সমুদ্রসীমার রায়-যুক্তি এবং ন্যায়ের বিজয় by ফারুক চৌধুরী

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমা বিরোধ নিয়ে সমুদ্র আইনবিষয়ক ট্রাইব্যুনাল (ITLOS) যে রায় দিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে তা একটি সুখবর। ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সাহসী, সময়োপযোগী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের জন্য শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারকে সাধুবাদ জানাই।

রায়টি বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি অতি মূল্যবান উপহার।
১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে মিয়ানমারের সঙ্গে এই বিষয়ে তখনকার রেঙ্গুনে আমাদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সূত্রপাত হয়। সেই সময়ে আমি লন্ডনে আমাদের হাইকমিশনে কর্মরত ছিলাম এবং ঢাকায় আমার ছুটি উপভোগ করছিলাম। সেই ছুটি বাতিল করে বঙ্গবন্ধু আমাকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে রেঙ্গুনে যাওয়ার আদেশ প্রদান করেন। সেই সময়ে বার্মায় (বর্তমানের মিয়ানমার) আমাদের রাষ্ট্রদূত খাজা মোহাম্মদ কায়সার ছিলেন আমাদের দলনেতা। আমি ছাড়া সেই প্রতিনিধিদলের অন্য দুজন সদস্য ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক ও আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার হারুন উর রশিদ (পরবর্তী সময়ে জেনেভায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও বর্তমানে আমার মতোই কলাম লেখক) ও চিফ হাইড্রোগ্রাফার জনাব আবু হেনা (তাঁর বর্তমান অবস্থান আমার অজানা)। ১৯৭৪ সালের ১৬ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের Territorial Waters and Maritime Zones Act (টেরিটরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট) গেজেটভুক্ত করে এবং তা সঙ্গে নিয়েই আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করি। আমাদের যুক্তি এই ছিল যে যেহেতু বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা রেখায় অবতলতা (Concarity) রয়েছে, সীমা নির্ধারণের জন্য সমদূরত্ব (Equidistance) পদ্ধতি আমরা গ্রহণ করতে পারি না। তা ছাড়া মিয়ানমার বাংলাদেশসংলগ্ন দেশ, ভৌগোলিকভাবে বিপরীত অবস্থানের দেশ নয়। আমাদের বক্তব্য ছিল যে এ জন্য আমাদের সমুদ্রসীমান্ত ন্যায়সংগত সমবণ্টন পদ্ধতিতে হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সেই সময়ে মিয়ানমার আমাদের দাবিটি প্রত্যাখ্যান করে। তারপর সত্তরের দশকে মিয়ানমারের সঙ্গে এই বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে, কিন্তু কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে মিয়ানমারের সঙ্গে ২০০৯ সালে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি পুনরায় উত্থাপন করে। কিন্তু তখনো বিষয়টি অমীমাংসিত থাকায় তা সমুদ্র আইনবিষয়ক ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবটি বাংলাদেশের তরফ থেকে করা হয়। উল্লেখ্য, UNCLOS অর্থাৎ জাতিসংঘ সমুদ্রসীমা কমিশনের আওতায় সমুদ্রবিরোধ নিরসনের জন্য দুটি সংস্থা রয়েছে। সেগুলো হলো: সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল (ITLOS) এবং সালিসি ট্রাইব্যুনাল (আরবিট্রাল ট্রাইব্যুনাল)। ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমুদ্রসীমা কমিশনের প্রতি যথাক্রমে ১৯৯৫, ১৯৯৬ ও ২০১১ সালে অনুসমর্থন (Ratification) জানিয়েছে বিধায় মিয়ানমার বিষয়টি ট্রাইব্যুনালে নিতে সম্মত হয়। গতকালের রায়টি তারই ফল। উল্লেখ্য, এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের জন্য সমুদ্র উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং এক লাখ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটারের সাগর আর তার তলদেশের ওপর বাংলাদেশের মালিকানা অর্জিত হলো। আমাদের নদীমাতৃক এই দেশে প্রতিবছর প্রায় ২ দশমিক ২ বিলিয়ন টন পলিমাটি সাগরে নিক্ষিপ্ত হয়, যা আমাদের ভূখণ্ডকে স্বাভাবিকভাবেই প্রলম্বিত করছে। তা আমাদের ১২ কিলোমিটারের সমুদ্রসীমা এবং ১৮৮ কিলোমিটারের অর্থনৈতিক জোন নির্ণয়ের অনুকূলে। এখানে উল্লেখ্য যে ভারতের সঙ্গে আমাদের সাগরসীমা বিরোধটি সালিসি ট্রাইব্যুনালে উত্থাপন করা হয়েছে এবং আশা এই যে ২০১৪ সালের মধ্যে তার শুনানি এবং রায় প্রদান সমাপ্ত হবে। আন্তর্জাতিক সালিসের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি বেঞ্চ গঠিত হয় (তিনজন UNCLOS মনোনীত বিচারক এবং দুজন বিবদমান দুই দলের একজন করে মনোনীত বিচারক)। উল্লেখ্য, ITLOS-এর বিচারকসংখ্যা ২১ এবং আরও দুজন বিবদমান দুই দল দ্বারা মনোনীত বিচারক। আশা তো এই যে ট্রাইব্যুনালের গত বুধবারের সিদ্ধান্ত ভারতের সঙ্গে বিরোধে আমাদের অনুকূলে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এখন আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো, সমুদ্রসীমার অভ্যন্তরের সম্পদের যথার্থ আহরণ এবং ব্যবহার নিশ্চিত করা। সম্পদ থাকার পরও নিঃস্ব হয়ে যাওয়া জাতির দৃষ্টান্ত বিরল নয় (বর্তমানের নাইজেরিয়া)। অতএব, আমাদের এই বিশাল সম্পদের সদ্ব্যবহারের জন্য জনগণের শ্যেন দৃষ্টি রাখার প্রয়োজন রয়েছে এবং তা একটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের পক্ষেই সম্ভব, যেখানে সরকারি ও বিরোধী দল জনস্বার্থ এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থ সামনে রেখে আগামীর সিদ্ধান্ত নেবে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net

No comments

Powered by Blogger.