বাজার নিয়ন্ত্রণ কাঠামো by এ এম এম শওকত আলী
বিগত কয়েক বছর ধরেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ধারা সম্পর্কে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। ইলেকট্রনিক
মিডিয়ায়ও এ বিষয় নিয়ে প্রায়ই টকশো অনুষ্ঠিত হয়।
বিতর্কের
বিষয়বস্তু হয় বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা। ভোক্তারাও মিডিয়ার
প্রশ্নের উত্তরে বিষয়টি সরকারেরই দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করে। কিছু
ক্ষেত্রে সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের ব্যক্তিরাও এ সংক্রান্ত সেমিনার বা
টকশোতে অংশগ্রহণ করে। ব্যবসা ক্ষেত্রের নেতারাও এতে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু
এখন পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে কোন গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যায়নি।
দৃশ্যমান বিষয়টি হলো পারস্পরিক দোষারোপের ভিত্তিতে বিভিন্ন পক্ষের
অবস্থান।
গত বছর বা তার পূর্বেও সরকারি নীতিনির্ধারকরা নিবিড় পরিবীক্ষণের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সে প্রচেষ্টাও ফলপ্রসূ হয়নি। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে দৈনন্দিন পণ্যের মূল্য তালিকার প্রচেষ্টাও দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়া অনেক দৃশ্য প্রচার করেছে। বলা বাহুল্য যে, নির্ধারিত মূল্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সংগঠনের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। সুতরাং দেখা যায় যে, কাজে ও কথায় কোন মিল নেই। এটা দুপক্ষেরই ব্যর্থতা। একমাত্র সিটি করপোরেশন বা সরকারকে দোষারোপ করা যুক্তিযুক্ত নয়।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দ্রব্যমূল্য সহনশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষে নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রয়োজনীয় হলেও তা যথেষ্ট নয়। নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনি কাঠামোসহ দক্ষ ব্যবস্থাপনাও প্রয়োজন। আইনি কাঠামো সম্পর্কে চলমান বিতর্কে খুব একটা আলোকপাত করা হয় না। অনেকে মত প্রকাশ করে থাকেন যে, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করা হলেই মূল্য সহনশীল হবে। একই সাথে এ কথাও বলা হয় যে, সবকিছুই আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যে কথা সবসময় বলা হয় না তাহলো এ দেশে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। একই সাথে রয়েছে ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা। তবে সার্বিকভাবে এ কথা সত্য যে, ক্রেতার চাহিদার তুলনায় পণ্যের অভাব হলে মূল্যবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। সাম্প্রতিককালে অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেছেন যে, পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে। চিরাচরিত প্রথায় দোষারোপ করা হয়েছে সিন্ডিকেটের। সম্প্রতি শীর্ষ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সম্পাদিত সমীক্ষায় ও অন্যান্য বিষয়ের মধ্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়েছে। এ শব্দটি বারবার প্রচারিত হলেও সিন্ডিকেট ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্যদিকে চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা যে চলতি মূলধন গ্রহণ করে তা পরিশোধের সময়সীমাও হ্রাস করেছেন। উদ্দেশ্য হলো মজুদ পণ্যেও বেশিদিন গুদামজাত বন্ধ করা। গৃহীত পদক্ষেপের প্রভাব এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। যে নিবিড় পরিবীক্ষণের ওপর নীতি নির্ধারকরা গুরুত্ব আরোপ করেন, সে বিষয়টি এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে কে বা কারা এ দায়িত্ব পালন করবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারের যে প্রতিষ্ঠানসমূহ যুক্ত, তারা কি এ দায়িত্ব পালন করবে না কি চলতি মূলধন প্রদানকারী ব্যাংকগুলো করবে তা এখনও অজানা।
