বৈষম্যহীন সমাজের জন্য নারীর লড়াই by কেয়া চৌধুরী
বাঙালি নারী আন্দোলনের সূচনা ঠিক কখন কোন মহৎ চিন্তার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল, তা জানা নেই। কারণ কোনো আন্দোলনই ঘটা করে, দিন-তারিখ নির্দিষ্ট করে সূচিত হয় না। কিছু ভালো মানুষের কিছু ভালো উদ্যোগ, তার পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ, আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট_এভাবেই সৃষ্টি হয় একটি ইতিহাস।
এমনিভাবে ব্রিটিশ শাসনামল এবং এর পরবর্তীকালে যুগে যুগে বঙ্গনারীরা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে পালন করেছিলেন পথিকৃতের ভূমিকা। তবে আন্দোলনের সময় বা কারণটা যা-ই হোক না কেন, নিশ্চয়ই বঙ্গনারীরা প্রথম ধাপে তাঁদের মানবিক উপলব্ধির জাগরণ সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই কাজ করেছেন। আর তা ছিল আত্মমর্যাদা এবং মৌলিক অধিকারের পূর্ণাঙ্গ জীবনের প্রত্যাশা, যেখানে নারী নিজেকে প্রথমত একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। মানুষ হিসেবে 'নারী' যে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ_চিন্তার, উপলব্ধির এই ক্ষেত্রটুকু বোধ করি এত বছর পরও পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারেনি আমাদের সমাজজীবনে। যদিও নারীসমাজের বৃহৎ একটি অংশের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু নারী তাঁদের চিন্তাচেতনা ও যোগ্যতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ও স্থানে অধিষ্ঠিত আছেন, কিন্তু যত দিন পর্যন্ত এর বিস্তৃতি তৃণমূল পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নে উত্তরণ না হবে, তত দিন পর্যন্ত অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। নারী নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবার এ বিষয়টি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক তাঁর লেখায় বলেছেন, 'নারী মানুষ হিসেবে স্বীকৃতির প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়; এবং বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির কারিগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।' একইভাবে সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ তাঁর 'নারী' গ্রন্থে বলেছেন, 'রামমোহন রায় তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় সতীদাহ রদ করে নারীকে দিয়েছেন প্রাণ এবং পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর বিধবার পুনঃবিবাহ ও নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন জীবন।' রাজা রামমোহন রায় যেখানে শেষ করেছেন, বিদ্যাসাগর সেখানে শুরু করেছিলেন। সমাজ সংস্কারক এই দুই মহৎ ব্যক্তির মহৎ কর্মে বঙ্গনারীরা নিঃসন্দেহে পেয়েছিলেন প্রাণ ও জীবন। কিন্তু এই প্রাপ্তির উপলব্ধির প্রকৃত বোধ বা অর্জনের আকাঙ্ক্ষার অভাব বর্তমান সমাজের নারীদের মধ্যেও রয়েছে। প্রকৃত অর্থে এর চর্চার অভাব রয়েছে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজব্যবস্থায়। যুগে যুগে নারীদের অসাম্য ও বৈষম্যের চিত্রে ভিন্নতা ছিল। যেমন_মাত্র কয়েক যুগ আগেও মুসলিম নারীরা কুসংস্কার, সামাজিক বিধিবিধান এবং ধর্মীয় বিভিন্ন অজ্ঞতা, সর্বোপরি নিরক্ষরতার কারণে অনেক বেশি পশ্চাৎপদ ছিল। সেই সমাজে হিন্দু নারীরা তুলনামূলকভাবে কিছুটা শিক্ষার আলোকচ্ছটা পেলেও তারা ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিপূর্ণ রীতিনীতিতে শৃঙ্খলিত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন বঙ্গনারীদের মধ্যেও স্বল্পমাত্রার স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পিপাসা জাগায়। রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে অধিকার বঞ্চনাই এর মূল কারণ ছিল। আর এই বঞ্চনা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পুরুষের পাশাপাশি কিছু দূরদর্শী চিন্তার আলোকপ্রাপ্ত নারীরা এগিয়ে এসেছিলেন তখনকার মুক্তির আন্দোলনে।
