জামায়াত-শিবিরের ম্যানহোল রাজনীতি by ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান
জামায়াত-শিবির ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে
আধুনিকতার সকল উপকরণ ব্যবহার ও এর সুযোগ গ্রহণ করে। জীবনযাত্রার সকল
ক্ষেত্রে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে।
মনুষ্যসৃষ্ট কোন সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রেই তাদের আপত্তি নেই। এমনকি তাদের দল
পরিচালনার সিদ্ধান্তও যে মানুষই গ্রহণ করে সে বিষয়ে দলীয় সদস্যরা কোন
প্রশ্ন উত্থাপন করে না বা করতে পারে না। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে,
জামায়াত-শিবিরের অনুসারীরা তাদের নেতাকে সর্বশক্তিমান মহামানবের আসনে আসীন
করে। নেতার নির্দেশ তারা ঐশী বাণী বলে মনে করে। এজন্য আল্লাহ্ রাষ্ট্রের
রূপরেখা সম্পর্কে তারা সুষ্ঠুভাবে জানবার আগ্রহ বোধ করে না।
ব্যাংক-বীমায় অন্যদের মতো তারাও সুদ প্রদান ও গ্রহণ করে। কিন্তু এর নাম দেয়া হয় 'লাভ।" এজন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে তাদের পরিচালিত শাসন ব্যবস্থাই হবে 'আল্লাহর শাসন।' তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় এ রকম, জামায়াত-শিবির কি তখন ওহীপ্রাপ্ত একটি রাজনৈতিক দল বলে গণ্য হবে? তারা ৯১-এর নির্বাচনে 'সৎ লোকের শাসন'-এর একটি স্লোগান তুলেছিল। কিন্তু ২০০১-এ রাষ্ট্রমতার অংশীদার হবার পর থেকে এ স্লোগান অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। কারণ জামায়াত-শিবিরের অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে। তদুপরি মিডিয়ায় তাদের ৭১-এর কর্মকা- প্রকাশ হবার কারণেও এ স্লোগানটি সামনে আনতে পারছে না।
১৯৮০'র দশকে কেবল ধর্মীয় আবরণে ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে তারা তেমন রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়নি। নামাজ, রোজা, ইসলামের মৌলিক বিষয় নিয়েই সাধারণ ছাত্রদের সামনে হাজির হয়। প্রথমে তারা আধিপত্য বিস্তার করে খুলনা বিএল কলেজ ও রংপুর কারমাইকেল কলেজে। অতঃপর রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা ঘাঁটি স্থাপন করে। তখন ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারের সন্তানরা তাদের দিকে আকৃষ্ট হতো। ৮০'র দশকের মাঝামাঝি অনেক শিবির কর্মী ড. নজিবুল্লাহর সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আফগানিস্তান গমন করে এবং এর মধ্যে অনেকে প্রশিণ নিয়ে দেশেও ফিরে আসে। শিবির অধ্যুষিত এলাকায় এদেরকে অত্যন্ত গর্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো। বোরহানুদ্দীন রাব্বানী ও আহমদ শাহ্ মাসুদের সময়েও প্রচুর সংখ্যক শিবির কর্মী আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে দেশে ফেরত আসে এবং তারা ছাত্রশিবিরের মধ্যে আলাদা সামরিক ইউনিট গড়ে তোলে বলে জানা যায়। এ ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া অনেক কর্মী দেশের সামরিক ও বেসামরিক বহু জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। এখনও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের অনেক সংখ্যক সামরিক প্রশিক রয়েছে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ৭২-এর পর জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দেয়া কিছু ছাত্র পরবর্তীতে শিবিরের নেতৃত্ব পর্যায়ে চলে আসে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একজন সাবেক শিবির নেতার সাথে কথা বলার সময় জানান যে, প্রথমাবস্থায় তিনি জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধও করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের প্রথম সারির নেতার যোগ্যতা অর্জন করেন। তাঁর ভাষ্য থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পাহাড়ের উপর তাঁদের প্রশিক্ষণ চলত। এই প্রশিক্ষণ চলাকালে একজন কর্মীর বাহু উড়ে যায়। তখন তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঐ অনুসারী এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় সভাপতি। জেএমবির যেসব সামরিক প্রশিক্ষক এ পর্যন্ত ধরা পড়েছে, তাদের অনেকেই এ ধরনের স্বীকারোক্তি প্রদান করেছে যে, তারা অনেকে প্রাক্তন শিবিরকর্মী। রাজশাহীর বাগমারা, মোহনপুরে যখন সর্বহারার নামে নিরীহ মানুষকে বাংলা ভাইয়ের বাহিনী গাছের সাথে ঝুলিয়ে হত্যা করছিল, তখন মতিউর রহমান নিজামীর দেয়া