বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক-নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট? by নজরুল ইসলাম

নদীর পানি ভাগাভাগি ও ট্রানজিট ইস্যুতে ভারত ও বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে এবং তা হলো, ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’। অর্থাৎ বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিটের সুযোগ দেবে, বিনিময়ে ভারত অভিন্ন সব নদ-নদী উন্মুক্ত করে দেবে, যাতে তাদের পূর্ণ প্রবাহ বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারে।

এ সমঝোতার পেছনে যুক্তিটি প্রবল। স্বীয় ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ভারত অভিন্ন নদ-নদীগুলোর পানি ক্রমাগতভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। আবার স্বীয় ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিটের সুবিধা দিতে অস্বীকার করতে পারে। ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ সমঝোতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ে ভৌগোলিক কারণে প্রাপ্ত নিজ নিজ সুবিধা বিনিময় করতে পারে।
ভারত কর্তৃক নদীর পানি অপসারণের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৭৪ সাল থেকে এ বাঁধ দিয়ে ভারত পদ্মার পানি ভাগীরথী-হুগলী নদীর দিকে সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদী আজ মৃতপ্রায়। পানি অপসারণের দ্বিতীয় বড় উদাহরণ তিস্তা নদীর ওপর ভারত কর্তৃক নির্মিত গাজলডোবা বাঁধ। এ ছাড়া দুধকুমারী, খোয়াই, সোমেশ্বরী, মনু, গোমতী, মুহুরী, ধরলাসহ অন্য নদ-নদীর ওপরও ভারত পানি অপসারণমূলক কাঠামো নির্মাণ করেছে। টিপাইমুখ বাঁধের সঙ্গে ভবিষ্যতে ফুলেরতলে নির্মিতব্য ব্যারাজ যোগ হলে সুরমা-কুশিয়ারার প্রবাহও হ্রাস পাবে। বস্তুত বড় বড় অভিন্ন নদ-নদীর প্রায় সব কটির ওপরই ভারত হয় ইতিমধ্যে পানি অপসারণমূলক কাঠামো নির্মাণ করেছে, নির্মাণে রত অথবা নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
সম্প্রতি প্রকাশ, ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোয় ১৪৮টি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে ব্রহ্মপুত্রসহ বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় নদ-নদীগুলোর পানির প্রবাহ হ্রাস পাবে। এ ছাড়া ভারতে ‘আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প’ নামের একটি বিশাল প্রকল্প বিবেচনাধীন আছে, যার উদ্দেশ্য হলো ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার পানি ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে স্থানান্তর করা। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো আরও শুষ্ক হয়ে পড়বে। সুতরাং ভারতকে অভিন্ন নদ-নদীর পানি প্রত্যাহার থেকে নিবৃত্ত করা বাংলাদেশের জন্য আজ অত্যন্ত জরুরি কাজ।
জলবায়ু পরিবর্তন এ কাজকে আরও অপরিহার্য করে তুলেছে। যেসব ধারায় জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশকে আক্রান্ত করছে, এর মধ্যে অন্যতম হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে নিমজ্জন, লবণাক্ততার প্রসার ও নদ-নদী প্রবাহের চরমভাবাপন্নতার বৃদ্ধি (অর্থাৎ শীতকালে প্রবাহের আরও হ্রাস এবং গ্রীষ্মকালে প্রবাহের আরও বৃদ্ধি)। এই প্রতিটি ধারা প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক পূর্ণ প্রবাহ নিতান্ত জরুরি। প্রথমত, যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো বছরে প্রায় ২০০ কোটি টন পলিমাটি বয়ে এনেছে। এ পলিমাটিই বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠকে বছরে প্রায় দুই মিলিমিটার করে উঁচু করেছে। সে জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মুখে টিকে