চালের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান। এক. কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। দুই. ফুড প্লানিং এন্ড মনিটরিং ইউনিট সংক্ষেপে এফপিএমইউ। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানটিই দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে এ বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে। সরকার প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু গৃহীত পদক্ষেপসমূহ মূলত সরকারি কার্যপরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এক. আমদানি করে সরকারি মজুদ বৃদ্ধি করা। দুই. অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে মজুদ করা। মজুদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে নিম্ন আয়ের নাগরিকদের জন্য খোলা বাজারে সহনীয় মূল্যে চাল বিক্রি করা এবং একই সাথে খাদ্যভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যবস্থপনা জোরদার করা।
পত্রিকান্তারে জানা যায় যে, খাদ্য মন্ত্রণালয় ২৫ হাজার টন আতপ চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আতপ চালের চাহিদা সীমিত কারণ এ ধরনের চাল চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলার মানুষেরাই গ্রহণ করে থাকে। তবুও মন্দের ভাল। তবে এর প্রভাব কতটুকু মূল্যবৃদ্ধিরোধে কার্যকরি হবে তা এখনও অজানা। মূল বিষয়টা হচ্ছে এ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেসরকারী আমদানি কারকরা চাল আমদানি করতে আগ্রহী নয়। সুতরাং একা সরকারের পক্ষে এ কাজটি করা সম্ভব হবে না। ২০০৮-০৯ সালেও এর চাইতে অধিক প্রতিবন্ধকতা ছিল। ঐ সময় সরকারি মজুদও ছিল বর্তমান বছরের তুলনায় কম।
২০০৮-০৯ সালে দুইটি বিষয়ে সরকারের সাফল্য অর্জনের জন্য কোন নাগরিক অনাহারে মৃত্যুবরণ করেনি। কারণ, এক. ঐ বছর অভ্যন্তরীণ সরকারি চাল সংগ্রহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল যার ফলে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মজুদ ছিল ১৪ লাখ টন। দুই. ভারত সরকারের সম্মতিক্রমে পাঁচ লাখ টন চাল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমদানি করা হয়। এর সুফল বর্তমান সরকার পেয়েছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ আমন সংগ্রহে বর্তমান সরকার সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। ভরসা এখন আগামী বোরো ফসলের আশানুরূপ উৎপাদন। তবে প্রয়োজনীয় উৎপাদন হলেও সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার জন্য, সুফল পাওয়া যাবে না। ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এখন থেকেই সরকারকে অধিকতর সচেতন হতে হবে।
বাজার নিয়ন্ত্রণের আইনি কাঠামোর বিষয়ে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। খাদ্য মজুদ, সংগ্রহ ও সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রায় এক ডজন আইন রয়েছে। ১৯৯০ দশকে খাদ্যনীতি সংক্রান্ত দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় যে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্ত করে বেসরকারি খাতের উন্মুক্ত পরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান। এ জন্য ঐ সমস্ত আইনসমূহ সম্পূর্ণ রদ না করে কার্যকারিতা স্থগিত করা হয়। বিচার্য বিষয়টি হলো এ সমস্ত আইন পুনর্প্রবর্তন করা হবে কি-না। এ বিষয়টি এতই জটিল যে, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এজন্য নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে সে দিকে মনোযোগী হওয়া। বিচ্ছিন্নভাবে বক্তব্য, সময় সময় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রদান করে কাঠামোগত দুর্বলতা নির্মূল করা যাবে না।
