কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক কে. জি. মুস্তাফা by নিয়ামত হোসেন
'একে একে নিভিছে দেউটি।' কেজি মুস্তাফার চলে যাওয়ার সংবাদ শুনে সবার আগে
রবীন্দ্রকবিতার এই লাইনটি মনে আসে। এদেশের সাংবাদিকতার ৰেত্রে
কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
সাহিত্য, শিৰা, সংস্কৃতি,
সাংবাদিকতা ইত্যাদি ৰেত্রের এমন মানুষ যখন আমাদের মধ্য থেকে চলে যান
চিরবিদায় নিয়ে, তখন মনে হয় তিনি যে অঙ্গনেরই হোন না কেন, তিনি যেন দীপ্যমান
ছিলেন আলোর শিখার মতো, তাঁর চলে যাওয়া ঐ শিখাটি নিভে যাওয়া। আমাদের সমাজে এ
ধরনের মানুষের চলে যাওয়ার অর্থ_ যিনি চলে গেলেন তাঁর চলে যাওয়ায় শুধু তাঁর
পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হলো না, ৰতিগ্রসত্ম হলো গোটা দেশ। তাঁদের একেক জনের
চলে যাওয়া যেন একেকটি প্রদীপের আলো বিতরণ বন্ধ হয়ে যাওয়া। ঐ আলো আমাদের
সমাজের জন্য অতীব প্রয়োজন। ঐ আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠা, তাঁদের আলোয় পথ চিনে
নবীনদের এগিয়ে যাওয়া সমাজের জন্যই প্রয়োজন। তাঁদের চলে যাওয়ায় তাই
ক্ষতিগ্রসত্ম হয় গোটা সমাজ। কে.জি. মুস্তাফার চলে যাওয়ায় আমাদের সমাজ,
আমাদের দেশ সে-রকমই ৰতিগ্রসত্ম হলো।
কে.জি. মুসস্তাফা এদেশের সাংবাদিকতার ৰেত্রে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বলতে গেলে সাংবাদিকতার জীবনে তিনি যে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন, তাতে তিনি এই অঙ্গনে এক 'মিথ' হয়ে উঠেছিলেন, যেন জীবদ্দশায় হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি বা প্রবাদপুরুষের মতো।
ঢাকার এক হাসপাতালে শনিবার কে.জি. মুসস্তাফা ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩। কিছুদিন ধরে কিডনি ও হার্টের অসুখে ভুগছিলেন। ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ঐ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে আইসিইউতে নেয়া হয়। এরপর শনিবার তাঁর চিরবিদায়। তাঁর মৃত্যুতে একদিক থেকে দৈনিক জনকণ্ঠও হারালো তার অতি আপনজনকে। জনকণ্ঠের সঙ্গে তিনি ছিলেন একাত্ম। দীর্ঘদিন তিনি এ পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। অসুস্থ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি জনকণ্ঠে নিয়মিত লিখেছেন। তাঁর লেখায় অগণিত গুণগ্রাহী ভক্ত-পাঠক গড়ে উঠেছিল। এদিক থেকে বলা যায়, জীবনের প্রায় শেষ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। এই সম্পৃক্ততার সূচনা সুদূর অতীতে সেই পাকিস্তানী আমলে। সেই থেকে যে নিবিড় সম্পর্ক সাংবাদিকতার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তার চিরঅবসান ঘটল তাঁর চলে যাওয়ায়।
এক বর্ণাঢ্য চরিত্রের মানুষ ছিলেন কে.জি. মুস্তাফা। সাংবাদিকতা জীবনে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দৈনিক আজাদ, ইত্তেহাদ, সংবাদ, অবজারভার, মুক্তকণ্ঠ ইত্যাদি। মুক্তকণ্ঠ পত্রিকাটি তাঁর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কিছুদিন পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বরাবরই উজ্জ্বল। তবে সেটা বিশেষভাবে উজ্জ্বল পাকিস্তানী আমলে। সে আমলে সাংবাদিক সংগঠনের কাজে তাঁর ভূমিকাকে ঐতিহাসিক বলা যায়। পাকিস্তানী আমলে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা কোন পর্যায়ে ছিল সেটা বোঝা যাবে এই তথ্যে যে, তিনি সেই আমলের এক পর্যায়ে ছিলেন পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। সে সময় ঐ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট পাকিস্তানী সাংবাদিক মিনহাজ বার্না। সাংবাদিকদের সংগঠিত করা, তাঁদের ইউনিয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা, তাঁদের স্বার্থ সমুন্নত রাখা, তাদের জন্য বেতনবোর্ড যাতে গঠিত হয় সে ব্যাপারে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি কাজে পাকিস্তানের ঐ আমলে যাঁরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন কে.জি. মুস্তাফা ছিলেন তাঁদেরই একজন। তাঁর নেতৃত্বে সে সময় পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন অর্থাৎ পিএফইউজে বিরাট ভূমিকা পালন করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন তথা বিএফইউজের ব্যাপারেও যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