থাকার জন্য এ পলিমাটিভরণ অব্যাহত রাখা অত্যাবশ্যক। দুঃখজনক যে, ভারত কর্তৃক নদ-নদীগুলোর ওপর বাঁধ ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের ফলে পানিপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে পলিমাটির পরিমাণও হ্রাস পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নদ-নদীর পূর্ণ প্রবাহ লবণাক্ততা প্রসার রোধে সহায়ক হবে। তৃতীয়ত, শুষ্ক মৌসুমের পূর্ণ প্রবাহ জলবায়ু পরিবর্তন দ্বারা সৃষ্ট বাড়তি চরমভাবাপন্নতা প্রশমনেও সহায়ক হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশকে সহায়তা করা ভারতের নিজের স্বার্থের জন্যই জরুরি। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে যদি বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশ নিমজ্জিত হয় এবং এর ফলে এ দেশের কোটি কোটি মানুষ বাস্তুহারা ও জীবিকাহারা হয়, তাহলে তার প্রভাব অবশ্যম্ভাবীরূপে ভারতের ওপর গিয়ে পড়বে। কোটি কোটি মানুষ সাঁতার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাতে পারবে না। তারা পায়ে হেঁটে যেখানে যাওয়া যায়, সেখানেই রওনা দেবে। কোনো কাঁটাতারের বেড়া কোটি কোটি মানুষের ওই প্রবাহ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের উপর্যুক্ত ইস্যু ছাড়াও নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা চূড়ান্ত ও বৃহত্তর বিচারে ভারতের নিজের জন্যও মঙ্গলকর নয়। ফারাক্কাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এ বাঁধের পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা। অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, ফারাক্কা সেই উদ্দেশ্য সাধনে সফল হয়নি। প্রথমত, ফারাক্কা কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে হুগলীর পলি অপসারণেও সক্ষম হয়নি। দ্বিতীয়ত, তাতে সক্ষম হলেও ফারাক্কার পক্ষে সমুদ্র থেকে ১২৬ মাইল অভ্যন্তরে অবস্থিত কলকাতাকে বর্তমান যুগের উপযোগী সামুদ্রিক বন্দরে রূপান্তরিত করা সম্ভব ছিল না। কারণ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যুগের জাহাজ আর বর্তমান যুগের জাহাজের আকার, দ্রুততা ও তলদেশ গভীরতার আকাশ-পাতাল তফাত।
ফারাক্কা বরং পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের বহু স্থানে বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এসব এলাকার মানুষ প্রায়ই হাতুড়ি ও কুড়াল সহকারে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার দাবিতে মিছিল করছে।
এদিকে ফারাক্কায় বাধাগ্রস্ত হয়ে গঙ্গা নদী নিজেই বিকল্প পথের সন্ধানে ব্যাপৃত। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, গঙ্গার মূল প্রবাহ ধীরে ধীরে ফারাক্কার উত্তরে সরে যাচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো গঙ্গার প্রবাহ সম্পূর্ণ ফারাক্কা বাঁধের বাইরে দিয়ে প্রবাহিত হবে। তখন ফারাক্কা শুকনো নদীবক্ষে প্রযুক্তিগত অহমিকার একটি নিষ্ফল কিন্তু নিষ্ঠুর দৃষ্টান্ত হিসেবে বিরাজ করবে। সুতরাং ফারাক্কা একদিকে বাংলাদেশের ক্ষতি সাধন করেছে, অন্যদিকে তা ভারতের জন্যও তেমন কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনি।
ফারাক্কার এ পরিণতির মূল কারণ হলো, এটি একটি প্রকৃতিবিরুদ্ধ পদক্ষেপ। ব-দ্বীপ গঠনের সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মেই গঙ্গার মূল প্রবাহ একসময় ভাগীরথী-হুগলী থেকে পদ্মায় সরে আসে। বাঁধ দিয়ে জোর করে গঙ্গার প্রবাহ পুনরায় ভাগীরথী-হুগলী অভিমুখী করা ছিল প্রকৃতির ওই নিয়মকে অস্বীকার করার প্রয়াস। এরূপ প্রয়াসে কিছু সাময়িক ও আপাত সুফল পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে ও সামগ্রিক বিচারে তা কল্যাণকর হয় না।
