যুদ্ধাবস্থায় মুসলিম দেশ মালি by ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

১২ লাখ ২৫ হাজার  বর্গকিলোমিটার আয়তনের মালি স্বর্ণ, ইউরেনিয়াম ও অন্যান্য খনিজসম্পদে ভরপুর। মূলত এ সম্পদ গ্রাস করতেই মালিতে সেনা নিয়ন্ত্রণের ল্েয ফ্রান্স মালির উত্তরাঞ্চলে ইসলামি সংগঠন আনসারুদ দিনের দুর্গে গত ১১ জানুয়ারি হঠাৎ আক্রমণ করে বসে এবং প্রচুর বোমাবর্ষণ করে।
মালির বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ের যৌক্তিকতায় ফ্রান্সের বক্তব্য হচ্ছে, আনসারুদ দিন আলকায়েদার মদদপুষ্ট। তারা বিশ্বশান্তি ও ফ্রান্সের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। ফ্রান্স বলছে, গত এক বছরে আনসারুদ দিন মালির দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা দখল করে সেখানে শরিয়া আইন চালু করেছে। এখন তাদের বাহিনী দেিণ রাজধানী বামাকোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের ল্য পুরো মালিতে ইসলামি হুকুমত কায়েম করা।

এটা হুবহু সেই নাটকের নতুন রূপ, যা আমেরিকা ও তার জোট ১২ বছর আগে আফগানিস্তানে রচনা করেছিল। এখন ফ্রান্স আফ্রিকার এক মুসলিম রাষ্ট্র মালিতে সেনা দখলদারিত্বের জন্য এই লড়াইয়ের নাটক শুরু করেছে।

মালি ও ফ্রান্সের লড়াই শুরু হয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা যখন আফ্রিকা মহাদেশে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য দস্যুদের মতো ধেয়ে আসে এবং এ অঞ্চলকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়, তখন ফ্রান্সের ভাগে পড়ে পশ্চিম আফ্রিকা। মালিও তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৬০ সালে ফ্রান্স যখন আলজেরিয়ায় স্বাধীনতাযুদ্ধে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে এবং আফ্রিকাকে সামলানো তার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়, তখন সে বাধ্য হয়ে সেনেগালের সাথে মালিকে স্বাধীনতা দেয়। মালির গত ৫৩ বছরের ইতিহাস রাজনৈতিক উত্থান-পতনে ভরপুর। একটা লম্বা সময় (১৯৬০-১৯৬৮) মালিতে প্রেসিডেন্ট মোবিদো কেইটার সমাজতন্ত্রের শাসন পরিচালিত হয়েছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এরই ভিত্তিতে মালির সাবেক সাম্রাজ্যবাদী শাসক ফ্রান্স ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির কাছে প্রেসিডেন্ট কেইটার শাসনকে দুঃশাসন মনে হয়। অবশেষে আট বছর পর ফ্রান্সের সহযোগিতায় মুসা ট্রাওরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী কেইটার পতন ঘটায়। ১৯৬৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রেসিন্ডেন্ট মুসা ট্রাওরের শাসনামল মালির জনগণের জন্য আজাবে পরিণত হয়। পরিশেষে দীর্ঘ গণ-আন্দোলন, প্রতিবাদ ও বিােভের পর কর্নেল আহমদ উসমানি টোরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী মুসা ট্রাওরের পতন ঘটায়। এরপর দেশের সংবিধান তৈরি হয় এবং সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

বর্তমান পরিস্থিতি শুরু হয়েছে ২০১২-এর মার্চে। যখন সেনাবাহিনীতে জুনিয়র অফিসারদের একটি গ্র“প রাজধানী বামাকোতে প্রেসিডেন্ট ভবন দখল করে নেয় এবং সরকারকে উৎখাতপূর্বক সংবিধান বাতিল ঘোষণা করে, এই সময় উত্তরাঞ্চল আজাওয়াদে আঞ্চলিক স্বাধীনতা আন্দোলনরত দল ন্যাশনাল মুভমেন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব আজাওয়াদ (এনএমএসএ) আজাওয়াদকে মালি থেকে পৃথক করে এক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। কিন্তু ইতোমধ্যে এনএমএসএ’র আন্দোলনকে পিছে ফেলে এগিয়ে যায় ইসলামি সংগঠন আনসারুদ দিন। তারা উত্তর মালির দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা দখল করে নেয়। মালি থেকে আলাদা হওয়ার দাবিকে প্রত্যাখ্যান করে তারা পুরো মালিকে ইসলামি শরিয়া আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দেয়। ফ্রান্স এই ঘোষণাকে মালিতে হামলা করার অজুহাত হিসেবে পেশ করেছে। আর এই প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, মালিতে আলকায়েদার সাহায্যে আনসারুদ দিনের দখলদারিত্ব বিশ্বশান্তি ও ফ্রান্সের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। ফ্রান্স এই অপবাদও ছড়াচ্ছে, আনসারুদ দিন কর্তৃক উত্তর মালির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ব্যাপক হারে অপহরণের ঘটনা বেড়ে গেছে। স্মাগলিং চলছে অবাধে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো থেকে ব্যাপক অর্থ জোগান দেয়া হচ্ছে। এগুলো শুধুই মিথ্যা প্রচারণা। বানোয়াট অভিযোগ। এর সপে কোনো দলিল-প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়নি। ফ্রান্সের বক্তব্য হচ্ছে, তারা মালির বর্তমান সরকারের অনুরোধেই এই যুদ্ধ পরিচালনা করছে। বর্তমান সরকারকে তো ফ্রান্সের পুতুল সরকার বলা হয়। গত বছর নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পতন ঘটিয়ে তারা মতায় আসে। সেনা বিদ্রোহের সময় বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডিউন কোন্ডা ট্রাওরে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। দুই মাস ফ্রান্সে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বলা হয়, ওই সময়ই মালিতে ফ্রান্সের হামলার পরিকল্পনা করা হয়। ফ্রান্সের এই দাবি বড়ই আশ্চর্যের, আনসারুদ দিনের শরয়ি আইনভিত্তিক সরকার গঠন ফ্রান্সের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কোথায় ফ্রান্স, আর কোথায় মালি। মালি ও ফ্রান্সের মাঝে রয়েছে ৩,২৩৭ কিলোমিটার পর্বতময় এলাকার ব্যবধান। এ জন্য মালি থেকে ফ্রান্স যেতে হলে আলজেরিয়া, রোমসাগর ও স্পেনের ওপর দিয়ে যেতে হয়।