সারা জীবন তিনি ছিলেন প্রগতির পৰের মানুষ। এদেশের ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। তিনি ছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশের পৰে, দেশের ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতির পৰে বরাবরই ছিলেন সোচ্চার। গণমানুষের রাজনীতির সঙ্গে ছিল তাঁর যোগ। ফলে চিন্তাচেতনায় ছিল সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা, ছিল মানবপ্রেম, দেশপ্রেম। এখানে তাঁর অপর এক ভাই সম্পর্কে কিছু বলা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তাঁর সে ভাইও ছিলেন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর নাম খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের রাজনীতিতে এই দুই ভাই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন অল্পকিছু দিনের মধ্যে। এর কারণ তাঁরা দু'জনই ছিলেন গতানুগতিক পাকিস্তানী তোষামোদকারী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কে.জি. মুস্তাফার বড় ভাই খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস মওলানা ভাসানীর সানি্নধ্য লাভ করেছিলেন। মওলানা সাহেবের ওপর একটি বই লিখে তিনি সে সময় ব্যাপকভাবে বিখ্যাত এবং আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। বইটির নাম 'ভাসানী যখন ইউরোপে।' বইটি প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পরই পাকিস্তান সরকার সেটাকে বাজেয়াপ্ত করে। এরপর বইটির জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। গোপনে গোপনে বইটি যোগাড় করার জন্য পাঠাকরা সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, সে সময় বেশ কয়েকটি বই পাকিস্তান সরকার এদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এগুলোর মধ্যে একটি প্রবোধকুমার সান্ন্যালের হাঁসুবানু। আরেকটি 'ইলা মিত্র।' প্রবোধ কুমার সান্ন্যাল বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখক। আরেক খ্যাতিমান লেখক গোলাম কুদ্দুস। ইলা মিত্র বইটি কবিতার। লিখেছিলেন গোলাম কুদ্দুস। ইলা মিত্রের ওপর সে সময়ে পূর্বপাকিস্তান সরকার যে ভয়াবহ অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছিল তারই কাহিনী ঐ কাব্য গ্রন্থটি। শোনা যায় কলকাতায় বইটি ছাপার পর বাঁধাই খানায় বাঁধাই হতে হতে পুরোটি বিক্রি হয়ে যায়। কবি গোলাম কুদ্দুসের সেই 'ইলা মিত্র' গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করা হয় পাকিস্তানে। 'ভাসানী যখন ইউরোপে' বইটির ওপরও পাকিস্তানী শাসকচক্রের খ্তগ একইভাবে নেমে আসে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী শান্তি সম্মেলনে স্টকহোমে গিয়েছিলেন; মূলত বইটি তার ওপরেই লেখা। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে দু'টি নাম সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সকলের পরিচিত। একজন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, অপরজন তাঁর ভাই কে.জি. মুস্তাফা। দু'জনই বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে এদেশের মানুষের ভাষা আন্দোলনসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন দু'জনেই।
কে.জি. মুস্তাফা চলে গেলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন এদেশের সাংবাদিকতা জগতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তাঁর চলে যাওয়ায় এই জগতের এক বিরাট ক্ষতি হলো। সৃষ্টি হলো এক বড় ধরনের শূন্যতার। এ শূন্য পূরণ হবার নয়। সাংবাদিকতা জগতের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমরা হারিয়েছি। তাঁদের প্রত্যেকের মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ জগত। শুধু সাংবাদিকতার জগতই নয়, চিন্তা চেতনা এবং বামপন্থী ধারার যে সব সংগ্রামী মানুষ চলে গেছেন তাঁদের প্রত্যেকের চলে যাওয়া গোটা দেশের জন্য ৰতির। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এঁদের চিন্তার জড়তা নেই, সিদ্ধান্তে দ্বিধা নেই। অতীতে পাকিস্তানী ধারার রাজনৈতিক মতবাদ ও চিন্তাকে তাঁরা যেমন প্রত্যাখ্যান করে দেশের ভাষা সংস্কৃতির ব্যাপারে দেশের মানুষের স্বার্থের ব্যাপারে আপসহীন ভূমিকা পালন করেছেন সেই একই সময়ে অনেক বুদ্ধিজীবী রাজনীতিক ছিলেন ভিন্ন ধারার রাজনীতি আঁকড়ে। কে.জি. মুস্তাফা এবং তাঁর মতো ব্যক্তিরা দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থের ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। কে.জি. মুস্তাফার পক্ষে এটা বিশেষভাবে সম্ভব হয়েছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই তাঁর ভেতর গড়ে ওঠা বাম ধারার চিন্তাচেতনার কারণেই। এ জন্য পাকিস্তানী আমলে তাঁর মতো মানুষকে জেলও খাটতে হয়েছে। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাস এতটুকু টলেনি। নিজ বিশ্বাসের প্রতিও তিনি ছিলেন আপসহীন।
