সিডনির মেলব্যাগ- নোবেল জয়ীর নিরুত্তাপ সিডনি সফর by অজয় দাস গুপ্ত
বাঙালী হিসেবে গর্ব করার মতো অনেক কিছুই
আছে আমাদের। কে জানি বলছিল, অর্থনীতিতে পশ্চাৎপদ হলেও আমরা ঘুমোতে যাই
তিনটি নোবেল আর একটি অস্কার সাথে নিয়ে।
বলা বাহুল্য,
রবীন্দ্রনাথ ও অর্মত্য সেনের পর তৃতীয় নোবেল জয়ী পদ্মাপারের ড. ইউনূস।
অস্কারটি খ্যাতিমান সত্যজিত রায়ের। মূল প্রসঙ্গে যাবার পূর্বে বিনয়ের সাথে
বলতে চাই, মাদার তেরেসার পুরস্কারটিও আমাদেরই ভাবা উচিত। 'জন্ম হউক যথা তথা
কর্ম হউক মহৎ'_ এ আপ্তবাক্য শুনে বড় হওয়া বাঙালী মহীয়সী মা তেরেসাকে পর
ভাবলে নেহাৎ অন্যায় হবে। মূলত বঙ্গদেশীয় মানুষের কষ্ট ও দরিদ্রতার
বিরুদ্ধেই লড়াই করে গিয়েছেন তিনি।
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস এখন সিডনিতে। স্থানীয় ওয়েব কাগজ বাংলা সিডনি ডটকমে দেখি পরিচিত বেশ কয়েকজন বাঙালীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতকারের দুর্লভ ছবি। এদের মধ্যে একজন আমার জানী দোস্ত। তিনি ফোন করে জানিয়েছিলেন অমুক অপরাহ্নে অমুক হোটেলের লবিতে দেখা করার ব্যবস্থা পাকা। সবার ভাগ্যে কি আর সব সয়? সবে দেশ ভ্রমণ শেষে ফিরেছি। ঐ দিনটিতে কাজ শুরু করেছি মাত্র। অর্ধ বেলায় চাকরি ছেড়ে পগারপার ঠিক মনঃপূত মনে হয়নি। তাছাড়া এই ফাঁকি দেয়াটাও ঠিক ইউনূসীয় আদর্শের সাথে যায় না। ফলে দেখা না হবার মনস্তাপ নেয়াটাই শ্রেয় মনে করে চুপ থাকলাম। পরদিন সকালে অফিসের নৈমিত্তিক ইলেকট্রনিক পর্দা খুলে দেখি স্বয়ং ড. ইউনূস হাজির। এসেছিলেন আমাদের ব্যাংকের দফতরে। খুব ঘরোয়া সমাবেশে গ্রামীণ ব্যাংক ও তার কার্যক্রমের বিশদ, রসালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সে ভিডিও ও খবর পৌঁছে গেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মচারীদের টেবিলে। কম্পিউটারের পর্দায় তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন বাংলাদেশী নোবেল বিজয়ীর স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ ও কর্মসাফল্যের অভিজ্ঞতার বিশদ বর্ণনা।
ড. ইউনূস সম্ভবত একমাত্র নোবেল বিজয়ী যিনি এত বড় অর্জনের পরও তিরস্কৃত এবং সমালোচিত। ঢাকায় শুনেছি, নোবেল পাবার পর সে মাত্রায় বেগ বেড়েছে। কেন? কতটা যৌক্তিক, সে আলোচনায় যাব না। তবে এর পেছনে একেবারে যে যুক্তি নেই তাও কিন্তু নয়। ব্যক্তিগত মানুষ এক একটি বিশাল অর্জনের পর ব্যক্তিগত থাকেন না। পৃথিবীর ইতিহাসে খ্যাতিমান মানুষের কাহিনীতেই তা বিধৃত। জ্যোতির্ময় হবার ৰমতা থাকে না সবার। জ্যোতি ছড়ানোও সবার পক্ষে অসম্ভব। ড. ইউনূস আমাদের দরিদ্র দেশ ও জাতির আয়ু, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও চিন্তার আলোকিত সন্তান। তাঁর কছে জাতির প্রত্যাশা, অন্ধকার তাড়ানোর সংগ্রামে দৃঢ় ভূমিকা। ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পক্ষপাত আনুগত্য। আশ্চর্যজনকভাবে কিছু ক্ষেত্রে গৌরবময় ভূমিকার পরও তিনি সংশয়হীন অবস্থানে থাকতে পারেননি। অনেকে মনে করেন, রাজনীতি-নিরপেক্ষ থাকার কারণে এই অবস্থা। রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ সমর্থন আর জড়িয়ে থাকাটা মূলত অন্য বিষয়। কিন্তু সমাজ ও জীবনবোধে কোন মানুষই নিরপেক্ষ কেউ নয়। ঋতিক ঘটক বিশ্বাস করতেন 'ইউ অর অলওয়েজ এ পার্টিশন, ফর অর এগেনস্ট', ২য় পক্ষ অথবা বিপক্ষের দেয়াল হবার বিকল্প নেই। এটাই মানুষের নিয়তি। কেউ হিটলার বা আধুনিক কালের আমেরিকার সর্বগ্রাসী ৰুধার সমর্থক হলে অনিবার্যভাবেই তাঁর অবস্থান হবে গণতান্ত্রিক জীবনবিরোধী। সেই মতো আমাদের দেশের ইতিহাস ও ঘটনাপরম্পরা বিবেচনায় পক্ষ-বিপক্ষও এক অনিবার্য অবস্থান নির্ণয়কারী নির্দেশিকা।
ড. ইউনূস সে অবস্থানে নিজেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। চিঠি লিখে মতামত সংগ্রহ ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিতর্ক তাঁকে মানায়নি। মানায়নি ঔদার্য ও ভালবাসায় জাতির জনক বা রাজনীতিকে বরণ করার ব্যর্থতা। সামাজিক দুঃখ-কষ্ট, অভাব মোচন কেবল মাইক্রো ক্রেডিটে সম্ভব নয়। সেটা তিনিই ভাল জানেন। সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ওঠার পর সমতলের সবাইকে এক সাইজের মনে হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। সেটা তিনি পেরেছেন কি-না জানি না। তাঁর দেশপ্রেম ও জনগণের হিত কামনা প্রশ্নাতীত। প্রশ্ন_ তিনি কি অর্থনীতির রোল মডেল থাকবেন, না জনমানুষের অগ্রগতির নেতৃত্বেও শামিল হবেন? নোবেল জয়ীদের সে জাতীয় তৎপরতা নতুন কিছু নয়। সাহিত্যে নোবেল পেলেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আপাদমস্তক সমাজসেবক। শিক্ষাব্রতী, শিক্ষক ও শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার পুরোধা। এর কোন উদাহরণ দেয়ারও প্রয়োজন নেই। নোবেল জয়ী পাশের দেশের সুচি আরেক জলন্ত প্রমাণ। দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্রতী আউং সান সুচি অবরোধবাসিনী। গণতন্ত্র ও সাম্যের জন্য লড়াইয়ে অকুতোভয়, ডিসমেন্ড টুটোর কথাও মনে করছি। নিজ দেশ ও জাতির জন্য উচ্চারিত বিশপ টুটোর অবিস্মরণীয় উক্তি : "ইউরোপিয়ানরা যখন এসেছিল তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল, আমাদের ছিল জমি। তারা আমাদের চোখ বুজে মগ্ন হতে বলল। চোখ খুলে দেখি, আমাদের হাতে বাইবেল, আর তাদের কাছে জমি। সাফ কথার এমন দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় বিরল। তাতে কী? স্বেতাঙ্গ অসন্তুষ্ট হলেও টুটোর ইমেজ বেড়েছে বৈই কমেনি। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস যুগ্ম নোবেল বিজয়ী। সে পর্যায়ে এখন ইতিহাস। ব্যাংকটি দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নে কতটা মুনাফাহীন সাহায্য দিতে পারে' তিনি কতটা সমাজপতি, দেশবরেণ্য হবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এটা নিশ্চিত দেশের ইমেজ বাড়িয়ে পরিচয় ও অবস্থানকে ক্রমাগত গৌরবান্বিত করে চলেছেন তিনি। করবারই কথা। দুর্ভাগা দেশের এমন মঙ্গলদূত যে আর একটিও নেই। সিডনি জয় তো তাঁর হাতের তুড়ি। অথচ স্থানীয় ওয়েব পত্রিকাতে ক্ষোভ প্রকাশ অথবা বেদনা ঝরেছে এই বলে : তাঁর সম্মাননা ও বক্তৃতা পর্বে বাঙালী উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা। কেন এই দুরবস্থা?