একাধারে পাকিস্তান আমলে এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর সম-অধিকারের আইনগত ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও তা আজও নারীরা পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রেই চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। শিকার হচ্ছে নিজ পরিবারের পৈতৃক সম্পত্তির ন্যায্য অধিকার থেকে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নারী যে পরিমাণ সম্পত্তি পাওয়ার হকদার, সেটুকু সম্পত্তিও অন্যায়-অনৈতিকভাবে কিছু কিছু পরিবারের পুরুষরাই (বাবা-ভাই-চাচা-মামারা) গ্রাস করে ফেলছেন। আইনগত দুর্বলতার কারণে হিন্দু নারীদের অধিক হারে অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। নারীর দুরবস্থার পেছনে অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি মুখ্য কারণ। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে লক্ষণীয় এবং বিবেচ্য বিষয় হলো পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে নারী-পুরুষের বৈষম্য, বিশেষ করে সম্পদ-সম্পত্তিতে মালিকানার সম-অধিকারহীনতা এবং সম্পদ বণ্টনে পুরুষ কর্তৃক নারীকে বঞ্চিতকরণের মনোভাব। নারীর সার্বিক উন্নয়নে রাষ্ট্র কর্তৃক আর্থিক মূলধন বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। তবে তা হতে হবে বাস্তবসম্মত ও স্বচ্ছতাপূর্ণ, যেন সম-অধিকার পাওয়ার ভিত্তিতে স্বমহিমায় উজ্জীবিত হওয়া প্রতিটি নারী-পুরুষ একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে দক্ষ হতে পারে। আর এটাই ছিল স্বাধীন দেশের মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি।
যেখানে সমাজে দীর্ঘদিনে নারীকুলের বঞ্চনার ইতিহাস প্রায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল, সেখানে শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের বারতা নিয়ে ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো 'নারী উন্নয়ন নীতি' ঘোষণা করল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার কাঙ্ক্ষিত ওই নারী উন্নয়ন নীতিকে কঙ্কালসার পশ্চাৎপদ নারীনীতিতে পরিণত করল। ২০১১ সালের মার্চ মাসে আবারও যখন মহাজোট সরকার নারীসমাজের প্রত্যাশাকে পূর্ণ মর্যাদা দিতে 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি' ঘোষণা ও বাস্তবায়নে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে আমিনী এবং তাঁর পেছনের একটি স্বার্থান্বেষী মহল প্রগতিশীল এই নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১-কে বাস্তবায়ন না করার জন্য অনৈতিক ও বেআইনিভাবে নানা রকম হুমকি-ধমকিসহ নারীর সামাজিক-রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথটিকে আরো কণ্টকাকীর্ণ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বর্তমান সরকার একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার। বিপুল জনসমর্থিত এই সরকার কোনো অবস্থায়ই জনবিচ্ছিন্ন কোনো মহল থেকে আসা পশ্চাৎপদ বক্তব্য আমলে নেবে না বলেই সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। নানাজনের নানা মত থাকতেই পারে। তাই বলে সমাজে বৃহত্তর একটি অংশ, যারা যথেষ্ট পরিমাণ পিছিয়ে পড়া অনুন্নত, অধিকারবঞ্চিত, সেসব নারীর উন্নয়নে দীর্ঘ প্রত্যাশিত এই 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১'-এর বিরুদ্ধে গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী মহলের বক্তব্যের কারণে লক্ষ্য থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রার পথটি সুগম করার ক্ষেত্রে সব সংগ্রামে আমরা বাঙালি নারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে বৈষম্যহীন সমাজের লক্ষ্যেই লড়ব।
লেখক : আইনজীবী ও সদস্যসচিব, চেতনায় '৭১, হবিগঞ্জ
kchowdhury71@gmail.com
একাধারে পাকিস্তান আমলে এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে নারীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ ইতিহাসে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর সম-অধিকারের আইনগত ভিত্তি থাকা সত্ত্বেও তা আজও নারীরা পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রেই চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। শিকার হচ্ছে নিজ পরিবারের পৈতৃক সম্পত্তির ন্যায্য অধিকার থেকে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নারী যে পরিমাণ সম্পত্তি পাওয়ার হকদার, সেটুকু সম্পত্তিও অন্যায়-অনৈতিকভাবে কিছু কিছু পরিবারের পুরুষরাই (বাবা-ভাই-চাচা-মামারা) গ্রাস করে ফেলছেন। আইনগত দুর্বলতার কারণে হিন্দু নারীদের অধিক হারে অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। নারীর দুরবস্থার পেছনে অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি মুখ্য কারণ। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে লক্ষণীয় এবং বিবেচ্য বিষয় হলো পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে নারী-পুরুষের বৈষম্য, বিশেষ করে সম্পদ-সম্পত্তিতে মালিকানার সম-অধিকারহীনতা এবং সম্পদ বণ্টনে পুরুষ কর্তৃক নারীকে বঞ্চিতকরণের মনোভাব। নারীর সার্বিক উন্নয়নে রাষ্ট্র কর্তৃক আর্থিক মূলধন বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। তবে তা হতে হবে বাস্তবসম্মত ও স্বচ্ছতাপূর্ণ, যেন সম-অধিকার পাওয়ার ভিত্তিতে স্বমহিমায় উজ্জীবিত হওয়া প্রতিটি নারী-পুরুষ একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে দক্ষ হতে পারে। আর এটাই ছিল স্বাধীন দেশের মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি।
যেখানে সমাজে দীর্ঘদিনে নারীকুলের বঞ্চনার ইতিহাস প্রায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল, সেখানে শান্তি, মুক্তি ও কল্যাণের বারতা নিয়ে ১৯৯৭ সালে প্রথমবারের মতো 'নারী উন্নয়ন নীতি' ঘোষণা করল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার কাঙ্ক্ষিত ওই নারী উন্নয়ন নীতিকে কঙ্কালসার পশ্চাৎপদ নারীনীতিতে পরিণত করল। ২০১১ সালের মার্চ মাসে আবারও যখন মহাজোট সরকার নারীসমাজের প্রত্যাশাকে পূর্ণ মর্যাদা দিতে 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি' ঘোষণা ও বাস্তবায়নে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে আমিনী এবং তাঁর পেছনের একটি স্বার্থান্বেষী মহল প্রগতিশীল এই নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১-কে বাস্তবায়ন না করার জন্য অনৈতিক ও বেআইনিভাবে নানা রকম হুমকি-ধমকিসহ নারীর সামাজিক-রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথটিকে আরো কণ্টকাকীর্ণ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। বর্তমান সরকার একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার। বিপুল জনসমর্থিত এই সরকার কোনো অবস্থায়ই জনবিচ্ছিন্ন কোনো মহল থেকে আসা পশ্চাৎপদ বক্তব্য আমলে নেবে না বলেই সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। নানাজনের নানা মত থাকতেই পারে। তাই বলে সমাজে বৃহত্তর একটি অংশ, যারা যথেষ্ট পরিমাণ পিছিয়ে পড়া অনুন্নত, অধিকারবঞ্চিত, সেসব নারীর উন্নয়নে দীর্ঘ প্রত্যাশিত এই 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১'-এর বিরুদ্ধে গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী মহলের বক্তব্যের কারণে লক্ষ্য থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রার পথটি সুগম করার ক্ষেত্রে সব সংগ্রামে আমরা বাঙালি নারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে বৈষম্যহীন সমাজের লক্ষ্যেই লড়ব।
লেখক : আইনজীবী ও সদস্যসচিব, চেতনায় '৭১, হবিগঞ্জ
kchowdhury71@gmail.com
No comments