ধর্ম-মানুষের নীতি ও নৈতিকতাবোধ by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলাম মানবজীবনের সকল পর্যায়ে নৈতিকতার বিধানকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। নৈতিকতাই মানুষের জীবনের সব দিক ও বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানবজাতির সহজাত মৌলিক প্রবৃত্তি ও মনোবৃত্তিই হলো নিয়মকানুন। এক দিক থেকে মানুষ প্রকৃতির অংশ বা প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন।

সুতরাং ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হিসেবে আত্মমর্যাদা বহাল রাখতে এবং মহৎ জীবনের অনুসন্ধান করতে হলে প্রাকৃতিক নিয়ম ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে। ইসলামের রীতিনীতির প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন, সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকেই আসে নীতিবোধ ও আদর্শিক গুণাবলি। আর এই নীতিবোধ থেকেই নৈতিকতা। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে নৈতিকতার বিধানগুলো সর্বাঙ্গীণ সুন্দরভাবে বিধৃত আছে। মানুষকে যে ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজে বিরত রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দেবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করবে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১০)
মানুষের নৈতিক চেতনা বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সামাজিক জীবন ও প্রতিষ্ঠানাদি যেমন, নৈতিক চেতনাও তেমনি ধাপে ধাপে ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। যেমন শুরুতে আদি মানবের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি মূল্যবোধক চেতনা ছিল খুবই অস্পষ্ট। তখন নীতিবোধ ও মূল্যবোধের চেয়ে প্রয়োজন ও আত্মস্বার্থই মুখ্য ছিল। প্রকৃতির রাজ্যে যা কিছু আছে, এর সবগুলোতেই ব্যক্তি দাবি করত অবাধ অধিকার। এ অবাধ প্রতিযোগিতা থেকে স্বাভাবিক কারণেই মানুষে মানুষে কলহ-বিবাদ ও হানাহানি শুরু হতো, যুদ্ধবিগ্রহ বেধে যেত। ফলে সবার নিরাপত্তার স্বার্থেই সম্পাদিত হয় সামাজিক চুক্তি এবং প্রণীত হয় প্রয়োজনীয় সব নিয়ম-কানুন। এভাবে আদিম মানুষের পারস্পরিক স্বার্থ সুরক্ষার প্রয়োজনবোধ থেকেই সূত্রপাত ঘটে নৈতিক চেতনার। এ থেকেই ক্রমশ গড়ে ওঠে নীতিবিদ্যার মৌলিক বিধি-নিয়ম।
নৈতিকতা হলো নীতিবোধ ও গুণাবলির দর্শন অর্থাৎ জীবন দর্শন। মানবজীবনকে সুপথে ভালো কাজে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা একটি প্রশিক্ষণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘সুন্দর নৈতিক চরিত্র ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে উত্তম কিছুই পিতামাতা সন্তানদের দান করতে পারে না।’ (তিরমিজি)
নৈতিকতা আত্মার অস্তিত্বের ও আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে নিবেদিত ও উৎসর্গীকৃত। দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও প্রধান অবলম্বন নৈতিকতা অর্জন। নৈতিকতা অর্জন ব্যতিরেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও নির্মূল করা কখনো সম্ভব নয়। নৈতিকতা সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্মমতার আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য এক সাহসী ও প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠন ও অবক্ষয় রোধে রাসূলুল্লাহ (সা.) দিকনির্দেশনা প্রদান করে ঘোষণা করেছেন, ‘আর অবশ্যই তোমরা মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকবে, কেননা মিথ্যা অবশ্যই অনৈতিক কাজের দিকে পরিচালিত করে, আর নিশ্চয়ই অনৈতিক কাজসমূহ জাহান্নামের দিকে পরিচালিত করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারি, মানবজাতির নিয়ামত, সীমাহীন গুণে গুণান্বিত, অনুপম ও মহান চরিত্রের অধিকারী বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন ছিল মানবপ্রেমে ও নৈতিকতায় ভরপুর। মানবতার সামনে নীতি ও নৈতিকতার উন্নত আদর্শ হিসেবে আল্লাহ তাআলা নবী করিম (সা.)-কে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। উন্নত নৈতিকতা ও উত্তম আদর্শের প্রতীক হিসেবে আল্লাহর নবী যে আগমন করেছেন তা তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমাকে উন্নত নৈতিকতার মর্যাদা সহকারে প্রেরণ করা হয়েছে।’ (ইবনে মাজা)
কিন্তু দুঃখের বিষয়, দেশে আজ সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ চলছে। নৈতিক সংকটের আবর্তে ক্লিষ্ট ভাগ্যহত মানুষের জীবনের পরতে পরতে একটা সত্য অবিরত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যায়, তা হচ্ছে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণীর মধ্যে আল্লাহর দেওয়া পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা সর্বাত্মকভাবে গ্রহণ করতে পারলে পৃথিবীটা প্রকৃত সুখের ও শান্তিময় হয়ে উঠত। নৈতিকতা সেই তাগাদা ও মহান শিক্ষা নিয়ে আসে। তাই নৈতিকতা বিশ্বাসের, আত্মপ্রত্যয়ের ও আত্মোপলব্ধির চেতনালব্ধ সহজ সত্যের সরল স্বীকারোক্তি ও প্রতিশ্রুতি। মানুষ তার সমকালীন প্রথা প্রচলনকে নতুন করে বিচার-বিশ্লেষণ এবং যুক্তির আলোকে সংশোধন করতে পারে। এভাবে প্রচলিত প্রথার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও সংশোধনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে মানবসভ্যতা। নবী করিম (সা.) নৈতিকতার মহিমা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে আমার কাছে অধিক প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন মর্যাদার দিক থেকে অধিক নিকটবর্তী সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে আখলাক ও নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম।’ (তিরমিজি)
মানুষের অধিকার নিশ্চিত হয় পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে। আর তাই নিজে বাঁচ, অন্যকে বাঁচতে দাও, দুষ্কর্ম ছেড়ে সদাচরণের পক্ষে এসো—এসব প্রাথমিক নীতির ভিত্তিতেই রচিত হয় আদিকালের নৈতিক মানদণ্ড। দিকে দিকে বিশ্বায়নের যে জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, এর একটা প্রভাব নৈতিকতার ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে নানা রকম ভেদ-বিভেদের মধ্যেও অনেকেই বিশ্বজনীন নৈতিক চেতনার এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সব মানুষের ঐক্য ও সদ্ভাব-সমপ্রীতির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। এর পরও নৈতিক অবক্ষয় বেড়েই চলছে; তাই নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিকারী ধর্মীয় শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই—ইসলাম এটাই শিক্ষা দেয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.