এজন্য প্রয়োজন সার্বিকভাবে বিদ্যমান বাজার কাঠামোর বিশ্লেষণ এবং তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কৃষিজাত পণ্যের বাজার কাঠামো সম্পর্কে ১৯৬৪ সালে প্রণীত একটি আইন বিদ্যমান। ঐ আইনের আওতায় সারাদেশের নির্ধারিত বাজারের কাঠামোর এবং কার্যাবলীর বিষয় অন্তর্ভুক্ত। এ আইন পরবর্তী পর্যায়ে সামান্য কিছু সংশোধন করা হলেও এর কার্যকারিতার মূল্যায়ন কখনও হয়েছে কিনা জানা নেই। চলমান বিতর্কে অনেক দুর্বলতার মধ্যে বাজার কাঠামোর একটি দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়। তা হলো মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্রিয়াকলাপ। এদেরও মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হয়। বলা হয় যে, একই পণ্য দশ ধাপ বদল করে যখন বাজারে আসে তখন প্রতি ধাপেই মূল্য বৃদ্ধি হয়। এর ফলে ভোক্তাকেও সর্বশেষ নির্ধারিত মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হয়। ১৯৬৪ সালে কৃষিজাত পণ্য বিপণন আইনে মধ্যস্বত্বভোগীদের অবস্থান ও কার্যকলাপ স্বীকৃত। এ আইনে মধ্যস্বত্বভোগের সংজ্ঞায় একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি কৃষিজাত পণ্যের ক্রয় ও বিক্রয়ের সাথে যুক্ত সেই হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী। এর মধ্যে রয়েছে পাইকার, আড়তদার, মজুদকারী, ওজন করার ব্যক্তি, পরিমাপের ব্যক্তি, কমিশন এজেন্ট, দালাল, গুদামজাত যে করে সে ব্যক্তি ইত্যাদি।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে লাইসেন্স গ্রহণ করা হয়। লাইসেন্স গ্রহণকারী ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি বিপণন ক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে পারবে না। এজন্য শাস্তিরও বিধান রয়েছে। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিপণন খরচ হিসাবে লাইসেন্সধারী ব্যক্তিদের প্রদান করারও বিধান রয়েছে।
কালের বিবর্তনে এ প্রথা বর্তমানে অকেজো হয়ে গেছে। এমনই একটি সংবাদ দৃশ্যমান করেছিল কোন একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া, কাওরান বাজারে এমনই অদৃশ্য প্রথা বিদ্যমান। অন্যান্য বাজারেও যে নেই তা নয়। এ প্রথাকেই অনেকে চাঁদাবাজি বলে আখ্যায়িত করে। এ বিষয়টি বহুল আলোচিত হলেও এখন পর্যন্ত সরকার কোন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। যা করা প্রয়োজন তা হলো সংশ্লিষ্ট সকল আইন পর্যালোচনা করে বাজার কাঠামোকে যুগোপযোগী করা।
১৪-মার্চ, ২০১০
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
গত বছর বা তার পূর্বেও সরকারি নীতিনির্ধারকরা নিবিড় পরিবীক্ষণের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। সে প্রচেষ্টাও ফলপ্রসূ হয়নি। সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে দৈনন্দিন পণ্যের মূল্য তালিকার প্রচেষ্টাও দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়া অনেক দৃশ্য প্রচার করেছে। বলা বাহুল্য যে, নির্ধারিত মূল্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সংগঠনের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতেই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। সুতরাং দেখা যায় যে, কাজে ও কথায় কোন মিল নেই। এটা দুপক্ষেরই ব্যর্থতা। একমাত্র সিটি করপোরেশন বা সরকারকে দোষারোপ করা যুক্তিযুক্ত নয়।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দ্রব্যমূল্য সহনশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষে নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রয়োজনীয় হলেও তা যথেষ্ট নয়। নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনি কাঠামোসহ দক্ষ ব্যবস্থাপনাও প্রয়োজন। আইনি কাঠামো সম্পর্কে চলমান বিতর্কে খুব একটা আলোকপাত করা হয় না। অনেকে মত প্রকাশ করে থাকেন যে, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করা হলেই মূল্য সহনশীল হবে। একই সাথে এ কথাও বলা হয় যে, সবকিছুই আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। যে কথা সবসময় বলা হয় না তাহলো এ দেশে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। একই সাথে রয়েছে ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা। তবে সার্বিকভাবে এ কথা সত্য যে, ক্রেতার চাহিদার তুলনায় পণ্যের অভাব হলে মূল্যবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। সাম্প্রতিককালে অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেছেন যে, পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ ও সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে। চিরাচরিত প্রথায় দোষারোপ করা হয়েছে সিন্ডিকেটের। সম্প্রতি শীর্ষ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে সম্পাদিত সমীক্ষায় ও অন্যান্য বিষয়ের মধ্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়েছে। এ শব্দটি বারবার প্রচারিত হলেও সিন্ডিকেট ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্যদিকে চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা যে চলতি মূলধন গ্রহণ করে তা পরিশোধের সময়সীমাও হ্রাস করেছেন। উদ্দেশ্য হলো মজুদ পণ্যেও বেশিদিন গুদামজাত বন্ধ করা। গৃহীত পদক্ষেপের প্রভাব এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। যে নিবিড় পরিবীক্ষণের ওপর নীতি নির্ধারকরা গুরুত্ব আরোপ করেন, সে বিষয়টি এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে কে বা কারা এ দায়িত্ব পালন করবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারের যে প্রতিষ্ঠানসমূহ যুক্ত, তারা কি এ দায়িত্ব পালন করবে না কি চলতি মূলধন প্রদানকারী ব্যাংকগুলো করবে তা এখনও অজানা।
চালের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান। এক. কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। দুই. ফুড প্লানিং এন্ড মনিটরিং ইউনিট সংক্ষেপে এফপিএমইউ। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানটিই দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভিত্তিতে এ বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে। সরকার প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু গৃহীত পদক্ষেপসমূহ মূলত সরকারি কার্যপরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এক. আমদানি করে সরকারি মজুদ বৃদ্ধি করা। দুই. অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে মজুদ করা। মজুদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হলে নিম্ন আয়ের নাগরিকদের জন্য খোলা বাজারে সহনীয় মূল্যে চাল বিক্রি করা এবং একই সাথে খাদ্যভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যবস্থপনা জোরদার করা।
পত্রিকান্তারে জানা যায় যে, খাদ্য মন্ত্রণালয় ২৫ হাজার টন আতপ চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আতপ চালের চাহিদা সীমিত কারণ এ ধরনের চাল চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি জেলার মানুষেরাই গ্রহণ করে থাকে। তবুও মন্দের ভাল। তবে এর প্রভাব কতটুকু মূল্যবৃদ্ধিরোধে কার্যকরি হবে তা এখনও অজানা। মূল বিষয়টা হচ্ছে এ বছর আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেসরকারী আমদানি কারকরা চাল আমদানি করতে আগ্রহী নয়। সুতরাং একা সরকারের পক্ষে এ কাজটি করা সম্ভব হবে না। ২০০৮-০৯ সালেও এর চাইতে অধিক প্রতিবন্ধকতা ছিল। ঐ সময় সরকারি মজুদও ছিল বর্তমান বছরের তুলনায় কম।
২০০৮-০৯ সালে দুইটি বিষয়ে সরকারের সাফল্য অর্জনের জন্য কোন নাগরিক অনাহারে মৃত্যুবরণ করেনি। কারণ, এক. ঐ বছর অভ্যন্তরীণ সরকারি চাল সংগ্রহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল যার ফলে ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মজুদ ছিল ১৪ লাখ টন। দুই. ভারত সরকারের সম্মতিক্রমে পাঁচ লাখ টন চাল বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমদানি করা হয়। এর সুফল বর্তমান সরকার পেয়েছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ আমন সংগ্রহে বর্তমান সরকার সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। ভরসা এখন আগামী বোরো ফসলের আশানুরূপ উৎপাদন। তবে প্রয়োজনীয় উৎপাদন হলেও সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার জন্য, সুফল পাওয়া যাবে না। ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এখন থেকেই সরকারকে অধিকতর সচেতন হতে হবে।