বক্তব্য পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ থাকবে। নিজামী তখন এটিএন বাংলার মুন্নী সাহাকে বলেন, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। তার এই বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলা ভাই ও শায়খ রহমানের কর্মকাণ্ডে তাদের সমর্থন ছিল। এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ত কিছু শিক্ষক বাংলা ভাইকে মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু পরে ৫৮ জেলায় একযোগে বোমা হামলার পর যখন জেএমবি আত্মপ্রকাশ করে, তখন জামায়াত কিছুটা চুপসে যায়। অতএব, ইসলামের নামে পরিচালিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন যে জামায়াতেরই বিভিন্ন ইউনিট, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রথমদিকে ছাত্রশিবির নামাজ-রোজা করা ভাল ছেলে হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তখন তারা প্রায়শ মসজিদে বসে ধর্মীয় আলোচনার নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরামর্শ করত। অন্য ছাত্রদেরকে তারা নামাজে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাত। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যেহেতু ধর্মপ্রাণ, এজন্য তাদের ডাকে তখন অনেকেই সাড়া দেয়। কিন্তু এই সময় থেকেই তারা তাদের মিছিলে মাদ্রাসার ছাত্র ও বহিরাগতদেরকে নিয়ে আসে। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ ছাত্রশিবির নবীনবরণের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে অছাত্রদেরকে আমদানি করে। ঐদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষ বেধে যায় এবং সাবি্বর, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার নামে শিবিরের ৪ কর্মী মারা যায়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অনেক কর্মীও আহত হয়। বলা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের এটিই প্রথম সশস্ত্র মহড়া। কিন্তু এর ফল হলো ৪ তরুণ তাজা প্রাণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। এই ঘটনার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির আধিপত্য বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ঘাঁটি স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর, মির্জাপুর, ধরমপুর, ডাঁশমারী, মেহেরচণ্ডী ও নতুন বুধপাড়ায় স্থানীয় কিছু মানুষকে তারা বিভিন্নভাবে বশীভূত করে এবং তাদের তৈরি মেসগুলোতে ছাত্রশিবির শক্ত অবস্থান তৈরি করে। স্থানীয়ভাবে তারা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মসজিদে ইমামতি ও মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে ছাত্রশিবিরের এক ধরনের সামাজিকীকরণ হয়। কিন্তু প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের বিপরীতে তেমন কোন কর্মকৌশল গ্রহণ করতে পারেনি। জামায়াত-শিবির যে ধর্মকে ব্যবহার করে কিছু মানুষকে সন্ত্রাসী করে তুলছে, তা তারা বিবেকবান মানুষকে বোঝাতে সম হয়নি। এর বড় কারণ প্রগতিশীল শক্তির অনৈক্য। ছাত্রশিবিরের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হলে প্রতিপরে যে যথেষ্ট ধর্মীয় জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ছিল, তা তাদের মধ্যে কখনই আশাব্যঞ্জক ছিল না, এখনও নেই। ইত্যবসরে ছাত্রশিবিরের সাথে ছাত্রদল ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অনেক বার সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ১৯৮৮ সালের ১৭ নবেম্বর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে শিবিরের আসগর ও আসলাম মারা যায়। প্রতিটি সংঘর্ষের সময়েই এটা পরিলক্ষিত হয়েছে যে, ছাত্রশিবির কর্মীরা ময়দানে জীবন দেবার জন্য যেন উন্মাদ হয়ে যায়। ১০০ জন প্রতিপরে ছাত্রকে তারা ১০ জনে তাড়া করে নিয়ে যায়। তাদের এই সাহস মূলত জেহাদী উদ্দীপনা এবং সংঘর্ষে মারা গেলে পরিবার ও দেশের প্রতি সে চিন্তা না করে বরং শহীদ হবার নেশায় অস্থির হয়ে পড়ে। এভাবেই ১৯৮৯ সালের ১৮ এপ্রিল ছাত্রশিবিরের সফিক নিহত হয় এবং ১৯৯০ সালের ২২ জুন আমীর আলী হলে খলিলুর রহমানের মৃত্যু হয়।