তিস্তার ওপর ভারত কর্তৃক নির্মিত গাজলডোবা বাঁধের অন্যতম যুক্তি হলো সেচ, কিন্তু গবেষণা থেকে দেখা গেছে, এ ধরনের সেচ প্রকল্প শেষাবধি অপচয়মূলক বলেই প্রমাণিত হয়। প্রথমত, পানির সদ্ব্যবহার সাধিত হয় না। দ্বিতীয়ত, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটে। তৃতীয়ত, দেখা যায় যে পানি-সাশ্রয়ী ফসলের উদ্ভাবন ও চাষ এবং লভ্য পানির আরও দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে নদীর পানির বৃহদাকার প্রত্যাহারমূলক সেচ প্রকল্প ছাড়াও উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। সুতরাং কলকাতা বন্দরের নাব্যতা রক্ষা যেমন ফারাক্কার যথার্থ যুক্তি হতে পারে না, তেমনি সেচের প্রয়োজনীয়তায় গাজলডোবা সার্থক যুক্তি হতে পারে না।
পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের অভিজ্ঞতাও নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিবিরোধী আচরণের শেষ বিচারে বিফলতার সাক্ষ্য দেয়। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাজাখস্তানে তুলা চাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমু দরিয়া ও সির দরিয়া নদীদ্বয়ের পানি দক্ষিণের আরল সমুদ্রের পরিবর্তে উত্তরাভিমুখী করা হয়েছিল। তাতে তুলা উৎপাদন কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতিবিরুদ্ধ এ পদক্ষেপের ফলে আরল সমুদ্রের সর্বনাশ সাধিত হয়। অন্যদিকে কাজাখস্তানের কৃষিজমি জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার শিকার হয় এবং শেষাবধি তুলা চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রকৃতিবিরুদ্ধ এসব পদক্ষেপের চিন্তাগত উৎস হলো নদ-নদীর প্রতি ‘বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি’। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নদীর পানি সমুদ্রে চলে যাওয়াটা অপচয়, বরং সমুদ্রে পৌঁছানোর আগেই নদীর পানি বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রয়োজনে শুষে নিতে হবে। নদীর প্রতি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে সূচিত আধুনিকায়নের একটি সহজাত চিন্তা, কিন্তু অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব প্রমাণের প্রচেষ্টা যদি প্রকৃতিসম্মত ধারায় অগ্রসর না হয়ে বরং প্রকৃতিবিরুদ্ধ ধারায় অগ্রসর হয়, তবে তা শেষ বিচারে কল্যাণকর হয় না; তখন প্রকৃতির প্রতিশোধের সম্মুখীন হতে হয়।
সে কারণেই বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে নদ-নদীর প্রতি ‘প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি’ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এ দৃষ্টিভঙ্গি এখন সমাদৃত হচ্ছে। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের গতিমুখ ও পরিমাণ যতটা পারা যায় অক্ষুণ্ন রাখাই শ্রেয়। বিশেষ করে, নদীপ্রবাহের বৃহদাকার প্রত্যাহারমূলক পদক্ষেপগুলো এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুমোদন করে না।
প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে পৃথিবীর অনেক দেশে এখন বাঁধ ভেঙে দিয়ে নদ-নদীগুলো উন্মুক্ত করা হচ্ছে। ২০০১ সালে প্রকাশিত ‘বাঁধবিষয়ক বিশ্ব কমিশন’-এর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে পাঁচ শতাধিক বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বহু নতুন বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাঁধ ভেঙে দেওয়ার হার নতুন বাঁধ নির্মাণের হারকে ছাড়িয়ে গেছে। জাপানেও বহু নতুন বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে এবং পুরোনো বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। এভাবে বাঁধের বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নদী ও এর অববাহিকার প্রকৃতি ও পরিবেশ নিষ্কৃতি পাচ্ছে।
খোদ ভারতেও পানি বিশেষজ্ঞ ও কর্মীদের মধ্যে প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হচ্ছে। তাঁদের অনেকেই নদ-নদীর ওপর বৃহদাকার অবকাঠামোর বিরোধিতা করছেন। নর্মদা নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সে দেশে প্রবল আন্দোলন হয়েছে। ২০০৪ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) ও অন্যান্য সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের প্রভাব-সম্পর্কিত দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিরাটসংখ্যক ভারতীয় নদী বিশেষজ্ঞ ও কর্মী যোগ দেন এবং তাঁদের অধিকাংশ সদস্য নদ-নদীর প্রতি প্রকৃতিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন।
ভারত কর্তৃক অভিন্ন নদ-নদীর পানি অপসারণ আন্তর্জাতিক নদ-নদীর ব্যবহারসংক্রান্ত ১৯৯৭ সালে প্রণীত জাতিসংঘের কনভেনশনের পরিপন্থী। এ কনভেনশনের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে অভিন্ন নদীর অংশীদার অন্য কোনো দেশের ‘লক্ষণীয় ক্ষতি’ সাধনে সক্ষম, এরূপ কোনো পদক্ষেপ থেকে নিবৃত্ত থাকতে বলা হয়েছে। একইভাবে এ কনভেনশনের ২৩ নম্বর অনুচ্ছেদে নদ-নদীর মোহনা ও সামুদ্রিক পরিবেশের ক্ষতি সাধন করতে পারে, এরূপ কোনো পদক্ষেপ থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়েছে। নদীপ্রবাহের ওপর ‘পূর্ব থেকে প্রচলিত ব্যবহার’-এর অগ্রাধিকারের বিষয়টিও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সুতরাং পরিষ্কার যে ভারত কর্তৃক নির্মিত বাংলাদেশের নদ-নদী থেকে পানি অপসারণমূলক কাঠামোগুলো উপর্যুক্ত কনভেনশন ও নীতির পরিপন্থী। অতএব আন্তর্জাতিক আইন ও অভিমতের দৃষ্টিকোণ থেকেও ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ সমঝোতাটি ভারতের জন্য গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত।
ট্রানজিটের বিনিময়ে শুল্ক, মাশুল ইত্যাদি নিশ্চয়ই বাংলাদেশের প্রাপ্য। এসবের হার, পরিমাণ, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, অবকাঠামো ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের অভিজ্ঞতা থেকে শুল্ক, মাশুল, নিরাপত্তা, অবকাঠামো ইত্যাদি ইস্যুর মীমাংসা সম্পর্কে নির্দেশনা পাওয়া সম্ভব।
কিন্তু ট্রানজিটের বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে শুল্ক ও মাশুল বাংলাদেশের মূল প্রাপ্য হওয়া উচিত নয়। যত উচ্চ হারেই ধরা হোক না কেন, এসব শুল্ক ও মাশুল থেকে অর্জিত অর্থের পরিমাণ খুব বেশি হবে না। বিশেষ করে, প্রবাসী কর্তৃক প্রতিবছর দেশে প্রেরিত অর্থের তুলনায় এর পরিমাণ নগণ্য। ট্রানজিটের প্রশ্নে শুল্ক ও মাশুলের হারের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য ঠিক হবে না।
ট্রানজিট একটি স্ট্র্যাটেজিক ইস্যু। ট্রানজিটের বিনিময়ে নদ-নদীগুলোর পূর্ণ প্রবাহ ফিরে পাওয়াই বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের জোরালো অবস্থান গ্রহণ করা দরকার। বাংলাদেশের জনগণকেও এ দাবিতে সোচ্চার হতে হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান চিরস্মরণীয়। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বাংলাদেশের বিশেষভাবে প্রয়োজন। উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন থেকে বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। একইভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ নিশ্চয় ভারতেরও কাম্য। সুতরাং ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ সমঝোতা বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্যই মঙ্গলকর।
ড. নজরুল ইসলাম: বিশ্ব সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন)।
sr.n.islam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.