অপর একজন দর্শকের প্রশ্নের জবাবে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকার সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছে। বিরোধী দল বলছে যে নামেই হোক নিরপে ও নির্দলীয় সরকারপদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। এখন সরকার বলছে বিরোধী দল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে এ দাবি করছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সরকার কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির দাবি মেনে বিরোধী দলের মুখ বন্ধ করছে না? আমি মনে করি, সরকার নিজেই ইচ্ছাকৃতভাবে দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিল ও স্বাধীনতার ৫১ বছর পর এসে যুদ্ধাপরাধের বিচারের আয়োজন করেছে।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক : আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিষয়ে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, এই রায় ন্যায়ভ্রষ্ট। এর বিরুদ্ধে আমরা আপিল করব। তার বিরুদ্ধে সরকারের উত্থাপিত অভিযোগের পে কোনো চাুষ সাী ছিল না। যারাই সাী দিয়েছেন, তারা সবাই অপরের কাছ থেকে ঘটনা শুনেছেন বলে আদালতকে জানান। সরকারপরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাী হচ্ছেন কবি রোজি। তিনি যুদ্ধের ৯ মাসই ভারতে ছিলেন। ভারত থেকে দেশে এসে তিনি শুনেছেন যে আবদুল কাদের মোল্লা কবি মেহেরুন নেছাকে হত্যা করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, কবি রোজি ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে ২০১১ সালে একটি বই লিখেছেন। যা ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। ওই বইয়ে আবদুল কাদের মোল্লার নামটিও উল্লেখ নেই। সেখানে অনেক হত্যাকারীর নামই উল্লেখ রয়েছে। জেরার সময় তাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি ভয়ে বইটিতে আবদুল কাদের মোল্লার নাম উল্লেখ করিনি। পরের প্রশ্নে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কাদের মোল্লা তো ২০১০ সাল থেকেই কারাগারে। আপনি কার ভয়ে তার নামটি উল্লেখ করেননি। তিনি এ প্রশ্নের জবাব দেননি। খন্দকার আবুল হাসান নামে আরেকজন প্রত্যদর্শী সাী রয়েছেন। তিনিও আদালতে বলেছেন, তিনি তার গাড়িচালকের কাছ থেকে শুনেছেন যে, আবদুল কাদের মোল্লা তার বাবাকে হত্যা করেছেন। এসব সাীর জবানবন্দীর ভিত্তিতে আইনের দৃষ্টিতে এ বিচার চলতে পারে না। জনগণের আদালতে হতে পারে। এ কারণেই আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব। আশা করছি আপিল বিভাগে আবদুল কাদের মোল্লা বেকসুর খালাস পাবেন।
এম কে রহমান : অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন টিমের প্রধান সমন্বয়কারী এম কে রহমান উপস্থাপকের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরাতো প্রত্যাশিত রায় পাইনি। যেহেতু পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, তাই মৃত্যুদণ্ড আশা করেছিলাম। এ নিয়ে ট্রাইব্যুনালে ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন। একটা অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। আমরা এখন আপিল করব। আশা করি আপিল বিভাগে ন্যায় বিচার পাবো। ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবে কাজ করেছে। বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য অনেক হুমকি দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ভেঙে না দিলে উড়িয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল স্বাধীনভাবেই চলছে। এটা একটা অবিশ^াস্য ব্যাপার যে ৪০ বছর পর একটি অপরাধের বিচার হচ্ছে। জনপ্রত্যাশার একটা ব্যাপার আছে।
এম কে রহমান বলেন, খালাস দিলে আপিলের বিধান আছে। আপিল করার পর আমরা ন্যায়বিচার পেতে পারি। আদালত বলেছেন, পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত। তাই প্রসিকিউশন ব্যর্থ হয়েছে বলা যায় না।
No comments