মূলত ছাত্রমৈত্রীর প্রভাব থেকে চূড়ান্তভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের হাতে চলে যায় ১৯৯২ সালে। ঐ বছরের ১৭ মার্চ শিবির নবাব আব্দুল লতিফ হল গানপাউডার দিয়ে ভস্মীভূত ও ব্যাপক লুটতরাজ করে। এদিন প্রকাশ্যে ছাত্রশিবির আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া দেয়। অস্ত্র উঁচিয়ে ছাত্রশিবির সব হল দখল করে নেয় এবং ভিন্নমতের ছাত্র কর্মীদের হল থেকে বের করে দেয়। এমনকি তখন বিএনপি রাষ্ট্রীয় মতায় থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদল হলে অবস্থান করতে পারেনি। সরকার লতিফ হল মেরামতের জন্য ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। হল মেরামত হয় ঠিকই, কিন্তু হলগুলোতে তখন থেকে ছাত্রদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লোপ পায়। ১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ছাত্রশিবির মাদার বখ্শ, সোহরাওয়ার্দী ও শহীদ শামসুজ্জোহা হলে আক্রমণ করে এবং ছাত্রদলের বিশ্বজিৎ ও তপনকে হত্যা করে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান। তিনি ৭ ফেব্রুয়ারি হল পরিদর্শনে গেলে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় সাধারণ ছাত্রদের তোপের মুখে পড়েন এবং লাঞ্ছিত হন। ১৯৯৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ছাত্রমৈত্রী নেতা জোবায়ের চৌধুরী রিমু শের-ই-বাংলা হলের সামনে ছাত্রশিবিরের হাতে নিহত হয়। সাম্প্রতিক সময়ের মতো তখনও সমগ্র বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রিমুর মা জেলেনা চৌধুরী সম্ভবত সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সহসভানেত্রী ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তখন সংসদে আলোচনা হয় এবং সরকার ও প্রধান বিরোধী দল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একমত হয়। তখন সংসদ উপনেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, 'যারা ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যা করে, তারা সাইকোপ্যাথ।' কিন্তু পরবর্তীতে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হবার বিষয়টি ধামাচাপা পড়ায় স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী ক্ষোভের সাথে বলেন, 'রাজনীতিবিদদের চেহারা মানুষ দেখল।' ১৯৯৭ সালের ৭ জানুয়ারি শিক্ষক সমিতি ও ডিন সিন্ডিকেট নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী শিক্ষকদের প্যানেল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ৮ জানুয়ারি শিক সমিতি পূর্বনির্ধারিত এক কর্মসূচী অনুযায়ী উপাচাযের্র দফতরে পৌঁছালে ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র কর্মীরা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। এতে বেশ কিছু শিক আহত হন। ঐদিন অধ্যাপক মলয় ভৌমিককে হত্যার উদ্দেশ্যে তারা তাড়া করে। এর প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাসে ধর্মঘট ডাকে। ধর্মঘট ঠিকমতো পালিত হচ্ছে কি-না তা পর্যবেণের জন্য ১৪ জানুয়ারি সমিতির নেতৃবৃন্দ বের হলে ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা শিক্ষকদের ওপর হামলে পড়ে এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। শিক্ষকরা এই পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁরা সে বছরের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর আব্দুল খালেকের বাসায় তাণ্ডবলীলা চালায়। তখন বাসায় প্রহরারত পুলিশ নারী ও শিশুদের জীবন রক্ষা করে। এ সময় আরও দু'জন শিক্ষকের বাসায় এ ধরনের হামলা চালানো হয়েছিল। তখন রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার ছিলেন আমিনুল ইসলাম। অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রত্যভাবে শিবিরকে মদদ দেন। এর পর ২০০১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন মার্কেটে গানপাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পার্শ্ববর্তী মেহেরচণ্ডী গ্রামের আওয়ামী লীগ সমর্থক কিছু ব্যক্তির বাড়িঘর ভস্মীভূত করে। কিন্তু তাদের এসব কর্মকাণ্ডের যথাযথ বিচার সম্পন্ন হবার পূর্বেই জাতীয় নির্বাচনে চারদলীয় জোট সরকার মতায় আসে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে রদবদল হয়। এরপর শিবির প্রগতিশীল ছাত্র-শিক্ষকদের ঘুম হারাম করে দেয়। হলগুলোতে তাদের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পী ও খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি বন্ধ হয়। হলগুলোর সার্বিক অবস্থা তখন 'তালেবান' শাসনের পর্যায়ে পৌঁছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জেনেশুনেই এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তখন