ভাষা-সংগ্রামী , প্রবীণ এই সাংবাদিকের স্মৃতির প্রতি আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা।
কে.জি. মুসস্তাফা এদেশের সাংবাদিকতার ৰেত্রে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বলতে গেলে সাংবাদিকতার জীবনে তিনি যে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন, তাতে তিনি এই অঙ্গনে এক 'মিথ' হয়ে উঠেছিলেন, যেন জীবদ্দশায় হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি বা প্রবাদপুরুষের মতো।
ঢাকার এক হাসপাতালে শনিবার কে.জি. মুসস্তাফা ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩। কিছুদিন ধরে কিডনি ও হার্টের অসুখে ভুগছিলেন। ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ঐ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে আইসিইউতে নেয়া হয়। এরপর শনিবার তাঁর চিরবিদায়। তাঁর মৃত্যুতে একদিক থেকে দৈনিক জনকণ্ঠও হারালো তার অতি আপনজনকে। জনকণ্ঠের সঙ্গে তিনি ছিলেন একাত্ম। দীর্ঘদিন তিনি এ পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। অসুস্থ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি জনকণ্ঠে নিয়মিত লিখেছেন। তাঁর লেখায় অগণিত গুণগ্রাহী ভক্ত-পাঠক গড়ে উঠেছিল। এদিক থেকে বলা যায়, জীবনের প্রায় শেষ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতার সঙ্গে। এই সম্পৃক্ততার সূচনা সুদূর অতীতে সেই পাকিস্তানী আমলে। সেই থেকে যে নিবিড় সম্পর্ক সাংবাদিকতার সঙ্গে গড়ে উঠেছিল তার চিরঅবসান ঘটল তাঁর চলে যাওয়ায়।
এক বর্ণাঢ্য চরিত্রের মানুষ ছিলেন কে.জি. মুস্তাফা। সাংবাদিকতা জীবনে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দৈনিক আজাদ, ইত্তেহাদ, সংবাদ, অবজারভার, মুক্তকণ্ঠ ইত্যাদি। মুক্তকণ্ঠ পত্রিকাটি তাঁর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কিছুদিন পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা বরাবরই উজ্জ্বল। তবে সেটা বিশেষভাবে উজ্জ্বল পাকিস্তানী আমলে। সে আমলে সাংবাদিক সংগঠনের কাজে তাঁর ভূমিকাকে ঐতিহাসিক বলা যায়। পাকিস্তানী আমলে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা কোন পর্যায়ে ছিল সেটা বোঝা যাবে এই তথ্যে যে, তিনি সেই আমলের এক পর্যায়ে ছিলেন পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট। সে সময় ঐ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিশিষ্ট পাকিস্তানী সাংবাদিক মিনহাজ বার্না। সাংবাদিকদের সংগঠিত করা, তাঁদের ইউনিয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা, তাঁদের স্বার্থ সমুন্নত রাখা, তাদের জন্য বেতনবোর্ড যাতে গঠিত হয় সে ব্যাপারে ভূমিকা রাখা ইত্যাদি কাজে পাকিস্তানের ঐ আমলে যাঁরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন কে.জি. মুস্তাফা ছিলেন তাঁদেরই একজন। তাঁর নেতৃত্বে সে সময় পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন অর্থাৎ পিএফইউজে বিরাট ভূমিকা পালন করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন তথা বিএফইউজের ব্যাপারেও যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
সারা জীবন তিনি ছিলেন প্রগতির পৰের মানুষ। এদেশের ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। তিনি ছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশের পৰে, দেশের ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতির পৰে বরাবরই ছিলেন সোচ্চার। গণমানুষের রাজনীতির সঙ্গে ছিল তাঁর যোগ। ফলে চিন্তাচেতনায় ছিল সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা, ছিল মানবপ্রেম, দেশপ্রেম। এখানে তাঁর অপর এক ভাই সম্পর্কে কিছু বলা হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তাঁর সে ভাইও ছিলেন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর নাম খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের রাজনীতিতে এই দুই ভাই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন অল্পকিছু দিনের মধ্যে। এর কারণ তাঁরা দু'জনই ছিলেন গতানুগতিক পাকিস্তানী তোষামোদকারী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। কে.