dasguptaajoy@hotmail.com
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস এখন সিডনিতে। স্থানীয় ওয়েব কাগজ বাংলা সিডনি ডটকমে দেখি পরিচিত বেশ কয়েকজন বাঙালীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতকারের দুর্লভ ছবি। এদের মধ্যে একজন আমার জানী দোস্ত। তিনি ফোন করে জানিয়েছিলেন অমুক অপরাহ্নে অমুক হোটেলের লবিতে দেখা করার ব্যবস্থা পাকা। সবার ভাগ্যে কি আর সব সয়? সবে দেশ ভ্রমণ শেষে ফিরেছি। ঐ দিনটিতে কাজ শুরু করেছি মাত্র। অর্ধ বেলায় চাকরি ছেড়ে পগারপার ঠিক মনঃপূত মনে হয়নি। তাছাড়া এই ফাঁকি দেয়াটাও ঠিক ইউনূসীয় আদর্শের সাথে যায় না। ফলে দেখা না হবার মনস্তাপ নেয়াটাই শ্রেয় মনে করে চুপ থাকলাম। পরদিন সকালে অফিসের নৈমিত্তিক ইলেকট্রনিক পর্দা খুলে দেখি স্বয়ং ড. ইউনূস হাজির। এসেছিলেন আমাদের ব্যাংকের দফতরে। খুব ঘরোয়া সমাবেশে গ্রামীণ ব্যাংক ও তার কার্যক্রমের বিশদ, রসালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সে ভিডিও ও খবর পৌঁছে গেছে অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মচারীদের টেবিলে। কম্পিউটারের পর্দায় তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন বাংলাদেশী নোবেল বিজয়ীর স্বতঃস্ফূর্ত ভাষণ ও কর্মসাফল্যের অভিজ্ঞতার বিশদ বর্ণনা।
ড. ইউনূস সম্ভবত একমাত্র নোবেল বিজয়ী যিনি এত বড় অর্জনের পরও তিরস্কৃত এবং সমালোচিত। ঢাকায় শুনেছি, নোবেল পাবার পর সে মাত্রায় বেগ বেড়েছে। কেন? কতটা যৌক্তিক, সে আলোচনায় যাব না। তবে এর পেছনে একেবারে যে যুক্তি নেই তাও কিন্তু নয়। ব্যক্তিগত মানুষ এক একটি বিশাল অর্জনের পর ব্যক্তিগত থাকেন না। পৃথিবীর ইতিহাসে খ্যাতিমান মানুষের কাহিনীতেই তা বিধৃত। জ্যোতির্ময় হবার ৰমতা থাকে না সবার। জ্যোতি ছড়ানোও সবার পক্ষে অসম্ভব। ড. ইউনূস আমাদের দরিদ্র দেশ ও জাতির আয়ু, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও চিন্তার আলোকিত সন্তান। তাঁর কছে জাতির প্রত্যাশা, অন্ধকার তাড়ানোর সংগ্রামে দৃঢ় ভূমিকা। ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পক্ষপাত আনুগত্য। আশ্চর্যজনকভাবে কিছু ক্ষেত্রে গৌরবময় ভূমিকার পরও তিনি সংশয়হীন অবস্থানে থাকতে পারেননি। অনেকে মনে করেন, রাজনীতি-নিরপেক্ষ থাকার কারণে এই অবস্থা। রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ সমর্থন আর জড়িয়ে থাকাটা মূলত অন্য বিষয়। কিন্তু সমাজ ও জীবনবোধে কোন মানুষই নিরপেক্ষ কেউ নয়। ঋতিক ঘটক বিশ্বাস করতেন 'ইউ অর অলওয়েজ এ পার্টিশন, ফর অর এগেনস্ট', ২য় পক্ষ অথবা বিপক্ষের দেয়াল হবার বিকল্প নেই। এটাই মানুষের নিয়তি। কেউ হিটলার বা আধুনিক কালের আমেরিকার সর্বগ্রাসী ৰুধার সমর্থক হলে অনিবার্যভাবেই তাঁর অবস্থান হবে গণতান্ত্রিক জীবনবিরোধী। সেই মতো আমাদের দেশের ইতিহাস ও ঘটনাপরম্পরা বিবেচনায় পক্ষ-বিপক্ষও এক অনিবার্য অবস্থান নির্ণয়কারী নির্দেশিকা।