গভীর রাতে বিভিন্ন শিক্ষকের বাসায় ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ চলত। তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিপরীতে অবস্থান থাকায় প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুসকে হত্যা করে রাস্তার পাশের খাদে ফেলে রাখে এবং প্রফেসর এস তাহের আহমদকে হত্যা করে বাসার পেছনের ম্যানহোলে লুকিয়ে রাখা হয়। অধ্যাপক তাহের আহমদ হত্যাকাণ্ডে একজন শিক্ষকসহ ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এমএ সালেহীর নাম উঠে আসে এবং তারা গ্রেফতার হয়। কিন্তু আইনের ফাঁকে শিবির সভাপতি নিম্ন আদালতে বেকসুর খালাস পায়। তাহের আহমদ হত্যাকাণ্ডকে ছাত্রশিবির ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ঐ বিভাগের অন্য একজন শিক্ষককে গ্রেফতারের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। কিন্তু ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ সোচ্চার থাকার কারণে তারা হালে পানি পায়নি।
ইসলামী ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সব সময় মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিপক্ষে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শিক্ষক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত একটি সেমিনারে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তারা প্রফেসর হককে হত্যার হুমকি দেয়। 'তাঁর পরিণতি হুমায়ুন আজাদের মতো হবে' বলে তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। জোট সরকারের শেষদিকে এসে ধূমকেতু নাট্যদলের 'মান্দার' নাটকের রসুল নামের একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে তারা ক্যাম্পাসে নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদেরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এমনকি সমগ্র ক্যাম্পাসে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। কিছু শিকও তাদের সাথে এ সময় যুক্ত হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সাথে শিক্ষকদের একটি অংশ সরাসরি সম্পৃক্ত। অন্য কোন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সাথে শিক্ষকদের এ ধরনের যোগাযোগ আছে বলে জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কিছু নেতৃত্ব আছেন, যাঁরা এখানে অধ্যাপনার সাথে নিয়োজিত। এঁরাই এখানে শিবিরের হাইকমান্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে তাঁরা এত বেশি সংগঠিত যে, সংঘবদ্ধভাবে নৈতিকতা পরিপন্থী বিভিন্ন কাজকর্মে লিপ্ত থাকেন। এর মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল প্রভাবিত করা অন্যতম। প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার পরই তাঁরা ছাত্রশিবিরের কর্মীদেরকে চিহ্নিত করে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থী বেশ কয়েক শিক্ষক কোচিং সেন্টারে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এসব কোচিং সেন্টার ছাত্রশিবির কর্তৃক পরিচালিত। এসব কোচিং সেন্টারের শিকদের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেবার কথাও শোনা যায়।
বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনৈতিক সহযোগিতা, কিছু শিক্ষকের অনৈতিক মদদ এবং সর্বোপরি ভণ্ড রাজনৈতিক কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের উত্থান। কিন্তু গতানুগতিক গণতান্ত্রিক ধারার বাইরে তাদের পেশীশক্তির প্রয়োগে এখানে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্র-শিক্ষকের অবস্থান চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর যেভাবে তারা পৈশাচিকতা চালিয়েছে তার নাম রাজনীতি হতে পারে না। এমনকি বিভিন্ন সময়ের সংঘর্ষে ছাত্রশিবিরের যারা নিহত হয়েছে তাও কারও কাম্য নয়। ধর্মের নামে শাহাদৎবরণ, কোন মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার অধিকার কোন রাজনৈতিক দলের থাকতে পারে না। জামায়াত-শিবির সেই কাজটিই করছে। তারা প্রতিপকে যেমন হত্যা ও পঙ্গু করছে, তেমনি নিজ দলীয় কর্মীদেরকে ধর্মের নামে জীবন দিতে উৎসাহিত করছে। শুধু রাষ্ট্রীয় মতা দখলের জন্য এভাবে মানুষের জীবনদান কোনভাবেই ইসলামসম্মত হতে পারে না। বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের উত্থান থেকে অদ্যাবধি কর্মকা- পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতীয়মান হবে যে, তাদের কথা ও কাজের মধ্যে মিল নেই, এমনকি বৈপরীত্যে ভরা। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার লোভে ইসলামের নামে তারা মানুষকে নিরন্তর ধোঁকা দিচ্ছে। ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। একে অকল্যাণের পথে নিয়ে যাবার অধিকার কারও নেই। এ বিষয়ে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রকেই সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
