১৯৭১॥ চট্টগ্রাম শহরে প্রতিরোধ যুদ্ধ by সামসুদ্দিন আহম্মদ

ক্যাপ্টেন রফিক জেনারেল হসপিটাল ও কোর্ট হিলে যেসব ইপিআর সদস্যকে ডিউটির জন্য পাঠিয়েছিলেন তাদের কিছু গুলির প্রয়োজন বলে জানিয়েছিল। আমরা রাত ১টার দিকে এসপি সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি সিওডি থেকে ২ বাক্স গুলি দিলেন আমাদের।
গুলিগুলো আমরা ডিউটিরতদের কাছে বণ্টন করে দিই। শহরের দক্ষিণ দিক অর্থাৎ নেভাল সদর দফতর থেকে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে বন্দরে অবস্থিত যুদ্ধ জাহাজ 'বাবর' থেকে শহরের দিকে শেলিং করছিল পাকিস্তনীরা। শহরের উত্তরদিকে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টে রাত সাড়ে ১১টা থেকে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পরে শুনেছি, ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারে ঘুমনন্ত সৈনিকদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছিল। সে রাতে ১ হাজারেরও বেশি বাঙালী সৈনিককে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। বাঙালী সেনারা তখন ঘুমিয়ে ছিল। আরও শুনেছি, এই ২০ বেলুচ রেজিমেন্ট সে রাতে বাঙালী আবাসিক কোয়ার্টারগুলোতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাকা- সংঘটিত করে। এই ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরাই গত মার্চ মাসের প্রথম থেকে অবাঙালীদের অস্ত্র সরবরাহ করে পাহাড়তলীতে অনেক বাঙালীকে হত্যা করে। এতদিন আমরা জেনে আসছি ক্যান্টনমেন্টে বেলুচ রেজিমেন্টের ৩০০ সেনা ছিল, আর বাঙালী সৈনিক ছিল প্রায় ১ হাজার। এই রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল চৌধুরী। আর এদিকে ষোলশহরে ছিল ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। তাদের সৈনিক সংখ্যা ছিল চার শ'র মতো। ২৬ তারিখ সকাল ১০টার দিকে মীর্জা মনসুরের নেতৃত্বে অবাঙালী দোস্ত মোহাম্মদের গুদাম ও মুসলিম কমার্স ব্যাংকের গুদাম থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়।
সেদিন ২৫ মার্চ কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে 'সোয়াত' জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাসের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর শওকতকে। তিনি যেন অস্ত্রগুলো ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসেন। সেদিন কর্নেল জানজুয়া মেজর শওকত, ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে সাথে নিয়ে সারাদিন বন্দরে অস্ত্র খালাসে নিয়োজিত ছিলেন। দুপুরের দিকে ষোলশহর রেলগেটে ছাত্র-জনতা আর শ্রমিকরা মিলে কয়েকটি মালবাহী ট্রেনের বগি নিয়ে আসে। বগিগুলো দুই নম্বর গেটে রেখে দু'দিকের রেলক্রসিংয়ে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য পাক সেনারা যেন ক্যান্টনমেন্ট থেকে শহরে না আসতে পারে। এখানে আগে থেকেই ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা পাহারারত ছিল। তারা কোন বাধা প্রদান করেনি। একই দিন সন্ধ্যায় কর্নেল জানজুয়ার কড়া নির্দেশে মেজর মীর শওকত মালবাহী ট্রেনটি সরিয়ে সেনানিবাসে ঢোকার রাস্তা ও বায়েজিদ বোস্তামি সড়কটি উন্মুক্ত করে দেন। ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পরে মেজর জিয়া অস্ত্র খালাসের উদ্দেশ্যে ষোলশহর থেকে বন্দরের দিকে যাত্রা করেন। ইস্পাহানি মোড় থেকে আগ্রাবাদ হয়ে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত আপামর জনতা শত শত ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। এই ব্যারিকেড সরিয়ে সরিয়ে রাত ১১টায় মেজর জিয়া আগ্রাবাদ পৌঁছেন। এদিকে ক্যান্টনমেন্টে গোলাগুলি আওয়াজ শুনে বাঙালী সৈনিকেরা আক্রানত্ম হবার খবর ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান জিয়াকে ফিরিয়ে আনার জন্য পোর্টের দিকে চলে যান। আগ্রাবাদ গিয়ে দেখেন মেজর জিয়া ব্যারিকেড সরাতে ব্যস্ত। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান মেজর জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট আক্রান্ত হওয়ার খবর জানিয়ে ষোলশহর ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.