ড. ইউনূস সে অবস্থানে নিজেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। চিঠি লিখে মতামত সংগ্রহ ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিতর্ক তাঁকে মানায়নি। মানায়নি ঔদার্য ও ভালবাসায় জাতির জনক বা রাজনীতিকে বরণ করার ব্যর্থতা। সামাজিক দুঃখ-কষ্ট, অভাব মোচন কেবল মাইক্রো ক্রেডিটে সম্ভব নয়। সেটা তিনিই ভাল জানেন। সর্বোচ্চ শৃঙ্গে ওঠার পর সমতলের সবাইকে এক সাইজের মনে হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। সেটা তিনি পেরেছেন কি-না জানি না। তাঁর দেশপ্রেম ও জনগণের হিত কামনা প্রশ্নাতীত। প্রশ্ন_ তিনি কি অর্থনীতির রোল মডেল থাকবেন, না জনমানুষের অগ্রগতির নেতৃত্বেও শামিল হবেন? নোবেল জয়ীদের সে জাতীয় তৎপরতা নতুন কিছু নয়। সাহিত্যে নোবেল পেলেও রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আপাদমস্তক সমাজসেবক। শিক্ষাব্রতী, শিক্ষক ও শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার পুরোধা। এর কোন উদাহরণ দেয়ারও প্রয়োজন নেই। নোবেল জয়ী পাশের দেশের সুচি আরেক জলন্ত প্রমাণ। দেশ ও জাতির কল্যাণে ব্রতী আউং সান সুচি অবরোধবাসিনী। গণতন্ত্র ও সাম্যের জন্য লড়াইয়ে অকুতোভয়, ডিসমেন্ড টুটোর কথাও মনে করছি। নিজ দেশ ও জাতির জন্য উচ্চারিত বিশপ টুটোর অবিস্মরণীয় উক্তি : "ইউরোপিয়ানরা যখন এসেছিল তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল, আমাদের ছিল জমি। তারা আমাদের চোখ বুজে মগ্ন হতে বলল। চোখ খুলে দেখি, আমাদের হাতে বাইবেল, আর তাদের কাছে জমি। সাফ কথার এমন দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় বিরল। তাতে কী? স্বেতাঙ্গ অসন্তুষ্ট হলেও টুটোর ইমেজ বেড়েছে বৈই কমেনি। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস যুগ্ম নোবেল বিজয়ী। সে পর্যায়ে এখন ইতিহাস। ব্যাংকটি দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নে কতটা মুনাফাহীন সাহায্য দিতে পারে' তিনি কতটা সমাজপতি, দেশবরেণ্য হবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এটা নিশ্চিত দেশের ইমেজ বাড়িয়ে পরিচয় ও অবস্থানকে ক্রমাগত গৌরবান্বিত করে চলেছেন তিনি। করবারই কথা। দুর্ভাগা দেশের এমন মঙ্গলদূত যে আর একটিও নেই। সিডনি জয় তো তাঁর হাতের তুড়ি। অথচ স্থানীয় ওয়েব পত্রিকাতে ক্ষোভ প্রকাশ অথবা বেদনা ঝরেছে এই বলে : তাঁর সম্মাননা ও বক্তৃতা পর্বে বাঙালী উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা। কেন এই দুরবস্থা?
dasguptaajoy@hotmail.com
No comments