ব্যাংক-বীমায় অন্যদের মতো তারাও সুদ প্রদান ও গ্রহণ করে। কিন্তু এর নাম দেয়া হয় 'লাভ।" এজন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে তাদের পরিচালিত শাসন ব্যবস্থাই হবে 'আল্লাহর শাসন।' তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায় এ রকম, জামায়াত-শিবির কি তখন ওহীপ্রাপ্ত একটি রাজনৈতিক দল বলে গণ্য হবে? তারা ৯১-এর নির্বাচনে 'সৎ লোকের শাসন'-এর একটি স্লোগান তুলেছিল। কিন্তু ২০০১-এ রাষ্ট্রমতার অংশীদার হবার পর থেকে এ স্লোগান অনেকটা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। কারণ জামায়াত-শিবিরের অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে। তদুপরি মিডিয়ায় তাদের ৭১-এর কর্মকা- প্রকাশ হবার কারণেও এ স্লোগানটি সামনে আনতে পারছে না।
১৯৮০'র দশকে কেবল ধর্মীয় আবরণে ছাত্রশিবিরের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে তারা তেমন রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়নি। নামাজ, রোজা, ইসলামের মৌলিক বিষয় নিয়েই সাধারণ ছাত্রদের সামনে হাজির হয়। প্রথমে তারা আধিপত্য বিস্তার করে খুলনা বিএল কলেজ ও রংপুর কারমাইকেল কলেজে। অতঃপর রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা ঘাঁটি স্থাপন করে। তখন ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারের সন্তানরা তাদের দিকে আকৃষ্ট হতো। ৮০'র দশকের মাঝামাঝি অনেক শিবির কর্মী ড. নজিবুল্লাহর সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আফগানিস্তান গমন করে এবং এর মধ্যে অনেকে প্রশিণ নিয়ে দেশেও ফিরে আসে। শিবির অধ্যুষিত এলাকায় এদেরকে অত্যন্ত গর্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো। বোরহানুদ্দীন রাব্বানী ও আহমদ শাহ্ মাসুদের সময়েও প্রচুর সংখ্যক শিবির কর্মী আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে দেশে ফেরত আসে এবং তারা ছাত্রশিবিরের মধ্যে আলাদা সামরিক ইউনিট গড়ে তোলে বলে জানা যায়। এ ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া অনেক কর্মী দেশের সামরিক ও বেসামরিক বহু জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। এখনও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের অনেক সংখ্যক সামরিক প্রশিক রয়েছে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ৭২-এর পর জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দেয়া কিছু ছাত্র পরবর্তীতে শিবিরের নেতৃত্ব পর্যায়ে চলে আসে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একজন সাবেক শিবির নেতার সাথে কথা বলার সময় জানান যে, প্রথমাবস্থায় তিনি জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধও করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের প্রথম সারির নেতার যোগ্যতা অর্জন করেন। তাঁর ভাষ্য থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পাহাড়ের উপর তাঁদের প্রশিক্ষণ চলত। এই প্রশিক্ষণ চলাকালে একজন কর্মীর বাহু উড়ে যায়। তখন তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঐ অনুসারী এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় সভাপতি। জেএমবির যেসব সামরিক প্রশিক্ষক এ পর্যন্ত ধরা পড়েছে, তাদের অনেকেই এ ধরনের স্বীকারোক্তি প্রদান করেছে যে, তারা অনেকে প্রাক্তন শিবিরকর্মী। রাজশাহীর বাগমারা, মোহনপুরে যখন সর্বহারার নামে নিরীহ মানুষকে বাংলা ভাইয়ের বাহিনী গাছের সাথে ঝুলিয়ে হত্যা করছিল, তখন মতিউর রহমান নিজামীর দেয়া বক্তব্য পাঠকদের নিশ্চয়ই স্মরণ থাকবে। নিজামী তখন এটিএন বাংলার মুন্নী সাহাকে বলেন, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। তার এই বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলা ভাই ও শায়খ রহমানের কর্মকাণ্ডে তাদের সমর্থন ছিল। এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ত কিছু শিক্ষক বাংলা ভাইকে মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু পরে ৫৮ জেলায় একযোগে বোমা হামলার পর যখন জেএমবি আত্মপ্রকাশ করে, তখন জামায়াত কিছুটা চুপসে যায়। অতএব, ইসলামের নামে পরিচালিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন যে জামায়াতেরই বিভিন্ন ইউনিট, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রথমদিকে ছাত্রশিবির নামাজ-রোজা করা ভাল ছেলে হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তখন তারা প্রায়শ মসজিদে বসে ধর্মীয় আলোচনার নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরামর্শ করত। অন্য ছাত্রদেরকে তারা নামাজে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাত। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যেহেতু ধর্মপ্রাণ, এজন্য তাদের ডাকে তখন অনেকেই সাড়া দেয়। কিন্তু এই সময় থেকেই তারা তাদের মিছিলে মাদ্রাসার ছাত্র ও বহিরাগতদেরকে নিয়ে আসে। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ ছাত্রশিবির নবীনবরণের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে অছাত্রদেরকে আমদানি করে। ঐদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষ বেধে যায় এবং সাবি্বর, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার নামে শিবিরের ৪ কর্মী মারা যায়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অনেক কর্মীও আহত হয়। বলা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের এটিই প্রথম সশস্ত্র মহড়া। কিন্তু এর ফল হলো ৪ তরুণ তাজা প্রাণ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। এই ঘটনার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির আধিপত্য বিস্তারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে ঘাঁটি স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর, মির্জাপুর, ধরমপুর, ডাঁশমারী, মেহেরচণ্ডী ও নতুন বুধপাড়ায় স্থানীয় কিছু মানুষকে তারা বিভিন্নভাবে বশীভূত করে এবং তাদের তৈরি মেসগুলোতে ছাত্রশিবির শক্ত অবস্থান তৈরি করে। স্থানীয়ভাবে তারা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মসজিদে ইমামতি ও মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে ছাত্রশিবিরের এক ধরনের সামাজিকীকরণ হয়। কিন্তু প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের বিপরীতে তেমন কোন কর্মকৌশল গ্রহণ করতে পারেনি। জামায়াত-শিবির যে ধর্মকে ব্যবহার করে কিছু মানুষকে সন্ত্রাসী করে তুলছে, তা তারা বিবেকবান মানুষকে বোঝাতে সম হয়নি। এর বড় কারণ প্রগতিশীল শক্তির অনৈক্য। ছাত্রশিবিরের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হলে প্রতিপরে যে যথেষ্ট ধর্মীয় জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ছিল, তা তাদের মধ্যে কখনই আশাব্যঞ্জক ছিল না, এখনও নেই। ইত্যবসরে ছাত্রশিবিরের সাথে ছাত্রদল ও অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অনেক বার সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ১৯৮৮ সালের ১৭ নবেম্বর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে শিবিরের আসগর ও আসলাম মারা যায়। প্রতিটি সংঘর্ষের সময়েই এটা পরিলক্ষিত হয়েছে যে, ছাত্রশিবির কর্মীরা ময়দানে জীবন দেবার জন্য যেন উন্মাদ হয়ে যায়। ১০০ জন প্রতিপরে ছাত্রকে তারা ১০ জনে তাড়া করে নিয়ে যায়। তাদের এই সাহস মূলত জেহাদী উদ্দীপনা এবং সংঘর্ষে মারা গেলে পরিবার ও দেশের প্রতি সে চিন্তা না করে বরং শহীদ হবার নেশায় অস্থির হয়ে পড়ে। এভাবেই ১৯৮৯ সালের ১৮ এপ্রিল ছাত্রশিবিরের সফিক নিহত হয় এবং ১৯৯০ সালের ২২ জুন আমীর আলী হলে খলিলুর রহমানের মৃত্যু হয়।
মূলত ছাত্রমৈত্রীর প্রভাব থেকে চূড়ান্তভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের হাতে চলে যায় ১৯৯২ সালে। ঐ বছরের ১৭ মার্চ শিবির নবাব আব্দুল লতিফ হল গানপাউডার দিয়ে ভস্মীভূত ও ব্যাপক লুটতরাজ করে। এদিন প্রকাশ্যে ছাত্রশিবির আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া দেয়। অস্ত্র উঁচিয়ে ছাত্রশিবির সব হল দখল করে নেয় এবং ভিন্নমতের ছাত্র কর্মীদের হল থেকে বের করে দেয়। এমনকি তখন বিএনপি রাষ্ট্রীয় মতায় থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদল হলে অবস্থান করতে পারেনি। সরকার লতিফ হল মেরামতের জন্য ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। হল মেরামত হয় ঠিকই, কিন্তু হলগুলোতে তখন থেকে ছাত্রদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লোপ পায়। ১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ছাত্রশিবির মাদার বখ্শ, সোহরাওয়ার্দী ও শহীদ শামসুজ্জোহা হলে আক্রমণ করে এবং ছাত্রদলের বিশ্বজিৎ ও তপনকে হত্যা করে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আনিসুর রহমান। তিনি ৭ ফেব্রুয়ারি হল পরিদর্শনে গেলে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় সাধারণ ছাত্রদের তোপের মুখে পড়েন এবং লাঞ্ছিত হন। ১৯৯৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ছাত্রমৈত্রী নেতা জোবায়ের চৌধুরী রিমু শের-ই-বাংলা হলের সামনে ছাত্রশিবিরের হাতে নিহত হয়। সাম্প্রতিক সময়ের মতো তখনও সমগ্র বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রিমুর মা জেলেনা চৌধুরী সম্ভবত সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সহসভানেত্রী ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তখন সংসদে আলোচনা হয় এবং সরকার ও প্রধান বিরোধী দল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একমত হয়। তখন সংসদ উপনেতা বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, 'যারা ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ হত্যা করে, তারা সাইকোপ্যাথ।' কিন্তু পরবর্তীতে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হবার বিষয়টি ধামাচাপা পড়ায় স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী ক্ষোভের সাথে বলেন, 'রাজনীতিবিদদের চেহারা মানুষ দেখল।' ১৯৯৭ সালের ৭ জানুয়ারি শিক্ষক সমিতি ও ডিন সিন্ডিকেট নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী শিক্ষকদের প্যানেল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ৮ জানুয়ারি শিক সমিতি পূর্বনির্ধারিত এক কর্মসূচী অনুযায়ী উপাচাযের্র দফতরে পৌঁছালে ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র কর্মীরা শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়। এতে বেশ কিছু শিক আহত হন। ঐদিন অধ্যাপক মলয় ভৌমিককে হত্যার উদ্দেশ্যে তারা তাড়া করে। এর প্রতিবাদে শিক্ষক সমিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাসে ধর্মঘট ডাকে। ধর্মঘট ঠিকমতো পালিত হচ্ছে কি-না তা পর্যবেণের জন্য ১৪ জানুয়ারি সমিতির নেতৃবৃন্দ বের হলে ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা শিক্ষকদের ওপর হামলে পড়ে এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। শিক্ষকরা এই পরিস্থিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। এরই ধারাবাহিকতায় তাঁরা সে বছরের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন উপাচার্য প্রফেসর আব্দুল খালেকের বাসায় তাণ্ডবলীলা চালায়। তখন বাসায় প্রহরারত পুলিশ নারী ও শিশুদের জীবন রক্ষা করে। এ সময় আরও দু'জন শিক্ষকের বাসায় এ ধরনের হামলা চালানো হয়েছিল। তখন রাজশাহীর পুলিশ কমিশনার ছিলেন আমিনুল ইসলাম। অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রত্যভাবে শিবিরকে মদদ দেন। এর পর ২০০১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন মার্কেটে গানপাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পার্শ্ববর্তী মেহেরচণ্ডী গ্রামের আওয়ামী লীগ সমর্থক কিছু ব্যক্তির বাড়িঘর ভস্মীভূত করে। কিন্তু তাদের এসব কর্মকাণ্ডের যথাযথ বিচার সম্পন্ন হবার পূর্বেই জাতীয় নির্বাচনে চারদলীয় জোট সরকার মতায় আসে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে রদবদল হয়। এরপর শিবির প্রগতিশীল ছাত্র-শিক্ষকদের ঘুম হারাম করে দেয়। হলগুলোতে তাদের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। হলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পী ও খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি বন্ধ হয়। হলগুলোর সার্বিক অবস্থা তখন 'তালেবান' শাসনের পর্যায়ে পৌঁছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জেনেশুনেই এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তখন গভীর রাতে বিভিন্ন শিক্ষকের বাসায় ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ চলত। তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিপরীতে অবস্থান থাকায় প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুসকে হত্যা করে রাস্তার পাশের খাদে ফেলে রাখে এবং প্রফেসর এস তাহের আহমদকে হত্যা করে বাসার পেছনের ম্যানহোলে লুকিয়ে রাখা হয়। অধ্যাপক তাহের আহমদ হত্যাকাণ্ডে একজন শিক্ষকসহ ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এমএ সালেহীর নাম উঠে আসে এবং তারা গ্রেফতার হয়। কিন্তু আইনের ফাঁকে শিবির সভাপতি নিম্ন আদালতে বেকসুর খালাস পায়। তাহের আহমদ হত্যাকাণ্ডকে ছাত্রশিবির ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ঐ বিভাগের অন্য একজন শিক্ষককে গ্রেফতারের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। কিন্তু ছাত্র ও শিক্ষক সমাজ সোচ্চার থাকার কারণে তারা হালে পানি পায়নি।