জি. মুস্তাফার বড় ভাই খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস মওলানা ভাসানীর সানি্নধ্য লাভ করেছিলেন। মওলানা সাহেবের ওপর একটি বই লিখে তিনি সে সময় ব্যাপকভাবে বিখ্যাত এবং আলোচিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। বইটির নাম 'ভাসানী যখন ইউরোপে।' বইটি প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পরই পাকিস্তান সরকার সেটাকে বাজেয়াপ্ত করে। এরপর বইটির জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পায়। গোপনে গোপনে বইটি যোগাড় করার জন্য পাঠাকরা সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, সে সময় বেশ কয়েকটি বই পাকিস্তান সরকার এদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এগুলোর মধ্যে একটি প্রবোধকুমার সান্ন্যালের হাঁসুবানু। আরেকটি 'ইলা মিত্র।' প্রবোধ কুমার সান্ন্যাল বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখক। আরেক খ্যাতিমান লেখক গোলাম কুদ্দুস। ইলা মিত্র বইটি কবিতার। লিখেছিলেন গোলাম কুদ্দুস। ইলা মিত্রের ওপর সে সময়ে পূর্বপাকিস্তান সরকার যে ভয়াবহ অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছিল তারই কাহিনী ঐ কাব্য গ্রন্থটি। শোনা যায় কলকাতায় বইটি ছাপার পর বাঁধাই খানায় বাঁধাই হতে হতে পুরোটি বিক্রি হয়ে যায়। কবি গোলাম কুদ্দুসের সেই 'ইলা মিত্র' গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করা হয় পাকিস্তানে। 'ভাসানী যখন ইউরোপে' বইটির ওপরও পাকিস্তানী শাসকচক্রের খ্তগ একইভাবে নেমে আসে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী শান্তি সম্মেলনে স্টকহোমে গিয়েছিলেন; মূলত বইটি তার ওপরেই লেখা। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে দু'টি নাম সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সকলের পরিচিত। একজন খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, অপরজন তাঁর ভাই কে.জি. মুস্তাফা। দু'জনই বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ফলে এদেশের মানুষের ভাষা আন্দোলনসহ সকল আন্দোলন সংগ্রামে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন দু'জনেই।
কে.জি. মুস্তাফা চলে গেলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন এদেশের সাংবাদিকতা জগতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তাঁর চলে যাওয়ায় এই জগতের এক বিরাট ক্ষতি হলো। সৃষ্টি হলো এক বড় ধরনের শূন্যতার। এ শূন্য পূরণ হবার নয়। সাংবাদিকতা জগতের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমরা হারিয়েছি। তাঁদের প্রত্যেকের মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ জগত। শুধু সাংবাদিকতার জগতই নয়, চিন্তা চেতনা এবং বামপন্থী ধারার যে সব সংগ্রামী মানুষ চলে গেছেন তাঁদের প্রত্যেকের চলে যাওয়া গোটা দেশের জন্য ৰতির। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এঁদের চিন্তার জড়তা নেই, সিদ্ধান্তে দ্বিধা নেই। অতীতে পাকিস্তানী ধারার রাজনৈতিক মতবাদ ও চিন্তাকে তাঁরা যেমন প্রত্যাখ্যান করে দেশের ভাষা সংস্কৃতির ব্যাপারে দেশের মানুষের স্বার্থের ব্যাপারে আপসহীন ভূমিকা পালন করেছেন সেই একই সময়ে অনেক বুদ্ধিজীবী রাজনীতিক ছিলেন ভিন্ন ধারার রাজনীতি আঁকড়ে। কে.জি. মুস্তাফা এবং তাঁর মতো ব্যক্তিরা দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থের ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। কে.জি. মুস্তাফার পক্ষে এটা বিশেষভাবে সম্ভব হয়েছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই তাঁর ভেতর গড়ে ওঠা বাম ধারার চিন্তাচেতনার কারণেই। এ জন্য পাকিস্তানী আমলে তাঁর মতো মানুষকে জেলও খাটতে হয়েছে। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাস এতটুকু টলেনি। নিজ বিশ্বাসের প্রতিও তিনি ছিলেন আপসহীন।
ভাষা-সংগ্রামী , প্রবীণ এই সাংবাদিকের স্মৃতির প্রতি আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা।
No comments