মনে হচ্ছে, পশ্চিমা সব সরকারই যুদ্ধে নাম লেখাতে চাচ্ছে। কিন্তু তারা কেউ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেনি যে, তাদের পূর্বসূরিদের পরিণাম কী হয়েছিল। যারা যুদ্ধবিজয়ীদের সারিতে নিজেদের নাম লিখতে সম হয়নি। বরং তারা নিজেদের নাম লিপিবদ্ধ করেছে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলনকারীদের তালিকায়। ফ্রান্সের নবনির্বাচিত সমাজতন্ত্রবাদী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে মালির পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছেন। কেননা এখন পর্যন্ত শুধু মালির প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ছাড়া পাশ্চাত্য শক্তির কেউ তাকে পরিপূর্ণরূপে সহায়তা করেনি। আমেরিকা বলেছে, তারা শুধু গোয়েন্দা সহযোগিতা দেবে। ব্রিটেন এই যুদ্ধে শুধু দু’টি জঙ্গিবিমান পাঠানোর ওয়াদা করেছে। জার্মান ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ একেবারে নিশ্চুপ। বলা যায়, প্রেসিডেন্ট ওঁলাদে মালির যুদ্ধে একাই লড়ে যাচ্ছেন। পাশ্চাত্য শক্তিগুলো শত্র“দেশগুলোর বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের অজুহাত হিসেবে আলকায়েদাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর যেখানেই আলকায়েদা তার সহযোগিতার নেটওয়ার্ক বিস্তৃতি করবে সেখানেই সেনা অভিযান পরিচালনা করা তাদের মহান দায়িত্ব।

ফ্রান্স গত ১১ জানুয়ারি সেজেগুজে প্রস্তুতি নিয়েই উত্তর মালিতে সেনা অভিযান শুরু করে এবং ১৩ জানুয়ারি থেকে আনসারুদ দিনের ঘাঁটিতে ব্যাপক হারে বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে। ফরাসি সরকার মালিতে সেনা অভিযানের ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করছে। এমনকি যুদ্ধেেত্র কোনো সাংবাদিককে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে ফরাসি বাহিনী উত্তর মালিতে কোনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বরং প্রকৃত খবর হচ্ছে ফ্রান্স সেনা অভিযান শুরু করার পর ১৪ জানুয়ারি আনসারুদ দিনের সৈনিকেরা সরকারি সেনাকবলিত এলাকায় পাল্টা অভিযানে রাজধানী থেকে ৩৫০ কিলোমিটার উত্তরে দায়াবেলি শহর দখল করে নেয়। ফ্রান্সের প্রতিরামন্ত্রী জ্যঁ ওয়াইভেস লা ড্রিয়ান স্বীকার করেছেন, ফ্রান্স ও মালির সৈন্যরা বাধ্য হয়ে পিছু হটে এসেছে। তার বক্তব্য হচ্ছে, উত্তর মালিতে আনসারুদ দিনের দুর্গে বোমাবর্ষণের পর বিদ্রোহীদের সৈনিকেরা মৌরিতানিয়ার সীমান্ত দিয়ে শহর আক্রমণ করেছে এবং লড়াই ১০ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এতে আনসারুদ দিনের সৈনিকদের শক্তি অনুমান করা যায়।

ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরেন্ট ফেবিয়াসের বক্তব্য হচ্ছে, মালিতে সেনা অভিযান মাত্র কয়েক সপ্তাহ চলবে। কিন্তু কেউ এটা বুঝছে না কয়েক সপ্তাহে ফরাসি সৈন্যরা কী অর্জন করবে? তারা কি এই সময়ের মধ্যে আনসারুদ দিনের দুর্গ ধ্বংস করতে পারবে? এটাকে সম্ভব মনে করার লোকের সংখ্যা নেহাতই কম। ফ্রান্স মালির প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো ও আফ্রিকার অন্যান্য রাষ্ট্রের সেনাদের সংগঠিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আনসারুদ দিনের মুখপাত্র আবু দরদা বলেছেন, ফ্রান্স ইসলামের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমরা ফ্রান্সের অভ্যন্তরে হামলা করব। এত দিন আমরা হুমকি ছিলাম না। তবে মালির কট্টরপন্থীরা এখন প্যারিস ও ফ্রান্সের অন্যান্য শহরকে টার্গেট বানাতে মোটেও দ্বিধা করবে না। তখন বুঝবে প্রকৃত হুমকি কাকে বলে।

ahmadimtiajdr@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.