ইসলামী ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সব সময় মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিপক্ষে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শিক্ষক সমাজের ব্যানারে আয়োজিত একটি সেমিনারে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তারা প্রফেসর হককে হত্যার হুমকি দেয়। 'তাঁর পরিণতি হুমায়ুন আজাদের মতো হবে' বলে তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। জোট সরকারের শেষদিকে এসে ধূমকেতু নাট্যদলের 'মান্দার' নাটকের রসুল নামের একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে তারা ক্যাম্পাসে নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদেরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এমনকি সমগ্র ক্যাম্পাসে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। কিছু শিকও তাদের সাথে এ সময় যুক্ত হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সাথে শিক্ষকদের একটি অংশ সরাসরি সম্পৃক্ত। অন্য কোন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের সাথে শিক্ষকদের এ ধরনের যোগাযোগ আছে বলে জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কিছু নেতৃত্ব আছেন, যাঁরা এখানে অধ্যাপনার সাথে নিয়োজিত। এঁরাই এখানে শিবিরের হাইকমান্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে তাঁরা এত বেশি সংগঠিত যে, সংঘবদ্ধভাবে নৈতিকতা পরিপন্থী বিভিন্ন কাজকর্মে লিপ্ত থাকেন। এর মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল প্রভাবিত করা অন্যতম। প্রথম বর্ষে ভর্তি হবার পরই তাঁরা ছাত্রশিবিরের কর্মীদেরকে চিহ্নিত করে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জামায়াতপন্থী বেশ কয়েক শিক্ষক কোচিং সেন্টারে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এসব কোচিং সেন্টার ছাত্রশিবির কর্তৃক পরিচালিত। এসব কোচিং সেন্টারের শিকদের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেবার কথাও শোনা যায়।
বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনৈতিক সহযোগিতা, কিছু শিক্ষকের অনৈতিক মদদ এবং সর্বোপরি ভণ্ড রাজনৈতিক কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের উত্থান। কিন্তু গতানুগতিক গণতান্ত্রিক ধারার বাইরে তাদের পেশীশক্তির প্রয়োগে এখানে শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্র-শিক্ষকের অবস্থান চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুমন্ত ছাত্রদের ওপর যেভাবে তারা পৈশাচিকতা চালিয়েছে তার নাম রাজনীতি হতে পারে না। এমনকি বিভিন্ন সময়ের সংঘর্ষে ছাত্রশিবিরের যারা নিহত হয়েছে তাও কারও কাম্য নয়। ধর্মের নামে শাহাদৎবরণ, কোন মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার অধিকার কোন রাজনৈতিক দলের থাকতে পারে না। জামায়াত-শিবির সেই কাজটিই করছে। তারা প্রতিপকে যেমন হত্যা ও পঙ্গু করছে, তেমনি নিজ দলীয় কর্মীদেরকে ধর্মের নামে জীবন দিতে উৎসাহিত করছে। শুধু রাষ্ট্রীয় মতা দখলের জন্য এভাবে মানুষের জীবনদান কোনভাবেই ইসলামসম্মত হতে পারে না। বাংলাদেশে জামায়াত-শিবিরের উত্থান থেকে অদ্যাবধি কর্মকা- পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতীয়মান হবে যে, তাদের কথা ও কাজের মধ্যে মিল নেই, এমনকি বৈপরীত্যে ভরা। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার লোভে ইসলামের নামে তারা মানুষকে নিরন্তর ধোঁকা দিচ্ছে। ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের ধর্ম। একে অকল্যাণের পথে নিয়ে যাবার অধিকার কারও নেই। এ বিষয়ে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রকেই সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।
No comments