বাজার নিয়ন্ত্রণের আইনি কাঠামোর বিষয়ে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। খাদ্য মজুদ, সংগ্রহ ও সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রায় এক ডজন আইন রয়েছে। ১৯৯০ দশকে খাদ্যনীতি সংক্রান্ত দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় যে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্ত করে বেসরকারি খাতের উন্মুক্ত পরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান। এ জন্য ঐ সমস্ত আইনসমূহ সম্পূর্ণ রদ না করে কার্যকারিতা স্থগিত করা হয়। বিচার্য বিষয়টি হলো এ সমস্ত আইন পুনর্প্রবর্তন করা হবে কি-না। এ বিষয়টি এতই জটিল যে, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এজন্য নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে সে দিকে মনোযোগী হওয়া। বিচ্ছিন্নভাবে বক্তব্য, সময় সময় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রদান করে কাঠামোগত দুর্বলতা নির্মূল করা যাবে না।
এজন্য প্রয়োজন সার্বিকভাবে বিদ্যমান বাজার কাঠামোর বিশ্লেষণ এবং তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কৃষিজাত পণ্যের বাজার কাঠামো সম্পর্কে ১৯৬৪ সালে প্রণীত একটি আইন বিদ্যমান। ঐ আইনের আওতায় সারাদেশের নির্ধারিত বাজারের কাঠামোর এবং কার্যাবলীর বিষয় অন্তর্ভুক্ত। এ আইন পরবর্তী পর্যায়ে সামান্য কিছু সংশোধন করা হলেও এর কার্যকারিতার মূল্যায়ন কখনও হয়েছে কিনা জানা নেই। চলমান বিতর্কে অনেক দুর্বলতার মধ্যে বাজার কাঠামোর একটি দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়। তা হলো মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্রিয়াকলাপ। এদেরও মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হয়। বলা হয় যে, একই পণ্য দশ ধাপ বদল করে যখন বাজারে আসে তখন প্রতি ধাপেই মূল্য বৃদ্ধি হয়। এর ফলে ভোক্তাকেও সর্বশেষ নির্ধারিত মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে হয়। ১৯৬৪ সালে কৃষিজাত পণ্য বিপণন আইনে মধ্যস্বত্বভোগীদের অবস্থান ও কার্যকলাপ স্বীকৃত। এ আইনে মধ্যস্বত্বভোগের সংজ্ঞায় একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি কৃষিজাত পণ্যের ক্রয় ও বিক্রয়ের সাথে যুক্ত সেই হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী। এর মধ্যে রয়েছে পাইকার, আড়তদার, মজুদকারী, ওজন করার ব্যক্তি, পরিমাপের ব্যক্তি, কমিশন এজেন্ট, দালাল, গুদামজাত যে করে সে ব্যক্তি ইত্যাদি।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে লাইসেন্স গ্রহণ করা হয়। লাইসেন্স গ্রহণকারী ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তি বিপণন ক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে পারবে না। এজন্য শাস্তিরও বিধান রয়েছে। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিপণন খরচ হিসাবে লাইসেন্সধারী ব্যক্তিদের প্রদান করারও বিধান রয়েছে।
কালের বিবর্তনে এ প্রথা বর্তমানে অকেজো হয়ে গেছে। এমনই একটি সংবাদ দৃশ্যমান করেছিল কোন একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া, কাওরান বাজারে এমনই অদৃশ্য প্রথা বিদ্যমান। অন্যান্য বাজারেও যে নেই তা নয়। এ প্রথাকেই অনেকে চাঁদাবাজি বলে আখ্যায়িত করে। এ বিষয়টি বহুল আলোচিত হলেও এখন পর্যন্ত সরকার কোন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি। যা করা প্রয়োজন তা হলো সংশ্লিষ্ট সকল আইন পর্যালোচনা করে বাজার কাঠামোকে যুগোপযোগী করা।
১৪-মার্চ, ২০১০
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments