একজন প্রেমিকের আত্মানুসন্ধান by জাফরিন গুলশান
সেই দিন/ আজও অমলিন।/ নিশিভোরে সোনালি মাঠে রঙের গভীরে স্নান!/বর্ণিল দিন-রাত উদ্দাম উচ্ছল/ আনন্দ প্রপাতে মেলে সব কোলাহল।/ জলকনা করে নির্মাণ রঙের দেয়াল—/ জীবনের কী বিপুল সাজ,/ প্রস্ফুটিত হেমন্ত গোধূলিতে/ ফিরে দেখি আজ।
৯ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘হেমন্তগোধূলি’ কবিতাটিতে বর্ষীয়ান এই কবি মূলত বাংলাদেশের অন্যতম চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর জীবনকে স্মৃতি হাতড়ে ফিরে দেখেছেন অভিজ্ঞতাসঞ্চিত দৃষ্টিতে। এই ‘আত্মানুসন্ধান’কে উপজীব্য করে রং-তুলি ক্যানভাসে ছবি এঁকেছেন। নিজেকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিজ শিকড়ের উৎসমূলে পৌঁছেছেন। বাংলাদেশের মাটির সোঁদা গন্ধ, জল-জোছনা, ধানখেত, আবহমানকালের শক্তিশালী সংস্কৃতি-লোকঐতিহ্য, সাধারণ মানুষের জীবন—সব মিলিয়ে এই একজন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। কোয়েস্ট অফ সেল্ফ বা ‘আত্মানুসন্ধান’ শিরোনামে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টস শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করেছে একটি একক চিত্র প্রদর্শনী। ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে পঞ্চাশের দশকে পাস করে বেরোনো সমকালীন বাংলাদেশের সফলতম একজন শিল্পী, যাঁর চিত্রকলার ভাষা নির্মিত হয়েছে লোকজ মোটিফকে নিজস্ব ভঙ্গিতে প্রচ্ছদ অলংকরণের গুণ বৈশিষ্ট্যে। আর্ট কলেজের ছাত্রাবস্থায় নিজ লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে বই অলংকরণে প্রবেশ (ব্যক্তিগত এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন) এবং এ দেশের বইয়ের প্রচ্ছদ চিত্রণে নতুন মাত্রা যোগ করেন তিনি। সুদীর্ঘ সময়ের সেই চর্চা নিজস্ব ভাষা উপস্থাপনে সহযোগী হয়েছে তাঁর চিত্রকলায়। মূলত একজন চিত্রশিল্পী। কবিতাও লেখেন। ‘একজন মানুষের শিল্পসাহিত্যের সব ক্ষেত্র সম্পর্কে জ্ঞান থাকাটা জরুরি। তবেই গভীরতা তৈরি হয়’—বিগত এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন। তাঁর এই বহুমুখী জ্ঞানতৃষ্ণা চৌকো ক্যানভাসগুলোতে ছন্দময়, কাব্যিক গুণসমৃদ্ধ এক গল্পকথনের সৃজন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী কামরুল হাসানের পর এ দেশের লোকজ ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ নাগরিক শিল্পচরিত্র নির্মাণে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী অবশ্যই সফল। জ্যামিতিক ড্রইং আঙ্গিকে বাংলাদেশের নিসর্গ, নদী, নৌকো-নৌকোর গলুই, মাছ, শাপলা ফুল, বাঙালি রমণীর সহজ সাধারণ উপস্থিতি, পাখি, বৃক্ষ, সূর্য ইত্যাদি দেখি তাঁর ছবিতে চরিত্র হিসেবে। একই চিত্রপটে বিভিন্ন দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিত থেকে উপস্থাপন করেছেন চরিত্রগুলোকে। যেমন: গাছের আঙ্গিকের আলংকরণিক বৈশিষ্ট্যের সরলীকরণ উপস্থিতির সঙ্গে হয়তো তিনটি পাখির খাবার খাওয়ার দৃশ্য ‘বার্ডস আই ভিউ’ থেকে দেখা। সাদা, লাল, সবুজ, নীল, হলুদ রংগুলোকে বিবিধ গ্রেডে চমকপ্রদ উপায়ে ব্যবহার করেন। এ ক্ষেত্রেও শিল্পী লোকঐতিহ্যের বহমান ধারায় (নকশিকাঁথা, সরাচিত্র, গাজীর পটচিত্র প্রভৃতি) জটিলতাবিবর্জিত ভিন্ন ভিন্ন ড্রইংয়ের অভ্যন্তরে একেকটি রং পুরোটা জুড়ে দেওয়ার প্রবণতাকে কিছুটা ঢঙে উপস্থাপন করেছেন। ৮০টি ছবিই ‘কোয়েস্ট অফ সেল্ফ’ সিরিজের অন্তর্গত। মূলত অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে কখনো কাগজে, কখনো কাপড়ের ক্যানভাসে এঁকেছেন। কোথাও বা প্যাস্টেল রং কিংবা কলমের ইচ্ছামতো আঁকিবুঁকি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক ড্রইং। প্রদর্শনীর ক্যাটালগে সৈয়দ শামসুল হকের লেখায় শিল্পীর এই প্রদর্শনী সম্পর্কে উদ্ধৃতি, ‘এ প্রদর্শনীর কাজগুলোর সাথে আমার আগের কাজের খুব একটা মিল নেই; এ ধরনের কাজ, এ ধরনের খুব প্রাথমিক পর্যায়ের কিছু কাজ আমি উপস্থিত করেছিলাম ১৯৭৭ সালে, শিল্পকলা একাডেমীর গ্যালারিতে। তারপর আর এগোইনি, মূলত এ প্রদর্শনীর এ কাজ সবই আমার বাল্যস্মৃতি থেকে তুলে আনা। ...আমি বাংলাকে ধরতে চেয়েছি আমার পটে, বাঙালির ইতিহাস, জীবন ও মানস থেকে আমি একটা নান্দনিক বিন্যাস নিজের মতো করে রচনা করতে চেয়েছি পটে; এই-ই আমার কাজ, এই-ই আমার সন্ধান; আমার ভেতরে বাংলা আছে, বাংলার ভেতরে আমি আছি।’ প্রশান্তি দেয় তাঁর ছবি। কিছু তেলরং ও ছাপচিত্র মাধ্যমের সেরিগ্রাফের কাজ রয়েছে। বর্ষীয়ান গুণী শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর শিল্পকর্মের রস আস্বাদন এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সহজবোধগম্যতার আয়ত্তে। একই সঙ্গে শিল্পক্রেতারা অবশ্য মূল্যবান এই শিল্পীকে শ্রদ্ধাভরে মূল্যায়ন করেছেন প্রদর্শনীতে। ফলে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক জগতে গুরুত্বপূর্ণ একজন শিল্পী হিসেবে বিশ্বের দরবারেও বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন তাঁর শিল্পকর্মের মূল্যগুণ বিচারে। সময়পরিক্রমায়, এখন নবীন প্রজন্মের শিল্পচিন্তা দেশ-সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা ধরতে চায়। আরও স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ নবীন প্রজন্মের শিল্পকর্মে। ধারাবাহিক অগ্রযাত্রার অংশীদার নবীন শিল্পী প্রজন্মের বিকাশ আরও দ্রুত ও সঠিক হয় যদি অগ্রজ প্রজন্মের শিল্পকর্মের গুণ, মান বিচার ও সমালোচনার ভেতর দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় নিজ শিল্পসৃজনের স্বরূপ সম্পর্কে। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর জন্য শুভকামনা ও অভিনন্দন। ৯ মার্চ শুরু হওয়া প্রদর্শনী চলবে ২২ মার্চ পর্যন্ত।
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩২ সালে ফেনীতে। ১৯৫৪ সালে ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে বিএফএ পাস করেন। বর্তমান চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে ২০০০ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন। দেশে-বিদেশে বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদকসহ বহু সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন। জাতীয় চিত্রশালা, বাংলাদেশ; মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, ব্রাজিল; ফুকুওয়াকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়াম, জাপানসহ দেশে-বিদেশে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তাঁর কাজ সংরক্ষিত হয়েছে। বর্তমানে ত্রৈমাসিক পত্রিকা শিল্প ও শিল্পীর সম্পাদকীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান, শিল্প উপদেষ্টা প্রথম আলো এবং ফ্রিল্যান্স শিল্পী ও গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন।
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩২ সালে ফেনীতে। ১৯৫৪ সালে ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে বিএফএ পাস করেন। বর্তমান চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে ২০০০ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন। দেশে-বিদেশে বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদকসহ বহু সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন। জাতীয় চিত্রশালা, বাংলাদেশ; মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, ব্রাজিল; ফুকুওয়াকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়াম, জাপানসহ দেশে-বিদেশে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তাঁর কাজ সংরক্ষিত হয়েছে। বর্তমানে ত্রৈমাসিক পত্রিকা শিল্প ও শিল্পীর সম্পাদকীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান, শিল্প উপদেষ্টা প্রথম আলো এবং ফ্রিল্যান্স শিল্পী ও গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন।
No comments